মেয়েটি দরিদ্র ইমামকে বিয়ে করে কঠিন মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়েছে। একই সঙ্গে সে লােকটিকে প্রচণ্ড ভালােবাসে আবার প্রচণ্ড ঘৃণাও করে। কি ভয়াবহ অবস্থা।
‘মেয়েটি ইমামকে প্রচণ্ড ঘৃণা করে এটা কেন বলছেন? ‘ইমামতি পেশা মেয়েটির পছন্দ নয়। পছন্দ নয় বলেই মেয়েটি কফিলের গলায় বলেছে – ইমাম আসছে। অজুর পানি দে, জায়নামাজ দে, কেবলা কোনদিকে বলে দে। এক ধরনের রসিকতা করার চেষ্টা করছে।
‘মনােবিকার এমন ভয়াবহ রূপ নিলাে কেন? সে নিজের বাচ্চাকে হত্যা করছে কেন?”
‘বড় ধরনের বিকারে এরকম হয়। সে নিজেকে ধ্বংস করতে চাইছে। নিজের সন্তান হত্যার মাধ্যমে সেই ইচ্ছারই অংশবিশেষ পূর্ণ হচ্ছে। আরাে কিছু থাকতে পারে। না দেখে বলতে পারবাে না।”
ধুন্দুল নাড়া গ্রামে সন্ধ্যার পর পৌছলাম। পৌছেই খবর পেলাম পাঁচদিন হয় ইমাম সাহেবের একটি কন্যা হয়েছে। কন্যাটি ভালাে আছে। বড় ধরনের স্বস্তি বােধ করলাম।
ইমাম সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম মসজিদে। তিনি আমাদের দেখে বড়ই অবাক হলেন। আমি বললাম, আপনার স্ত্রী কেমন আছেন?
ইমাম সাহেব বিব্রত গলায় বললেন, ভালাে না। খুব খারাপ। কফিল তার সঙ্গে সঙ্গে আছে। কফিল বলেছে সাতদিনের মাথায় মেয়েটাকে মেরে ফেলবে। খুব কষ্টে আছি ভাই সাহেব। আল্লাহপাকের কাছে আমার জন্য খাস দিলে একটু দোয়া করবেন।
ভয় (পর্ব-১৬)-হুমায়ূন আহমেদ
আমি বললাম, আমি আমার এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। উনি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কিছু কথা বলবেন।
ইমাম সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন?
যাতে আপনার বাচ্চাটা ভালাে থাকে। সুস্থ থাকে। উনি খুব বড় একজন সাইকিয়াট্রিষ্ট। অনেক কিছু বুঝতে পারেন। যা আমরা বুঝতে পারিনা। উনার কথা
শুনলে আপনাদের মঙ্গল হবে। এইজন্যেই উনাকে এনেছি। ‘অবশ্যই আমি উনার কথা শুনবাে। অবশ্যই শুনবাে।
ইমাম সাহেব আমাদের ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরে অনেক লােকজন ছিল তাদের সরিয়ে দেয়! হল।।
মিসির আলি বললেন, আমি কিছু কথা বলব যা শুনতে ভাল লাগবে না তবু দয়া করে শুনুন।
লতিফা চাপা গলায় বলল, আমার সাথে কি কথা? ‘আপনার বাচ্চাটির বিষয়ে কথা। বাচ্চাটি যাতে বেঁচে থাকে, ভাল থাকে সে জন্যেই আমার কথাগুলি আপনাকে শুনতে হবে।
লতিফা তার স্বামীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, বলেন কি বলবেন। মিসির আলি খুবই নিরাসক্ত গলায় কথা বলতে শুরু করলেন। কথা বলার সময় একবারও লতিফার দিকে তাকালেন না। লতিফা তার শিশুকে বুকের কাছে নিয়ে খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার মাথায় লম্বা ঘােমটা। ঘােমটার ফাক দিয়ে মাঝে মাঝে তার তীব্র চোখের দৃষ্টি নজরে আসছে। ইমাম সাহেব তার স্ত্রীর পাশে বসে আছেন। মিসির আলির ব্যাখ্যা যতােই শুনছে ততােই তার চেহারা অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে।
ভয় (পর্ব-১৬)-হুমায়ূন আহমেদ
মিসির আলি কথা শেষ করে লতিফার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি আমার ব্যাখ্যা বিশ্বাস করলেন?
লতিফা জবাব দিলাে না। মাথার ঘােমটা সরিয়ে দিলাে। কি সুন্দর শান্ত মুখ। চোখের তীব্রতা এখন আর নেই। মনে হচ্ছে অশ্রু টলমল করছে।
মিসির আলি কঠিন গলায় বললেন, আমার ব্যাখ্যা আপনি বিশ্বাস না করলেও শিশুটির দিকে তাকিয়ে তার মঙ্গলের জন্য শিশুটিকে আপনি অন্যের কাছে দিন। সে যেন কিছুতেই আপনার সঙ্গে না থাকে। আমার যা বলবার বললাম বাকিটা আপনাদের ব্যাপার। আচ্ছা আজ তাহলে যাই। আমরা রাতেই রওনা হবাে। নৌকা ঠিক করা আছে।
আমরা বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আমি বললাম, মিসির আলি সাহেব আপনার কি মনে হয় মেয়েটি আপনার কথা বিশ্বাস করেছে ?
মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, যা করেছে। এবং বিশ্বাস করার কারণেই তার দ্রুত রােগমুক্তি ঘটবে। আমার ধারণা মেয়েটি নিজেও খানিকটা হলেও
এই সন্দেহই করছিলাে। মেয়েটি অসম্ভব বুদ্ধিমতী। চলুন রওনা দেয়া যাক। এই গ্রামে রাত কাটাতে চাইনা।
আমি বললাম, ইমাম সাহেবের সঙ্গে কথা বলে যাবেন না? না। আমার কাজ শেষ। বাকিটা ওরা দেখবে। রওনা হবার আগে আগে ইমাম সাহেব ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। শিশুটি তার কোলে। তিনি বললেন, লতিফা মেয়েটাকে দিয়ে দিয়েছে। সে খুব কাদতেছে। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়। মেহেরবানী করে একটু আসেন।
ভয় (পর্ব-১৬)-হুমায়ূন আহমেদ
আমরা আবার ঢুকলাম। বিস্মিত হয়ে দেখলাম লতিফা ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। মিসির আলি কোমল গলায় বললেন, আপনি কি কিছু বলবেন?
লতিফা কাদতে কাদতে বললাে, আল্লাহ আপনার ভালাে করবে। আল্লাহ আপনার ভালাে করবে।
‘আপনি কোন রকম চিন্তা করবেন না। আপনার অসুখ সেরে গেছে। আর কোনােদিন হবে না।
লতিফা তার স্বামীর কানে কানে কি যেন বললাে। ইমাম সাহেব বিব্রত গলায় বললেন, জনাব কিছু মনে করবেন না। লতিফা আপনারে একটু ছুঁইয়া দেখতে চায়।
মিসির আলি হাত বাড়িয়ে দিলেন। লতিফা দু‘হাতে সেই হাত জড়িয়ে ধরে শিশুর মতাে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাে।
নৌকায় উঠছি।
ইমাম সাহেব আমাদের তুলে দিতে এলেন। নৌকা ছাড়ার আগমুহূর্তে নিচু গলায় বললেন, ভাই সাহেব আমি অতি দরিদ্র মানুষ, আপনাদের যে কিছু দিবাে আল্লাহপাক আমাকে সেই ক্ষমতা দেন নাই। এই কোরান শরীফটা আমার দীর্ঘ দিনের সঙ্গী। যখন মন খুব খারাপ হয় তখন পড়ি – মন শান্ত করি। আমি খুব খুশি হবাে যদি কোরান মজিদটা আপনি নেন। আপনি নিবেন কি–না তা অবশ্য জানি না।
মিসির আলি বললেন, অবশ্যই নেবাে। খুব আনন্দের সঙ্গে নেবাে।
‘ভাই সাহেব, আমার মেয়েটার একটা নাম কি আপনি রাইখা যাইবেন?”
মিসির আলি হাসি মুখে বললেন, হ্যা যাবে। আপনার মেয়ের নাম রাখলাম লাবণ্য। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় এই নামের একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম। মেয়েটা আমাকে একেবারেই পাত্তা দেয়নি। মাঝে মাঝেই মেয়েটার কথা আমার মনে হয়। মনটা খারাপ হয়ে যায়। ভাই যাই।
ভয় (পর্ব-১৬)-হুমায়ূন আহমেদ
সঙ্গিনী
মিসির আলি বললেন, গল্প শুনবেন নাকি?
আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত মন্দ হয়নি। দশটার মত বাজে। বাসায় ফেরা দরকার। আকাশের অবস্থাও ভাল না। গুড় গুড় করে মেঘ ডাকছে। আষাঢ় মাস। যে কোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে।
আমি বললাম, আজ থাক। আরেকদিন শুনব। রাত অনেক হয়েছে। বাসায় চিন্তা করবে।
মিসির আলি হেসে ফেললেন।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, হাসছেন কেন? মিসির আলি হাসতে হাসতেই বললেন, বাসায় কে চিন্তা করবে? আপনার স্ত্রী কি বাসায় আছেন? আমারতাে ধারণা তিনি রাগ করে বাচ্চাদের নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে গেছেন।
মিসির আলির পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং সামান্য সূত্র ধরে সিদ্ধান্তুে চলে যাবার প্রায় অলৌকিক ক্ষমতার সঙ্গে আমি পরিচিত। তবুও বিস্মিত হলাম। আমার স্ত্রীর সঙ্গে আজ দুপুরেই বড় ধরণের ঝগড়া হয়েছে। সন্ধ্যাবেলায় সে সুটকেস গুছিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেছে। একা একা খালি বাড়িতে থাকতে অসহ্য বােধ হচ্ছিল বলে মিসির আলির কাছে এসেছি তবে এই ঘটনার কিছুই বলিনি। আগ বাড়িয়ে পারিবারিক ঝগড়ার কথা বলে বেড়ানাের কোন মানে হয় না।
ভয় (পর্ব-১৬)-হুমায়ূন আহমেদ
আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, ঝগড়া হয়েছে বুঝলেন কি করে? ‘অনুমানে বলছি। ‘অনুমানটাই বা কি করে করলেন?
‘আমি লক্ষ্য করলাম, আপনি আমার কাছে কোন কাজে আসেন নি। সময় কাটাতে এসেছেন। গল্প করছেন এবং আমার গল্প শুনছেন। কোন কিছুতেই তেমন
আনন্দ পাচ্ছেন না। অর্থাৎ কোন কারণে মুন বিক্ষিপ্ত। আমি বললাম, ভাবী কেমন আছেন? আপনি বললেন, ভাল। কিন্তু বলার সময় আপনার মুখ কঠিন হয়ে গেল। অর্থাৎ ভাবীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে।
(চলবে)