সেই সম্পর্কে আপনাকে আমি বলব, আপনি নিজে ঠিক করবেন – আমার হাইপােথিসিসে কি কি ত্রুটি আছে। তখন আমরা দুজন মিলে জুটি গুলি ঠিক করব।
‘শুনি আপনার হাইপােথিসিস। ‘আপনার স্ত্রী বলছেন, ঘুমুবার পর আপনি মৃত মানুষের মত হয়ে যান। আপনার হাত পা নড়ে না। পাথরের মূর্তীর মত বিছানায় পড়ে থাকেন। তাই না?”
‘– তাই। ‘স্লীপ এ্যানালিষ্টরা আপনাকে পরীক্ষা করে বলেছেন– আপনার ঘুম সাধারণ মানুষের ঘুমের মতই । ঘুমের মধ্যে আপনি স্বাভাবিক ভাবেই নড়া চড়া করেন।
‘জি– কয়েকবারই পরীক্ষা করা হয়েছে।
‘আমি আমার হাইপােথিসিসে দুজনের বক্তব্যই সত্য ধরে নিচ্ছি। সেটা কিভাবে সম্ভব? একটি মাত্র উপায়ে সম্ভৱ–আপিন যখন বিছানায় শুয়েছিলেন তখন ঘুমুচ্ছিলেন না। জেগে ছিলেন।
রাশেদুল করিম বিস্মিত হয়ে বললেন, কি বলছেন আপনি? মিসির আলি বললেন, আমি গতকালও লক্ষ্য করেছি – আজও লক্ষ্য করছি আপনার বসে থাকার মধ্যেও এক ধরণের কাঠিন্য আছে। আপনি আরাম করে বসে। নেই – শিরদাড়া সােজা করে বসে আছেন। আপনার দুটা হাত হাঁটুর উপর রাখা। দীর্ঘ সময় চলে গেছে আপনি একবারও হাত বা পা নাড়ান নি। অথচ স্বাভাবিকভাবেই আমরা হাত পা নাড়ি। কেউ কেউ পা নাচান।
রাশেদুল করিম চুপ করে রইলেন। মিসির আলি বলল, ঐ রাতে আপনি বিছানায় শুয়েছেন – মূতীর মত শুয়েছেন। চোখ বন্ধ করে ভাবছেন আপনার অংকের সমস্যা। নিয়ে। গভীরভাবে ভাবছেন। মানুষ যখন গভীরভাবে কিছু ভাবে তখন এক ধরণের ট্রেন্স ষ্টেটে ভাব জগতে চলে যায়। গভীরভাবে কিছু ভাবা হচ্ছে এক ধরণের মেডিটেশন। রাশেদুল করিম সাহেব।
‘অংক নিয়ে ঐ ধরণের গভীর চিন্তা কি আপনি প্রায়ই করেন না?” ‘দ্ধি করি।” ‘আপনি কি লক্ষ্য করেছেন এই সময় আশে পাশে কি ঘটছে তা আপনার খেয়াল থাকে না।
‘লক্ষ্য করেছি।
‘আপনি নিশ্চয়ই আরাে লক্ষ্য করেছেন যে এই অবস্থায় আপনি ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দিচ্ছেন। লক্ষ্য করেন নি?
করেছি। ‘তাহলে আমি আমার হাইপােথিসিসে ফিরে আসি। আপনি বিছানায় শুয়ে আছেন। আপনার মাথায় অংকের জটিল সমস্যা। আপনি ভাবছেন, আর ভাবছেন। আপনার হাত পা নড়ছে না। নিঃশ্বাস এত ধীরে পড়ছে যে মনে হচ্ছে আপনি মৃত।
রাশেদুল করিম সাহেব সানগ্লাস খুলে – এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মিসির আলি বললেন, ভাল কথা আপনি কি লেফট হ্যানডেড পারসন? ন্যাটা?
ভদ্রলােক বিস্মিত হয়ে বললেন, হ্যা কেন বলুনতাে? আমার হাইপােথিসিসের জন্যে আপনার লেফট হ্যানডেড পারসন হওয়া খুবই প্রয়ােজন।
কেন? ‘বলছি। তার আগে – শুরুতে যা বলছিলাম সেখানে ফিরে যাই। দৃশ্যটি আপনি দয়া করে কল্পনা করুন। আপনি এক ধরণের ট্রেন্স অবস্থায় আছেন। আপনার স্ত্রী জেগে আছেন – ভীত চোখে আপনাকে দেখছেন। আপনার এই অবস্থার সঙ্গে তার পরিচয় নেই। তিনি ভয়ে অস্থির হয়ে গেলেন। তাঁর ধারণা হল আপনি মারা গেছেন। তিনি আপনার গায়ে হাত দিয়ে আরাে ভয় পেয়ে গেলেন কারণ আপনার গা হিম শীতল।
‘গা হিমশীতল হবে কেন?” ‘মানুষ যখন গভীর ট্রেল ষ্টেটে চলে যায় তখন তার হার্ট বিট কমে যায়। নিঃশ্বাস প্রঃশ্বাস ধীর বয়। শরীরের টেম্পারেচার দুই থেকে তিন ডিগ্রী পর্যন্ত নেমে যায়। এই টুক নেমে যাওয়া মানে অনেকখানি নেমে যাওয়া। যাই হােক আপনার স্ত্রী আপনার গায়ে হাত দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি তাকালেন – তাকালেন কিন্তু এক চোখ মেলে। বা চোখে। ডান চোখটি তখনাে বন্ধ।
“কেন?” | ‘ব্যাখ্যা করছি। রাইট হ্যানডেড পারসন যারা আছে তাদের এক চোখ বন্ধ করে অন্য চোখে তাকাতে বললে তারা বা চোখ বন্ধ করে ডান চোখে তাকাবে। ডান চোখ বন্ধ করে বা চোখে তাকানাে তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এটা সম্ভব শুধু যারা ন্যাটা তাদের জন্যেই। আপনি লেফট হ্যানডেড পারসন – আপনি এক ধরণের গভীর ট্রেল ষ্টেটে আছেন। আপনার স্ত্রী আপনার গায়ে হাত রেখেছেন। আপনি কি হচ্ছে
জানতে চাচ্ছেন। চোখ মেলছেন। দুটি চোখ মেলতে চাচ্ছেন না। গভীর আলস্যে একটা চোখ কোন মতে মেললেন – অবশ্যই সেই চোখ হবে বা চোখ। আমার যুক্তি কি গ্রহণযােগ্য মনে হচ্ছে?
রাশেদুল করিম হানা কিছু বললেন না। ‘মিসির আলি বললেন, আপনার স্ত্রী আরাে ভয় পেলেন। সেই ভয় তার রক্তে মিশে গেল। কারণ শুধুমাত্র একবার এই ব্যাপার ঘটেনি অনেকবার ঘটেছে। আপনার কথা থেকেই আমি জেনেছি সেই সময় অংকের একটি জটিল সমাধান নিয়ে আপনি ব্যস্ত। আপনার সমগ্র চিন্তা চেতনায় আছে – অংকের সমাধান – নতুন কোন থিওরী। নয়–কি?”
‘এখন আমি আমার হাইপােথিসিসের সবচে জটিল অংশে আসছি। আমার হাইপােথিসিস বলে আপনার স্ত্রী আপনার চোখ গেলে দেন নি। তার পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। তিনি আপনার চোখের প্রেমে পড়েছিলেন। একজন শিল্পী মানুষ কখনাে সুন্দর কোন সৃষ্টি নষ্ট করতে পারেন না। তবুও যদি ধরে নেই তার মাথায় হঠাৎ রক্ত উঠে গিয়েছিল এবং তিনি এই ভয়াবহ কাণ্ড করেছেন – তাহলে তাকে এটা করতে হবে ঝোকের মাথায় – আচমকা।
আপনার চোখ গেলে দেয়া হয়েছে পেনসিলে – যে পেনসিলটি আপনার মাথার বালিশের নীচে রাখা। যিনি ঝোকের মাথায় একটা কাজ করবেন তিনি এত যন্ত্রণা করে বালিশের নীচ থেকে পেনসিল নেবেন না। হয়তবা তিনি জানতেনও না বালিশের নীচে পেনসিল ও নােট বই নিয়ে আপনি ঘুমান।
রাশেদুল করিম বললেন, কাজটি তাহলে কে করেছে ? ‘সেই প্রসঙ্গে আসছি – আপনি কি আরেক কাপ চা পাবেন। বানিয়ে দেব?
না। ‘এ্যাকসিডেন্ট কিভাবে ঘটল তা বলার আগে আপনার স্ত্রীর লেখা ডায়েরীর প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি – এক জায়গায় তিনি লিখেছেন – আপনার বা চোখ দিয়ে পানি পড়ত। কথাটা কি সত্যি?
‘সত্যি। ‘কেন পানি পড়তাে। একটি চোখ কেন কাদতাে? আপনার কি ধারণা?
রাশেদুল করিম বললেন, আমার কোন ধারণা নেই। আপনার ধারণাটা বলুন। আমি অবশ্যি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ডাক্তার বলেছেন এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। যে গ্লাও চোখের জল নিয়ন্ত্রণ করে সেই গ্র্যাণ্ড বা চোখে বেশী কর্মক্ষম ছিল।”
মিসির আলি বললেন, এটা একটা মজার ব্যাপার। হঠাৎ কেন বা চোখের গ্ল্যাণ্ড কর্মক্ষম হয়ে পড়ল। আপনি মনে মনে এই চোখকে আপনার সব রকম অশান্তির মূল বলে চিহ্নিত করার জন্যেই কি এটা হল ? আমি ডাক্তার নই। শরীর বিদ্যা জানি না। তবে আমি দুজন বড় ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছেন এটা হতে পারে। মােটেই অস্বাভাবিক নয়। গ্ল্যাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিস্ক। একটি চোখকে অপছন্দও করছে মস্তিস্ক।। ‘তাতে কি প্রমাণ হচ্ছে?
মিসির আলি কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, তাতে একটি জিনিশই প্রমাণিত হচ্ছে – আপনার বা চোখ আপনি নিজেই নষ্ট করেছেন।
অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে রাশেদুল করিম ভাঙ্গা গলায় বললেন, ‘কি বলছেন আপনি?
‘কনশাস অবস্থায় আপনি এই ভয়ংকর কাজ করেন নি। করেছেন সাব কনসাস অবস্থায়। কেন করেছেন তাও বলি – আপনি আপনার স্ত্রীকে অসম্ভব ভালবাসেন। সেই স্ত্রী আপনার কাছে থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন? কেন দূরে সরে যাচ্ছেন কারণ তিনি ভয় পাচ্ছেন আপনার বা চোখকে। আপনি আপনার স্ত্রীকে হারাচ্ছেন বা চোখের জন্যে।
আপনার ভেতর রাগ, অভিমান জমতে শুরু করেছে। সেই রাগ আপনার নিজের একটি প্রত্যঙ্গের উপর। চোখের উপর। এই রাগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রচণ্ড হতাশা। আপনি যে বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন সেই গবেষণা অন্য একজন করে ফেলেছেন। জার্নালে তা প্রকাশিত হয়ে গেছে। আপনার চোখ সমস্যা তৈরী না করলে এমনটা ঘটতাে না। নিজেই গবেষণাটা শেষ করতে পারতেন। সব কিছুর জন্যে দায়ী হল চোখ।
মিসির আলি আরেকটি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আমার এই হাইপােথিসিসের পেছনে আরেকটি শক্ত যুক্তি আছে। যুক্তিটি বলেই আমি কথা শেষ করব।
বলুন। ‘আপনার স্ত্রী পুরােপুরি মস্তিষ্ক বিকৃত হবার পরে যে কথাটা বলতেন – তা হল – এই লােকটা পিশাচ।
আমার কাছে প্রমাণ আছে। কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে
কিন্তু প্রমাণ আছে।
‘তিনি এই কথা বলতেন কারণ পেনসিল দিয়ে নিজের চোখ নিজের গেলে দেয়ার দৃশ্য তিনি দেখেছেন। আমার হাইপােথিসিস আমি আপনাকে বললাম। এর বেশী আমার কিছু বলার নেই।
রাশেদুল করিম দীর্ঘ সময় চুপ করে রইলেন।
(চলবে)