ভয় (পর্ব-১৪)-হুমায়ূন আহমেদ

সকালে দেখি সব ঠিকঠাকলতিফা ঘরের কাজকর্ম করছেএইভাবে দিন পার করতে লাগলামকখনাে ভালাে কখনাে মন্দ. | লতিফা যখন আটমাসের পােয়াতী তখন আমি হাতে পায়ে ধরে আমার শাশুড়ীকে এই বাড়িতে নিয়া আসলামলতিফা খানিকটা শান্ত হলােতবে আগের মতাে সহজ স্বাভাবিক হলাে নাচমকে চমকে উঠেরাতে ঘুমাতে পারে নাছটফট করেমাঝে মাঝে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখেসেই দুঃস্বপ্নে কফিল এসে উপস্থিত হয়কফিল চাপা গলায় বলে, দেরী নাই আর দেরী নাইপুত্র সন্তান আসতেছেসাতদিনের মধ্যে নিয়ে যাবােভয় কাদাকাটি যা করার কইরা নেও৷ ঘুম ভেঙে লতিফা জেগে ওঠেচীৎকার করে কাঁদেআমি চোখে দেখি অন্ধকারকি করবাে কিছুই বুঝি না। 

শ্রাবণ মাসের তিন তারিখে লতিফার একটা পুত্র সন্তান হলােকি সুন্দর যে ছেলেটা হলাে ভাইসাহেব না দেখলে বিশ্বাস করবেন নাচাপা ফুলের মতাে গায়ের রঙটানা টানা চোখআমি একশরাকাত শােকরানা নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে আমার সন্তানের হায়াত চাইলামআমার মনের অস্থিরতা কমলাে না। 

আঁতুর ঘরের বাইরে একটা বেঞ্চ পেতে রাতে শুয়ে থাকিআমার স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন আমার শাশুড়ী আর আমার স্ত্রীর দূর সম্পর্কের এক খালাতাে বােনপালা করে কেউ না কেউ সারা রাত জেগে থাকি। 

লতিফার চোখে এক ফোটাও ঘুম নাইসন্তানের মাসারাক্ষণ বাচ্চা বুকের নিচে আড়াল করে রাখেএক মুহুর্তের জন্যে চোখের আড়াল করে নাআমার শাশুড়ী যখন বাচ্চা কোলে নেন তখনাে লতিফা বাচ্চাটার গায়ে হাত দিয়ে রাখে যেন কেউ নিয়ে যেতে না পারে। 

ছয় দিনের দিন কি হলাে শুনেনঘাের বর্ষাসারাদিন বৃষ্টি হয়েছেসন্ধ্যার পর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলােএরকম বর্ষা আমি আমার জীবনে দেখি নাই। 

লতিফা আমাকে বললাে, আইজ রাইতটা আপনে জাগনা থাকবেনআমারকেমন জানি লাগতেছে। 

আমি বললাম, কেমন লাগতেছে? জানি নাএকটু পরে পরে শরীর কাপতেছেতুমি নিশ্চিন্ত হইয়া থাকোআমি সারা রাইত জাগনা থাকবেআপনে একটু বলরামরেও খবর দেনসেও যেন জাগনা থাকে। 

আমি বলরামকে খবর দিলামলতিফা, বাচ্চাটারে বুকের নিচে নিয়া শুইয়া আছেআমি একমনে আল্লাহপাকেরে ডাকতেছিজীবন দেয়ার মালিক তিনিজীবন নেয়ার মালিকও তিনি। 

রাত তখন কতাে আমি জানি না ভাইসাহেবঘুমায়ে পড়েছিলামলতিফার চিত্ত্বারে ঘুম ভাঙলােসে আসমান-ফাটাইয়া চিৎকার করতেছেআমার বাচ্চা কই গেলআমার বাচ্চা কইদুইটা হারিকেন জ্বালানাে ছিলােদুইটাই নিভাননাপুরা 

বাড়ি অন্ধকারকাপতে কাপতে হারিকেন জ্বালালামদেখি সত্যি বাচ্চা নাইআমার শাশুড়ী ফিট হয়ে পড়ে গেলেন। 

লতিফা ঝড়বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলছুটে গেলাে কুয়ার দিকে। 

কুয়ার উপর টিন দিয়া ঢাকা ছিলােতাকায়ে দেখি টিন সরানােলতিফা চিৎকার করে বলছে আমার বাচ্চারে কুয়ার ভিতর ফালাইয়া দিছেআমার বাচ্চা কুয়ার ভিতরেলতিফা লাফ দিয়া কুয়াতে নামতে চাইলােআমি তাকে জড়ায়ে ধরলাম। 

ইমাম সাহেব চুপ করে গেলেনকপালের ঘাম মুছলেনআমি বললাম, বাচ্চাটা কি সত্যি কুয়াতে ছিলাে

জিআর দ্বিতীয় বাচ্চাসেও কি এইভাবে মারা যায় ? জি না জনাবআমার দ্বিতীয় বাচ্চা সন্তান বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেসিদ্দিক সাহেবের বাড়ি তাহলে আপনি ছেড়ে দেন? | জিতাতে অবশ্য লাভ হয় না। কফিলের যন্ত্রণা কমে নাদ্বিতীয় সন্তানটাকেও সে মারেজন্মের চারদিনের দিন ...‘ 

আমি আঁৎকে উঠে বললাম, থাক ভাই আমি শুনতে চাই নাগল্পগুলাে আমি সহ্য করতে পারছি না। 

ইমাম সাহেব বললেন, আল্লাহপাক আরেকটা সন্তান দিতেছেনকিন্তু এই সন্তানটাকেও বাঁচাতে পারবাে নামনটা বড়ই খারাপ ভাই সাহেববড়ই খারাপআমি কতােবার চিৎকার করে বলেছি কফিল, তুমি আমারে মেরে ফেলােআমার সন্তানরে মের নাএই সুন্দর দুনিয়া তারে দেখতে দাও। 

ইমাম সাহ্বে কাঁদতে লাগলেনকিছুক্ষণের মধ্যেই ভাের হলােইমাম সাহেব ফজরের নামাজের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। 

সেইদিন ভােরেই আমি সফিককে নিয়ে ঢাকায় চলে এলামসফিকের আরাে কিছুদিন থেকে কালু খা রহস্য ভেদকরে আসার ইচ্ছা ছিলােআমি তা হতে দিলাম নাইমাম সাহেবের সঙ্গে আরােকিছু সময় থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলাে না। 

সাধারণত আমি আমার জীবনের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার গল্প মিসির আলির সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্র বলিমজার ব্যাপার হচ্ছে ইমাম সাহেবের এই গল্প তাকে বলা হলাে না। 

ঢাকায় ফেরার তিনদিনের মাথায় তার সঙ্গে আমার দেখানানান কথাবার্তা হলাে এটা বাদ পড়ে গেলাে| দুমাস পর মিসির আলি আমার বাসায় এলেন

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *