ভয় (পর্ব-১৮)-হুমায়ূন আহমেদ

আমার প্রফেসর ছিলেন ডঃ সুইন হার্নদুঃস্বপ্নের ব্যাপারে যাকে পৃথিবীর সেরা বিশেষজ্ঞ বলা যেতে পারেদুঃস্বপ্ন এ্যানালিসিসের তিনি একটা টেকনিক বের করেছেন যার নাম সুইন হার্ন এ্যানালিসিস

ভয়সুইন হার্ন এ্যানালিসিসে ব্যাখ্যা করা যায় না এমন সব দুঃস্বপ্নের একটা ফাইল তাঁর কাছে ছিলসেই ফাইল তিনি তার গ্রাজুয়েট ছাত্রদের দিতেন নাআমাকে তিনি খুবই পছন্দ 

করতেন সম্ভবত সে কারণেই সেই ফাইল ঘাটার সুযােগ হয়ে গেলফাইল পড়ে আমি হতভম্বব্যাখ্যাতীত সব ব্যাপারএকটা উদাহরণ দেই নিউ ইংল্যাণ্ডের একটি তেইশ বছর বয়েসী মেয়ে দুস্বপ্ন দেখা শুরু করলতার নাভীমূল থেকে একটা হাত বের হয়ে আসছেস্বাভাবিক হাতের চেয়ে সরু লম্বা লম্বা আঙুলহাতটার রঙ নীলচেখুব তুলতুলেদুঃস্বপ্নটা সে প্রায়ই দেখতে লাগলপ্রতিবারই স্বপ্ন ভাঙতাে

বিকট চিৎকারতাকে ড্রীম ল্যাবরেটরীতে ভর্তি করা হলপ্রফেসর সুইন হার্ন রুগীনীর মনােবিশ্লেষণ করলেনঅস্বাভাবিক কিছুই পেলেন নামেয়েটিকে পাঠিয়ে দেয়া হল নিউ ইংল্যাণ্ডেতার কিছুদিন পর মেয়েটি লক্ষ্য করল তার নাভীমুল ফুলে উঠেছে এক ধরণের নন ম্যালিগন্যান্ট গ্রোথ হচ্ছেএক মাসের মধ্যে সেই টিউমার মানুষের হাতের আকৃতি ধারণ করলটিউমারটির মাথায় মানুষের হাতের আঙুলের মত পাচটি আঙুল ........” 

আমি মিসির আলিকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ভাই এই গল্পটা থাকশুনতে ভাল লাগছে নাঘেন্না লাগছে। 

ভয় (পর্ব-১৮)-হুমায়ূন আহমেদ

ঘেন্না লাগার মতই ব্যাপারছবি দেখলে আরাে ঘেন্না লাগবেমেয়েটির ছবি ছাপা হয়েছে নিউ ইংল্যাণ্ড জার্নাল অব মেডিসিনেছবি দেখতে চান

জিনাপিএইচডি প্রােগ্রামে গিয়েছিলাম, পিইএচডি না করেই ফিরতে হলপ্রফেসরের সঙ্গে ঝামেলা হলযে লােক আমাকে এত পছন্দ করতাে সেই বিষ নজরে দেখতে লাগলােএম, এস ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরলামঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পার্ট টাইম টিচিং এর একটা ব্যবস্থা হলছাত্রদের এবনরমাল বিহেভিয়ার পড়াইস্বপ্ন সম্পর্কেও বলিস্বল্পের সঙ্গে মানুষের অস্বাভাবিক আচরণের একটা সম্পর্ক বের করার চেষ্টা করিছাত্রদের বলি, তােমরা যদি কখনাে কোন ভয়ংকর স্বপ্ন দেখ তাহলে আমাকে বলবে। 

ছাত্ররা প্রায়ই এসে স্বপ্ন বলে যায়ওদের কোন স্বপ্নই তেমন ভয়ংকর ন্মসাপে তাড়া করছে, আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে এই জাতীয় স্বপ্নআমার ইচ্ছা ছিল দুঃস্বপ্ন নিয়ে গবেষণার কিছু কাজ করবসেই ইচ্ছা সফল হল নাদুঃস্বপ্ন দেখছে এমন লােকজনই পাওয়া গেলাে নাআমি গবেষণার কথা যখন ভুলে গেলাম তখন এলাে লােকমান ফকির। 

লােকমান ফকিরের বাড়ি কুমিল্লার বীনগরেবয়স ত্রিশ পয়ত্রিশশিপিং করপােরেশনে মােটামুটি ধরনের চাকরি করেদুকামরার একটা বাড়ি ভাড়া করেছে কাঠাল বাগানেবিয়ে করেনি তবে বিয়ের চিন্তা ভাবনা করছেতার এক মামাতাে বােনের সঙ্গে বিয়ের কথা বার্তা হচ্ছে। মেয়েটিকে তার পছন্দ নয়তবে অপছন্দের কথা সে সরাসরি বলতেও পারছে নাকারণ তার এই মামা তাকে পড়াশােনা করিয়েছেন। 

ভয় (পর্ব-১৮)-হুমায়ূন আহমেদ

ছেলেটি এক সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে দেখা করতে এলআমি তাকে দেখে চমকে উঠলামমুখ পপুর বর্ণ, মৃত মানুষের চোখের মত ভাবলেশহীন চোখযৌবনের নিজস্ব যে জ্যোতি যুবকযুবতীর চোখে থাকে তার কিছুই নেইছেলেটি হাঁটছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে কিছুক্ষণ পরপরই চমকে উঠছেসে ঘরে ঢুকেই বিনা ভূমিকায় বলল, স্যার আপনি আমাকে বাঁচান

আমি ছেলেটিকে বসালামপরিচয় নিলামহাল্কা কিছু কথাবার্তা বলে তাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলামতাতে খুব লাভ হল বলে মনে হল নাতার অস্থিরতা কমল নালক্ষ্য করলাম সে স্থির হয়ে বসতেও পারছে নাখুব নড়াচড়া করছেআমি বললাম, তােমার সমস্যাটা কি

ছেলেটি রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে প্রায় অস্পষ্ট গলায় বললাে, স্যার আমি দুঃস্বপ্ন দেখিভয়ংকর দুঃস্বপ্নআমি বললাম, দুঃস্বপ্ন দেখে না এমন মানুষ তুমি খুঁজে পাবে নাসাপে তাড়া করছে, বাঘে তাড়া করছে আকাশ থেকে নীচে পড়ে যাওয়া এগুলি খুবই কমন স্বপ্নসাধারণত হজমের অসুবিধা হলে লােকজন দুঃস্বপ্ন দেখে

ঘুমের অসুবিধা হলেও দেখো তুমি শুয়ে আছ, মাথার নীচ থেকে বালিশ সরে গেল তখনাে এরকম স্বপ্ন তুমি দেখতে পারশারিরীক অস্বস্তির একটা প্রকাশ ঘটে দুঃস্বপ্নেআগুনে পুড়ার স্বপ্ন মানুষ কখন দেখে জান? যখন পেটে গ্যাস হয় সেই গ্যাসে বুক জ্বালাপুড়া করে তখন সে স্বপ্ন দেখে তাকে জ্বলন্ত আগুনে ফেলে দেয়া হয়েছে। 

ভয় -হুমায়ূন আহমেদ

স্যার আমার স্বপ্ন রকম নাঅন্যরকমঠিক আছে, গুছিয়ে বল। শুনে দেখি কি রকম। 

ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে কথা শুরু করলমুখস্ত বলে যাবার মত বলে যেতে লাগলােমনে হয় আগে থেকে ঠিক ঠাক করে এসেছে এবং অনেকবার রিহার্সেল দিয়েছে। 

কথা বলার সময় একবারও আমার চোখের দিকে তাকাল নাযখন প্রশ্ন করলাম তখনাে না। 

প্রথম স্বপ্নটা দেখি বুধবার রাতেএগারােটার দিকে ঘুমুতে গেছিআমার ঘুমের কোন সমস্যা নেইশােয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়তে পারিসে রাতেও তাই হলবিছানায় শােয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়েছিসঙ্গে সঙ্গেই স্বপ্নটা দেখেছি

