আমার প্রফেসর ছিলেন ডঃ সুইন হার্ন। দুঃস্বপ্নের ব্যাপারে যাকে পৃথিবীর সেরা বিশেষজ্ঞ বলা যেতে পারে। দুঃস্বপ্ন এ্যানালিসিসের তিনি একটা টেকনিক বের করেছেন যার নাম সুইন হার্ন এ্যানালিসিস।
সুইন হার্ন এ্যানালিসিসে ব্যাখ্যা করা যায় না এমন সব দুঃস্বপ্নের একটা ফাইল তাঁর কাছে ছিল। সেই ফাইল তিনি তার গ্রাজুয়েট ছাত্রদের দিতেন না। আমাকে তিনি খুবই পছন্দ
করতেন সম্ভবত সে কারণেই সেই ফাইল ঘাটার সুযােগ হয়ে গেল। ফাইল পড়ে আমি হতভম্ব। ব্যাখ্যাতীত সব ব্যাপার। একটা উদাহরণ দেই – নিউ ইংল্যাণ্ডের একটি তেইশ বছর বয়েসী মেয়ে দুস্বপ্ন দেখা শুরু করল। তার নাভীমূল থেকে একটা হাত বের হয়ে আসছে। স্বাভাবিক হাতের চেয়ে সরু লম্বা লম্বা আঙুল। হাতটার রঙ নীলচে–খুব তুলতুলে। দুঃস্বপ্নটা সে প্রায়ই দেখতে লাগল। প্রতিবারই স্বপ্ন ভাঙতাে।
বিকট চিৎকার। তাকে ড্রীম ল্যাবরেটরীতে ভর্তি করা হল। প্রফেসর সুইন হার্ন রুগীনীর মনােবিশ্লেষণ করলেন। অস্বাভাবিক কিছুই পেলেন না। মেয়েটিকে পাঠিয়ে দেয়া হল নিউ ইংল্যাণ্ডে। তার কিছুদিন পর মেয়েটি লক্ষ্য করল তার নাভীমুল ফুলে উঠেছে – এক ধরণের নন ম্যালিগন্যান্ট গ্রোথ হচ্ছে। এক মাসের মধ্যে সেই টিউমার মানুষের হাতের আকৃতি ধারণ করল। টিউমারটির মাথায় মানুষের হাতের আঙুলের মত পাচটি আঙুল ........”
আমি মিসির আলিকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ভাই এই গল্পটা থাক। শুনতে ভাল লাগছে না। ঘেন্না লাগছে।
ভয় (পর্ব-১৮)-হুমায়ূন আহমেদ
‘ঘেন্না লাগার মতই ব্যাপার। ছবি দেখলে আরাে ঘেন্না লাগবে। মেয়েটির ছবি ছাপা হয়েছে নিউ ইংল্যাণ্ড জার্নাল অব মেডিসিনে। ছবি দেখতে চান?
‘জিনা।। ‘পিএইচডি প্রােগ্রামে গিয়েছিলাম, পিইএচডি না করেই ফিরতে হল। প্রফেসরের সঙ্গে ঝামেলা হল। যে লােক আমাকে এত পছন্দ করতাে সেই বিষ নজরে দেখতে লাগলাে। এম, এস ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পার্ট টাইম টিচিং এর একটা ব্যবস্থা হল। ছাত্রদের এবনরমাল বিহেভিয়ার পড়াই। স্বপ্ন সম্পর্কেও বলি। স্বল্পের সঙ্গে মানুষের অস্বাভাবিক আচরণের একটা সম্পর্ক বের করার চেষ্টা করি। ছাত্রদের বলি, তােমরা যদি কখনাে কোন ভয়ংকর স্বপ্ন দেখ তাহলে আমাকে বলবে।
ছাত্ররা প্রায়ই এসে স্বপ্ন বলে যায়। ওদের কোন স্বপ্নই তেমন ভয়ংকর ন্ম। সাপে তাড়া করছে, আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে এই জাতীয় স্বপ্ন। আমার ইচ্ছা ছিল দুঃস্বপ্ন নিয়ে গবেষণার কিছু কাজ করব। সেই ইচ্ছা সফল হল না। দুঃস্বপ্ন দেখছে এমন লােকজনই পাওয়া গেলাে না। আমি গবেষণার কথা যখন ভুলে গেলাম তখন এলাে লােকমান ফকির।
লােকমান ফকিরের বাড়ি কুমিল্লার বীনগরে। বয়স ত্রিশ পয়ত্রিশ। শিপিং করপােরেশনে মােটামুটি ধরনের চাকরি করে। দুকামরার একটা বাড়ি ভাড়া করেছে কাঠাল বাগানে। বিয়ে করেনি তবে বিয়ের চিন্তা ভাবনা করছে। তার এক মামাতাে বােনের সঙ্গে বিয়ের কথা বার্তা হচ্ছে। মেয়েটিকে তার পছন্দ নয়। তবে অপছন্দের কথা সে সরাসরি বলতেও পারছে না। কারণ তার এই মামা তাকে পড়াশােনা করিয়েছেন।
ভয় (পর্ব-১৮)-হুমায়ূন আহমেদ
ছেলেটি এক সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। আমি তাকে দেখে চমকে উঠলাম। মুখ পপুর বর্ণ, মৃত মানুষের চোখের মত ভাবলেশহীন চোখ। যৌবনের নিজস্ব যে জ্যোতি যুবক–যুবতীর চোখে থাকে তার কিছুই নেই। ছেলেটি হাঁটছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে কিছুক্ষণ পরপরই চমকে উঠছে। সে ঘরে ঢুকেই বিনা ভূমিকায় বলল, স্যার আপনি আমাকে বাঁচান।
আমি ছেলেটিকে বসালাম। পরিচয় নিলাম। হাল্কা কিছু কথাবার্তা বলে তাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। তাতে খুব লাভ হল বলে মনে হল না। তার অস্থিরতা কমল না। লক্ষ্য করলাম সে স্থির হয়ে বসতেও পারছে না। খুব নড়াচড়া করছে। আমি বললাম, তােমার সমস্যাটা কি?
ছেলেটি রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে প্রায় অস্পষ্ট গলায় বললাে, স্যার আমি দুঃস্বপ্ন দেখি। ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন। আমি বললাম, দুঃস্বপ্ন দেখে না এমন মানুষ তুমি খুঁজে পাবে না। সাপে তাড়া করছে, বাঘে তাড়া করছে আকাশ থেকে নীচে পড়ে যাওয়া এগুলি খুবই কমন স্বপ্ন। সাধারণত হজমের অসুবিধা হলে লােকজন দুঃস্বপ্ন দেখে।
ঘুমের অসুবিধা হলেও দেখো তুমি শুয়ে আছ, মাথার নীচ থেকে বালিশ সরে গেল তখনাে এরকম স্বপ্ন তুমি দেখতে পার। শারিরীক অস্বস্তির একটা প্রকাশ ঘটে দুঃস্বপ্নে। আগুনে পুড়ার স্বপ্ন মানুষ কখন দেখে জান? যখন পেটে গ্যাস হয় সেই গ্যাসে বুক জ্বালাপুড়া করে তখন সে স্বপ্ন দেখে তাকে জ্বলন্ত আগুনে ফেলে দেয়া হয়েছে।
ভয় -হুমায়ূন আহমেদ
“স্যার আমার স্বপ্ন এ রকম না। অন্যরকম। “ঠিক আছে, গুছিয়ে বল। শুনে দেখি কি রকম।
ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে কথা শুরু করল। মুখস্ত বলে যাবার মত বলে যেতে লাগলাে। মনে হয় আগে থেকে ঠিক ঠাক করে এসেছে এবং অনেকবার রিহার্সেল দিয়েছে।
কথা বলার সময় একবারও আমার চোখের দিকে তাকাল না। যখন প্রশ্ন করলাম তখনাে না।
‘প্রথম স্বপ্নটা দেখি বুধবার রাতে। এগারােটার দিকে ঘুমুতে গেছি। আমার ঘুমের কোন সমস্যা নেই। শােয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়তে পারি। সে রাতেও তাই হল। বিছানায় শােয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়েছি। সঙ্গে সঙ্গেই স্বপ্নটা দেখেছি।
ভয় -হুমায়ূন আহমেদ
‘কি করে বুঝলে শােয়ামাত্র স্বপ্ন দেখেছ?” ‘জেগে উঠে ঘড়ি দেখেছি, এগারােটা দশ ? ‘স্বপ্নটা বল।” ‘আমি দেখলাম খােলামেলা একটা মাঠের মত জায়গা। খুব বাতাস বইছে। শাে শোঁ শব্দ হচ্ছে। রীতিমত শীত লাগছে। আমার চারদিকে অনেক মানুষ কিন্তু ওদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। এদের কথা শুনতে পাচ্ছি। হাসির শব্দ শুনছি। একটা বাচ্চা ছেলে কাদছে তাও শুনছি। বুড়ামত একটা লােকের কাশির শব্দ শােনা যাচ্ছে কিন্তু কাউকে আবছা ভাবেও দেখতে পাচ্ছি না।
একবার মনে হল আমি বােধ হয় অন্ধ হয়ে গেছি। চারদিকে খুব তীক্ষ্ম চোখে তাকালাম – মাঠ দেখতে পাচ্ছি, কুয়াশা দেখতে পাচ্ছি – কিন্তু মানুষজন দেখছি না অথচ তাদের কথা শুনছি। হঠাৎ ওদের কথাবার্তা সব থেমে গেলাে। বাতাসের শাে শো শব্দও বন্ধ হয়ে গেল। মনে হল কেউ যেন এসেছে। তার ভয়ে সবাই চুপ করে গেছে। আমার নিজেরাে প্রচণ্ড ভয় লাগলাে। এক ধরণের অন্ধ ভয়। | তখন শ্লেষা জড়িত মােটা গলায় কে একজন বলল, ছেলেটিতাে দেখি এসেছে। মেয়েটা কোথায়?
ভয় (পর্ব-১৮)-হুমায়ূন আহমেদ
কেউ জবাব দিল না। খানিকক্ষণের জন্যে বাচ্চা ছেলেটির কান্না শােনা গেল, সঙ্গে সঙ্গে থেমেও গেল। মনে হল কেউ যেন তার মুখে হাত চাপা দিয়ে কান্না বন্ধ করার চেষ্টা করছে। ভারী গলার লােকটা আবার কথা বলল, মেয়েটা দেরী করছে কেন? কেন এত দেরী? ছেলেটিকেতাে বেশীক্ষণ রাখা যাবে না। এর ঘুম পাতলা হয়ে এসেছে। ও জেগে যাবে।
হঠাৎ চারদিকে সাড়া পড়ে গেলাে। এক সঙ্গে সবাই বলে উঠলাে এসেছে, এসেছে, মেয়েটা এসেছে। আমি চমকে উঠে দেখলাম আমার পাশে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
খুব রােগা একটা মেয়ে। অসম্ভব ফর্সা, বয়স আঠারাে উনিশ। এলােমেলাে ভাবে শাড়ি পরা। লম্বা চুল। চুলগুলি ছেড়ে দেয়া, বাতাসে উড়ছে। মেয়েটা ভয়ে থর থর করে কাপছে। আমি অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছি। সে অসংকোচে আমার হাত ধরে কাঁপা গলায় বলল, আমার ভয় করছে। আমার ভয় করছে।
আমি বললাম, আপনি কে?
ভয় (পর্ব-১৮)-হুমায়ূন আহমেদ
সে বলল, আমার নাম নারগিস। আপনি যা দেখছেন তা স্বপ্ন। ভয়ংকর স্বপ্ন। একটু পরই বুঝবেন। আগে এই স্বপ্নটা শুধু আমি একা দেখতাম। এখন মনে হয় আপনিও দেখবেন।
মেয়েটা কাঁদতে শুরু করল। আতংকে অস্থির হয়ে আমার গা ঘেঁষে দাড়াল। কাদতে কাদতেই বলল, আপনি কিছু মনে করবেন না আমার ভয় লাগছে বলেই আমি এভাবে দাড়িয়ে আছি। এরা প্রতিমাসে একবার করে আমাকে এই স্বপ্নটা দেখায়।
(চলবে)