এক সময় গা থেকে মৃত মানুষের শরীরের পচা গন্ধ বেরুতে থাকে এবং তখন আচমকা আমার বা চোখ খুলে যায়, সেই চোখে আমি এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। সেই চোখের দৃষ্টি সাপের মত কুটিল।
জুডির কথা শুনে শুনে আমার ধারণা হল হতেওতাে পারে। জগতে কত রহস্যময় ব্যাপারইতাে ঘটে। হয়ত আমার নিজেরই কোন সমস্যা আছে। আমিও ডাক্তারের কাছে গেলাম। স্লীপ এ্যানালিষ্ট। জানার উদ্দেশ্য একটিই ঘুমের মধ্যে আমার কোন শারিরীক পরিবর্তন হয় কি–না। ডাক্তাররা পুংখানুপুংখ পরীক্ষা করলেন। একবার না বার বার করলেন।
দেখা গেল আমার ঘুম আর দশটা মানুষের ঘুমের চেয়ে আলাদা নয়। ঘুমের মধ্যে আমিও হাত পা নাড়ি। অন্য মানুষদের যেমন ঘুমের তিনটি স্তর পার হতে হয় আমারাে হয়। ঘুমের সময় আর দশটা মানুষের মত। আমার শরীরের উত্তাপও আধ ডিগ্রী হ্রাস পায়। আমিও অন্য সবার মত স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন দেখি।
জুডি সব দেখে শুনে বলল, ডাক্তাররা জানে না। ডাক্তাররা কিছুই জানে না। আমি জানি। তুমি আসলে মানুষ না। দিনের বেলা তুমি মানুষ থাক–সূর্য ডােবার পর থাক না।
আমি কি হই? তুমি পিশাচ বা এই জাতীয় কিছু হয়ে যাও। আমি বললাম, এই ভাবেতাে বাস করা সম্ভব না। তুমি বরং আলাদা থাক। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার জুডি তাতে রাজি হল না। অতি তুচ্ছ কারণে আমেরিকানদের বিয়ে ভাঙ্গে। স্বামীর পছন্দ হলুদ রঙের বিছানার চাদর, স্ত্রীর পছন্দ নীল রঙ। ভেঙ্গে গেল বিয়ে। আমাদের এত বড় সমস্যা কিন্তু বিয়ে ভাঙ্গলাে না। আমি বেশ কয়েকবার তাকে বললাম, জুড়ি তুমি আলাদা হয়ে যাও! ভাল দেখে একটা ছেলেকে বিয়ে কর। সারা জীবন তােমার সামনে পড়ে আছে। তুমি এই ভাবে জীবনটা নষ্ট করতে পার না।
জুডি প্রতিবারই বলে, যাই হােক, যত সমস্যাই হােক আমি তােমাকে ছেড়ে যাব all, I Love you. I love you. | আমি গল্পের প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। শেষ অংশটি বলার আগে আমি আপনাকে আমার চোখের দিকে তাকাতে অনুরােধ করব। দয়া করে আমার চোখের দিকে তাকান।
রাশেদুল করিম সানগ্লাস খুলে ফেললেন। মিসির আলি তৎক্ষণাৎ বললেন, আপনার চোখ সুন্দর। সত্যি সুন্দর। আপনার মা যে বলতেন চোখে জন্ম–কাজল, ঠিকই বলতেন।
রাশেদুল করিম বললেন, পৃথিবীতে সবচে সুন্দর চোখ কার ছিল জানেন? ‘ক্লিওপেট্রার ?
‘অধিকাংশ মানুষের তাই ধারণা। এ ধারণা সত্যি নয়। পৃথিবীতে সবচে সুন্দর চোখ ছিল বুদ্ধদেবের পুত্র কুনালের। ইংরেজ কবি শেলীর চোখও খুব সুন্দর ছিল। আমার
স্ত্রীর ধারণা, এই পৃথিবীতে সবচে সুন্দর চোখ আমার। জুডি বলতাে এই চোখের কারণেই সে কোনদিন আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না।
রাশেদুল করিম সানগ্লাস চোখে দিয়ে বললেন, গল্পের শেষ অংশ বলার আগে আপনাকে ক্ষুদ্র ধন্যবাদ দিতে চাচ্ছি। | মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, কি জন্যে বলুনতাে?
‘কাউকে যখন আমি আমার চোখের দিকে তাকাতে বলি, সে আমার পাথরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আপনি প্রথম ব্যক্তি যিনি একবারও আমার পাথরের চোখের দিকে তাকান নি। আমার আসল চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। So nice of you, Sir.‘
রাশেদুল করিমের গলা মুহুর্তের জন্যে হলেও ভারী হয়ে গেল। তিনি স্বশ্যি চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, আটটা প্রায় বাজতে চলল, গল্পের শেষটা বলি | “জুডির অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে লাগল। কড়া ডােজের ঘুমের অষুধ খেয়ে ঘুমুতে যায়, দুএক ঘন্টা ঘুম হয় বাকি রাত জেগে বসে থাকে। মাঝে মাঝে চিৎকার করে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। বারান্দায় দাড়িয়ে ফুপিয়ে কাঁদে।
ভয় (পর্ব-৪)-হুমায়ূন আহমেদ
এমনি এক রাতের ঘটনা। জুলাই মাস। রাত সাড়ে তিনটার মত হবে। জুডির মাথা পুরােপুরি খারাপ হয়ে গেল – সে আমার বা চোখটা গেলে দিল। আমি ঘুমুচ্ছিলাম, নারকীয় যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলাম। সেই ভয়াবহ কষ্টের কোন সীমা পরিসীমা নেই।”
রাশেদুল করিম চুপ করলেন। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগল। মিসির আলি বললেন, কি দিয়ে চোখ গেলে দিলেন?
‘সুচালাে পেনসিল দিয়ে। আমার মাথার বালিশের নীচে প্যাড এবং পেনসিল থাকে। তখন গ্রুপ থিওরী নিয়ে গভীর চিন্তায় ছিলাম। মাথায় যদি হঠাৎ কিছু আসে – তা লিখে ফেলার জন্যে বালিশের নীচে প্যাড এবং পেনসিল রাখতাম।
‘আপনার স্ত্রী ঘটনা প্রসঙ্গে কি বক্তব্য দিয়েছেন। ‘তার মাথা পুরােপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সে কিছুই বলেনি শুধু চিৎকার করেছে। তার একটিই বক্তব্য – এই লােকটা পিশাচ। আমি প্রমাণ পেয়েছি। কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমার কাছে প্রমাণ আছে।
“কি প্রমাণ আছে তা–কি কখনাে জিজ্ঞেস করা হয়েছে ?”
‘না। একজন উন্মাদকে প্রশ্ন করে বিপর্যস্ত করার কোন মানে হয়না। তাছাড়া আমি তখন ছিলাম হাসপাতালে। আমি হাসপাতালে থাকতে থাকতেই জুডির মৃত্যু হয়।
‘স্বাভাবিক মৃত্যু?”
না। স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। সে মারা যায় ঘুমের অষুধ খেয়ে। এই টুকুই আমার গল্প। আমি আপনার কাছে একটাই অনুরােধ নিয়ে এসেছি, আপনি সমস্যাটা কি বের করবেন। আমাকে সাহায্য করবেন। আমি যদি পিশাচ হই তাও আমাকে বলবেন। এই ফাইলের ভেতর জুডির একটা স্কেচ বুক আছে। স্কেচ বুকে নানান ধরণের কমেন্টস লেখা আছে। এই কমেন্টসগুলি পড়লে জুডির মানসিক অবস্থা আঁচ করতে আপনার সুবিধা হতে পারে। আটটা বাজে আমি তাহলে উঠি?”
‘আবার কবে আসবেন? ‘আগামীকাল ভাের ছটায়। ভাল কথা, আমার এই গল্পে কোথাও কি প্রকাশ পেয়েছে জুডিকে আমি কতটা ভালবাসতাম?”
‘না– প্রকাশ পায় নি। ‘জুডির প্রতি আমার ভালবাসা ছিল সীমাহীন। আমি এখন উঠছি।” ছিল বলছেন কেন? এখন কি নেই? ভদ্রলােক জবাব দিলেন না। রাশেদুল করিম চলে যাবার পর মিসির আলি ফাইল খুললেন। ফাইলের শুরুতেই একটা খাম। খামের উপর মিসির আলির নাম লেখা।
মিসির আলি খাম খুললেন। খামের ভেতর ইংরেজীতে একটা চিঠি লেখা। সঙ্গে চারটি একশ ডলারের নােট। চিঠি খুবই সংক্ষিপ্ত।
প্রিয় মহােদয়,
আপনার সার্ভিসের জন্য সম্মানী বাবদ সামান্য কিছু দেয়া হল। গ্রহণ করলে খুশী হব।
বিনীত, আর করিম।
মিসির আলি স্কেচ বুকের প্রতিটি পাতা সাবধানে ওল্টালেন। চারকোল এবং পেনসিলে স্কেচ আঁকা। প্রতিটি স্কেচের নীচে আঁকার তারিখ। স্কেচের বিষয়বস্তু অতি তুচ্ছ, বই ঘরােয়া জিনিশ – এক জোড়া জুতা, মলাট ছেড়া বই, টিভি, বুক শেলফ। স্কেচ বুকের শেষের দিকে শুধুই চোখের ছবি। বিড়ালের চোখ, কুকুরের
চোখ, মাছের চোখ এবং মানুষের চোখ। মানুষের চোখের মডেল যে রাশেদুল করিম। তা বলার অপেক্ষা রাখে না। না বললেও ছবির নীচের মন্তব্য থেকে বােঝা যাচ্ছে। মন্তব্যগুলি বেশ দীর্ঘ। যেমন একটি মন্তব্য – | আমি খুব মন দিয়ে আমার স্বামীর চোখ লক্ষ্য করছি। মানুষের চোখ একেক সময় একেক রকম থাকে। ভােরবেলার চোখ এবং দুপুরের চোখ এক নয়। আরাে একটি জিনিশ লক্ষ্য করলাম চোখের আইরিশের ট্রান্সপারেন্সি মুডের উপর বদলায়। বিষাদগ্রস্থ মানুষের চোখের আইরিশ থাকে অস্বচ্ছ।
(চলবে)