আমি তখন নিশ্চিত হবার জন্যে বললাম, আমার সঙ্গে চারটা ভাত খান। আপনি রাজি হয়ে গেলেন। আমি ধরে নিলাম – রাগারাগি হয়েছে এবং আপনার স্ত্রী বাসায় নেই।
আপনার একা একা লাগছে বলেই আপনি এসেছেন আমার কাছে। এই সিদ্ধান্তে আসার জন্যে শার্লক হােমস হতে হয় না। একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলেই বুঝা যায়।
আমি কিছু বললাম না। মিসির আলি বললেন, চা চড়াচ্ছি। চা খেয়ে গল্প শুনুন, তারপর এই খানেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। খালি বাসায় একা একা রাত কাটাতে ভাল লাগবে না। তাছাড়া বৃষ্টি নামল বলে।
‘এটাও কি আপনার লজিক্যাল ডিডাকশান?”
না–এটা হচ্ছে উইসফুল থিংকিং। গরমে কষ্ট পাচ্ছি বৃষ্টি হলে জীবন বাচে। তবে বাতাস ভারী, বৃষ্টির দেরী নেই বলে আমার ধারণা।
‘বাতাসের আবার হাল্কা ভারী কি?” ‘আছে। হাল্কা–ভারীর ব্যাপার আছে। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ যখন বেড়ে যায় বাতাস হয় ভারী। সেটা আমি বুঝতে পারি মাথার চুলে হাত দিয়ে। জলীয় বাষ্পের পরিমাণের উপর নির্ভর করে মাথার চুল নরম বা শক্ত হয়। শীতকালে মাথার চুলে হাত দিয়ে দেখবেন এক রকম আবার গরম কালে যখন বাতাসে হিউমিডিটি অনেক বেশী তখন অন্যরকম। | আমার কাছেতাে সব সময় এক রকম লাগে।
ভয় (পর্ব-১৭)-হুমায়ূন আহমেদ
মিসির আলি ঘর ফাটিয়ে হাসতে লাগলেন। ভাবটা এ রকম যেন এরচে মজার কথা আগে শুনেন নি। আমি বােকার মত বসে রইলাম। অস্বস্তিও লাগতে লাগল। খুব বুদ্ধিমান মানুষের সঙ্গে গল্প করার মধ্যেও এক ধরণের অস্বস্তি থাকে। নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়। ” মিসির আলি ষ্টোভে চায়ের পানি বসিয়ে দিলেন। শো শাে শব্দ হতে লাগল।
এই যুগে ষ্টোভ প্রায় চোখেই পড়ে না। মিসির আলি এই বস্তু কোখেকে জোগাড় করেছেন কে জানে। কিছুক্ষণ পর পর পাম্প করতে হয়। অনেক যন্ত্রণা। | চায়ের কাপ হাতে বিছানায় এসে বসামাত্র বৃষ্টি শুরু হল। তুমুল বর্ষণ। মিসির আলি বললেন, আমার বেহেশতে যেতে ইচ্ছা করেনা কেন জানেন?
‘জানি না।
‘বেহেশতে যেতে ইচ্ছা করে না কারণ সেখানে ঝড় বৃষ্টি নেই। এয়ার কুলার বসানাে একটা ঘরের মত সেখানকার আবহাওয়া। তাপ বাড়বেও না, কমবেও না।
অনন্তকাল একই থাকবে। কোন মানে হয়?
‘আপনি কি বেহেশত দোজখ এইসব নিয়ে মাথা ঘামান?”
না ঘামাইনা। ‘সৃষ্টিকর্তা নিয়ে মাথা ঘামান? ‘হা ঘামাই। খুব চিন্তা করি, কোন কুল কিনারা পাই না। পৃথিবীর সমস্ত ধর্ম গ্রন্থ কি বলে জানেন? বলে – সৃষ্টিকর্তা বা ইশ্বর পারেন না এমন কিছুই নেই। তিনি সব পারেন। অথচ আমার ধারণা তিনি দুটা জিনিশ পারেন না যা মানুষ পারে।
ভয় (পর্ব-১৭)-হুমায়ূন আহমেদ
‘আমি অবাক হয়ে বললাম, উদাহরণ দিন।
‘সৃষ্টিকর্তা নিজেকে ধ্বংস করতে পারেন না। মানুষ পারে। আবার সৃষ্টিকর্তা দ্বিতীয় একজন সৃষ্টিকর্তা তৈরী করতে পারেন না। মানুষ কিন্তু পারে, সে সন্তানের জন্ম দেয়।
‘আপনি তাহলে একজন নাস্তিক?
না আমি নাস্তিক না। আমি খুবই আস্তিক। আমি এমন সব রহস্যময় ঘটনা আমার চারপাশে ঘটতে দেখেছি যে বাধ্য হয়ে আমাকে আস্তিক হতে হয়েছে। ব্যাখ্যাতীত সব ঘটনা। যেমন স্বপ্নের কথাটাই ধরুন। সামান্য স্বপ্ন অথচ ব্যাখ্যাতীত একটা ঘটনা।
ব্যাখ্যাতীত হবে কেন? ফ্রয়েডতাে চমৎকার ব্যাখ্যা করেছেন বলে শুনেছি। ‘মােটেই চমৎকার ব্যাখ্যা করেন নি। স্বপ্নের পুরাে ব্যাপারটাই তিনি অবদিমিত কামনার উপর চাপিয়ে দিয়ে লিখলেন– Interpretations of dream; তিনি শুধু বিশেষ এক ধরণের স্বপ্নই ব্যাখ্যা করলেন। অন্য দিক সম্পর্কে চুপ করে রইলেন। যদিও তিনি খুব ভাল করে জানতেন মানুষের বেশ কিছু স্বপ্ন আছে যা ব্যাখ্যা করা যায় না।
তিনি এই নিয়ে প্রচুর কাজও করেছেন কিন্তু প্রকাশ করেননি। নষ্ট করে ফেলেছেন। তার ছাত্র প্রফেসর জাং কিছু কাজ করেছেন – মূল সমস্যায় পৌছতে পারেন নি, বলতে বাধ্য হয়েছেন যে কিছু কিছু স্বপ্ন মানুষ কেন দেখে তা বলা যাচ্ছেনা। যেমন একটা লােক স্বপ্ন দেখল হঠাৎ মাথার উপর সিলিং ফ্যানটা খুলে পড়ে গেল। স্বপ্ন দেখার দুদিন পর দেখা গেল সত্যি সত্যি সিলিং ফ্যান খুলে পড়ে গেছে।
ভয় (পর্ব-১৭)-হুমায়ূন আহমেদ
এই ধরণের স্বপ্নকে বলে প্রিকগনিশন ড্রিম (Precognition drean) এর একটিই ব্যাখ্যা স্বপ্নে মানুষ ভবিষৎ দেখতে পাচ্ছে। যা সম্ভব নয়। কাজেই এ জাতীয় স্বপ্ন ব্যাখ্যাতীত।
আমি বললাম, এমনােতাে হতে পারে – যে কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে। ‘হতে পারে। প্রচুর কাকতালীয় ব্যাপার পৃথিবীতে ঘটছে। তবে কাকতালীয় ব্যাপারগুলিকেও একটা স্ট্যাটিসটিক্যাল প্রবাবিলিটির ভেতর থাকতে হবে। Precognition dream এর ক্ষেত্রে তা থাকে না।
‘বুঝতে পারছি না। ‘বােঝানাে একটু কঠিন আমি বরং স্বপ্ন সম্পর্কে একটা গল্প বলি– শুনতে চান?
বলুন শুনি – ভৌতিক কিছু? ‘না – ভৌতিক না – তবে রহস্যময়তাে বটেই। আরেক দফা চা হয়ে যাক। ‘হােক। ‘কি ঠিক করলেন? থেকে যাবেন? বৃষ্টি কিন্তু বাড়ছে।
আমি থেকে যাওয়াই ঠিক করলাম। মিসির আলি চা নিয়ে বিছানায় পা তুলে বসলেন। গল্প শুরু হল।
“ছােটবেলায় আমাদের বাসায় খাবনামা‘ নামে একটা স্বপ্ন তথ্যের বই ছিল। কোন্ স্বপ্ন দেখলে কি হয় সব ঐ বইয়ে লেখা। আমার মা ছিলেন বইটার বিশেষ ভক্ত। ঘুম থেকে উঠেই বলতেন, ও মিসির বইটা একটু দেখতাে। একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নের মানে কি বল। ‘আমি বই নিয়ে বসতাম।
দেখতাে বাবা গরু স্বপ্ন দেখলে কি হয়। আমি বই উল্টে জিজ্ঞেস করলাম, কি রঙের গরু মা? সাদা না কালাে ? ‘এইতাে মুসকিলে ফেললি, সাদা না কালাে খেয়াল নেই।” ‘সাদা রঙের গরু হলে – ধনলাভ। কালাে রঙের গরু হলে – বিবাদ।
কার সঙ্গে বিবাদ? তাের বাবার সাথে? ‘লেখা নাইতাে মা।
ভয় (পর্ব-১৭)-হুমায়ূন আহমেদ
মা চিন্তিত হয়ে পড়তেন। স্বপ্ন নিয়ে চিন্তার তার কোন শেষ ছিল না। আর কত বিচিত্র স্বপ্ন যে দেখতেন – একবার দেখলেন দুটা অন্ধ চড়ুই পাখি। খাবনামায় অন্ধ
চড়ুই পাখি দেখলে কি হয় লেখা নেই। কবুতর দেখলে কি হয় লেখা আছে। মা’র কারণেই খাবনামা ঘাটতে ঘাটতে একসময় পুরাে বইটা আমার মুখস্ত হয়ে গেল। স্বপ্ন বিশারদ হিসেবে আমার নাম রটে গেল। যে যা দেখে আমাকে এসে অর্থ জিজ্ঞেস করে। এই করতে গিয়ে জানলাম কত বিচিত্র স্বপ্নই না মানুষ দেখে। সেই সঙ্গে মজার মজার কিছু জিনিশও লক্ষ্য করলাম যেমন অসুস্থ মানুষরা সাধারণত বিকট সব দুঃস্বপ্ন দেখে।
বােকা মানুষদের স্বপ্নগুলি হয় সরল ধরণের। বুদ্ধিমান মানুষরা খুব জটিল স্বপ্ন দেখে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা একটা স্বপ্ন প্রায়ই দেখে সেটা হচ্ছে কোন একটি অনুষ্ঠানে সে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে উপস্থিত হয়েছে। সবার গায়ে ভাল পােষাক আষাক শুধু সেই পুরােপুরি নগ্ন। কেউ তা লক্ষ্য করছে না।”
মিসির আলি সাহেব কথা বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই জাতীয় স্বপ্ন কি আপনি কখনাে দেখেছেন? | ‘আমি বললাম, না। একটা স্বপ্নই আমি বার বার দেখি পরীক্ষা হলে পরীক্ষা দিতে বসেছি। খুব সহজ প্রশ্ন, সবগুলির উত্তর আমার জানা। লিখতে গিয়ে দেখি কলম দিয়ে কালি বেরুচ্ছে না। কলমটা বদলে অন্য কলম নিলাম সেটা দিয়েও কালি বেরুচ্ছে না। এদিকে ঘন্টা পড়ে গেছে।
“এই স্বপ্নটাও খুব কমন। আমিও দেখি। একবার দেখলাম বাংলা পরীক্ষা – প্রশ্ন দিয়েছে অংকের। কঠিন সব অংক। বাদরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উঠার অংক।
ভয় (পর্ব-১৭)-হুমায়ূন আহমেদ
একটা বাঁদরের জায়গায় দুটা বাদর। একটা খানিকটা উঠে অন্যটা তার লেজ ধরে টেনে নীচে নামায় – খুবই জটিল ব্যাপার। বাঁশের সবটা আবার তৈলাক্ত না কিছুটা তেল ছাড়া ....”
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, সত্যিই কি এমন স্বপ্ন দেখেছেন? ‘জিনা – ঠাট্টা করে বলছি – জটিল সব অংক ছিল এইটুকু মনে আছে। যাই হােক ছােটবেলা থেকেই এইসব কারণে স্বপ্নের দিকে আমি কুঁকলাম। দেশের বাইরে যখন প্যারাসাইকোলজী পড়তে গেলাম তখন স্পেশাল টপিক নিলাম ‘ড্রীম‘। ড্রীম ল্যাবােরেটরীতে কাজও করলাম।
(চলবে)