ভয় -হুমায়ূন আহমেদ

 

কি করে বুঝলে শােয়ামাত্র স্বপ্ন দেখেছ?জেগে উঠে ঘড়ি দেখেছি, এগারােটা দশ ? স্বপ্নটা বল।আমি দেখলাম খােলামেলা একটা মাঠের মত জায়গাখুব বাতাস বইছেশাে শোঁ শব্দ হচ্ছেরীতিমত শীত লাগছেআমার চারদিকে অনেক মানুষ কিন্তু ওদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি নাএদের কথা শুনতে পাচ্ছিহাসির শব্দ শুনছিএকটা বাচ্চা ছেলে কাদছে তাও শুনছিবুড়ামত একটা লােকের কাশির শব্দ শােনা যাচ্ছে কিন্তু কাউকে আবছা ভাবেও দেখতে পাচ্ছি না

একবার মনে হল আমি বােধ হয় অন্ধ হয়ে গেছিচারদিকে খুব তীক্ষ্ম চোখে তাকালাম মাঠ দেখতে পাচ্ছি, কুয়াশা দেখতে পাচ্ছি কিন্তু মানুষজন দেখছি না অথচ তাদের কথা শুনছিহঠাৎ ওদের কথাবার্তা সব থেমে গেলােবাতাসের শাে শো শব্দও বন্ধ হয়ে গেলমনে হল কেউ যেন এসেছেতার ভয়ে সবাই চুপ করে গেছেআমার নিজেরাে প্রচণ্ড ভয় লাগলােএক ধরণের অন্ধ ভয়| তখন শ্লেষা জড়িত মােটা গলায় কে একজন বলল, ছেলেটিতাে দেখি এসেছেমেয়েটা কোথায়

ভয় (পর্ব-১৮)-হুমায়ূন আহমেদ

কেউ জবাব দিল নাখানিকক্ষণের জন্যে বাচ্চা ছেলেটির কান্না শােনা গেল, সঙ্গে সঙ্গে থেমেও গেলমনে হল কেউ যেন তার মুখে হাত চাপা দিয়ে কান্না বন্ধ করার চেষ্টা করছেভারী গলার লােকটা আবার কথা বলল, মেয়েটা দেরী করছে কেন? কেন এত দেরী? ছেলেটিকেতাে বেশীক্ষণ রাখা যাবে নাএর ঘুম পাতলা হয়ে এসেছেজেগে যাবে। 

হঠাৎ চারদিকে সাড়া পড়ে গেলােএক সঙ্গে সবাই বলে উঠলাে এসেছে, এসেছে, মেয়েটা এসেছেআমি চমকে উঠে দেখলাম আমার পাশে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 

খুব রােগা একটা মেয়েঅসম্ভব ফর্সা, বয়স আঠারাে উনিশএলােমেলাে ভাবে শাড়ি পরালম্বা চুলচুলগুলি ছেড়ে দেয়া, বাতাসে উড়ছেমেয়েটা ভয়ে থর থর করে কাপছেআমি অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছিসে অসংকোচে আমার হাত ধরে কাঁপা গলায় বলল, আমার ভয় করছেআমার ভয় করছে। 

আমি বললাম, আপনি কে

ভয় (পর্ব-১৮)-হুমায়ূন আহমেদ

সে বলল, আমার নাম নারগিসআপনি যা দেখছেন তা স্বপ্নভয়ংকর স্বপ্নএকটু পরই বুঝবেনআগে এই স্বপ্নটা শুধু আমি একা দেখতামএখন মনে হয় আপনিও দেখবেন। 

মেয়েটা কাঁদতে শুরু করলআতংকে অস্থির হয়ে আমার গা ঘেঁষে দাড়ালকাদতে কাদতেই বলল, আপনি কিছু মনে করবেন না আমার ভয় লাগছে বলেই আমি এভাবে দাড়িয়ে আছিএরা প্রতিমাসে একবার করে আমাকে এই স্বপ্নটা দেখায়। 

(চলবে)

ভয় (পর্ব-১৭)-হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *