সকালে দেখি সব ঠিকঠাক। লতিফা ঘরের কাজকর্ম করছে। এইভাবে দিন পার করতে লাগলাম। কখনাে ভালাে কখনাে মন্দ। . | লতিফা যখন আটমাসের পােয়াতী তখন আমি হাতে পায়ে ধরে আমার শাশুড়ীকে এই বাড়িতে নিয়া আসলাম। লতিফা খানিকটা শান্ত হলাে। তবে আগের মতাে সহজ স্বাভাবিক হলাে না। চমকে চমকে উঠে। রাতে ঘুমাতে পারে না। ছটফট করে। মাঝে মাঝে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে। সেই দুঃস্বপ্নে কফিল এসে উপস্থিত হয়। কফিল চাপা গলায় বলে, দেরী নাই আর দেরী নাই। পুত্র সন্তান আসতেছে।সাতদিনের মধ্যে নিয়ে যাবাে। কাদাকাটি যা করার কইরা নেও৷ ঘুম ভেঙে লতিফা জেগে ওঠে। চীৎকার করে কাঁদে। আমি চোখে দেখি অন্ধকার। কি করবাে কিছুই বুঝি না।
শ্রাবণ মাসের তিন তারিখে লতিফার একটা পুত্র সন্তান হলাে। কি সুন্দর যে ছেলেটা হলাে ভাইসাহেব না দেখলে বিশ্বাস করবেন না। চাপা ফুলের মতাে গায়ের রঙ। টানা টানা চোখ। আমি একশ’ রাকাত শােকরানা নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে আমার সন্তানের হায়াত চাইলাম। আমার মনের অস্থিরতা কমলাে না।
আঁতুর ঘরের বাইরে একটা বেঞ্চ পেতে রাতে শুয়ে থাকি। আমার স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন আমার শাশুড়ী আর আমার স্ত্রীর দূর সম্পর্কের এক খালাতাে বােন। পালা করে কেউ না কেউ সারা রাত জেগে থাকি।
লতিফার চোখে এক ফোটাও ঘুম নাই। সন্তানের মা। সারাক্ষণ বাচ্চা বুকের নিচে আড়াল করে রাখে। এক মুহুর্তের জন্যে চোখের আড়াল করে না। আমার শাশুড়ী যখন বাচ্চা কোলে নেন তখনাে লতিফা বাচ্চাটার গায়ে হাত দিয়ে রাখে যেন কেউ নিয়ে যেতে না পারে।
ছয় দিনের দিন কি হলাে শুনেন। ঘাের বর্ষা। সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে। সন্ধ্যার পর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলাে। এরকম বর্ষা আমি আমার জীবনে দেখি নাই।
লতিফা আমাকে বললাে, আইজ রাইতটা আপনে জাগনা থাকবেন। আমার। কেমন জানি লাগতেছে।
আমি বললাম, কেমন লাগতেছে? “জানি না। একটু পরে পরে শরীর কাপতেছে। “তুমি নিশ্চিন্ত হইয়া থাকো। আমি সারা রাইত জাগনা থাকবে। ‘আপনে একটু বলরামরেও খবর দেন। সেও যেন জাগনা থাকে।
আমি বলরামকে খবর দিলাম। লতিফা, বাচ্চাটারে বুকের নিচে নিয়া শুইয়া আছে। আমি একমনে আল্লাহপাকেরে ডাকতেছি। জীবন দেয়ার মালিক তিনি। জীবন নেয়ার মালিকও তিনি।
রাত তখন কতাে আমি জানি না ভাইসাহেব। ঘুমায়ে পড়েছিলাম। লতিফার চিত্ত্বারে ঘুম ভাঙলাে। সে আসমান-ফাটাইয়া চিৎকার করতেছে। আমার বাচ্চা কই গেল। আমার বাচ্চা কই। দুইটা হারিকেন জ্বালানাে ছিলাে। দুইটাই নিভাননা। পুরা
বাড়ি অন্ধকার। কাপতে কাপতে হারিকেন জ্বালালাম। দেখি সত্যি বাচ্চা নাই। আমার শাশুড়ী ফিট হয়ে পড়ে গেলেন।
লতিফা ঝড়–বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ছুটে গেলাে কুয়ার দিকে।
কুয়ার উপর টিন দিয়া ঢাকা ছিলাে। তাকায়ে দেখি টিন সরানাে। লতিফা চিৎকার করে বলছে – আমার বাচ্চারে কুয়ার ভিতর ফালাইয়া দিছে। আমার বাচ্চা কুয়ার ভিতরে। লতিফা লাফ দিয়া কুয়াতে নামতে চাইলাে। আমি তাকে জড়ায়ে ধরলাম।
ইমাম সাহেব চুপ করে গেলেন। কপালের ঘাম মুছলেন। আমি বললাম, বাচ্চাটা কি সত্যি কুয়াতে ছিলাে?
‘জি। ‘আর দ্বিতীয় বাচ্চা। সেও কি এইভাবে মারা যায় ? ‘জি – না জনাব। আমার দ্বিতীয় বাচ্চা সন্তান বাড়িতে জন্মগ্রহণ করে। ‘সিদ্দিক সাহেবের ঐ বাড়ি তাহলে আপনি ছেড়ে দেন? | ‘জি। তাতে অবশ্য লাভ হয় না। কফিলের যন্ত্রণা কমে না। দ্বিতীয় সন্তানটাকেও সে মারে। জন্মের চারদিনের দিন ...‘
আমি আঁৎকে উঠে বললাম, থাক ভাই আমি শুনতে চাই না। গল্পগুলাে আমি সহ্য করতে পারছি না।
ইমাম সাহেব বললেন, আল্লাহপাক আরেকটা সন্তান দিতেছেন। কিন্তু এই সন্তানটাকেও বাঁচাতে পারবাে না। মনটা বড়ই খারাপ ভাই সাহেব। বড়ই খারাপ। আমি কতােবার চিৎকার করে বলেছি – কফিল, তুমি আমারে মেরে ফেলাে। আমার সন্তানরে মের না। এই সুন্দর দুনিয়া তারে দেখতে দাও।
ইমাম সাহ্বে কাঁদতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাের হলাে। ইমাম সাহেব ফজরের নামাজের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন।
সেইদিন ভােরেই আমি সফিককে নিয়ে ঢাকায় চলে এলাম। সফিকের আরাে কিছুদিন থেকে কালু খা রহস্য ভেদকরে আসার ইচ্ছা ছিলাে। আমি তা হতে দিলাম না। ইমাম সাহেবের সঙ্গে আরােকিছু সময় থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলাে না।
সাধারণত আমি আমার জীবনের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার গল্প মিসির আলির সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্র বলি। মজার ব্যাপার হচ্ছে – ইমাম সাহেবের এই গল্প তাকে বলা হলাে না।
ঢাকায় ফেরার তিনদিনের মাথায় তার সঙ্গে আমার দেখা। নানান কথাবার্তা হলাে – এটা বাদ পড়ে গেলাে। | দুমাস পর মিসির আলি আমার বাসায় এলেন।