ভয় (পর্ব-১৬)-হুমায়ূন আহমেদ

মেয়েটি দরিদ্র ইমামকে বিয়ে করে কঠিন মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়েছেএকই সঙ্গে সে লােকটিকে প্রচণ্ড ভালােবাসে আবার প্রচণ্ড ঘৃণাও করেকি ভয়াবহ অবস্থা। 

ভয়

মেয়েটি ইমামকে প্রচণ্ড ঘৃণা করে এটা কেন বলছেন? ইমামতি পেশা মেয়েটির পছন্দ নয়পছন্দ নয় বলেই মেয়েটি কফিলের গলায় বলেছে ইমাম আসছেঅজুর পানি দে, জায়নামাজ দে, কেবলা কোনদিকে বলে দেএক ধরনের রসিকতা করার চেষ্টা করছে। 

মনােবিকার এমন ভয়াবহ রূপ নিলাে কেন? সে নিজের বাচ্চাকে হত্যা করছে কেন?” 

বড় ধরনের বিকারে এরকম হয়সে নিজেকে ধ্বংস করতে চাইছেনিজের সন্তান হত্যার মাধ্যমে সেই ইচ্ছারই অংশবিশেষ পূর্ণ হচ্ছেআরাে কিছু থাকতে পারেনা দেখে বলতে পারবাে না।” 

ধুন্দুল নাড়া গ্রামে সন্ধ্যার পর পৌছলামপৌছেই খবর পেলাম পাঁচদিন হয় ইমাম সাহেবের একটি কন্যা হয়েছেকন্যাটি ভালাে আছেবড় ধরনের স্বস্তি বােধ করলাম। 

ইমাম সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম মসজিদেতিনি আমাদের দেখে বড়ই অবাক হলেনআমি বললাম, আপনার স্ত্রী কেমন আছেন

ইমাম সাহেব বিব্রত গলায় বললেন, ভালাে নাখুব খারাপকফিল তার সঙ্গে সঙ্গে আছেকফিল বলেছে সাতদিনের মাথায় মেয়েটাকে মেরে ফেলবেখুব কষ্টে আছি ভাই সাহেবআল্লাহপাকের কাছে আমার জন্য খাস দিলে একটু দোয়া করবেন। 

ভয় (পর্ব-১৬)-হুমায়ূন আহমেদ

আমি বললাম, আমি আমার এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিউনি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কিছু কথা বলবেন। 

ইমাম সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন

যাতে আপনার বাচ্চাটা ভালাে থাকে। সুস্থ থাকেউনি খুব বড় একজন সাইকিয়াট্রিষ্টঅনেক কিছু বুঝতে পারেনযা আমরা বুঝতে পারিনাউনার কথা 

শুনলে আপনাদের মঙ্গল হবেএইজন্যেই উনাকে এনেছিঅবশ্যই আমি উনার কথা শুনবােঅবশ্যই শুনবাে। 

ইমাম সাহেব আমাদের ঘরে নিয়ে গেলেনঘরে অনেক লােকজন ছিল তাদের সরিয়ে দেয়! হল। 

মিসির আলি বললেন, আমি কিছু কথা বলব যা শুনতে ভাল লাগবে না তবু দয়া করে শুনুন। 

লতিফা চাপা গলায় বলল, আমার সাথে কি কথা? আপনার বাচ্চাটির বিষয়ে কথাবাচ্চাটি যাতে বেঁচে থাকে, ভাল থাকে সে জন্যেই আমার কথাগুলি আপনাকে শুনতে হবে। 

লতিফা তার স্বামীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, বলেন কি বলবেনমিসির আলি খুবই নিরাসক্ত গলায় কথা বলতে শুরু করলেনকথা বলার সময় একবারও লতিফার দিকে তাকালেন নালতিফা তার শিশুকে বুকের কাছে নিয়ে খাটে হেলান দিয়ে বসে আছেতার মাথায় লম্বা ঘােমটাঘােমটার ফাক দিয়ে মাঝে মাঝে তার তীব্র চোখের দৃষ্টি নজরে আসছেইমাম সাহেব তার স্ত্রীর পাশে বসে আছেনমিসির আলির ব্যাখ্যা যতােই শুনছে ততােই তার চেহারা অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে

ভয় (পর্ব-১৬)-হুমায়ূন আহমেদ

 মিসির আলি কথা শেষ করে লতিফার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি আমার ব্যাখ্যা বিশ্বাস করলেন

লতিফা জবাব দিলাে নামাথার ঘােমটা সরিয়ে দিলােকি সুন্দর শান্ত মুখচোখের তীব্রতা এখন আর নেইমনে হচ্ছে অশ্রু টলমল করছে। 

মিসির আলি কঠিন গলায় বললেন, আমার ব্যাখ্যা আপনি বিশ্বাস না করলেও শিশুটির দিকে তাকিয়ে তার মঙ্গলের জন্য শিশুটিকে আপনি অন্যের কাছে দিনসে যেন কিছুতেই আপনার সঙ্গে না থাকেআমার যা বলবার বললাম বাকিটা আপনাদের ব্যাপারআচ্ছা আজ তাহলে যাইআমরা রাতেই রওনা হবােনৌকা ঠিক করা আছে। 

আমরা বাইরে এসে দাঁড়ালামআমি বললাম, মিসির আলি সাহেব আপনার কি মনে হয় মেয়েটি আপনার কথা বিশ্বাস করেছে

মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, যা করেছেএবং বিশ্বাস করার কারণেই তার দ্রুত রােগমুক্তি ঘটবেআমার ধারণা মেয়েটি নিজেও খানিকটা হলেও 

এই সন্দেহই করছিলােমেয়েটি অসম্ভব বুদ্ধিমতীচলুন রওনা দেয়া যাক। এই গ্রামে রাত কাটাতে চাইনা। 

আমি বললাম, ইমাম সাহেবের সঙ্গে কথা বলে যাবেন না? নাআমার কাজ শেষবাকিটা ওরা দেখবেরওনা হবার আগে আগে ইমাম সাহেব ঘর থেকে বের হয়ে এলেনশিশুটি তার কোলেতিনি বললেন, লতিফা মেয়েটাকে দিয়ে দিয়েছেসে খুব কাদতেছেআপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়মেহেরবানী করে একটু আসেন। 

ভয় (পর্ব-১৬)-হুমায়ূন আহমেদ

আমরা আবার ঢুকলামবিস্মিত হয়ে দেখলাম লতিফা ব্যাকুল হয়ে কাঁদছেমিসির আলি কোমল গলায় বললেন, আপনি কি কিছু বলবেন

লতিফা কাদতে কাদতে বললাে, আল্লাহ আপনার ভালাে করবেআল্লাহ আপনার ভালাে করবে। 

আপনি কোন রকম চিন্তা করবেন নাআপনার অসুখ সেরে গেছেআর কোনােদিন হবে না। 

লতিফা তার স্বামীর কানে কানে কি যেন বললােইমাম সাহেব বিব্রত গলায় বললেন, জনাব কিছু মনে করবেন নালতিফা আপনারে একটু ছুঁইয়া দেখতে চায়। 

মিসির আলি হাত বাড়িয়ে দিলেনলতিফা দুহাতে সেই হাত জড়িয়ে ধরে শিশুর মতাে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাে। 

নৌকায় উঠছি। 

ইমাম সাহেব আমাদের তুলে দিতে এলেননৌকা ছাড়ার আগমুহূর্তে নিচু গলায় বললেন, ভাই সাহেব আমি অতি দরিদ্র মানুষ, আপনাদের যে কিছু দিবাে আল্লাহপাক আমাকে সেই ক্ষমতা দেন নাইএই কোরান শরীফটা আমার দীর্ঘ দিনের সঙ্গীযখন মন খুব খারাপ হয় তখন পড়ি মন শান্ত করিআমি খুব খুশি হবাে যদি কোরান মজিদটা আপনি নেনআপনি নিবেন কিনা তা অবশ্য জানি না। 

মিসির আলি বললেন, অবশ্যই নেবােখুব আনন্দের সঙ্গে নেবাে। 

ভাই সাহেব, আমার মেয়েটার একটা নাম কি আপনি রাইখা যাইবেন?” 

মিসির আলি হাসি মুখে বললেন, হ্যা যাবেআপনার মেয়ের নাম রাখলাম লাবণ্যইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় এই নামের একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছিলামমেয়েটা আমাকে একেবারেই পাত্তা দেয়নিমাঝে মাঝেই মেয়েটার কথা আমার মনে হয়মনটা খারাপ হয়ে যায়ভাই যাই। 

ভয় (পর্ব-১৬)-হুমায়ূন আহমেদ

সঙ্গিনী 

মিসির আলি বললেন, গল্প শুনবেন নাকি

আমি ঘড়ির দিকে তাকালামরাত মন্দ হয়নিদশটার মত বাজেবাসায় ফেরা দরকারআকাশের অবস্থাও ভাল নাগুড় গুড় করে মেঘ ডাকছেআষাঢ় মাসযে কোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। 

আমি বললাম, আজ থাকআরেকদিন শুনবরাত অনেক হয়েছেবাসায় চিন্তা করবে। 

মিসির আলি হেসে ফেললেন। 

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, হাসছেন কেন? মিসির আলি হাসতে হাসতেই বললেন, বাসায় কে চিন্তা করবে? আপনার স্ত্রী কি বাসায় আছেন? আমারতাে ধারণা তিনি রাগ করে বাচ্চাদের নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে গেছেন। 

মিসির আলির পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং সামান্য সূত্র ধরে সিদ্ধান্তুে চলে যাবার প্রায় অলৌকিক ক্ষমতার সঙ্গে আমি পরিচিততবুও বিস্মিত হলামআমার স্ত্রীর সঙ্গে আজ দুপুরেই বড় ধরণের ঝগড়া হয়েছেসন্ধ্যাবেলায় সে সুটকেস গুছিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেছেএকা একা খালি বাড়িতে থাকতে অসহ্য বােধ হচ্ছিল বলে মিসির আলির কাছে এসেছি তবে এই ঘটনার কিছুই বলিনিআগ বাড়িয়ে পারিবারিক ঝগড়ার কথা বলে বেড়ানাের কোন মানে হয় না। 

ভয় (পর্ব-১৬)-হুমায়ূন আহমেদ

আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, ঝগড়া হয়েছে বুঝলেন কি করে? অনুমানে বলছিঅনুমানটাই বা কি করে করলেন

আমি লক্ষ্য করলাম, আপনি আমার কাছে কোন কাজে আসেন নি। সময় কাটাতে এসেছেনগল্প করছেন এবং আমার গল্প শুনছেনকোন কিছুতেই তেমন 

আনন্দ পাচ্ছেন নাঅর্থাৎ কোন কারণে মুন বিক্ষিপ্তআমি বললাম, ভাবী কেমন আছেন? আপনি বললেন, ভালকিন্তু বলার সময় আপনার মুখ কঠিন হয়ে গেলঅর্থাৎ ভাবীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে

(চলবে)

ভয় (পর্ব-১৫)-হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *