ভয় (পর্ব-৫)-হুমায়ূন আহমেদ

মানুষ যতই আনন্দিত হতে থাকে তার চোখের আইরিশ ততই স্বচ্ছ হতে থাকেআমার এই অবজারভেশন কতটুকু সত্য তা বুঝতে পারছি না। 

ভয়মেয়েটি মাঝে মাঝে তার মনের অবস্থাও লিখেছেঅনেকটা ডায়েরী লেখার ভঙ্গিতেমনে হয় হাতের কাছে ডায়েরী না থাকায় স্কেচ বুকে লিখে রেখেছেসব লেখাই পেনসিলেপ্রচুর কাটা কুটি আছেকিছু লাইন রাবার ঘষে তুলেও ফেলা হয়েছে। 

আমি ভয়ে অস্থির হয়ে আছিনিজেকে বুঝানাের চেষ্টা করছি এই ভয় অমূলকবুঝতে পারছি নাআমি আমার স্বামীকে ভয় পাচ্ছি এই তথ্য স্বভাবতই স্বামী বেচারার জন্য সুখকর নাসে নানান ভাবে আমাকে সান্তনা দেবার চেষ্টা করছেকিছু কিছু চেষ্টা বেশ হাস্যকরআজ আমাকে বলল, জুডি আমি ঠিক করেছি এখন থেকে রাতে ঘুমুব নাআমার অংকের সমস্যা নিয়ে ভাববলেখালেখি করবতুমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাও

আমি দিনের বেলায় ঘুমুএকজন মানুষের জন্যে চার ঘন্টা ঘুমই যথেষ্টনেপােলীয়ান মাত্র তিন ঘন্টা ঘুমুতেন| আমি এই গম্ভীর, স্বল্পভাষী লােকটিকে ভালবাসিভালবাসি, ভালবাসি, নি:বাসিআমি চাইনা, আমার কোন কারণে সে কষ্ট পাককিন্তু সে কষ্ট পাচ্ছেখুব কষ্ট পাচ্ছেহে ইশ্বর, তুমি আমার মন শান্ত করআমার ভয় দূর করে দাও। 

যে জিনিশ খুব সুন্দর তা কত দ্রুত অসুন্দর হতে পারে বিস্মিত হয়ে আমি তাই দেখছিরাশেদের ধারণা আমি অসুস্থসত্যি কি অসুস্থ? আমার মনে হয় নাকারণ এখনাে ছবি আঁকতে পারছিএকজন অসুস্থ মানুষ তার যাই পারুকছবি 

আঁকতে পারে নাগত দুদিন ধরে ওয়াটার কালারে বাসার সামনের চেরী গাছের ফুল ধরতে চেষ্টা করছিলামআজ সেই ফুল কাগজে বন্দি করেছিঅনেকক্ষণ ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইলামভাল হয়েছেরাশেদ ছবি তেমন বুঝে বলে মনে হয় 

সেও মুগ্ধ হয়ে অনেকক্ষণ দেখলতারপর বলল, আমি যখন বুড়াে হয়ে যাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেব তখন তুমি আমাকে ছবি আঁকা শিখিয়ে দেবেএই কথাটি সে আজ প্রথম বলেনিআগেও বলেছেআন্তরিক ভঙ্গিতে বলেছেকেউ যখন আন্তরিক ভাবে কিছু বলে তখন তা টের পাওয়া যায়আমার মনে হয় না দে কোনদিন ছবি আঁকবেতার মাথায় অংক ছাড়া কিছুই নেই। 

আমি ছবি আঁকতে পারছি নাযেখানে নীল রঙ চড়ানাে দরকার সেখানে গাঢ় হলুদ রঙ বসাচ্ছিডাক্তার সিডেটিভের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছেসারাক্ষণ মাথা ঝিম ধরে থাকেকেন জানি খুব বমি হচ্ছে। 

আজ দুপুরে অনেকক্ষণ ঘুমুলামমজার ব্যাপার হচ্ছে সুন্দর একটা স্বপ্নও দেখে ফেললামসুন্দর স্বপ্ন আমি অনেকদিন দেখি নাঅনেকদিন দেখি না, অনেকদিন দেখিনাঅনেকদিন দেখিনাঅনেকদিন দেখিনাআচ্ছা আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছিশুনেছি পাগলরাই একই কথা বার বার লেখেকারণ তাদের মাথায় একটি বাক্যই বার বার ঘুরপাক খায়। 

বৃহস্পতিবার কিংবা বুধবার — 

আজ কত তারিখ আমি জানি নাবেশ কয়েকদিন ধরেই দিন তারিখে গণ্ডগােল হচ্ছেআজ কত তারিখ তা জানার কোন রকম আগ্রহ বােধ করছি নাতবে মনের অবস্থা লেখার চেষ্ঠা করছি যাতে পরবর্তি সময়ে কেউ আমার লেখা পড়ে বুঝবে যে মাথা খারাপ হবার সময় একজন মানুষ কি ভাবেকি চিন্তা করেমাথা খারাপের প্রথম লক্ষণ হচ্ছে আলাে অসহ্য হওয়াআমি এখন আলাে সহ্য করতে পারি নাদিনের বেলায় দরজা জানালা বন্ধ করে রাখিঘর অন্ধকার বলেই প্রায় অনুমানের উপর নির্ভর করে আজকের এই লেখা লিখছি

দ্বিতীয় লক্ষণ হচ্ছে সারাক্ষণ শরীরে এক ধরণের জ্বালা অনুভব করামনে হয় সব কাপড় খুলে বাথটাবে শুয়ে থাকতে পারলে ভাল লাগতআমার আগে যারা পাগল হয়েছে তাদেরও কি এমন হয়েছে? জানার জন্যে পাবলিক লাইব্রেরীতে টেলিফোন করেছিলাম। আমি খুব সহজ ভাবে বললাম, আচ্ছা আপনাদের এখানে পাগলের লেখা কোন বই আছে

যে মেয়েটি টেলিফোন ধরেছিল সে বিস্মিত হয়ে বলল, পাগলের লেখা বই বলতে কি বুঝাচ্ছেন

মানসিক রুগীদের লেখা বইমানসিক রুগীরা বই লিখবে কেন?কেন লিখবে নাআমি তাে লিখছি, বই অবশ্যি নয়ডায়েরীর আকারে লেখা। 

আচ্ছাঠিক আছে আপনার বই ছাপা হােকছাপা হবার পর অবশ্যই আমরা আপনার বই এর কপি সংগ্রহ করব| আমি মনে মনে হাসলামমেয়েটি আমাকে উন্মাদ ভাবছেভাবুকউমাদকে উন্মাদ ভাববে নাতাে কি ভাববে

রাত দুটা দশ 

আমার মা, এই কিছুক্ষণ আগে টেলিফোন করলেনদুপুর রাতে তার টেলিফোন করার বদঅভ্যাস আছেআমার মাঅনিদ্রা রােগ আছেকাজেই তিনি মনে করেন পৃথিবীর সবাই অনিদ্রা রুগীযাই হােক আমি জেগে ছিলামমা বললেন, জুডি তুই আমার কাছে চলে আয়আমি বললাম, না রাশেদকে ফেলে আমি যাবনা। 

মা বললেন, আমিতাে শুনলাম ওকে নিয়েই তার সমস্যাওকে নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই মাI love him, I love him

I love him. চিৎকার করছিস কেন? চিৎকার করছি নামা টেলিফোন রাখিকথা বলতে ভাল লাগছে না। 

আমি টেলিফোন নামিয়ে রাখলামরাশেদকে ফেলে যাবার প্রশ্নই উঠে নাআমার ধারাশেদ নিজেও অসুস্থ হয়ে ড়েছেসেও এখন রাতে ঘুমায় নাগ্রুপ থিীর যে সমস্যাটি নিয়ে সে ভাবছিল, সেই সমস্যার সমাধান অন্য কে কি বেরকরে ফেলেছেজার্নালে ছাপা হয়েছে

ভয় (পর্ব-৫)-হুমায়ূন আহমেদ

সে গত পরশু জার্নাল পেয়ে কুচি কুচি করে ছিড়েছেশুধু তাই না বারান্দার এক কোণায় বসে ছেলেমানুষের মত কাঁদতে শুরু করেছেআমি সান্তনা দেবার জন্যে তার কাছে গিয়ে চমকে উঠলামসে কাঁদছে ঠিকই কিন্তু তার বা চোখ দিয়ে পানি পড়ছেডান চোখ শুকনাে। 

আমি তাকে কিছু বললাম নাকিন্তু সে আমার চাউনি থেকেই ব্যাপারটা বুঝে ফেললনীচু গলায় বলল, জুডি ইদানীং এই ব্যাপারটা হচ্ছেমাঝে মাঝেই দেখছি বা চোখ দিয়ে পানি পড়ে। 

কথাগুলি বলার সময় তাকে এত অসহায় লাগছিলআমার ইচ্ছা করছিল তাকে জড়িয়ে ধরে বলি I love you. I love you. I love you.। 

হে ঈশ্বরহে পরম করুণাময় ঈশ্বরএই ভয়াবহ সমস্যা থেকে তুমি আমাদের দুজনকে উদ্ধার কর। 

স্কেচবুকের প্রতিটি লেখা বার বার পড়ে মিসির আলি খুব বেশী তথ্য বের করতে পারলেন না তবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যা জানা গেল তা হচ্ছে মেয়েটি তার স্বামীকে ভালবাসেযে ভালবাসায় এক ধরণের সারল্য আছে। 

স্কেচ বুকে কিছু স্প্যানীশ ভাষায় লেখা কথা বার্তাও আছেস্প্যানিশ ভাষা না জানার কারণে তার অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হল নাতবে এই লেখাগুলি যে ভাবে সাজাননা তাতে মনে হচ্ছে কবিতা কিংবা গান হবে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মডার্ন ল্যাংগুয়েজ ইনষ্টিটিউটে স্কেচ বুক নিয়ে গেলেই ওরা পাঠোদ্ধারের ব্যবস্থা করে দেবে তবে মিসির আলির মনে হল তার প্রয়ােজন নেইযা জানার তিনি জেনেছেনএর বেশী কিছু জানার নেই। 

রাশেদুল করিম ঠিক ছটায় এসেছেন। মনে হচ্ছে বাইরে অপেক্ষা করছিলেনঠিক ছটা বাজার পর কলিং বেলে হাত রেখেছেনমিসির আলি দরজা খুলে বললেন, আসুন। 

রাশেদুল করিমের জন্যে সামান্য বিস্ময় অপেক্ষা করছিলতার জন্যে টেবিলে দুধ ছাড়া চামিসির আলি বললেন, আপনি কাটায় কাঁটায় টায় আসবেন বলে ধারণা করেই চা বানিয়ে রেখেছিলিকার কড়া হয়ে গেছে বলে আমার ধারণাখেয়ে দেখুনতাে। 

রাশেদুল করিম চায়ের কাপে চুমুদিয়ে বললেন, ধন্যবাদ। 

মিসির আলি নিজের কাপ হাতে নিতে নিতে বললেন, আপনাকে একটা কথা শুরুতেই বলে নেয়া দরকারআমি মাঝে মাঝে নিজের শখের কারণে সমস্যা নিয়ে চিন্তা করিতার জন্যে কখনাে অর্থ গ্রহণ করি নাআমি যা করি তা আমার পেশা না নেশা বলতে পারেন

আপনার ডলার আমি নিতে পারছি নাতাছাড়া অধিকাংশ সময়ই আমি সমস্যার কোন সমাধানে পৌছতে পারি নাআমার কাছে পাচশ পৃষ্ঠার একটা নােট বই আছেনােট বই ভর্তি এমন সব সমস্যাযার সমাধান আমি বের করতে পারি নি। 

আপনি কি আমার সমস্যাটার কিছু করেছেন?” 

‘সমস্যার পুরাে সমাধান বের করতে পারিনি আংশিক সমাধান আমার কাছে আছেআমি মােটামুটি ভাবে একটা হাইপােথিসিস দাঁড় করিয়েছি

(চলবে)

ভয় (পর্ব-৪)-হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *