ভয় (পর্ব-৯)-হুমায়ূন আহমেদ

বারান্দা থেকে গুন গুন শব্দ আসছেউৎকর্ণ হয়ে রইলামখুবই মিষ্টি গলায় টেনে টেনে গান হচ্ছেযার কথাগুলাের বেশির ভাগই অস্পষ্ট

ভয়

মাঝে মাঝে দুএকটা লাইন বােঝা যায় যার কোনাে অর্থ নেইযেমন

‘এতে ন্ম দেহে না দেহে না এতে নাইমাম সাহেব উঁচু গলায় বললেন, লতিফা চুপ করচুপ কর বললামগান থামিয়ে লতিফা বললতুই চুপ করতুই থাম শুওরের বাচ্চা। 

অবিকল পুরুষের ভারী গলাআমার গা কাঁটা দিয়ে উঠলােসেই পুরুষ কণ্ঠ থমথমে স্বরে বললাে, চুপ কইরা থাকবিএকটা কথা কইলে টান দিয়া মাথা আলগা করুমশইল থাকব একখানে মাথা আরেকখানেশুওরের বাচ্চা আমারে চুপ করতে কয়| আমরা হাত ধূয়ে উঠে পড়লামএত কাণ্ডের পর খাওয়া দাওয়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব না। 

জাতীয় যন্ত্রণায় পথ কখনাে ভাবিনি। 

সফিক নিচু গলায় বললাে, বিরাট সমস্যা হয়ে গেলাে দেখি! ভয় ভয় লাগছেকি করা যায় বলতাে

মসজিদের ভেতর এর আগে কখনাে রাত্রি যাপন করিনিঅস্বস্তি নিয়ে ঘুমুতে গেলামকেমন যেন দম বন্ধ দম বন্ধ লাগছেমসজিদের একটা মাত্র দরজা সেটি পেছন দিকেভেতরে গুমট ভাবইমাম সাহেব যত্নের চূড়ান্ত করেছেনস্ত্রীর অস্বাভাবিক আচরণজনিত লজ্জা হয়তােবা ঢাকার চেষ্টা করছেনআমাদের দুজনের জন্যে দুটা শীতল পাটি, পাটির চারপাশে কার্বলিক এসিড ছড়ানাে হয়েছেতার চেয়েও বড় কথা দুটা মশারি খাটানাে হয়েছে। 

ভয় (পর্ব-৯)-হুমায়ূন আহমেদ

ইমাম সাহেব বললেন, ভয়ের কিছু নাইহারিকেন জ্বালানাে থাকবেআলােতে সাপ আসে নাদরজা বন্ধসাপ ঢােকারও পথ নাই| আমি খুব যে ভরসা পাচ্ছি তা নাচৌকি এনে ঘুমােতে পারলে হতােমসজিদের ভেতর চৌকি পেতে শােয়াভাবাই যায় না। 

সফিকের হচ্ছে ইচ্ছা ঘুমশােয়া মাত্রনাক ডাকতে শুরু করেছেবাইরে ঝির ঝির করে বৃষ্টি হচ্ছেঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছেমসজিদের ভেতর আগরবাতির গন্ধযে গন্ধ সব সময় মৃত্যুকে মনে করিয়ে দেয়সব মিলিয়ে গা ছমছমাননা ব্যাপার। 

আমি ইমাম সাহেবকে বললাম, আপনি চলে যান, আপনি এখানে বসে আছেন কেন? আপনার স্ত্রী একাতার শরীরও ভালাে না। 

ইমাম সাহেব বললেন, আমি মসজিদেই থাকবএবাদত বন্দেগী করবফজরের নামাজ শেষ করে বাসায় গিয়ে ঘুমুব। 

লতিফা এখন আমাকে দেখলে উমাদের মতাে হয়ে যাবেমেঝেতে মাথা কিবে” 

কেন?” 

ওর দোষ নাই কিছুসঙ্গে জ্বীন আছে কফিলএই জ্বীনই সবকিছু করায়বেচারীর কোন দোষ নাই। 

আমি চুপ করে রইলামইমাম সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, এমনিতে তেমন উপদ্রব করে নাসন্তান সম্ভবা হলেই কফিল ভয়ংকর যন্ত্রণা করেবাচ্চাটা মেরে না ফেলা পর্যন্ত থামে নাদুইটা বাচ্চা মেরেছেএইটাও মারবে। 

আপনার স্ত্রী কি সন্তান সম্ভবা?” 

আপনি কি নিশ্চিত যে পুরাে ব্যাপারটা জ্বীন করছেঅন্য কিছু না?জ্বি নিশ্চিতজ্বীনের সঙ্গে আমার মাঝে মধ্যে কথা হয়অবিশ্বাস্য সব কথাবার্তা বলছেন আপনি। 

ভয় (পর্ব-৯)-হুমায়ূন আহমেদ

অবিশ্বাসের কিছু নাইএকদিনের ঘটনা বলি তাহলে বুঝবেনভাদ্র মাসখুব গরমএকটা ভেজা গামছা শরীরে জড়ায়ে এশার নামাজে দাড় হয়েছি। মসজিদে আমি একাআমি ছাড়া আর কেউ নাইহঠাৎ দপ করে হারিকেনটা নিভে গেলচমকে উঠলামতারপর শুনি মসজিদের পেছনের দরজার কাছে ধুপ ধুপ শব্দখুব ভয় লাগল

নামাজ ছেড়ে উঠতে পারি নানামাজে মনও দিতে পারি নাকিছুক্ষণ পর পর পিছনের দরজায় ধুপ ধুপ শব্দযেন কেউ কিছু একটা এনে ফেলছেসেজদায় যাবার সময় কফিলের গলা শুনলাম টেনে টেনে বলল, তােরে আইজ পুড়াইয়া মারবতােরে আইজ পুড়াইয়া মারব

তারপর ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলদাউ দাউ আগুননামাজ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালামদেখি দরজার কাছে গাদা করা শুকনা লাকড়িআগুন জ্বলছেআমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম বাচাও বাঁচাওআমার চিঙ্কার শুনে লতিফা পানির বালতি হাতে ছুটে আসলপানি দিয়ে আগুন নিভায়ে আমারে মসজিদ থেকে টেনে বার করলআমার স্ত্রীর কারণে সেই যাত্রা বেঁচে গেলামলতিফা সময় মত না আসলে মারা পড়তাম। 

জ্বীন মসজিদের ভেতরে ঢুকলাে না কেন? খারাপ ধরনের জ্বীনআল্লাহর ঘরে এরা ঢুকতে পারে নাআমি এই জন্যেই বেশির ভাগ সময় মসজিদে থাকিমসজিদে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাতে পারিঘরে পারি না। 

ভয় (পর্ব-৯)-হুমায়ূন আহমেদ

কফিল আপনাকে খুন করতে চায়?তাও ঠিক নাএকবারই চেয়েছিলােতারপর আর চায় নাইখুন করতে চেয়েছিলাে কেন?” 

ইমাম সাহেব চুপ করে রইলেনআমি বললাম, আপনার যদি আপত্তি না থাকে পুরাে ঘটনাটা বলুনআপত্তি থাকলে বলার দরকার নেই। 

নাআপত্তির কি আছে? আপত্তির কিছু নাইআমি লতিফার অবস্থা একটু দেখে আসি। 

যান দেখে আসুন। 

ইমাম সাহেব চলে গেলেনআমি ভয়ে অস্থির হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলামভূত, প্রেত, জ্বীন, পরী কখনাে বিশ্বাস করিনি এখনাে করছি না তবু আতংকে আধমরা হয়ে গেছিসফিক জেগে থাকলে খানিকটা ভরসা পাওয়া যেতসে ঘুমুচ্ছে মরার মতএকেই বলে পরিবেশইমাম সাহেব দশ মিনিটের মধ্যে ফিরে এলেনবিরস গলায় বললেন, ভালই আছেতবে ভীষণ চিৎকার করছে। 

তালা বন্ধ করে রেখেছেন? জি নাতালা বন্ধ করে তাকে রাখা সম্ভব নাকফিল ওর সঙ্গে থাকেকাজেই 

ওর গায়ের জোর থাকে অসম্ভবনা দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না। 

ইমাম সাহেব মন খারাপ করে বসে রইলেনআমি বললাম, গল্পটা শুরু করুন ভাই। 

তিনি নিচু গলায় বললেন, আমার স্ত্রীর ডাকনাম বুড়ি। 

কথা পুরােপুরি শেষ করতে পারলেন নামসজিদে প্রচণ্ড শব্দে ঢিল পড়তে লাগলােধুপ ধুপ শব্দসেই সঙ্গে মনে হচ্ছে কয়েকজন মানুষ যেন চারদিকে ছুটাছুটি করছেআমি আতংকিত গলায় বললাম, কি ব্যাপার

ইমাম সাহেব বললেন, কিছু নাকফিল চায় না আমি কিছু বলিথাক ভাই বাদ দিনগল্প বলার দরকার নেইঅল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢিল ছোড়া বন্ধ হবেভয়ের কিছুই নাই। 

ভয় (পর্ব-৯)-হুমায়ূন আহমেদ

সত্যি সত্যি বন্ধ হলােবৃষ্টির বেগ বাড়তে লাগলােইমাম সাহেব গল্প শুরু করলেনআমি তার গল্পটাই বলছিতাঁর ভাষাতেতবে আঞ্চলিকতাটা সামান্য বাদ দিয়ে। 

গল্পের মাঝখানেও একবার তুমুল ঢিল ছোড়া হলােইমাম সাহেব একমনে আয়াতুল কুরসি পড়লেনআমার জীবনে সে এক ভয়াবহ রাত। 

নেত্রকোনা শহরের বিশিষ্ট মােক্তার মমতাজউদ্দিন সাহেবের বাড়িতে তখন আমি থাকিউনার সংগে আমার কোনাে আত্মীয়তা সম্পর্ক নাইলােকমুখে শুনেছিলাম 

বিশিষ্ট ভদ্রলােককেউ কোন বিপদে পড়ে তার কাছে গেলে তিনি যথাসাধ্য করেনআমার তখন মহাবিপদএকবেলা খাইতাে এক বেলা উপাস দেই। সাহসে ভর করে তার কাছে গেলাম চাকরির জন্যেউনি বললেন, চাকরি যে দিবাে পড়াশােনা কি জানাে

আমি বললাম, উলা পাস করেছি। 

(চলবে)

ভয় (পর্ব-৮)-হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *