বারান্দা থেকে গুন গুন শব্দ আসছে। উৎকর্ণ হয়ে রইলাম–খুবই মিষ্টি গলায় টেনে টেনে গান হচ্ছে–যার কথাগুলাের বেশির ভাগই অস্পষ্ট।
মাঝে মাঝে দুএকটা লাইন বােঝা যায় যার কোনাে অর্থ নেই। যেমন :
‘এতে ন্ম দেহে না দেহে না এতে না। ইমাম সাহেব উঁচু গলায় বললেন, লতিফা চুপ কর। চুপ কর বললাম। গান থামিয়ে লতিফা বলল–তুই চুপ কর। তুই থাম শুওরের বাচ্চা।
অবিকল পুরুষের ভারী গলা। আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠলাে। সেই পুরুষ কণ্ঠ থমথমে স্বরে বললাে, চুপ কইরা থাকবি। একটা কথা কইলে টান দিয়া মাথা আলগা করুম। শইল থাকব একখানে মাথা আরেকখানে। শুওরের বাচ্চা আমারে চুপ করতে কয়। | আমরা হাত ধূয়ে উঠে পড়লাম। এত কাণ্ডের পর খাওয়া দাওয়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব না।
এ জাতীয় যন্ত্রণায় পথ কখনাে ভাবিনি।
সফিক নিচু গলায় বললাে, বিরাট সমস্যা হয়ে গেলাে দেখি! ভয় ভয় লাগছে। কি করা যায় বলতাে?
মসজিদের ভেতর এর আগে কখনাে রাত্রি যাপন করিনি। অস্বস্তি নিয়ে ঘুমুতে গেলাম। কেমন যেন দম বন্ধ দম বন্ধ লাগছে। মসজিদের একটা মাত্র দরজা সেটি পেছন দিকে। ভেতরে গুমট ভাব। ইমাম সাহেব যত্নের চূড়ান্ত করেছেন। স্ত্রীর অস্বাভাবিক আচরণজনিত লজ্জা হয়তােবা ঢাকার চেষ্টা করছেন। আমাদের দুজনের জন্যে দুটা শীতল পাটি, পাটির চারপাশে কার্বলিক এসিড ছড়ানাে হয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা দুটা মশারি খাটানাে হয়েছে।
ভয় (পর্ব-৯)-হুমায়ূন আহমেদ
ইমাম সাহেব বললেন, ভয়ের কিছু নাই। হারিকেন জ্বালানাে থাকবে। আলােতে সাপ আসে না। দরজা বন্ধ। সাপ ঢােকারও পথ নাই। | আমি খুব যে ভরসা পাচ্ছি তা না। চৌকি এনে ঘুমােতে পারলে হতাে। মসজিদের ভেতর চৌকি পেতে শােয়া–ভাবাই যায় না।
সফিকের হচ্ছে ইচ্ছা ঘুম। শােয়া মাত্র–নাক ডাকতে শুরু করেছে। বাইরে ঝির ঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। মসজিদের ভেতর আগরবাতির গন্ধ। যে গন্ধ সব সময় মৃত্যুকে মনে করিয়ে দেয়। সব মিলিয়ে গা ছমছমাননা ব্যাপার।
আমি ইমাম সাহেবকে বললাম, আপনি চলে যান, আপনি এখানে বসে আছেন কেন? আপনার স্ত্রী একা। তার শরীরও ভালাে না।
ইমাম সাহেব বললেন, আমি মসজিদেই থাকব। এবাদত বন্দেগী করব। ফজরের নামাজ শেষ করে বাসায় গিয়ে ঘুমুব।
লতিফা এখন আমাকে দেখলে উমাদের মতাে হয়ে যাবে। মেঝেতে মাথা কিবে।”
“কেন?”
‘ওর দোষ নাই কিছু। সঙ্গে জ্বীন আছে কফিল। এই জ্বীনই সবকিছু করায়। বেচারীর কোন দোষ নাই।
আমি চুপ করে রইলাম। ইমাম সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, এমনিতে তেমন উপদ্রব করে না। সন্তান সম্ভবা হলেই কফিল ভয়ংকর যন্ত্রণা করে। বাচ্চাটা মেরে না ফেলা পর্যন্ত থামে না। দুইটা বাচ্চা মেরেছে–এইটাও মারবে।
“আপনার স্ত্রী কি সন্তান সম্ভবা?”
‘আপনি কি নিশ্চিত যে পুরাে ব্যাপারটা জ্বীন করছে। অন্য কিছু না?” “জ্বি নিশ্চিত। জ্বীনের সঙ্গে আমার মাঝে মধ্যে কথা হয়।” ‘অবিশ্বাস্য সব কথাবার্তা বলছেন আপনি।
ভয় (পর্ব-৯)-হুমায়ূন আহমেদ
‘অবিশ্বাসের কিছু নাই। একদিনের ঘটনা বলি তাহলে বুঝবেন। ভাদ্র মাস। খুব গরম। একটা ভেজা গামছা শরীরে জড়ায়ে এশার নামাজে দাড় হয়েছি। মসজিদে আমি একা। আমি ছাড়া আর কেউ নাই। হঠাৎ দপ করে হারিকেনটা নিভে গেল। চমকে উঠলাম। তারপর শুনি মসজিদের পেছনের দরজার কাছে ধুপ ধুপ শব্দ। খুব ভয় লাগল।
নামাজ ছেড়ে উঠতে পারি না। নামাজে মনও দিতে পারি না। কিছুক্ষণ পর পর পিছনের দরজায় ধুপ ধুপ শব্দ। যেন কেউ কিছু একটা এনে ফেলছে। সেজদায় যাবার সময় কফিলের গলা শুনলাম – টেনে টেনে বলল, তােরে আইজ পুড়াইয়া মারব। তােরে আইজ পুড়াইয়া মারব।
তারপর ধপ করে আগুন জ্বলে উঠল। দাউ দাউ আগুন। নামাজ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। দেখি দরজার কাছে গাদা করা শুকনা লাকড়ি। আগুন জ্বলছে। আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম বাচাও বাঁচাও। আমার চিঙ্কার শুনে লতিফা পানির বালতি হাতে ছুটে আসল। পানি দিয়ে আগুন নিভায়ে আমারে মসজিদ থেকে টেনে বার করল। আমার স্ত্রীর কারণে সেই যাত্রা বেঁচে গেলাম। লতিফা সময় মত না আসলে মারা পড়তাম।।
“জ্বীন মসজিদের ভেতরে ঢুকলাে না কেন? ‘খারাপ ধরনের জ্বীন। আল্লাহর ঘরে এরা ঢুকতে পারে না। আমি এই জন্যেই বেশির ভাগ সময় মসজিদে থাকি। মসজিদে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাতে পারি। ঘরে পারি না।
ভয় (পর্ব-৯)-হুমায়ূন আহমেদ
কফিল আপনাকে খুন করতে চায়?” ‘তাও ঠিক না–একবারই চেয়েছিলাে। তারপর আর চায় নাই। ‘খুন করতে চেয়েছিলাে কেন?”
ইমাম সাহেব চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, আপনার যদি আপত্তি না থাকে পুরাে ঘটনাটা বলুন। আপত্তি থাকলে বলার দরকার নেই।
না। আপত্তির কি আছে? আপত্তির কিছু নাই। আমি লতিফার অবস্থা একটু দেখে আসি।
‘যান দেখে আসুন।
ইমাম সাহেব চলে গেলেন। আমি ভয়ে অস্থির হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ভূত, প্রেত, জ্বীন, পরী কখনাে বিশ্বাস করিনি এখনাে করছি না তবু আতংকে আধমরা হয়ে গেছি। সফিক জেগে থাকলে খানিকটা ভরসা পাওয়া যেত। সে ঘুমুচ্ছে মরার মত। একেই বলে পরিবেশ। ইমাম সাহেব দশ মিনিটের মধ্যে ফিরে এলেন। বিরস গলায় বললেন, ভালই আছে– তবে ভীষণ চিৎকার করছে।
‘তালা বন্ধ করে রেখেছেন? ‘জি না। তালা বন্ধ করে তাকে রাখা সম্ভব না। কফিল ওর সঙ্গে থাকে–কাজেই
ওর গায়ের জোর থাকে অসম্ভব। না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না।
ইমাম সাহেব মন খারাপ করে বসে রইলেন। আমি বললাম, গল্পটা শুরু করুন ভাই।
তিনি নিচু গলায় বললেন, আমার স্ত্রীর ডাকনাম বুড়ি।
কথা পুরােপুরি শেষ করতে পারলেন না। মসজিদে প্রচণ্ড শব্দে ঢিল পড়তে লাগলাে। ধুপ ধুপ শব্দ। সেই সঙ্গে মনে হচ্ছে কয়েকজন মানুষ যেন চারদিকে ছুটাছুটি করছে। আমি আতংকিত গলায় বললাম, কি ব্যাপার?
ইমাম সাহেব বললেন, কিছু না। কফিল চায় না আমি কিছু বলি। “থাক ভাই বাদ দিন। গল্প বলার দরকার নেই। ‘অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢিল ছোড়া বন্ধ হবে। ভয়ের কিছুই নাই।
ভয় (পর্ব-৯)-হুমায়ূন আহমেদ
সত্যি সত্যি বন্ধ হলাে। বৃষ্টির বেগ বাড়তে লাগলাে। ইমাম সাহেব গল্প শুরু করলেন। আমি তার গল্পটাই বলছি। তাঁর ভাষাতে। তবে আঞ্চলিকতাটা সামান্য বাদ দিয়ে।
গল্পের মাঝখানেও একবার তুমুল ঢিল ছোড়া হলাে। ইমাম সাহেব একমনে আয়াতুল কুরসি পড়লেন। আমার জীবনে সে এক ভয়াবহ রাত।
নেত্রকোনা শহরের বিশিষ্ট মােক্তার মমতাজউদ্দিন সাহেবের বাড়িতে তখন আমি থাকি। উনার সংগে আমার কোনাে আত্মীয়তা সম্পর্ক নাই। লােকমুখে শুনেছিলাম
বিশিষ্ট ভদ্রলােক। কেউ কোন বিপদে পড়ে তার কাছে গেলে তিনি যথাসাধ্য করেন। আমার তখন মহাবিপদ। একবেলা খাইতাে এক বেলা উপাস দেই। সাহসে ভর করে তার কাছে গেলাম চাকরির জন্যে। উনি বললেন, চাকরি যে দিবাে পড়াশােনা কি জানাে?
আমি বললাম, উলা পাস করেছি।
(চলবে)