ভয় (পর্ব-১৭)-হুমায়ূন আহমেদ

আমি তখন নিশ্চিত হবার জন্যে বললাম, আমার সঙ্গে চারটা ভাত খানআপনি রাজি হয়ে গেলেনআমি ধরে নিলাম রাগারাগি হয়েছে এবং আপনার স্ত্রী বাসায় নেই

ভয়আপনার একা একা লাগছে বলেই আপনি এসেছেন আমার কাছেএই সিদ্ধান্তে আসার জন্যে শার্লক হােমস হতে হয় নাএকটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলেই বুঝা যায়। 

আমি কিছু বললাম নামিসির আলি বললেন, চা চড়াচ্ছিচা খেয়ে গল্প শুনুন, তারপর এই খানেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ুনখালি বাসায় একা একা রাত কাটাতে ভাল লাগবে নাতাছাড়া বৃষ্টি নামল বলে। 

এটাও কি আপনার লজিক্যাল ডিডাকশান?” 

নাএটা হচ্ছে উইসফুল থিংকিংগরমে কষ্ট পাচ্ছি বৃষ্টি হলে জীবন বাচেতবে বাতাস ভারী, বৃষ্টির দেরী নেই বলে আমার ধারণা। 

বাতাসের আবার হাল্কা ভারী কি?আছেহাল্কাভারীর ব্যাপার আছেবাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ যখন বেড়ে যায় বাতাস হয় ভারীসেটা আমি বুঝতে পারি মাথার চুলে হাত দিয়েজলীয় বাষ্পের পরিমাণের উপর নির্ভর করে মাথার চুল নরম বা শক্ত হয়শীতকালে মাথার চুলে হাত দিয়ে দেখবেন এক রকম আবার গরম কালে যখন বাতাসে হিউমিডিটি অনেক বেশী তখন অন্যরকম| আমার কাছেতাে সব সময় এক রকম লাগে। 

ভয় (পর্ব-১৭)-হুমায়ূন আহমেদ

মিসির আলি ঘর ফাটিয়ে হাসতে লাগলেনভাবটা রকম যেন এরচে মজার কথা আগে শুনেন নিআমি বােকার মত বসে রইলামঅস্বস্তিও লাগতে লাগলখুব বুদ্ধিমান মানুষের সঙ্গে গল্প করার মধ্যেও এক ধরণের অস্বস্তি থাকেনিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়মিসির আলি ষ্টোভে চায়ের পানি বসিয়ে দিলেনশো শাে শব্দ হতে লাগল

এই যুগে ষ্টোভ প্রায় চোখেই পড়ে নামিসির আলি এই বস্তু কোখেকে জোগাড় করেছেন কে জানেকিছুক্ষণ পর পর পাম্প করতে হয়অনেক যন্ত্রণা| চায়ের কাপ হাতে বিছানায় এসে বসামাত্র বৃষ্টি শুরু হলতুমুল বর্ষণমিসির আলি বললেন, আমার বেহেশতে যেতে ইচ্ছা করেনা কেন জানেন

জানি না। 

বেহেশতে যেতে ইচ্ছা করে না কারণ সেখানে ঝড় বৃষ্টি নেইএয়ার কুলার বসানাে একটা ঘরের মত সেখানকার আবহাওয়াতাপ বাড়বেও না, কমবেও না। 

অনন্তকাল একই থাকবেকোন মানে হয়

আপনি কি বেহেশত দোজখ এইসব নিয়ে মাথা ঘামান?” 

না ঘামাইনাসৃষ্টিকর্তা নিয়ে মাথা ঘামান? হা ঘামাইখুব চিন্তা করি, কোন কুল কিনারা পাই নাপৃথিবীর সমস্ত ধর্ম গ্রন্থ কি বলে জানেন? বলে সৃষ্টিকর্তা বা ইশ্বর পারেন না এমন কিছুই নেইতিনি সব পারেনঅথচ আমার ধারণা তিনি দুটা জিনিশ পারেন না যা মানুষ পারে। 

ভয় (পর্ব-১৭)-হুমায়ূন আহমেদ

আমি অবাক হয়ে বললাম, উদাহরণ দিন। 

সৃষ্টিকর্তা নিজেকে ধ্বংস করতে পারেন নামানুষ পারেআবার সৃষ্টিকর্তা দ্বিতীয় একজন সৃষ্টিকর্তা তৈরী করতে পারেন নামানুষ কিন্তু পারে, সে সন্তানের জন্ম দেয়। 

আপনি তাহলে একজন নাস্তিক

না আমি নাস্তিক নাআমি খুবই আস্তিকআমি এমন সব রহস্যময় ঘটনা আমার চারপাশে ঘটতে দেখেছি যে বাধ্য হয়ে আমাকে আস্তিক হতে হয়েছেব্যাখ্যাতীত সব ঘটনাযেমন স্বপ্নের কথাটাই ধরুনসামান্য স্বপ্ন অথচ ব্যাখ্যাতীত একটা ঘটনা। 

ব্যাখ্যাতীত হবে কেন? ফ্রয়েডতাে চমৎকার ব্যাখ্যা করেছেন বলে শুনেছিমােটেই চমৎকার ব্যাখ্যা করেন নি। স্বপ্নের পুরাে ব্যাপারটাই তিনি অবদিমিত কামনার উপর চাপিয়ে দিয়ে লিখলেInterpretations of dream; তিনি শুধু বিশেষ এক ধরণের স্বপ্নই ব্যাখ্যা করলেনঅন্য দিক সম্পর্কে চুপ করে রইলেনযদিও তিনি খুব ভাল করে জানতেন মানুষের বেশ কিছু স্বপ্ন আছে যা ব্যাখ্যা করা যায় না

তিনি এই নিয়ে প্রচুর কাজও করেছেন কিন্তু প্রকাশ করেননিনষ্ট করে ফেলেছেনতার ছাত্র প্রফেসর জাং কিছু কাজ করেছেন মূল সমস্যায় পৌছতে পারেন নি, বলতে বাধ্য হয়েছেন যে কিছু কিছু স্বপ্ন মানুষ কেন দেখে তা বলা যাচ্ছেনাযেমন একটা লােক স্বপ্ন দেখল হঠাৎ মাথার উপর সিলিং ফ্যানটা খুলে পড়ে গেলস্বপ্ন দেখার দুদিন পর দেখা গেল সত্যি সত্যি সিলিং ফ্যান খুলে পড়ে গেছে। 

ভয় (পর্ব-১৭)-হুমায়ূন আহমেদ

এই ধরণের স্বপ্নকে বলে প্রিকগনিশন ড্রিম (Precognition drean) এর একটিই ব্যাখ্যা স্বপ্নে মানুষ ভবিষৎ দেখতে পাচ্ছেযা সম্ভব নয়কাজেই জাতীয় স্বপ্ন ব্যাখ্যাতীত। 

আমি বললাম, এমনােতাে হতে পারে যে কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছেহতে পারেপ্রচুর কাকতালীয় ব্যাপার পৃথিবীতে ঘটছেতবে কাকতালীয় ব্যাপারগুলিকেও একটা স্ট্যাটিসটিক্যাল প্রবাবিলিটির ভেতর থাকতে হবেPrecognition dream এর ক্ষেত্রে তা থাকে না। 

বুঝতে পারছি নাবােঝানাে একটু কঠিন আমি বরং স্বপ্ন সম্পর্কে একটা গল্প বলিশুনতে চান

বলুন শুনি ভৌতিক কিছু? না ভৌতিক না তবে রহস্যময়তাে বটেইআরেক দফা চা হয়ে যাকহােককি ঠিক করলেন? থেকে যাবেন? বৃষ্টি কিন্তু বাড়ছে। 

আমি থেকে যাওয়াই ঠিক করলামমিসির আলি চা নিয়ে বিছানায় পা তুলে বসলেনগল্প শুরু হল। 

ছােটবেলায় আমাদের বাসায় খাবনামানামে একটা স্বপ্ন তথ্যের বই ছিলকোন্ স্বপ্ন দেখলে কি হয় সব বইয়ে লেখাআমার মা ছিলেন বইটার বিশেষ ভক্তঘুম থেকে উঠেই বলতেন, মিসির বইটা একটু দেখতােএকটা স্বপ্ন দেখলামস্বপ্নের মানে কি বলআমি বই নিয়ে বসতাম। 

দেখতাে বাবা গরু স্বপ্ন দেখলে কি হয়আমি বই উল্টে জিজ্ঞেস করলাম, কি রঙের গরু মা? সাদা না কালাে ? এইতাে মুসকিলে ফেললি, সাদা না কালাে খেয়াল নেইসাদা রঙের গরু হলে ধনলাভকালাে রঙের গরু হলে বিবাদ। 

কার সঙ্গে বিবাদ? তাের বাবার সাথে? লেখা নাইতাে মা। 

ভয় (পর্ব-১৭)-হুমায়ূন আহমেদ

মা চিন্তিত হয়ে পড়তেনস্বপ্ন নিয়ে চিন্তার তার কোন শেষ ছিল নাআর কত বিচিত্র স্বপ্ন যে দেখতেন একবার দেখলেন দুটা অন্ধ চড়ুই পাখিখাবনামায় অন্ধ  

চড়ুই পাখি দেখলে কি হয় লেখা নেইকবুতর দেখলে কি হয় লেখা আছেমা’কারণেই খাবনামা ঘাটতে ঘাটতে একসময় পুরাে বইটা আমার মুখস্ত হয়ে গেলস্বপ্ন বিশারদ হিসেবে আমার নাম রটে গেলযে যা দেখে আমাকে এসে অর্থ জিজ্ঞেস করেএই করতে গিয়ে জানলাম কত বিচিত্র স্বপ্নই না মানুষ দেখেসেই সঙ্গে মজার মজার কিছু জিনিশও লক্ষ্য করলাম যেমন অসুস্থ মানুষরা সাধারণত বিকট সব দুঃস্বপ্ন দেখে

বােকা মানুষদের স্বপ্নগুলি হয় সরল ধরণেরবুদ্ধিমান মানুষরা খুব জটিল স্বপ্ন দেখেসমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা একটা স্বপ্ন প্রায়ই দেখে সেটা হচ্ছে কোন একটি অনুষ্ঠানে সে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে উপস্থিত হয়েছেসবার গায়ে ভাল পােষাক আষাক শুধু সেই পুরােপুরি নগ্নকেউ তা লক্ষ্য করছে না” 

মিসির আলি সাহেব কথা বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই জাতীয় স্বপ্ন কি আপনি কখনাে দেখেছেন? | আমি বললাম, নাএকটা স্বপ্নই আমি বার বার দেখি পরীক্ষা হলে পরীক্ষা দিতে বসেছিখুব সহজ প্রশ্ন, সবগুলির উত্তর আমার জানালিখতে গিয়ে দেখি কলম দিয়ে কালি বেরুচ্ছে নাকলমটা বদলে অন্য কলম নিলাম সেটা দিয়েও কালি বেরুচ্ছে নাএদিকে ঘন্টা পড়ে গেছে। 

এই স্বপ্নটাও খুব কমনআমিও দেখিএকবার দেখলাম বাংলা পরীক্ষা প্রশ্ন দিয়েছে অংকেরকঠিন সব অংকবাদরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উঠার অংক

ভয় (পর্ব-১৭)-হুমায়ূন আহমেদ

 একটা বাঁদরের জায়গায় দুটা বাদরএকটা খানিকটা উঠে অন্যটা তার লেজ ধরে টেনে নীচে নামায় খুবই জটিল ব্যাপার। বাঁশের সবটা আবার তৈলাক্ত না কিছুটা তেল ছাড়া ....” 

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, সত্যিই কি এমন স্বপ্ন দেখেছেন? ‘জিনা ঠাট্টা করে বলছি জটিল সব অংক ছিল এইটুকু মনে আছেযাই হােক ছােটবেলা থেকেই এইসব কারণে স্বপ্নের দিকে আমি কুঁকলামদেশের বাইরে যখন প্যারাসাইকোলজী পড়তে গেলাম তখন স্পেশাল টপিক নিলাম ড্রীমড্রীম ল্যাবােরেটরীতে কাজও করলাম

(চলবে)

ভয় (পর্ব-১৬)-হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *