লােকটি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, টাকার কথায় আপনি কি রাগ করেছেন? ‘রাগ করিনি। মজা পেয়েছি। চা খাবেন?” ‘খেতে পারি। দুধ ছাড়া।
মিসির আলি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, এক কাজ করুন – রান্নাঘরে চলে যান। কেতলি বসিয়ে দিন। দুকাপ বানান। আমাকেও এক কাপ দেবেন।
ভদ্রলোেক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, আমাকে ঘন্টা হিসেবে পে করবেন বলে যেভাবে হকচকিয়ে দিয়েছিলেন, আমিও ঠিক একই ভাবে আপনাকে হকচকিয়ে দিলাম। বসুন চা বানাতে হবেনা। সাতটার সময় রাস্তার ওপাশের রেষ্টুরেন্ট থেকে আমার জন্যে চা নাশতা আসে। তখন আপনার জন্যেও চা আনিয়ে দেব।
থ্যাংক ইউ স্যার। ‘আপনি কথা বলার সময় বার বার বাঁ দিকে ঘুরছেন, আমার মনে হচ্ছে আপনার বা চোখটা নষ্ট। এই জন্যেই কি কালাে চশমা পরে আছেন?”
ভদ্রলােক সহজ গলায় বললেন, জি। আমার বা চোখটা পাথরের।
ভয় (পর্ব-২)-হুমায়ূন আহমেদ
ভদ্রলােক সােফার এক কোণে বসলেন। মিসির আলি লক্ষ্য করলেন লােকটি শিরদাড়া সােজা করে বসে আছে। চাকরির ইন্টারভু দিতে এলে ক্যানডিডেটরা যে ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে অবিকল সেই ভঙ্গি। মিসির আলি বললেন, আজকের খবরের কাগজ এখনাে আসেনি। গতদিনের কাগজ দিতে পারি। যদি আপনি চোখ বুলাতে চান। | ‘আমি খবরের কাগজ পড়ি না। একা একা বসে থেকে আমার অভ্যাস আছে। আমার জন্যে আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। শুরুতে টাকা দেয়ার কথা বলে যদি আপনাকে আহত করে থাকি তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
মিসির আলি টুব্রাশ হাতে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। লােকটিকে তার বেশ ইস্টারেস্টিং বলে মনে হচ্ছে। তবে কোন গুরুতর সমস্যা নিয়ে এসেছে বলে মনে হয় । আজকাল অকারণেই কিছু লােকজন এসে তাকে বিরক্ত করা শুরু করেছে।
মাসখানিক আগে একজন এসেছিল ভূত বিশারদ। সে না–কি গবেষণাধর্মী একটি বই। লিখছে যার নাম “বাংলার–ভূত।” এ দেশে যত ধরণের ভূত পেত্নী আছে সবার নাম, আচার–ব্যবহার বই এ লেখা। মেছাে ভূত, গেছাে ভূত, জলা ভূত, শাকচুন্নি, কন্ধকাটা, কুনী ভূত, কুত্তী ভূত, আঁধি ভূত ..। সর্বমােট একশ’ ছ‘রকমের ভূত।
ভয় (পর্ব-২)-হুমায়ূন আহমেদ
মিসির আলি বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ভাই আমার কাছে কেন? আমি সারাজীবন ভূত নেই এইটা প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছি...।
সেই লােক মহা উৎসাহী হয়ে বলল, কোন্ কোন্ ভূত নেই বলে প্রমাণ করেছেন। – এইটা কাইণ্ডলি বলুন। আমার কাছে ক্যাসেট প্লেয়ার আছে। আমি টেপ করে নেব।
সানগ্লাস পরা বেঁটে ভদ্রলােক সেই পদের কেউ কিনা কে বলবে?
তােয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে মিসির আলি বললেন, ভাই বলুন কি ব্যাপার।
‘প্রথমেই আমার নাম বলি—এখনাে আমি আপনাকে আমার নাম বলিনি। আমার নাম রাশেদুল করিম। আমেরিকার টেক্সাস এম এণ্ড এন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের আমি একজন অধ্যাপক। বর্তমানে এক বছরের স্যাবােটিক্যাল লীভে দেশে এসেছি। আপনার খোঁজ কি ভাবে এবং কার কাছে পেয়েছি তা–কি বলব?”
তার দরকার নেই। কি জন্যে আমার খোজ করছেন সেটা বলুন। ‘আমি কি ধূমপান করতে পারি? সিগারেট খেতে খেতে কথা বললে আমার জন্যে সুবিধা হবে। সিগারেটের ধােয়া এক ধরণের আড়াল সৃষ্টি করে।
‘আপনি সিগারেট খেতে পারেন, কোন অসুবিধা নেই। ‘ছাই কোথায় ফেলব? আমি কোন এসট্র দেখতে পাচ্ছি না। ‘মেঝেতে ফেলুন। আমার গােটা বাড়িটাই একটা এসট্র।
রাশেদুল করিম সিগারেট ধরিয়েই কথা বলা শুরু করলেন। তার গলার স্বর ভারী এবং স্পষ্ট। কথাবার্তা খুব গােছানাে। কথা শুনে মনে হয় তিনি কি বলবেন তা আগে ভাগেই জানেন। কোন বাক্যটির পর কোন্ বাক্য বলবেন তাও ঠিক করা। যেন ক্লাসের বক্তৃতা। আগে থেকে ঠিকঠাক করা। প্রবাসী বাঙ্গালীরা এক নাগাড়ে বাংলায় কথা বলতে পারেন না– ইনি তা পারছেন।
ভয় (পর্ব-২)-হুমায়ূন আহমেদ
“আমার বয়স এই নভেম্বরে পঞ্চাশ হবে। সম্ভবত আমাকে দেখে তা বুঝতে পারছেন না। আমার মাথার চুল সব শাদা। কলপ ব্যবহার করছি গত চার বছর থেকে। আমার স্বাস্থ্য ভাল। নিয়মিত ব্যায়াম করি। মুখের চামড়ায় এখনাে ভাজ পড়ে নি। বয়সজনিত অসুখ বিসুখ কোনটাই আমার নেই। আমার ধারণা শারিরীক এবং মানসিক দিক দিয়ে আমার কর্মক্ষমতা এখনাে একজন পয়ত্রিশ বছরের যুবকের মত।
এই কথাটা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। আজ আমার গায়ে হলুদ। মেয়ে পক্ষীয়রা সকাল নটায় আসবে। আমি ঠিক আটটায় এখান থেকে যাব। আটটা পর্যন্ত সময় কি আমাকে দেবেন?”
‘দেব। ভাল কথা এটা নিশ্চয়ই আপনার প্রথম বিবাহ না। এর আগেও আপনি বিয়ে করেছেন?”
‘জি। এর আগে একবার বিয়ে করেছি। এটি আমার দ্বিতীয় বিবাহ। আমি আগেও বিয়ে করেছি তা কি করে বললেন? | ‘আজ আপনার গায়ে হলুদ তা খুব সহজভাবে বললেন দেখে অনুমান করলাম। বিয়ের তীব্র উত্তেজনা আপনার মধ্যে দেখতে পাইনি। | ‘সব মানুষতাে এক রকম নয়। একেকজন একেক রকম। উত্তেজনার ব্যাপারটি আমার মধ্যে একেবারেই নেই। প্রথমবার যখন বিয়ে করি তখনাে আমার মধ্যে বিন্দুমাত্র উত্তেজনা ছিল না। সেদিনও আমি যথারীতি ক্লাসে গিয়েছি। গ্রুপ থিওরীর উপর এক ঘন্টার লেকচার দিয়েছি।
“ঠিক আছে আপনি বলে যান।
রাশেদুল করিম শান্ত গলায় বললেন, আপনার ভেতর একটা প্রবণতা লক্ষ্য করছি – আমাকে আর দশটা মানুষের দলে ফেলে বিচার করার চেষ্টা করছেন। দয়া করে তা করবেন না। আমি আর দশজনের মত নই।
‘আপনি শুরু করুন। ‘অংকশাস্ত্রে এম–এ. ডিগ্রী নিয়ে আমি আমেরিকা যাই পি এইচ ডি করতে। এম. এতে আমার রেজাল্ট ভাল ছিল না। টেনে টুনে সেকেণ্ড ক্লাস।