আমি বললাম, এরা কারা? ‘জানি না। কিছু জানি না। আপনি থাকায় কেন জানি একটু ভরসা পাচ্ছি। যদিও জানি আপনি কিছুই করতে পারবেন না। কিছুই না, কিছুই না, কিছুই না ....
মেয়েটি হাপাতে শুরু করল আর তখন সেই ভারী এবং শ্রেষা জড়ানাে কণ্ঠ চিৎকার করে বললাে, সময় শেষ। দৌড়াও দৌড়াও, দৌড়াও ...।।
সেই চিৎকারের মধ্যে ভয়ংকর পৈশাচিক কিছু ছিল। আমার শরীরের প্রতিটি স্নায়ু থরথর করে কাঁপতে লাগলাে। চোখের সামনে কুয়াশা কেটে যেতে লাগলাে–চারদিকে তীব্র আলাে। এত তীব্র যে চোখ ধাধিয়ে যায় – যাদের কথা শুনছিলাম অথচ দেখতে পাচ্ছিলাম না; এই আলােয় সবাইকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম –এরা এরা এরা ...
এরা কি? এরা মানুষ না, অন্য কিছু – লম্বাটে পশুর মত মুখ, হাত পা মানুষের মত। সবাই নগ্ন। এরা অদ্ভুত এক ধরণের শব্দ করতে লাগলাে। আমার কানে বাজতে লাগলাে – দৌড়াও দৌড়াও ..... আমরা দৌড়াতে শুরু করলাম। আমাদের পেছনে সেই জন্তুর মত মানুষগুলিও দৌড়াচ্ছে।
ভয় (শেষ-পর্ব)-হুমায়ূন আহমেদ
আমরা ছুটছি মাঠের উপর দিয়ে। সেই মাঠে কোন ঘাস নেই। সমস্ত মাঠময় অযুত নিযুত লক্ষ কোটি ধারালাে ব্রেড সারি সারি সাজানাে। সেই ব্রেড়ে আমার পা কেটে
ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে– তীব্র তীক্ষ্ম যন্ত্রণা। চিৎকার করে উঠলাম, আর তখনি ঘুম ভেঙে গেলাে। দেখি ঘামে সমস্ত বিছানা ভিজে গেছে।
‘এই তােমার স্বপ্ন?
‘দ্বিতীয় স্বপ্ন কখন দেখলে?” “ঠিক একমাস পর।। ‘সেই মেয়েটিও কি দ্বিতীয় স্বপ্নে তােমার সঙ্গে ছিল?
‘একই স্বপ্ন? না একটু অন্য রকম? ‘একই স্বপ্ন। ‘দ্বিতীয়বারও কি তুমি মেয়েটির হাত ধরে দৌড়ালে?” ‘জি। ‘প্রথমবার যেমন তার সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছিল? দ্বিতীয়বারও হল? ‘জি।। ‘দ্বিতীয়বারও কি মেয়েটি পরে এসেছে? তুমি আগে এসে অপেক্ষা করছিলে?” “জিনা–দ্বিতীয়বারে মেয়েটি আগে এসেছিল। আমি পরে এসেছি। ‘দ্বিতীয়বারের স্বপ্ন তুমি রাত কটায় দেখেছাে?”
“ঠিক বলতে পারব না তবে শেষ রাতের দিকে। ঘুম ভাঙ্গার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফজরের আজান হল।
‘দ্বিতীয়বারও স্বপ্নে মােটা গলার লােকটি কথা বলল ?” ‘জ্বি।
লােকমান ফকির রুমালে কপালের ঘাম মুছতে লাগলাে। সে অসম্ভব ঘামছে। আমি বললাম, পানি খাবে? পানি এনে দেব?
“জ্বি স্যার দিন। | আমি পানি এনে দিলাম সে এক নিঃশ্বাসে পানি শেষ করে ফেলল। আমি বললাম স্বপ্ন ভাঙ্গার পর তুমি দেখলে তােমার দুটি পা–ই ব্লেডে কেটে ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেছে – তাই না?
ভয় (শেষ-পর্ব)-হুমায়ূন আহমেদ
লােকমান হতভম্ব হয়ে বললাে, জি স্যার। আপনি কি করে বুঝলেন? | ‘তুমি খুড়িয়ে খুড়িয়ে ঘরে ঢুকলে সেখান থেকে অনুমান করেছি। তাছাড়া তােমার পা স্বপ্ন দেখার পর কেটে যাচ্ছে বলেই স্বপ্নটা ভয়ংকর। পা যদি না কাটতাে তাহলে
স্বপ্নটা ভয়ংকর হত না বরং একটা মধুর স্বপ্ন হত। কারণ স্বপ্নে একটি মেয়ের সঙ্গে তােমার দেখা হচ্ছে যে তােমার গা ঘেসে দাড়িয়ে আছে। আঠারাে উনিশ বছরের রূপবতী একটি মেয়ে, হাত ধরে তােমার সঙ্গে দৌড়াচ্ছে।
আমার কথার মাঝখানেই লােকমান ফকির পায়ের জুতা খুলে ফেললাে, মােজা খুলল, আমি হতভম্ব হয়ে দেখলাম পায়ের তলা ফালা ফালা করে কাটা। এমন কিছু সত্যি সত্যি ঘটতে পারে আমি ভাবি নি।।
লােকমান ক্ষীণ গলায় বলল, এটা কি করে হয় স্যার?
‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে স্বপ্নের ব্যাপারে পড়াশােনা যা করেছি তার থেকে তােমাকে একটা কথা বলতে পারি – Invert reaction বলে একটা ব্যাপার। আছে। ধর তােমার একটা আঙুল পুড়ে গেল সেই খবর স্নায়ুর মাধ্যমে যখন তােমার মস্তিষ্কে পৌছবে তখন তুমি তীব্র ব্যথা পাবে। Invert reaction এ কি হয় জান? আগে মস্তিস্কে আঙুল পােড়ার অনুভূতি পায় তারপর সেই খবর আঙুলে পৌছে – । তখন আঙুলটি পােড়া পােড়া হয়ে যেতে পারে। স্বপ্নের পুরাে ব্যাপারটা হয় মস্তিস্কে। সেখান থেকে Invert reaction এ শরীরে তার প্রভাব পড়তে পারে।
ভয় (শেষ-পর্ব)-হুমায়ূন আহমেদ
এক লোেক স্বপ্নে দেখতাে তার হাতে কে যেন পিন ফুটাচ্ছে। ঘুম ভাঙ্গার পর তার হাতে সত্যি সত্যি পিন ফোটার দাগ দেখা যেত। তােমার ক্ষেত্রেও হয়ত তাই ঘটেছে। তবে এমন ভয়াবহ ভাবে পা কাটা Invert reaction এ সম্ভব বলে আমার মনে হয়না।
তাহলে কি? “আমি বুঝতে পারছি না।
লােকমান ক্লান্তু স্বরে বলল, এক মাস পর পর আমি স্বপ্নটা দেখি। কারণ পায়ের ঘা শুকাতে এক মাস লাগে।
আমি, লােকমান ফকিরের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম, তুমি এখন থেকে একটা কাজ করবে – ঘুমুতে যাবে জুতা পায়ে দিয়ে। স্বপ্নে যদি তােমাকে দৌড়াতেও হয় – তােমার পায়ে থাকবে জুতা। ব্রড তােমাকে কিছু করতে পারবে না।
‘সত্যি বলছেন? ‘আমার তাই ধারণা। আমার মনে হচ্ছে জুতা পরে ঘুমুলে তুমি স্বপ্নটাই আর দেখবে না।
লােকমান ফকির চলে গেল। খুব ভরসা পেল বলে মনে হল না। আমি তাকে বলে দিয়েছিলাম এক মাস পর স্বপ্ন দেখা হয়ে গেলে সে যেন আসে। সে এল দেড় মাস পর।
তার মুখ আগের চেয়েও শুকনাে চোখ ভাবলেশহীন। অথর্ব মানুষের মত হাটছে। আমি বললাম, স্বপ্ন দেখেছাে?”
‘জিনা। ‘জুতা পায়ে ঘুমুচ্ছাে?” “জ্বি স্যার। জুতা পায়ে দেয়ার জন্যেই স্বপ্ন দেখছিনা।
আমি হাসিমুখে বললাম। তাহলেতাে তােমার রােগ সেরে গেল। এত মন খারাপ কেন? মনে হচ্ছে বিরাট সমস্যায় পড়েছে। সমস্যাটা কি?
লােকমান নীচু গলায় বলল, মেয়েটার জন্যে মন খারাপ স্যার। বেচারী একা একা স্বপ্ন দেখছে। এত ভাল একটা মেয়ে কষ্ট করছে। আমি সঙ্গে থাকলে সে একটু ভরসা পায়। নিজের জন্যে কিছু না। মেয়েটার জন্যে খুব কষ্ট হয়।
লােকমানের চোখে প্রায় পানি এসে গেল। আমি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম। সে বলেকি?
‘স্যার আমি ঠিক করেছি। জুতা পরবনা। যা হবার হবে। নারগিসকে একা একা যেতে দেব না। আমি থাকব সঙ্গে। মেয়েটার জন্যে আমার খুব কষ্ট হয় স্যার। এত চমৎকার একটা মেয়ে। আমি স্যার থাকব তার সঙ্গে।
ভয় (শেষ-পর্ব)-হুমায়ূন আহমেদ
‘সেটা কি ভাল হবে?” ‘জ্বি স্যার হবে। আমি তাকে ছাড়া বাচব না।” “সে কিন্তু স্বপ্নের একটি মেয়ে।
‘সে স্বপ্নের মেয়ে নয়। আমি যেমন, সেও তেমন। আমরা দুজন এই পৃথিবীতেই বাস করি। সে হয়ত ঢাকাতেই কোন এক বাসায় থাকে। তার পায়ে ব্লেডের কাটা। আমি যেমন সারাক্ষণ তার কথা ভাবি সেও নিশ্চয়ই ভাবে। শুধু আমাদের দেখা হয় স্বপ্নে।
মিসির আলি সিগারেট ধরিয়ে বললেন, গল্পটি এই পর্যন্তই। আমি চেঁচিয়ে বললাম, এই পর্যন্ত মানে? শেষটা কি? ‘শেষটা আমি জানি না। ছেলেটি ক্ষত বিক্ষত পা নিয়ে একবার এসেছিল। সে বলল, জুতা খুলে ঘুমানাে মাত্রই সে আবার স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে মেয়েটির দেখা পায়।
তারা দুজন খানিকক্ষণ গল্প করে। দুজন, দু’জনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। এক সময় – মানুষের মত জন্তুগুলি চেঁচিয়ে বলে – দৌড়াও, দৌড়াও। তারা দৌড়াতে শুরু করে।
‘ছেলেটি আপনার কাছে আর আসে নি?” ‘জি–না।” ‘ছেলেটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপনি কি কিছু জানেন?
না জানি না। তবে অনুমান করতে পারি। ছেলেটি জানে জুতাে পায়ে ঘুমুলে এই দুঃস্বপ্ন সে দেখবে না তারপরেও জুতাে পায়ে দেয় না। কারণ মেয়েটিকে একা ছেড়ে দেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রেমের ক্ষমতা যে কি প্রচণ্ড হতে পারে প্রেমে না পড়লে তা বুঝা যায় না। ছেলেটির পক্ষে এই জীবনে তার স্বপ্ন সঙ্গিনীর মায়া কাটানাে সম্ভব ।
ভয় (শেষ-পর্ব)-হুমায়ূন আহমেদ
সে বাকি জীবনে কখনাে জুতা পায়ে ঘুমুবে না। সে আসলে দুঃস্বপ্নের হাত থেকে মুক্তি চায় না। দুঃস্বপ্ন হলেও এটি সেই সঙ্গে তার জীবনের মধুরতম স্বপ্ন। | ‘আপনার কি ধারণা নারগিস নামের কোন মেয়ে এই পৃথিবীতে সত্যি সত্যি আছে?”
মিসির আলি নীচু গলায় বললেন, আমি জানি না। রহস্যময় এই পৃথিবীর খুব কম রহস্যের সন্ধানই আমি জানি। তবে মাঝে মাঝে আমারাে কেন জানি এই মেয়েটির হাত ধরে একবার দৌড়াতে ইচ্ছা করে। আরেক দফা চা হবে? পানি কি গরম করব?