মানুষ যতই আনন্দিত হতে থাকে তার চোখের আইরিশ ততই স্বচ্ছ হতে থাকে। আমার এই অবজারভেশন কতটুকু সত্য তা বুঝতে পারছি না।
মেয়েটি মাঝে মাঝে তার মনের অবস্থাও লিখেছে–অনেকটা ডায়েরী লেখার ভঙ্গিতে। মনে হয় হাতের কাছে ডায়েরী না থাকায় স্কেচ বুকে লিখে রেখেছে। সব লেখাই পেনসিলে। প্রচুর কাটা কুটি আছে। কিছু লাইন রাবার ঘষে তুলেও ফেলা হয়েছে।
আমি ভয়ে অস্থির হয়ে আছি। নিজেকে বুঝানাের চেষ্টা করছি – এই ভয় অমূলক। বুঝতে পারছি না। আমি আমার স্বামীকে ভয় পাচ্ছি এই তথ্য স্বভাবতই স্বামী বেচারার জন্য সুখকর না। সে নানান ভাবে আমাকে সান্তনা দেবার চেষ্টা করছে। কিছু কিছু চেষ্টা বেশ হাস্যকর। আজ আমাকে বলল, জুডি আমি ঠিক করেছি এখন থেকে রাতে ঘুমুব না। আমার অংকের সমস্যা নিয়ে ভাবব। লেখালেখি করব। তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাও।
আমি দিনের বেলায় ঘুমুব। একজন মানুষের জন্যে চার ঘন্টা ঘুমই যথেষ্ট। নেপােলীয়ান মাত্র তিন ঘন্টা ঘুমুতেন। | আমি এই গম্ভীর, স্বল্পভাষী লােকটিকে ভালবাসি। ভালবাসি, ভালবাসি, নি:“বাসি। আমি চাইনা, আমার কোন কারণে সে কষ্ট পাক। কিন্তু সে কষ্ট পাচ্ছে। খুব কষ্ট পাচ্ছে। হে ইশ্বর, তুমি আমার মন শান্ত কর। আমার ভয় দূর করে দাও।
যে জিনিশ খুব সুন্দর তা কত দ্রুত অসুন্দর হতে পারে – বিস্মিত হয়ে আমি তাই দেখছি। রাশেদের ধারণা আমি অসুস্থ। সত্যি কি অসুস্থ? আমার মনে হয় না। কারণ এখনাে ছবি আঁকতে পারছি। একজন অসুস্থ মানুষ তার যাই পারুক–ছবি
আঁকতে পারে না। গত দুদিন ধরে ওয়াটার কালারে বাসার সামনের চেরী গাছের ফুল ধরতে চেষ্টা করছিলাম। আজ সেই ফুল কাগজে বন্দি করেছি। অনেকক্ষণ ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভাল হয়েছে। রাশেদ ছবি তেমন বুঝে বলে মনে হয়
– সেও মুগ্ধ হয়ে অনেকক্ষণ দেখল। তারপর বলল, আমি যখন বুড়াে হয়ে যাস । বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেব তখন তুমি আমাকে ছবি আঁকা শিখিয়ে দেবে। এই কথাটি সে আজ প্রথম বলেনি। আগেও বলেছে। আন্তরিক ভঙ্গিতে বলেছে। কেউ যখন আন্তরিক ভাবে কিছু বলে তখন তা টের পাওয়া যায়। আমার মনে হয় না দে কোনদিন ছবি আঁকবে। তার মাথায় অংক ছাড়া কিছুই নেই।
আমি ছবি আঁকতে পারছি না। যেখানে নীল রঙ চড়ানাে দরকার সেখানে গাঢ় হলুদ রঙ বসাচ্ছি। ডাক্তার সিডেটিভের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সারাক্ষণ মাথা ঝিম ধরে থাকে। কেন জানি খুব বমি হচ্ছে।
আজ দুপুরে অনেকক্ষণ ঘুমুলাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে সুন্দর একটা স্বপ্নও দেখে ফেললাম। সুন্দর স্বপ্ন আমি অনেকদিন দেখি না। অনেকদিন দেখি না, অনেকদিন দেখিনা। অনেকদিন দেখিনা। অনেকদিন দেখিনা। আচ্ছা আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি। শুনেছি পাগলরাই একই কথা বার বার লেখে। কারণ তাদের মাথায় একটি বাক্যই বার বার ঘুরপাক খায়।
বৃহস্পতিবার কিংবা বুধবার —
আজ কত তারিখ আমি জানি না। বেশ কয়েকদিন ধরেই দিন তারিখে গণ্ডগােল হচ্ছে। আজ কত তারিখ তা জানার কোন রকম আগ্রহ বােধ করছি না। তবে মনের অবস্থা লেখার চেষ্ঠা করছি যাতে পরবর্তি সময়ে কেউ আমার লেখা পড়ে বুঝবে যে মাথা খারাপ হবার সময় একজন মানুষ কি ভাবে। কি চিন্তা করে। মাথা খারাপের প্রথম লক্ষণ হচ্ছে আলাে অসহ্য হওয়া। আমি এখন আলাে সহ্য করতে পারি না। দিনের বেলায় দরজা জানালা বন্ধ করে রাখি। ঘর অন্ধকার বলেই প্রায় অনুমানের উপর নির্ভর করে আজকের এই লেখা লিখছি।
দ্বিতীয় লক্ষণ হচ্ছে সারাক্ষণ শরীরে এক ধরণের জ্বালা অনুভব করা। মনে হয় সব কাপড় খুলে বাথটাবে শুয়ে থাকতে পারলে ভাল লাগত। আমার আগে যারা পাগল হয়েছে তাদেরও কি এমন হয়েছে? জানার জন্যে পাবলিক লাইব্রেরীতে টেলিফোন করেছিলাম। আমি খুব সহজ ভাবে বললাম, আচ্ছা আপনাদের এখানে পাগলের লেখা কোন বই আছে?
যে মেয়েটি টেলিফোন ধরেছিল সে বিস্মিত হয়ে বলল, পাগলের লেখা বই বলতে কি বুঝাচ্ছেন?
‘মানসিক রুগীদের লেখা বই। ‘মানসিক রুগীরা বই লিখবে কেন?” “কেন লিখবে না। আমি তাে লিখছি, বই অবশ্যি নয়–ডায়েরীর আকারে লেখা।
“ও আচ্ছা। ঠিক আছে আপনার বই ছাপা হােক। ছাপা হবার পর অবশ্যই আমরা আপনার বই এর কপি সংগ্রহ করব। | আমি মনে মনে হাসলাম। মেয়েটি আমাকে উন্মাদ ভাবছে। ভাবুক। উমাদকে উন্মাদ ভাববে নাতাে কি ভাববে?
রাত দুটা দশ
আমার মা, এই কিছুক্ষণ আগে টেলিফোন করলেন। দুপুর রাতে তার টেলিফোন করার বদঅভ্যাস আছে। আমার মা‘র অনিদ্রা রােগ আছে। কাজেই তিনি মনে করেন পৃথিবীর সবাই অনিদ্রা রুগী। যাই হােক আমি জেগে ছিলাম। মা বললেন, জুডি তুই আমার কাছে চলে আয়। আমি বললাম, না রাশেদকে ফেলে আমি যাবনা।
মা বললেন, আমিতাে শুনলাম ওকে নিয়েই তার সমস্যা। ‘ওকে নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই মা। I love him, I love him.
I love him. ‘চিৎকার করছিস কেন? ‘চিৎকার করছি না। মা টেলিফোন রাখি। কথা বলতে ভাল লাগছে না।
আমি টেলিফোন নামিয়ে রাখলাম। রাশেদকে ফেলে যাবার প্রশ্নই উঠে না। আমার ধার রাশেদ নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেও এখন রাতে ঘুমায় না। গ্রুপ থিীর যে সমস্যাটি নিয়ে সে ভাবছিল, সেই সমস্যার সমাধান অন্য কে –কি বের। করে ফেলেছে। জার্নালে ছাপা হয়েছে।
ভয় (পর্ব-৫)-হুমায়ূন আহমেদ
সে গত পরশু ঐ জার্নাল পেয়ে কুচি কুচি করে ছিড়েছে। শুধু তাই না বারান্দার এক কোণায় বসে ছেলেমানুষের মত কাঁদতে শুরু করেছে। আমি সান্তনা দেবার জন্যে তার কাছে গিয়ে চমকে উঠলাম। সে কাঁদছে ঠিকই কিন্তু তার বা চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ডান চোখ শুকনাে।
আমি তাকে কিছু বললাম না। কিন্তু সে আমার চাউনি থেকেই ব্যাপারটা বুঝে ফেলল। নীচু গলায় বলল, জুডি ইদানীং এই ব্যাপারটা হচ্ছে–মাঝে মাঝেই দেখছি বা চোখ দিয়ে পানি পড়ে।
কথাগুলি বলার সময় তাকে এত অসহায় লাগছিল। আমার ইচ্ছা করছিল তাকে জড়িয়ে ধরে বলি – I love you. I love you. I love you.।
হে ঈশ্বর। হে পরম করুণাময় ঈশ্বর। এই ভয়াবহ সমস্যা থেকে তুমি আমাদের দুজনকে উদ্ধার কর।
স্কেচবুকের প্রতিটি লেখা বার বার পড়ে মিসির আলি খুব বেশী তথ্য বের করতে পারলেন না তবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যা জানা গেল তা হচ্ছে – মেয়েটি তার স্বামীকে ভালবাসে। যে ভালবাসায় এক ধরণের সারল্য আছে।
স্কেচ বুকে কিছু স্প্যানীশ ভাষায় লেখা কথা বার্তাও আছে। স্প্যানিশ ভাষা না জানার কারণে তার অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হল না। তবে এই লেখাগুলি যে ভাবে সাজাননা তাতে মনে হচ্ছে – কবিতা কিংবা গান হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মডার্ন ল্যাংগুয়েজ ইনষ্টিটিউটে স্কেচ বুক নিয়ে গেলেই ওরা পাঠোদ্ধারের ব্যবস্থা করে দেবে – তবে মিসির আলির মনে হল তার প্রয়ােজন নেই। যা জানার তিনি জেনেছেন। এর বেশী কিছু জানার নেই।
রাশেদুল করিম ঠিক ছটায় এসেছেন। মনে হচ্ছে বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। ঠিক ছটা বাজার পর কলিং বেলে হাত রেখেছেন। মিসির আলি দরজা খুলে বললেন, আসুন।
রাশেদুল করিমের জন্যে সামান্য বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। তার জন্যে টেবিলে দুধ ছাড়া চা। মিসির আলি বললেন, আপনি কাটায় কাঁটায় ছ‘টায় আসবেন বলে ধারণা করেই চা বানিয়ে রেখেছি। লিকার কড়া হয়ে গেছে বলে আমার ধারণা। খেয়ে দেখুনতাে।
রাশেদুল করিম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ধন্যবাদ।
মিসির আলি নিজের কাপ হাতে নিতে নিতে বললেন, আপনাকে একটা কথা শুরুতেই বলে নেয়া দরকার। আমি মাঝে মাঝে নিজের শখের কারণে – সমস্যা নিয়ে চিন্তা করি। তার জন্যে কখনাে অর্থ গ্রহণ করি না। আমি যা করি তা আমার পেশা না – নেশা বলতে পারেন।
আপনার ডলার আমি নিতে পারছি না। তাছাড়া অধিকাংশ সময়ই আমি সমস্যার কোন সমাধানে পৌছতে পারি না। আমার কাছে পাচশ পৃষ্ঠার একটা নােট বই আছে। ঐ নােট বই ভর্তি এমন সব সমস্যা–যার সমাধান আমি বের করতে পারি নি।
‘আপনি কি আমার সমস্যাটার কিছু করেছেন?”
‘সমস্যার পুরাে সমাধান বের করতে পারিনি – আংশিক সমাধান আমার কাছে আছে। আমি মােটামুটি ভাবে একটা হাইপােথিসিস দাঁড় করিয়েছি।
(চলবে)