ভয় (পর্ব-৬)-হুমায়ূন আহমেদ

সেই সম্পর্কে আপনাকে আমি বলব, আপনি নিজে ঠিক করবেন আমার হাইপােথিসিসে কি কি ত্রুটি আছেতখন আমরা দুজন মিলে জুটি গুলি ঠিক করব। 

ভয়শুনি আপনার হাইপােথিসিসআপনার স্ত্রী বলছেন, ঘুমুবার পর আপনি মৃত মানুষের মত হয়ে যানআপনার হাত পা নড়ে নাপাথরের মূর্তীমত বিছানায় পড়ে থাকেনতাই না?” 

তাই স্লীপ এ্যানালিষ্টরা আপনাকে পরীক্ষা করে বলেছেনআপনার ঘুম সাধারণ মানুষের ঘুমের মতই ঘুমের মধ্যে আপনি স্বাভাবিক ভাবেই নড়া চড়া করেন। 

জিকয়েকবারই পরীক্ষা করা হয়েছে। 

আমি আমার হাইপােথিসিসে দুজনের বক্তব্যই সত্য ধরে নিচ্ছিসেটা কিভাবে সম্ভব? একটি মাত্র উপায়ে সম্ভৱআপিন যখন বিছানায় শুয়েছিলেন তখন ঘুমুচ্ছিলেন নাজেগে ছিলেন। 

রাশেদুল করিম বিস্মিত হয়ে বললেন, কি বলছেন আপনি? মিসির আলি বললেন, আমি গতকালও লক্ষ্য করেছি আজও লক্ষ্য করছি আপনার বসে থাকার মধ্যেও এক ধরণের কাঠিন্য আছেআপনি আরাম করে বসেনেই শিরদাড়া সােজা করে বসে আছেনআপনার দুটা হাত হাঁটুর উপর রাখাদীর্ঘ সময় চলে গেছে আপনি একবারও হাত বা পা নাড়ান নিঅথচ স্বাভাবিকভাবেই আমরা হাত পা নাড়িকেউ কেউ পা নাচান

রাশেদুল করিম চুপ করে রইলেনমিসির আলি বলল, রাতে আপনি বিছানায় শুয়েছেন মূতীর মত শুয়েছেনচোখ বন্ধ করে ভাবছেন আপনার অংকের সমস্যানিয়েগভীরভাবে ভাবছেনমানুষ যখন গভীরভাবে কিছু ভাবে তখন এক ধরণের ট্রেন্স ষ্টেটে ভাব জগতে চলে যায়গভীরভাবে কিছু ভাবা হচ্ছে এক ধরণের মেডিটেশনরাশেদুল করিম সাহেব। 

অংক নিয়ে ধরণের গভীর চিন্তা কি আপনি প্রায়ই করেন না?দ্ধি করিআপনি কি লক্ষ্য করেছেন এই সময় আশে পাশে কি ঘটছে তা আপনার খেয়াল থাকে না। 

লক্ষ্য করেছি। 

আপনি নিশ্চয়ই আরাে লক্ষ্য করেছেন যে এই অবস্থায় আপনি ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দিচ্ছেনলক্ষ্য করেন নি

করেছিতাহলে আমি আমার হাইপােথিসিসে ফিরে আসিআপনি বিছানায় শুয়ে আছেনআপনার মাথায় অংকের জটিল সমস্যাআপনি ভাবছেন, আর ভাবছেনআপনার হাত পা নড়ছে নানিঃশ্বাস এত ধীরে পড়ছে যে মনে হচ্ছে আপনি মৃত। 

রাশেদুল করিম সাহেব সানগ্লাস খুলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেনমিসির আলি বললেন, ভাল কথা আপনি কি লেফট হ্যানডেড পারসন? ন্যাটা

ভদ্রলােক বিস্মিত হয়ে বললেন, হ্যা কেন বলুনতাে? আমার হাইপােথিসিসের জন্যে আপনার লেফট হ্যানডেড পারসন হওয়া খুবই প্রয়ােজন। 

কেন? বলছিতার আগে শুরুতে যা বলছিলাম সেখানে ফিরে যাইদৃশ্যটি আপনি দয়া করে কল্পনা করুনআপনি এক ধরণের ট্রেন্স অবস্থায় আছেনআপনার স্ত্রী জেগে আছেন ভীত চোখে আপনাকে দেখছেনআপনার এই অবস্থার সঙ্গে তার পরিচয় নেইতিনি ভয়ে অস্থির হয়ে গেলেনতাঁর ধারণা হল আপনি মারা গেছেনতিনি আপনার গায়ে হাত দিয়ে আরাে ভয় পেয়ে গেলেন কারণ আপনার গা হিম শীতল। 

গা হিমশীতল হবে কেন?মানুষ যখন গভীর ট্রেল ষ্টেটে চলে যায় তখন তার হার্ট বিট কমে যায়নিঃশ্বাস প্রঃশ্বাস ধীর বয়শরীরের টেম্পারেচার দুই থেকে তিন ডিগ্রী পর্যন্ত নেমে যায়এই টুক নেমে যাওয়া মানে অনেকখানি নেমে যাওয়াযাই হােক আপনার স্ত্রী আপনার গায়ে হাত দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি তাকালেন তাকালেন কিন্তু এক চোখ মেলেবা চোখেডান চোখটি তখনাে বন্ধ। 

কেন?| ব্যাখ্যা করছিরাইট হ্যানডেড পারসন যারা আছে তাদের এক চোখ বন্ধ করে অন্য চোখে তাকাতে বললে তারা বা চোখ বন্ধ করে ডান চোখে তাকাবেডান চোখ বন্ধ করে বা চোখে তাকানাে তাদের পক্ষে সম্ভব নয়এটা সম্ভব শুধু যারা ন্যাটা তাদের জন্যেইআপনি লেফট হ্যানডেড পারসন আপনি এক ধরণের গভীর ট্রেল ষ্টেটে আছেনআপনার স্ত্রী আপনার গায়ে হাত রেখেছেনআপনি কি হচ্ছে 

জানতে চাচ্ছেনচোখ মেলছেনদুটি চোখ মেলতে চাচ্ছেন নাগভীর আলস্যে একটা চোখ কোন মতে মেললেন অবশ্যই সেই চোখ হবে বা চোখআমার যুক্তি কি গ্রহণযােগ্য মনে হচ্ছে

রাশেদুল করিম হানা কিছু বললেন নামিসির আলি বললেন, আপনার স্ত্রী আরাে ভয় পেলেনসেই ভয় তার রক্তে মিশে গেলকারণ শুধুমাত্র একবার এই ব্যাপার ঘটেনি অনেকবার ঘটেছেআপনার কথা থেকেই আমি জেনেছি সেই সময় অংকের একটি জটিল সমাধান নিয়ে আপনি ব্যস্তআপনার সমগ্র চিন্তা চেতনায় আছে অংকের সমাধান নতুন কোন থিওরীনয়কি?” 

এখন আমি আমার হাইপােথিসিসের সবচে জটিল অংশে আসছিআমার হাইপােথিসিস বলে আপনার স্ত্রী আপনার চোখ গেলে দেন নিতার পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়তিনি আপনার চোখের প্রেমে পড়েছিলেনএকজন শিল্পী মানুষ কখনাে সুন্দর কোন সৃষ্টি নষ্ট করতে পারেন নাতবুও যদি ধরে নেই তার মাথায় হঠাৎ রক্ত উঠে গিয়েছিল এবং তিনি এই ভয়াবহ কাণ্ড করেছেন তাহলে তাকে এটা করতে হবে ঝোকের মাথায় আচমকা

আপনার চোখ গেলে দেয়া হয়েছে পেনসিলে যে পেনসিলটি আপনার মাথার বালিশের নীচে রাখাযিনি ঝোকের মাথায় একটা কাজ করবেন তিনি এত যন্ত্রণা করে বালিশের নীচ থেকে পেনসিল নেবেন নাহয়তবা তিনি জানতেনও না বালিশের নীচে পেনসিল নােট বই নিয়ে আপনি ঘুমান। 

রাশেদুল করিম বললেন, কাজটি তাহলে কে করেছে ? সেই প্রসঙ্গে আসছি আপনি কি আরেক কাপ চা পাবেনবানিয়ে দেব

না‘এ্যাকসিডেন্ট কিভাবে ঘটল তা বলার আগে আপনার স্ত্রীর লেখা ডায়েরীর প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এক জায়গায় তিনি লিখেছেন আপনার বা চোখ দিয়ে পানি পড়তকথাটা কি সত্যি

সত্যিকেন পানি পড়তােএকটি চোখ কেন কাদতাে? আপনার কি ধারণা

রাশেদুল করিম বললেন, আমার কোন ধারণা নেইআপনার ধারণাটা বলুনআমি অবশ্যি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছিলামডাক্তার বলেছেন এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নাযে গ্লাও চোখের জল নিয়ন্ত্রণ করে সেই গ্র্যাণ্ড বা চোখে বেশী কর্মক্ষম ছিল” 

মিসির আলি বললেন, এটা একটা মজার ব্যাপারহঠাৎ কেন বা চোখের গ্ল্যাণ্ড কর্মক্ষম হয়ে পড়লআপনি মনে মনে এই চোখকে আপনার সব রকম অশান্তির মূল বলে চিহ্নিত করার জন্যেই কি এটা হল ? আমি ডাক্তার নই। শরীর বিদ্যা জানি নাতবে আমি দুজন বড় ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছিতারা বলেছেন এটা হতে পারেমােটেই অস্বাভাবিক নয়গ্ল্যাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিস্কএকটি চোখকে অপছন্দও করছে মস্তিস্কতাতে কি প্রমাণ হচ্ছে

মিসির আলি কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, তাতে একটি জিনিশই প্রমাণিত হচ্ছে আপনার বা চোখ আপনি নিজেই নষ্ট করেছেন। 

অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে রাশেদুল করিম ভাঙ্গা গলায় বললেন, কি বলছেন আপনি

কনশাস অবস্থায় আপনি এই ভয়ংকর কাজ করেন নিকরেছেন সাব কনসাস অবস্থায়কেন করেছেন তাও বলি আপনি আপনার স্ত্রীকে অসম্ভব ভালবাসেনসেই স্ত্রী আপনার কাছে থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন? কেন দূরে সরে যাচ্ছেন কারণ তিনি ভয় পাচ্ছেন আপনার বা চোখকেআপনি আপনার স্ত্রীকে হারাচ্ছেন বা চোখের জন্যে

আপনার ভেতর রাগ, অভিমান জমতে শুরু করেছেসেই রাগ আপনার নিজের একটি প্রত্যঙ্গের উপরচোখের উপরএই রাগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রচণ্ড হতাশাআপনি যে বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন সেই গবেষণা অন্য একজন করে ফেলেছেনজার্নালে তা প্রকাশিত হয়ে গেছেআপনার চোখ সমস্যা তৈরী না করলে এমনটা ঘটতাে নানিজেই গবেষণাটা শেষ করতে পারতেনসব কিছুর জন্যে দায়ী হল চোখ। 

মিসির আলি আরেকটি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আমার এই হাইপােথিসিসের পেছনে আরেকটি শক্ত যুক্তি আছেযুক্তিটি বলেই আমি কথা শেষ করব। 

বলুন আপনার স্ত্রী পুরােপুরি মস্তিষ্ক বিকৃত হবার পরে যে কথাটা বলতেন তা হল এই লােকটা পিশাচ

 আমার কাছে প্রমাণ আছেকেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে 

কিন্তু প্রমাণ আছে। 

তিনি এই কথা বলতেন কারণ পেনসিল দিয়ে নিজের চোখ নিজের গেলে দেয়ার দৃশ্য তিনি দেখেছেনআমার হাইপােথিসিস আমি আপনাকে বললামএর বেশী আমার কিছু বলার নেই। 

রাশেদুল করিম দীর্ঘ সময় চুপ করে রইলেন। 

(চলবে)

ভয় (পর্ব-৫)-হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *