ভয় (পর্ব-৭)-হুমায়ূন আহমেদ

মিসির আলি আরেকবার বললেন, ভাই চা করব? চা খাবেন? তিনি এই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন নাউঠে দাড়ালেনচোখে সানগ্লাস পরলেন

ভয়শুকনাে গলায় বললেন, যাই? মিসির আলি বললেন, মনে হচ্ছে আমি আপনাকে আহত করেছি কষ্ট দিয়েছিআপনি কিছু মনে করবেন নানিজের উপরেও রাগ করবেন নাআপনি যা করেছেন প্রচণ্ড ভালবাসা থেকেই করেছেন। 

রাশেদুল করিম হাত বাড়িয়ে মিসির আলির হাত ধরে ফেলে বললেন, আমার স্ত্রী বেঁচে থাকলে তার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিতাম আপনি দেখতেন সে কি চমৎকার একটি মেয়ে ছিলএবং সেও দেখতাে আপনি কত অসাধারণ একজন মানুষদুর্ঘটনার পর জুডির প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে আমি বেঁচেছিলাম। 

আপনি এই অন্যায় ঘৃণা থেকে তাকে মুক্তি দিয়েছেনজুডির হয়ে আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। 

ভদ্রলােকের গলা ধরে এলতিনি চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলে বললেন, মিসির আলি সাহেব ভাই দেখুন আমার দুটি চোখ থেকেই এখন পানি পড়ছেচোখ পাথরের হলেও চোখের অশ্রু গ্রন্থি এখনাে কার্যক্ষমকুড়ি বছর পর এই ঘটনা ঘটলআচ্ছা ভাই যাই। 

ভয় (পর্ব-৭)-হুমায়ূন আহমেদ

দু মাস পর আমেরিকা থেকে বিমান ডাকে মিসির আলি বড় একটা প্যাকেট পেলেনসেই প্যাকেটে জল রঙে আঁকা একটা চেরী গাছের ছবিঅপূর্ব ছবি। 

ছবির সঙ্গে একটি নােটরাশেদুল করিম সাহে লিখেছেন আমার সবচে প্রিয় জিনিশটি আপনাকে দিতে চাচ্ছিলামএই ছবিটির চেয়ে প্রিয় কিছু এই মুহূর্তে আমার কাছে নেইকোনদিন হবে বলেও মনে হয় না। 

জ্বীনকফিল 

জায়গাটার নাম, ধুন্দুল নাড়ানাম যেমন অদ্ভুত জায়গাও তেমন জলেএকবার গিয়ে পৌছলে মনে হবে সভ্য সমাজের বাইরে চলে এসেছিসেখানে যাবার ব্যবস্থাটা বলিপ্রথমে যেতে হবে ঠাকরােকোনাময়মনসিংহ মােহনগঞ্জ ব্রাঞ্চ লাইনের ছােট্ট ষ্টেশনঠাকরােকোনা থেকে গয়নার নৌকা যায় হাতীর বাজার পর্যন্তযেতে হবে হাতীর বাজারেভাগ্য ভালাে হলে হাতীর বাজারে কেরায়া নৌকা পাওয়া যাবেযদি পাওয়া যায় সেই নৌকায় শিয়ালজানি খাল ধুলে মাইল দশেক উত্তরে যেতে হবে

বাকি পথ পায়ে হেঁটেপেরুতে হবে মাঠ, ডোবা, জলাভূমিজুতা খুলে হাতে নিয়ে নিতে হবেপা কাটবে ভাঙা শামুকেগােটা বিশেক সেঁক ধরবেবিশ্রী অবস্থা। কতােটা হাঁটতে হবে তারাে অনুমান নেইএকেকজন একেক কথা বলবেএকটা সময় আসবে যখন লােকজন হাসিমুখে বলবেধুন্দুল নাড়া? তাে দেখা যায়তখন বুঝতে হবে আরাে মাইল সাতেক বাকি। 

ভয় (পর্ব-৭)-হুমায়ূন আহমেদ

বছর পাঁচেক আগে এই জঙ্গুলে জায়গায় . কে জনৈক সাধুর সন্ধানে যেতে হয়েছিলােসাধুর নাম কালু খামুসলমান নাম হলেও সাধু হিন্দু ব্রাহ্মণবাবামা তাকে শৈশবেই পরিত্যাগ করেনতিনি মানুষ হন মুসলিম পরিবারেকালু খা নাম তার মুসলমান পালক বাবার দেয়াযৌবনে তিনি সংসার ত্যাগী হয়ে শুশানে আশ্রয় নেনতার অসাধারণ ক্ষমতা, বিভূতীর কোনাে সীমা সংখ্যা নেইতিনি কোনাে রকম খাদ্য গ্রহণ করেন নাতার গা থেকে সবসময় কঁঠালাপ ফুলের তীব্র গন্ধ বের হয়পূর্ণিমার সময় সেই গন্ধ এতাে তীব্র হয় যে কাছে গেলে বমি এসে যায়নাকে রুমাল চেপে কাছে যেতে হয়। 

সাধু স্ন্যাসী, তাদের অলৌকিক ক্ষমতা এইসব নিয়ে আমি কখনাে মাথা ঘামাই ! আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি ব্যাখ্যার অতীত কোন ক্ষমতা প্রকৃতি মানুষকে দেয়নিকোনাে সাধু যদি আমার চোখের সামনে শূন্যে ভাসতে থাকেন আমি চমৎকৃত হবাে নাধরে নেবাে এর পেছনে আছে ম্যাজিকের সহজ কিছু কলাকৌশল যা এই 

সাধু আয়ত্ত করেছেন। কাজেই আমার পক্ষে সাধুর খোঁজে ধূলুলনাড়া নামের অজ অজ অজ পাড়াগায় যাবার প্রশ্নই আসে নাযেতে হয়েছিলাে সফিকের কারণে। 

সফিক আমার বাল্যবন্ধুসে বিশ্বাস করে না এমন জিনিশ নেইভূতপ্রেত থেকে সাধু সন্ন্যাসী সব কিছুতেই তার অসীম বিশ্বাসবিংশ শতাব্দীর মানুষ হয়েও সে বিশ্বাস করে যে সাপের মাথায় মণি আছেকৃষ্ণপক্ষের রাতে এই মণি সে উপড়ে ফেলেচারদিক আলাে হয়ে যায়আলােয় আকৃষ্ট হয়ে পােকামাকড় আসেসাপ তাদের ধরে ধরে খায়ভােজনপর্ব শেষ হলে মণিটি আবার গিলে ফেলে। 

ভয় (পর্ব-৭)-হুমায়ূন আহমেদ

সাধু কালু খার খবর সফিকই নিয়ে এলাে এবং এমন ভাব করতে লাগলাে যে অবতারের সন্ধান পেয়ে গেছেযে অবতারের সঙ্গে দেখা না হলে জীবন বৃথা| আমি সফিকের সঙ্গে রওনা হলাম দুটি কারণে, একসফিককে আমি অত্যন্ত পছন্দ করিতাকে একা একা ছেড়ে দেয়ার প্রশ্ন উঠে নাদুইসাধু ঘেঁজা উপলক্ষে গ্রামের দিকে খানিকটা হলেও ঘােরা হবেমাঝে মাঝে এরকম ঘুরে বেড়াতে মদ লাগে নানিজেকে পরিব্রাজকপরিব্রাজক মনে হয়যেন আমি ফাহিয়েনবাংলার পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি| খুব আগ্রহ নিয়ে রওনা হলেও আগ্রহ হাতীর বাজারে পৌছবার আগেই শেষ হয়ে গেলাে

অমানুষিক পরিশ্রম হলােহাতীর বাজার থেকে যে কেরায়া নৌকা নিলাম সে নৌকাও এখন ডুবে তখন ডুবে অবস্থানৌকার পাটাতনের ফুটা দিয়ে বিজ বিজ করে পানি উঠছেসারাক্ষণ সেই পানি সেঁচতে হচ্ছেশেষ পর্যন্ত সফিকের মতাে পাগলেরও ধৈর্যচ্যুতি হলােকয়েকবার বললাে, বিরাট বােকামি হয়েছেগ্রেট মিসটেকএরচেকঙ্গো নদীর উৎস বের করা সহজ ছিলােআমি বললাম, এখনাে সময় আছে

ফিরে যাবি কিনা বলআরে নাএতােদুর এসে ফিরে যাবাে মানেভালাে জিনিশের জন্যে কষ্ট করতেই হবেজাষ্ট চিন্তা করে দেখ একজন মানুষের গা থেকে ভুর ভুর করে কাঁঠালচাপা ফুলের গন্ধ বেরুচ্ছেভাবতেই গায়ের লােম খাড়া হয়ে যাচ্ছেহাউ ক্সাইটিং। 

ভয় (পর্ব-৭)-হুমায়ূন আহমেদ

সন্ধ্যার পর পর ধুন্দুল নাড়া গ্রামে উপস্থিত হলামকাদায় পানিতে মাখামাখিতিনবার বৃষ্টিতে ভিজেছিক্ষুধা এবং তৃষ্ণায় জীবন বের হবার উপক্রমবিদেশী মানুষ দেখলেই গ্রামের লােকজন সাধারণত খুব আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসেএইখানে উল্টো নিয়ম দেখলামআমাদের ব্যাপারে কারাে কোনাে আগ্রহ নেইকোখেকে এসেছিযাবাে কোথায়? এইটুকু দায়িত্ব পালন করার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করেই সবাই চলে যাচ্ছেএকি যন্ত্রণা। 

সাধু কালু খাকে দেখেও খুব হতাশ হতে হলােবদ্ধ উন্মাদ একজন মানুষশ্মশানে একটা পাকুড় গাছের নিচে ন্যাংটো অবস্থায় বসাআমাদের দেখেই গালাগালি শুরু করলােগালাগালি যে এতাে নােংরা হতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে ছিলােআমাকে এবং সফিককে কালু খা সবচেদ্ৰ কথা যা বললাে তা হচ্ছে বাড়িত যাবাড়িত গিয়া খাবলাইয়া খাবলাইয়া গুখা। 

আমি হতভম্বব্যাটা বলে কি। 

সফিকের দিকে তাকালামসে ভাব গদগদ স্বরে বললাে, লােকটার ভেতর জিনিশ আছে বলে মনে হচ্ছে। 

আমি বললাম, কি করে বুঝলি ? আমাদের গুখেতে বলেছে এইজন্যে? আরে নাসে আমাদের এড়াতে চাচ্ছেমানুষের সংসর্গ পছন্দ নয়মানুষের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার এটা একটা সহজ টেকনিক। 

লােকটা যে বদ্ধ উন্মাদ তা তাের মনে হচ্ছে না? তাও মনে হচ্ছে তবে একটা প্রবাবিলিটি আছে যে সে উন্মাদ না” 

গ্রামের কয়েকজন বয়স্ক মানুষ আমাদের সঙ্গে আছেনসাধুর প্রতি তাদের ভক্তি শ্রদ্ধাও সফিকের মতইতাদের একজন বললেন, বাবার মাথা এখন একটু গরম। 

ভয় (পর্ব-৭)-হুমায়ূন আহমেদ

আমি বিরক্ত গলায় বললাম, মাথা ঠাণ্ডা হবে কখন? ঠিক নাইচাদের সঙ্গে যােগাযােগচাদের সঙ্গে যােগাযােগ মানে?অমাবস্যা পূর্ণিমায় মাথা গরম থাকে। 

এই ব্যাপারেও মতভেদ দেখা গেলােএকজন বললাে, অমাবস্যা পূর্ণিমাতেই মাথাটা ঠাণ্ডা থাকেঅন্য সময় গরমবাবার কাছে মাসের পর মাস পড়ে থাকতে হয়অপেক্ষা করতে হয় কখন বাবার মাথা ঠাণ্ডা হবে। 

(চলবে)

ভয় (পর্ব-৬)-হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *