ভয় (শেষ-পর্ব)-হুমায়ূন আহমেদ

আমি বললাম, এরা কারা? জানি নাকিছু জানি নাআপনি থাকায় কেন জানি একটু ভরসা পাচ্ছিযদিও জানি আপনি কিছুই করতে পারবেন নাকিছুই না, কিছুই না, কিছুই না ...

ভয়মেয়েটি হাপাতে শুরু করল আর তখন সেই ভারী এবং শ্রেষা জড়ানাে কণ্ঠ চিৎকার করে বললাে, সময় শেষদৌড়াও দৌড়াও, দৌড়াও ...। 

সেই চিৎকারের মধ্যে ভয়ংকর পৈশাচিক কিছু ছিলআমার শরীরের প্রতিটি স্নায়ু থরথর করে কাঁপতে লাগলােচোখের সামনে কুয়াশা কেটে যেতে লাগলােচারদিকে তীব্র আলােএত তীব্র যে চোখ ধাধিয়ে যায় যাদের কথা শুনছিলাম অথচ দেখতে পাচ্ছিলাম না; এই আলােয় সবাইকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম এরা এরা এরা ... 

এরা কি? এরা মানুষ না, অন্য কিছু লম্বাটে পশুর মত মুখ, হাত পা মানুষের মতসবাই নগ্নএরা অদ্ভুত এক ধরণের শব্দ করতে লাগলােআমার কানে বাজতে লাগলাে দৌড়াও দৌড়াও ..... আমরা দৌড়াতে শুরু করলামআমাদের পেছনে সেই জন্তুর মত মানুষগুলিও দৌড়াচ্ছে। 

ভয় (শেষ-পর্ব)-হুমায়ূন আহমেদ

আমরা ছুটছি মাঠের উপর দিয়েসেই মাঠে কোন ঘাস নেইসমস্ত মাঠময় অযুত নিযুত লক্ষ কোটি ধারালাে ব্রেড সারি সারি সাজানােসেই ব্রেড়ে আমার পা কেটে 

ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছেতীব্র তীক্ষ্ম যন্ত্রণাচিৎকার করে উঠলাম, আর তখনি ঘুম ভেঙে গেলােদেখি ঘামে সমস্ত বিছানা ভিজে গেছে। 

এই তােমার স্বপ্ন

দ্বিতীয় স্বপ্ন কখন দেখলে?ঠিক একমাস পরসেই মেয়েটিও কি দ্বিতীয় স্বপ্নে তােমার সঙ্গে ছিল

একই স্বপ্ন? না একটু অন্য রকম? একই স্বপ্নদ্বিতীয়বারও কি তুমি মেয়েটির হাত ধরে দৌড়ালে?জিপ্রথমবার যেমন তার সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছিল? দ্বিতীয়বারও হল? জিদ্বিতীয়বারও কি মেয়েটি পরে এসেছে? তুমি আগে এসে অপেক্ষা করছিলে?জিনাদ্বিতীয়বারে মেয়েটি আগে এসেছিলআমি পরে এসেছিদ্বিতীয়বারের স্বপ্ন তুমি রাত কটায় দেখেছাে?” 

ঠিক বলতে পারব না তবে শেষ রাতের দিকেঘুম ভাঙ্গার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফজরের আজান হল। 

দ্বিতীয়বারও স্বপ্নে মােটা গলার লােকটি কথা বলল ?” জ্বি। 

লােকমান ফকির রুমালে কপালের ঘাম মুছতে লাগলােসে অসম্ভব ঘামছেআমি বললাম, পানি খাবে? পানি এনে দেব

জ্বি স্যার দিন| আমি পানি এনে দিলাম সে এক নিঃশ্বাসে পানি শেষ করে ফেললআমি বললাম স্বপ্ন ভাঙ্গার পর তুমি দেখলে তােমার দুটি পাব্লেডে কেটে ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেছে তাই না

ভয় (শেষ-পর্ব)-হুমায়ূন আহমেদ

লােকমান হতভম্ব হয়ে বললাে, জি স্যারআপনি কি করে বুঝলেন? | তুমি খুড়িয়ে খুড়িয়ে ঘরে ঢুকলে সেখান থেকে অনুমান করেছিতাছাড়া তােমার পা স্বপ্ন দেখার পর কেটে যাচ্ছে বলেই স্বপ্নটা ভয়ংকরপা যদি না কাটতাে তাহলে 

স্বপ্নটা ভয়ংকর হত না বরং একটা মধুর স্বপ্ন হতকারণ স্বপ্নে একটি মেয়ের সঙ্গে তােমার দেখা হচ্ছে যে তােমার গা ঘেসে দাড়িয়ে আছেআঠারাে উনিশ বছরের রূপবতী একটি মেয়ে, হাত ধরে তােমার সঙ্গে দৌড়াচ্ছে। 

আমার কথার মাঝখানেই লােকমান ফকির পায়ের জুতা খুলে ফেললাে, মােজা খুলল, আমি হতভম্ব হয়ে দেখলাম পায়ের তলা ফালা ফালা করে কাটাএমন কিছু সত্যি সত্যি ঘটতে পারে আমি ভাবি নি।। 

লােকমান ক্ষীণ গলায় বলল, এটা কি করে হয় স্যার

আমি ঠিক বুঝতে পারছি নাতবে স্বপ্নের ব্যাপারে পড়াশােনা যা করেছি তার থেকে তােমাকে একটা কথা বলতে পারি Invert reaction বলে একটা ব্যাপারআছেধর তােমার একটা আঙুল পুড়ে গেল সেই খবর স্নায়ুর মাধ্যমে যখন তােমার মস্তিষ্কে পৌছবে তখন তুমি তীব্র ব্যথা পাবেInvert reaction কি হয় জান? আগে মস্তিস্কে আঙুল পােড়ার অনুভূতি পায় তারপর সেই খবর আঙুলে পৌছে তখন আঙুলটি পােড়া পােড়া হয়ে যেতে পারেস্বপ্নের পুরাে ব্যাপারটা হয় মস্তিস্কেসেখান থেকে Invert reaction শরীরে তার প্রভাব পড়তে পারে। 

ভয় (শেষ-পর্ব)-হুমায়ূন আহমেদ

এক লোেক স্বপ্নে দেখতাে তার হাতে কে যেন পিন ফুটাচ্ছেঘুম ভাঙ্গার পর তার হাতে সত্যি সত্যি পিন ফোটার দাগ দেখা যেততােমার ক্ষেত্রেও হয়ত তাই টেছেতবে এমন ভয়াবহ ভাবে পা কাটা Invert reaction সম্ভব বলে আমার মনে হয়না। 

তাহলে কি? আমি বুঝতে পারছি না। 

লােকমান ক্লান্তু স্বরে বলল, এক মাস পর পর আমি স্বপ্নটা দেখিকারণ পায়ের ঘা শুকাতে এক মাস লাগে। 

আমি, লােকমান ফকিরের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম, তুমি এখন থেকে একটা কাজ করবে ঘুমুতে যাবে জুতা পায়ে দিয়েস্বপ্নে যদি তােমাকে দৌড়াতেও হয় তােমার পায়ে থাকবে জুতাব্রড তােমাকে কিছু করতে পারবে না। 

সত্যি বলছেন? আমার তাই ধারণাআমার মনে হচ্ছে জুতা পরে ঘুমুলে তুমি স্বপ্নটাই আর দেখবে না। 

লােকমান ফকির চলে গেলখুব ভরসা পেল বলে মনে হল নাআমি তাকে বলে দিয়েছিলাম এক মাস পর স্বপ্ন দেখা হয়ে গেলে সে যেন আসেসে এল দেড় মাস পর। 

তার মুখ আগের চেয়েও শুকনাে চোখ ভাবলেশহীনঅথর্ব মানুষের মত হাটছেআমি বললাম, স্বপ্ন দেখেছাে?” 

জিনাজুতা পায়ে ঘুমুচ্ছাে?জ্বি স্যারজুতা পায়ে দেয়ার জন্যেই স্বপ্ন দেখছিনা। 

আমি হাসিমুখে বললামতাহলেতাে তােমার রােগ সেরে গেলএত মন খারাপ কেন? মনে হচ্ছে বিরাট সমস্যায় পড়েছেসমস্যাটা কি

লােকমান নীচু গলায় বলল, মেয়েটার জন্যে মন খারাপ স্যারবেচারী একা একা স্বপ্ন দেখছেএত ভাল একটা মেয়ে কষ্ট করছেআমি সঙ্গে থাকলে সে একটু ভরসা পায়নিজের জন্যে কিছু নামেয়েটার জন্যে খুব কষ্ট হয়। 

লােকমানের চোখে প্রায় পানি এসে গেলআমি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলামসে বলেকি

স্যার আমি ঠিক করেছিজুতা পরবনাযা হবার হবেনারগিসকে একা একা যেতে দেব নাআমি থাকব সঙ্গেমেয়েটার জন্যে আমার খুব কষ্ট হয় স্যারএত চমৎকার একটা মেয়েআমি স্যার থাকব তার সঙ্গে। 

ভয় (শেষ-পর্ব)-হুমায়ূন আহমেদ

সেটা কি ভাল হবে?জ্বি স্যার হবেআমি তাকে ছাড়া বাচব নাসে কিন্তু স্বপ্নের একটি মেয়ে। 

সে স্বপ্নের মেয়ে নয়আমি যেমন, সেও তেমনআমরা দুজন এই পৃথিবীতেই বাস করিসে হয়ত ঢাকাতেই কোন এক বাসায় থাকেতার পায়ে ব্লেডের কাটাআমি যেমন সারাক্ষণ তার কথা ভাবি সেও নিশ্চয়ই ভাবেশুধু আমাদের দেখা হয় স্বপ্নে। 

মিসির আলি সিগারেট ধরিয়ে বললেন, গল্পটি এই পর্যন্তইআমি চেঁচিয়ে বললাম, এই পর্যন্ত মানে? শেষটা কি? শেষটা আমি জানি নাছেলেটি ক্ষত বিক্ষত পা নিয়ে একবার এসেছিলসে বলল, জুতা খুলে ঘুমানাে মাত্রই সে আবার স্বপ্ন দেখেস্বপ্নে মেয়েটির দেখা পায়। 

তারা দুজন খানিকক্ষণ গল্প করেদুজন, দু’জনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেএক সময় মানুষের মত জন্তুগুলি চেঁচিয়ে বলে দৌড়াও, দৌড়াওতারা দৌড়াতে শুরু করে। 

ছেলেটি আপনার কাছে আর আসে নি?জিনাছেলেটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপনি কি কিছু জানেন

না জানি নাতবে অনুমান করতে পারিছেলেটি জানে জুতাে পায়ে ঘুমুলে এই দুঃস্বপ্ন সে দেখবে না তারপরেও জুতাে পায়ে দেয় নাকারণ মেয়েটিকে একা ছেড়ে দেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়প্রেমের ক্ষমতা যে কি প্রচণ্ড হতে পারে প্রেমে না পড়লে তা বুঝা যায় নাছেলেটির পক্ষে এই জীবনে তার স্বপ্ন সঙ্গিনীর মায়া কাটানাে সম্ভব ।

ভয় (শেষ-পর্ব)-হুমায়ূন আহমেদ

সে বাকি জীবনে কখনাে জুতা পায়ে ঘুমুবে নাসে আসলে দুঃস্বপ্নের হাত থেকে মুক্তি চায় না। দুঃস্বপ্ন হলেও এটি সেই সঙ্গে তার জীবনের মধুরতম স্বপ্ন| আপনার কি ধারণা নারগিস নামের কোন মেয়ে এই পৃথিবীতে সত্যি সত্যি আছে?” 

মিসির আলি নীচু গলায় বললেন, আমি জানি নারহস্যময় এই পৃথিবীর খুব কম রহস্যের সন্ধানই আমি জানি। তবে মাঝে মাঝে আমারাে কেন জানি এই মেয়েটির হাত ধরে একবার দৌড়াতে ইচ্ছা করেআরেক দফা চা হবে? পানি কি গরম করব

ভয় (পর্ব-১৮)-হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *