মিসির আলি আরেকবার বললেন, ভাই চা করব? চা খাবেন? তিনি এই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না। উঠে দাড়ালেন। চোখে সানগ্লাস পরলেন।
শুকনাে গলায় বললেন, যাই? মিসির আলি বললেন, মনে হচ্ছে আমি আপনাকে আহত করেছি – কষ্ট দিয়েছি। আপনি কিছু মনে করবেন না। নিজের উপরেও রাগ করবেন না। আপনি যা করেছেন প্রচণ্ড ভালবাসা থেকেই করেছেন।
রাশেদুল করিম হাত বাড়িয়ে মিসির আলির হাত ধরে ফেলে বললেন, আমার স্ত্রী বেঁচে থাকলে তার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিতাম – আপনি দেখতেন সে কি চমৎকার একটি মেয়ে ছিল। এবং সেও দেখতাে – আপনি কত অসাধারণ একজন মানুষ। ঐ দুর্ঘটনার পর জুডির প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে আমি বেঁচেছিলাম।
আপনি এই অন্যায় ঘৃণা থেকে তাকে মুক্তি দিয়েছেন। জুডির হয়ে আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ভদ্রলােকের গলা ধরে এল। তিনি চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলে বললেন, মিসির আলি সাহেব ভাই দেখুন – আমার দুটি চোখ থেকেই এখন পানি পড়ছে। চোখ পাথরের হলেও চোখের অশ্রু গ্রন্থি এখনাে কার্যক্ষম। কুড়ি বছর পর এই ঘটনা ঘটল। আচ্ছা ভাই যাই।
ভয় (পর্ব-৭)-হুমায়ূন আহমেদ
দু মাস পর আমেরিকা থেকে বিমান ডাকে মিসির আলি বড় একটা প্যাকেট পেলেন। সেই প্যাকেটে জল রঙে আঁকা একটা চেরী গাছের ছবি। অপূর্ব ছবি।
ছবির সঙ্গে একটি নােট। রাশেদুল করিম সাহে লিখেছেন – আমার সবচে প্রিয় জিনিশটি আপনাকে দিতে চাচ্ছিলাম। এই ছবিটির চেয়ে প্রিয় কিছু এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই। কোনদিন হবে বলেও মনে হয় না।
জ্বীন–কফিল
জায়গাটার নাম, ধুন্দুল নাড়া। নাম যেমন অদ্ভুত জায়গাও তেমন জলে। একবার গিয়ে পৌছলে মনে হবে সভ্য সমাজের বাইরে চলে এসেছি। সেখানে যাবার ব্যবস্থাটা বলি–প্রথমে যেতে হবে ঠাকরােকোনা। ময়মনসিংহ মােহনগঞ্জ ব্রাঞ্চ লাইনের ছােট্ট ষ্টেশন। ঠাকরােকোনা থেকে গয়নার নৌকা যায় হাতীর বাজার পর্যন্ত। যেতে হবে হাতীর বাজারে। ভাগ্য ভালাে হলে হাতীর বাজারে কেরায়া নৌকা পাওয়া যাবে। যদি পাওয়া যায় সেই নৌকায় শিয়ালজানি খাল ধুলে মাইল দশেক উত্তরে যেতে হবে।
বাকি পথ পায়ে হেঁটে। পেরুতে হবে মাঠ, ডোবা, জলাভূমি। জুতা খুলে হাতে নিয়ে নিতে হবে। পা কাটবে ভাঙা শামুকে। গােটা বিশেক সেঁক ধরবে। বিশ্রী অবস্থা। কতােটা হাঁটতে হবে তারাে অনুমান নেই। একেকজন একেক কথা বলবে। একটা সময় আসবে যখন লােকজন হাসিমুখে বলবে–ধুন্দুল নাড়া? ঐ তাে দেখা যায়। তখন বুঝতে হবে আরাে মাইল সাতেক বাকি।
ভয় (পর্ব-৭)-হুমায়ূন আহমেদ
বছর পাঁচেক আগে এই জঙ্গুলে জায়গায় আ. কে জনৈক সাধুর সন্ধানে যেতে হয়েছিলাে। সাধুর নাম কালু খা। মুসলমান নাম হলেও সাধু হিন্দু ব্রাহ্মণ। বাবা–মা তাকে শৈশবেই পরিত্যাগ করেন। তিনি মানুষ হন মুসলিম পরিবারে। কালু খা নাম তার মুসলমান পালক বাবার দেয়া। যৌবনে তিনি সংসার ত্যাগী হয়ে শুশানে আশ্রয় নেন। তার অসাধারণ ক্ষমতা, বিভূতীর কোনাে সীমা সংখ্যা নেই। তিনি কোনাে রকম খাদ্য গ্রহণ করেন না। তার গা থেকে সবসময় কঁঠালাপ ফুলের তীব্র গন্ধ বের হয়। পূর্ণিমার সময় সেই গন্ধ এতাে তীব্র হয় যে কাছে গেলে বমি এসে যায়। নাকে রুমাল চেপে কাছে যেতে হয়।
সাধু স্ন্যাসী, তাদের অলৌকিক ক্ষমতা এইসব নিয়ে আমি কখনাে মাথা ঘামাই ! আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি ব্যাখ্যার অতীত কোন ক্ষমতা প্রকৃতি মানুষকে দেয়নি। কোনাে সাধু যদি আমার চোখের সামনে শূন্যে ভাসতে থাকেন আমি চমৎকৃত হবাে না। ধরে নেবাে এর পেছনে আছে ম্যাজিকের সহজ কিছু কলাকৌশল যা এই
সাধু আয়ত্ত করেছেন। কাজেই আমার পক্ষে সাধুর খোঁজে ‘ধূলুলনাড়া নামের অজ অজ অজ পাড়াগায় যাবার প্রশ্নই আসে না। যেতে হয়েছিলাে সফিকের কারণে।
সফিক আমার বাল্যবন্ধু। সে বিশ্বাস করে না এমন জিনিশ নেই। ভূত–প্রেত থেকে সাধু সন্ন্যাসী সব কিছুতেই তার অসীম বিশ্বাস। বিংশ শতাব্দীর মানুষ হয়েও সে বিশ্বাস করে যে সাপের মাথায় মণি আছে। কৃষ্ণপক্ষের রাতে এই মণি সে উপড়ে ফেলে। চারদিক আলাে হয়ে যায়। আলােয় আকৃষ্ট হয়ে পােকা–মাকড় আসে। সাপ তাদের ধরে ধরে খায়। ভােজনপর্ব শেষ হলে মণিটি আবার গিলে ফেলে।
ভয় (পর্ব-৭)-হুমায়ূন আহমেদ
সাধু কালু খার খবর সফিকই নিয়ে এলাে এবং এমন ভাব করতে লাগলাে যে অবতারের সন্ধান পেয়ে গেছে। যে অবতারের সঙ্গে দেখা না হলে জীবন বৃথা। | আমি সফিকের সঙ্গে রওনা হলাম দুটি কারণে, এক–সফিককে আমি অত্যন্ত পছন্দ করি। তাকে একা একা ছেড়ে দেয়ার প্রশ্ন উঠে না। দুই–সাধু ঘেঁজা উপলক্ষে গ্রামের দিকে খানিকটা হলেও ঘােরা হবে। মাঝে মাঝে এরকম ঘুরে বেড়াতে মদ লাগে না। নিজেকে পরিব্রাজক–পরিব্রাজক মনে হয়। যেন আমি ফাহিয়েন। বাংলার পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি। | খুব আগ্রহ নিয়ে রওনা হলেও আগ্রহ হাতীর বাজারে পৌছবার আগেই শেষ হয়ে গেলাে।
অমানুষিক পরিশ্রম হলাে। হাতীর বাজার থেকে যে কেরায়া নৌকা নিলাম সে নৌকাও এখন ডুবে তখন ডুবে অবস্থা। নৌকার পাটাতনের ফুটা দিয়ে বিজ বিজ করে পানি উঠছে। সারাক্ষণ সেই পানি সেঁচতে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সফিকের মতাে পাগলেরও ধৈর্যচ্যুতি হলাে। কয়েকবার বললাে, বিরাট বােকামি হয়েছে। গ্রেট মিসটেক। এরচে‘ কঙ্গো নদীর উৎস বের করা সহজ ছিলাে। আমি বললাম, এখনাে সময় আছে।
ফিরে যাবি কিনা বল। আরে না। এতােদুর এসে ফিরে যাবাে মানে। ভালাে জিনিশের জন্যে কষ্ট করতেই হবে। জাষ্ট চিন্তা করে দেখ একজন মানুষের গা থেকে ভুর ভুর করে কাঁঠালচাপা ফুলের গন্ধ বেরুচ্ছে। ভাবতেই গায়ের লােম খাড়া হয়ে যাচ্ছে। হাউ এক্সাইটিং।
ভয় (পর্ব-৭)-হুমায়ূন আহমেদ
সন্ধ্যার পর পর ধুন্দুল নাড়া গ্রামে উপস্থিত হলাম। কাদায় পানিতে মাখামাখি। তিনবার বৃষ্টিতে ভিজেছি। ক্ষুধা এবং তৃষ্ণায় জীবন বের হবার উপক্রম। বিদেশী মানুষ দেখলেই গ্রামের লােকজন সাধারণত খুব আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসে। এইখানে উল্টো নিয়ম দেখলাম। আমাদের ব্যাপারে কারাে কোনাে আগ্রহ নেই। কোখেকে এসেছি। যাবাে কোথায়? এইটুকু দায়িত্ব পালন করার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করেই সবাই চলে যাচ্ছে। একি যন্ত্রণা।
সাধু কালু খা–কে দেখেও খুব হতাশ হতে হলাে। বদ্ধ উন্মাদ একজন মানুষ। শ্মশানে একটা পাকুড় গাছের নিচে ন্যাংটো অবস্থায় বসা। আমাদের দেখেই গালাগালি শুরু করলাে। গালাগালি যে এতাে নােংরা হতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে ছিলাে। আমাকে এবং সফিককে কালু খা সবচে’ দ্ৰ কথা যা বললাে তা হচ্ছে – বাড়িত যা। বাড়িত গিয়া খাবলাইয়া খাবলাইয়া ‘গু’ খা।
আমি হতভম্ব। ব্যাটা বলে কি।
সফিকের দিকে তাকালাম। সে ভাব গদগদ স্বরে বললাে, লােকটার ভেতর জিনিশ আছে বলে মনে হচ্ছে।
আমি বললাম, কি করে বুঝলি ? আমাদের গু’ খেতে বলেছে এইজন্যে? “আরে না। সে আমাদের এড়াতে চাচ্ছে। মানুষের সংসর্গ পছন্দ নয়। মানুষের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার এটা একটা সহজ টেকনিক।
‘লােকটা যে বদ্ধ উন্মাদ তা তাের মনে হচ্ছে না? ‘তাও মনে হচ্ছে তবে একটা প্রবাবিলিটি আছে যে সে উন্মাদ না।”
গ্রামের কয়েকজন বয়স্ক মানুষ আমাদের সঙ্গে আছেন। সাধুর প্রতি তাদের ভক্তি শ্রদ্ধাও সফিকের মতই। তাদের একজন বললেন, বাবার মাথা এখন একটু গরম।
ভয় (পর্ব-৭)-হুমায়ূন আহমেদ
আমি বিরক্ত গলায় বললাম, মাথা ঠাণ্ডা হবে কখন? ‘ঠিক নাই। চাদের সঙ্গে যােগাযােগ। ‘চাদের সঙ্গে যােগাযােগ মানে?” ‘অমাবস্যা পূর্ণিমায় মাথা গরম থাকে।
এই ব্যাপারেও মতভেদ দেখা গেলাে। একজন বললাে, অমাবস্যা পূর্ণিমাতেই মাথাটা ঠাণ্ডা থাকে। অন্য সময় গরম। বাবার কাছে মাসের পর মাস পড়ে থাকতে হয়। অপেক্ষা করতে হয় কখন বাবার মাথা ঠাণ্ডা হবে।
(চলবে)