রাতে একসঙ্গে খাওয়া–দাওয়া করলাম। তিনি প্রায় দু‘ঘণ্টা কাটিয়ে বাড়ি চলে গেলেন — ইমাম সাহেবের গল্প বলা হলাে না। তিনি চলে যাবার পর মনে হলাে – ইমাম সাহেবের গল্পটাতাে তাকে শােনানাে হলাে না।
আমি আমার মেয়েকে বলে রাখলাম যে এরপরে যদি কখনাে মিসির আলি সাহেব আমাদের বাসায় আসেন সে যেন আমার কানের কাছে ‘ইমাম বলে একটা চিকার দেয়। আমার এই মেয়ের স্মৃতিশক্তি বেশ ভালাে। সে যে যথাসময়ে ‘ইমাম
বলে চিৎকার দেবে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
হলােও তাই। অনেকদিন পর মিসির আলি সাহেব এসেছেন। তার সঙ্গে গল্প করছি – আমার মেয়ে কানের কাছে এসে বিকট চিৎকার দিলাে। এমন চিৎকার যে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলাে। মেয়েকে কড়া ধমক দিলাম। মেয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাে, তুমিতাে বলেছিলে মিসির চাচু এলে – ‘ইমাম’ বলে চিৎকার করতে।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, কানের পর্দা ফাটিয়ে দিতে তাে বলিনি। যাও, এখন যাও তাে।
মিসির আলি বললেন, ব্যাপারটা কি?
আমি বললাম, তেমন কিছু না। আপনাকে একটা অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাচ্ছিলাম। একজন ইমাম সাহেবের গল্প। আপনার সঙ্গে দেখা হয় কিন্তু গল্পটা বলার কথা মনে থাকে না। মেয়েকে মনে করিয়ে দিতে বলেছি। সে এমন চিৎকার দিয়েছে, এখন মনে হচ্ছে বা কানে কিছু শুনতে পারছি না।
ভয় (পর্ব-১৫)-হুমায়ূন আহমেদ
মিসির আলি বললেন, গল্পটা কি বলুন শুনি। ‘আজ থাক। আরেকদিন বলবাে। একটু সময় লাগবে। লম্বা গল্প। মিসির আলি বললেন, আরেক কাপ চা দিতে বলুন। চা খেয়ে বিদেয় হই।
চায়ের কথা বলে মিসির আলির সামনে এসে বসলাম। মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন – ইমাম সাহেবের গল্পটা আপনি আমাকে কখনােই বলতে পারবেন না।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন? আপনার মস্তিষ্কের একটা অংশ আপনাকে গল্পটা বলতে বাধা দিচ্ছে। যে কারণে অনেকদিন থেকেই আপনি আমাকে গল্পটা বলতে চান অথচ বলা হয় না। আপনার মনে থাকে না। আজ আপনাকে মনে করিয়ে দেয়া হলাে। এবং মনে করিয়ে দেয়ার জন্য আপনি রেগে গেলেন। তার চেয়ে বড় কথা মনে করে দেবার পরেও আপনি গল্পটি বলতে চাচ্ছেন না। অজুহাত বের করেছেন – বলছেন লম্বা গল্প। আমি নিশ্চিত আপনার অবচেতন মন চাচ্ছে না, এই গল্প আপনি আমাকে বলেন। আপনার সাবকনসাস মাই আপনাকে বাধা দিচ্ছে।
‘আমার সাবকনসাস মাইও আমাকে বাধা দিচ্ছে কেন?‘ ‘আমি তা বুঝতে পারছি না। গল্পটা শুনলে বুঝতে পারবাে। চা আসুক। চা খেতে খেতে আপনি বলা শুরু করুন। আমার সিগারেটও ফুরিয়েছে। কাউকে দিয়ে কয়েকটা সিগারেট আনিয়ে দিন।
ভয় (পর্ব-১৫)-হুমায়ূন আহমেদ
আমি আর কোনাে অজুহাতে গেলাম না। গল্প শেষ করলাম। গল্প শেষ হওয়া মাত্র মিসির আলি বললেন, আবার বলুন।
‘আবার কেন ? ‘মানুষ যখন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার গল্প বলে তখন মূল গল্পটি দ্রুত বলার দিকে ঝোক থাকে বেশি। গল্পের ডিটেইলস–এ যেতে চায় না। একই গল্প দ্বিতীয়বার বলার সময় বর্ণনা বেশি থাকে। কারণ মূল কাহিনী বলা হয়ে গেছে। কথক তখন না বলা অংশ বলতে চেষ্টা করেন। আপনিও তাই করবেন। প্রথমবার শুনে কয়েকটা জিনিশ বুঝতে পারিনি। দ্বিতীয়বারে বুঝতে পারব। শুরু করুন।
আমি শুরু করলাম, বেশ সময় নিয়ে বললাম। | মিসির আলি বললেন, কবে গিয়েছিলেন ধুন্দুল নাড়া? তারিখ মনে আছে?
‘আছে।”
আমি মিসির আলিকে তারিখ বললাম। তিনি শান্ত গলায় বললেন, আপনার তারিখ অনুযায়ী মেয়েটির বাচ্চা এখন হবে কিংবা হয়ে গেছে। আপনি বলছেন দশ মাস আগের কথা। মেয়েটির বাচ্চা হয়ে গিয়ে থাকলে তাকে যে হত্যা করা হয়েছে সেই সম্ভাবনা নিরানই ভাগেরও বেশি। আর যদি এখনাে হয়ে না থাকে তাহলে বাচ্চাটাকে বাঁচানাে যেতে পারে। এখন কটা বাজে দেখুন তাে।
আমি ঘড়ি দেখলাম – নটা বাজে। মিসির আলি বললেন, রাত সাড়ে দশটায় ময়মনসিংহে যাওয়ার একটা ট্রেন আছে। চলুন রওনা হই। ‘সত্যি যেতে চান?
ভয় (পর্ব-১৫)-হুমায়ূন আহমেদ
‘অবশ্যই যেতে চাই। আপনার অসুবিধা থাকলে কিভাবে যেতে হবে আমাকে বলে দিন। আমি ঘুরে আসি। | ‘আমার অসুবিধা আছে। তবু যাবাে। এখন বলুন তাে জ্বীন কফিলের ব্যাপারটা আপনি বিশ্বাস করছেন?”
‘আপনার ধারণা বাচ্চাগুলােকে খুন করা হয়েছে? “তাতাে বটেই। ‘কে খুন করেছে?
মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, কে খুন করেছে তা আপনিও জানেন। আপনার সাবকনসাস মাইণ্ড জানে। জানে বলেই সাবকনসাস মাইণ্ড গল্পটি বলতে আপনাকে বাধা দিচ্ছিলাে।
‘আমি কিছুই জানি না।
মিসির আলি হাসতে হাসতে বললেন, আপনার সাবকনসাস মাইণ্ড জানে কিন্তু সে এটি আপনার কনসাস মাইকে জানায়নি বলেই আপনার মনে হচ্ছে আপনি জানেন।
আমি বললাম, কে খুন করেছে? ‘লতিফা। দুটি বাচ্চাই সে মেরেছে। তৃতীয়টিও মারবে। ‘কি বলছেন এসব?” ‘চলুন রওনা হয়ে যাই। দেরী হয়ে যাচ্ছে। ট্রেনে যেতে যেতে ব্যাখ্যা করবাে।
মিসির আলি বললেন, লতিফা যে পুরাে ঘটনাটা ঘটাচ্ছে তা পরিষ্কার হয়ে যায় শুরুতেই, যখন ইমাম সাহেব আপনাকে বলেন কিভাবে জ্বীন কফিল তাকে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছিলাে।
পুরানাে ধরনের মসজিদ একটা মাত্র দরজা। এই ধরনের মসজিদে বসে থাকলে বাইরের চিৎকার শােনা যাবে না ভেতর থেকে চিৎকার করলেও বাইরের কেউ শুনবে না। কারণ সাউণ্ড ওয়েভ চলার জন্য মাধ্যম লাগে। মসজিদের দেয়াল সেখানে বাধার মতাে কাজ করছে।
আপনি এবং ইমাম সাহেব মসজিদে ছিলেন। ইমাম সাহেব একসময় স্ত্রীর খােজ নিতে গেলেন এবং ফিরে এসে বললেন – লতিফা খুব চিৎকার করছে। তাই না?
‘জি তাই। ‘মসজিদের ভেতরে বসে সেই চিৎকার আপনি শুনতে পাননি। তাই না?”
ভয় (পর্ব-১৫)-হুমায়ূন আহমেদ
‘অথচ ইমাম সাহেব যখন আগুন দেখে ভয়ে চেঁচালেন, বাঁচাও বাঁচাও তখন লতিফা পানির বালতি নিয়ে ছুটে এলাে। প্রথমত ইমাম সাহেবের চিৎকার লতিফার শােনার কথা নয়। দ্বিতীয়ত শুনে থাকলেও লতিফা কি করে বুঝলাে আগুন লেগেছে? সে পানির বালতি নিয়ে ছুটে এলাে কেন? আগুন আগুন বলে চিৎকার করলেও আমরা চিৎকার শুনে প্রথমে খালি হাতে ছুটে আসি তারপর পানির বালতি আনি। এটাই স্বাভাবিক। এই মেয়েটি শুরুতেই পানির বালতি নিয়ে ছুটে এসেছে। কারণ পানির বালতি হাতের কাছে রেখেই সে আগুন ধরিয়েছে। আমার এই যুক্তি কি আপনার কাছে গ্রহণযােগ্য মনে হচ্ছে?”
‘হচ্ছে। ‘প্রথম শিশুটি মারা গেলাে। শিশুটিকে ফেলা হলাে কুয়ায়। এই খবর মেয়েটি জানে কারণ সে পাগলের মতাে ছুটে গেছে কুয়ার দিকে – অন্য কোথাও নয়। তার বাচ্চাটিকে কুয়াতে ফেলা হয়েছে এটা সে জানলাে কিভাবে ? জানলাে কারণ সে নিজেই ফেলেছে। এই যুক্তি কি আপনার কাছে গ্রহণযােগ্য মনে হচ্ছে?
‘হ্যা, হচ্ছে?” ‘আপনাকে কি আরাে যুক্তি দিতে হবে? আমার কাছে আরাে ছােটখাটো যুক্তি আছে। ‘আর লাগবে না। শুধু বলুন – কুয়ার উপরের টিনে ঝনঝন শব্দ হতাে কেন? যে। শব্দ ইমাম সাহেব নিজেও শুনেছেন। ‘কুয়ার টিনটা না দেখে বলতে পারবাে না। আমার ধারণা বাতাসে টিনটা কাপে, ঝন ঝন শব্দ হয়।
ভয় (পর্ব-১৫)-হুমায়ূন আহমেদ
দিনের বেলায় এই শব্দ শােনা যায় না, কারণ আশেপাশে অনেক ধরনের শব্দ হতে থাকে। রাত যতােই গভীর হয় চারপাশ নীরব হতে থাকে। সামান্য শব্দই বড় হয়ে কানে আসে। | ‘আপনার এই যুক্তিও গ্রহণ করলাম, এখন বলুন লতিফা এমন ভয়ংকর কাণ্ড কেন করছে?
‘মেয়েটা অসুস্থ। মনােবিকার ঘটেছে। ইমাম সাহেব লােকটি তাদের আশ্রিত। তাদের পরিবারে চাকর বাকররা যে কাজ করে সে তাই করতাে। মেয়েটি ভাগ্যের
পরিহাসে এমন একজন মানুষের প্রেমে পড়ে যায়। প্রচণ্ড মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়। পরিবারের সবার কাছে ছােট হয়। অপমানিত হয়। এতে প্রচণ্ড চাপ সহ্য করার ক্ষমতা তার ছিলাে না। তার মনােবিকার ঘটে। পােয়াতী অবস্থায় মেয়েদের হরমােনাল ব্যালান্স এদিক ওদিক হয়। সেই সময় মনােবিকার তীব্র হয়। মেয়েটির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
(চলবে)