একটা মজার ঘটনার কথা বলি।
ক্লাস নিচ্ছি, পড়াচ্ছি থার্মোডিনামিক্স। একটি ছেলেকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম সে উত্তর দিতে পারল না। বিরক্ত হয়ে বললাম, নাম কি তােমার? সে উঠে দাড়াল কিন্তু নাম বলল না। ক্লাসের সব ছেলেমেয়েরা হাসতে শুরু করল। আমি বিস্মিত। তাদের হাসির কারণ ধরতে পারছি না। আবার বললাম, নাম কি তােমার? ছাত্র–ছাত্রীরা আবারও হেসে উঠল। ছেলেটির পাশে বসা একজন বলল, স্যার সে নাম বলবে না। কারণ তার নাম – মিসির আলি।
ঘটনাটা ক্ষুদ্র। কিন্তু এই ক্ষুদ্র ঘটনা আমার মন আনন্দে পূর্ণ করল। মিসির আলি নামের চরিত্রটি আমি তাহলে অনেকের কাছেই পৌছে দিতে পেরেছি। একজন লেখকের কাছে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে?
আমি বিব্রত ভঙ্গিতে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে বললাম, তুমি অস্বস্তি বােধ করছ কেন? মিসির আলি চরিত্রটি কি তুমি পছন্দ কর না?
সে মাথা নীচু করে রইল, অন্য একজন পেছন থেকে বলল, স্যার ওর নামটাই মিসির আলি, বুদ্ধি শুক্তি খুব কম।
ভয় (পর্ব-১)-হুমায়ূন আহমেদ
আবার সবাই হেসে উঠল। ঐ দিনের ক্লাসের ঘটনাটি আমার জীবনের আনন্দময় ঘটনার একটি। | মিসির আলিকে নিয়ে আরাে তিনটি গল্প লেখা হল। এই আনন্দময় ঘটনার উনেখ সেই। কারণেই করলাম। হয়ত এতে খুব সুক্ষ্ম ভাবে হলেও সামান্য অহংকার প্রকাশ করা হয়েছে। পাঠক–পাঠিকা আমার এই মানবিক ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন এই বিনীত কামনা।
হুমায়ুন আহমেদ শহীদুল্লাহ হল
ভাের ছটায় কেউ কলিং বেল টিপতে থাকলে মেজাজ বিগড়ে যাবার কথা। মিসির আলির মেজাজ তেমন বিগড়াল না। ভোের দশটা পর্যন্ত কেন জানি তার মেজাজ বেশ ভাল থাকে। দশটা থেকে খারাপ হতে থাকে, চূড়ান্ত রকমের খারাপ হয় দুটার দিকে। তারপর আবার ভাল হতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে অসম্ভব ভাল থাকে তারপর আবার খারাপ হতে শুরু করে। ব্যাপারটা শুধু তার বেলায় ঘটে না সবার বেলায়ই ঘটে তা তিনি জানেন না। প্রায়ই ভাবেন একে ওকে জিজ্ঞেস করবেন – শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠে না। তার চরিত্রের বড় রকমের দুর্বল দিক হচ্ছে পরিচিত কারাে সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে না।
অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলতে পারেন, কথা বলতে ভালও লাগে। সেদিন রিকশা করে আসতে আসতে রিকশাওয়ালার সঙ্গে অতি উচ্চ শ্রেণীর কিছু কথাবার্তা চালিয়ে গেলেন। রিকশাওয়ালার বক্তব্য হচ্ছে – পৃথিবীতে যত অশান্তি সবের মূলে আছে মেয়েছেলে।
মিসির আলি বললেন, এই রকম মনে হওয়ার কারণ কি? রিকশাওয়ালা অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বললেন, চাচামিয়া এই দেহেন আমারে। আইজ আমি রিকশা চালাই। এর কারণ কি? এর কারণ বিবি হাওয়া। বিবি হাওয়া যদি কুবুদ্ধি দিয়া বাবা আদমরে গন্ধম ফল না খাওয়াইতাে তাহইলে আইজ আমি থাকতাম বেহেশতে। বেহেশতেততা আর রিকশাচালানীর কোন বিষয় নাই, কি কন চাচামিয়া? গন্ধম ফল খাওয়ানির কারণেইতাে আইজ আমি দুনিয়ায় আইসা পড়লাম। | মিসির আলি রিকশাওয়ালার কথাবার্তায় চমৎকৃত হলেন।
ভয় (পর্ব-১)-হুমায়ূন আহমেদ
পরবর্তি দশ মিনিট তিনি রিকশাওয়ালাকে যা বললেন, তার মূল কথা হল – নারীর কারণে আমরা যদি স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে থাকি তাহলে নারীই পারে আবার আমাদের স্বর্গে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।
রিকশাওয়ালা কি বুঝল কে জানে। তার শেষ বক্তব্য ছিল – যাই কন চাচামিয়া, মেয়ে মানুষ আসলে সুবিধার জিনিশ না।
কলিং বেল আবার বাজছে
মিসির আলি বেল টেপার ধরন থেকে অনুমান করতে চেষ্টা করলেন – কে হতে পারে।
ভিখিরী হবে না। ভিখিরীরা এত ভােরে বের হয় না। ভিক্ষাবৃত্তি যাদের পেশা তারা পরিশ্রান্ত হয়ে গভীর রাতে ঘুমুতে যায়, ঘুম ভাংতে সেই কারণেই দেরী হয়। পরিচিত কেউ হবে না। পরিচিতরা এত ভােরে আসবে না। তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে পারে এমন ঘনিষ্ঠতা তার কারাে সঙ্গেই নেই। | যে এসেছে, সে অপরিচিত। অবশ্যই মহিলা। পুরুষরা কলিং বেলের বােতাম অনেকক্ষণ চেপে ধরে থাকে।
ভয় (পর্ব-১)-হুমায়ূন আহমেদ
মেয়েরা তা পারে না। মেয়েটির বয়স অল্প তাও অনুমান করা যাচ্ছে। অল্পবয়স্ক মেয়েদের মধ্যে এক ধরণের ছটফটে ভাব থাকে। তারা অল্প সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকবার বেল টিপবে। নিজেদের অস্থিরতা ছড়িয়ে দেবে কলিং বেলে।
মিসির আলি, পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে দরজা খুললেন। বিস্মিত হয়ে দেখলেন, তার অনুমান সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে – মাঝবয়েসী এক দ্রলােক দাঁড়িয়ে আছেন। বেটে খাট একজন মানুষ। গায়ে সাফারি। চোখে সানগ্লাস। এত ভােরে কেউ সাল্লাস পরে । এই লােকটি কেন পরেছে কে জানে। ‘স্যার স্লামালিকুম ‘ওয়ালাইকুম সালাম। ‘আপনার নাম কি মিসির আলি?”
‘আমি কি আপনার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলতে পারি? –
ভয় (পর্ব-১)-হুমায়ূন আহমেদ
মিসির আলি কি বলবেন মনস্থির করতে পারলেন না। লােকটিকে তিনি পছন্দ করছেন না, তবে তার মধ্যে এক ধরণের আত্মবিশ্বাস লক্ষ্য করছেন–যা তার ভাল লাগছে। আত্মবিশ্বাসের ব্যাপারটা আজকাল আর দেখাই যায় না। | লােকটি শান্ত গলায় বলল, আমি আপনার কিছুটা সময় নষ্ট করব ঠিকই তবে তার জন্য আমি পে করব।
ভয় (পর্ব-১)-হুমায়ূন আহমেদ
‘পে করবেন? । প্রতি ঘন্টায় আমি আপনাকে এক হাজার করে টাকা দেব। আশা করি আপনি আপত্তি করবেন না। আমি কি ভেতরে আসতে পারি?
‘আসুন।
লােকটি ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, মনে হচ্ছে আপনার এখনাে হাত মুখ ধােয়া হয়নি। আপনি হাত মুখ ধুয়ে আসুন, আমি অপেক্ষা করছি।
মিসির আলি বললেন, ঘন্টা হিসেবে আপনি যে আমাকে টাকা দেবেন – সেই হিসেব কি এখন থেকে শুরু হবে ? না–কি হাত মুখ ধুয়ে আপনার সামনে বসার পর থেকে শুরু হবে ?