মধ্যাহ্ন-পর্ব-(১২)-হুমায়ূন আহমেদ

মধ্যাহ্ন

বাজারের একমাত্র স্বর্ণকারের দোকানের মালিক শ্রীধর বলল, এর মধ্যে সােনা বলতে কিছু নাইসবই ক্ষয়া গেছে

মধ্যাহ্নধনু শেখ বলল, কর্তা! না খায়া আছিস্ত্রীর সন্তান হবে। 

শ্রী ধর বলল, তােমার সাথে বাণিজ্য করব নাতুমি জাত নিয়া অন্দ মন্দ কথা বলােতােমার সাথে বাণিজ্য করলে শ্রী গণেশ বেজার হবেনদোকান লাটে আমিও তােমার মতাে না খায়া থাকব। 

বন্দক রাইখা কিছু দেন।। বন্দক রাখতে হয় ভগবানের নামে, তােমার আবার ভগবান কী ? ধনু শেখ বলল, তাও তাে কথা। 

ভাদ্র মাসের একদিন ধনু শেখকে সত্যি সত্যি উপাসে যেতে হলােসারাদিনে দুই মুঠ চিড়া ছাড়া খাওয়ার নেইতাও ভালাে কমলা খেতে পেরেছেচাল যা ছিল তাতে একজনের মতাে ভাত হয়েছেফ্যান ভাতে লবণ ছিটিয়ে কমলা এত আগ্রহ করে খেল যে ধনু শেখের চোখে পানি এসে গেলসে গম্ভীর গলায় বলল, বউ, একটা জটিল সিদ্ধান্ত নিয়েছি

কমলা আগ্রহ নিয়ে বলল, কী সিদ্ধান্ত ? ডাকাতি করব ডাকাতি বিনা পথ নাই । 

কমলা হাসতে শুরু করেই হাসি বন্ধ করে ফেলল ধনু শেখের মুখ গম্ভীরচোখ জ্বল জ্বল করছে। 

ডাকাতি করবেন

ডাকাইতের দল থাকেআপনের দল কই ? দল লাগে নাকমলা বলল, আমার সন্তানের কসম দিয়া একটা কথা বলিধনু শেখ কিছু বলল নাআপনি সত্যই ডাকাতি করবেন ? হুঁএই সময় ঘাট থেকে কেউ একজন ডাকল, এটা কি ধনু শেখের নাও

মধ্যাহ্ন-পর্ব-(১২)-হুমায়ূন আহমেদ

ধনু নৌকা থেকে বের হয়ে দেখে হরিচরণ পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেনধনু বলল, বাবু আদাব।  

আদাবতােমার সঙ্গে গল্প করার জন্যে আসছিনায়ে উঠি

উঠেনআমার সাথে কী গফ করবেন ? আমি একজন ছলুজুতার শুকতলি। 

হরিচরণ নৌকায় উঠলেনধনু শেখ পাটাতনে গামছা বিছিয়ে দিলহরিচরণ বসতে বসতে বললেন, কুকুরের বাচ্চা এবং মানুষের বাচ্চা নিয়া তুমি যে এক মীমাংসা দিয়েছ, মীমাংসাটা আমার মনে লেগেছে। 

মীমাংসার উত্তর কি আপনের কাছে আছে ? আছেবলেন শুনি। 

হরিচরণ বললেন, মানুষের তুলনা মানুষের সাথে হবেঅন্য কোনাে প্রাণীর সঙ্গে হবে নাএকটা মন্দ মানুষের সঙ্গে অন্য একটা মন্দ মানুষের বিবেচনা হবেকোনাে মন্দ প্রাণীর সঙ্গে হবে নাবুঝেছ

বােঝার চেষ্টা নিতেছিহরিচরণ বললেন, আরাে একটা কথা আছেবলেন শুনি। 

মানুষের তুলনায় পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী তুচ্ছের তুচ্ছের তুচ্ছধুলিকনার চেয়েও তুচ্ছধুলিকনা গায়ে তুললেও কিছু না, গা থেকে ফেলে দিলেও কিছু। 

ধনু বলল, আপনি জ্ঞানী মানুষজ্ঞানী মানুষের জ্ঞানী কথাআমি তুচ্ছ, তুচ্ছের কথাও তুচ্ছ। 

শুনেছি তুমি দুদর্শায় পড়েছতােমার চাকরি চলে গেছেআমার কাছ থেকে সাহায্য নিবে

ধনু বলল, কী সাহায্য করবেন ? কী ধরনের সাহায্য তুমি চাও

ধনু বিরক্ত গলায় বলল, পারলে একটা লঞ্চ কিন্যা দেনসােহাগগঞ্জ নারায়ণগঞ্জ রুটে চলবেলঞ্চের নাম এমএল কমলা। 

কমলা কে ? আমার পরিবারের নাম। 

হরিচরণ বললেন, আমি তােমাকে লঞ্চ কিনে দিবতুমি লঞ্চ ব্যবসার সঙ্গে অনেকদিন ছিলেএই ব্যবসা তুমি জানাে তােমার বুদ্ধি আছেচিন্তাশক্তি আছেতুমি পারবেআমি ব্যবসায়ী মানুষনা বুঝে কিছু করি না। 

মধ্যাহ্ন-পর্ব-(১২)-হুমায়ূন আহমেদ

হতভম্ব ধনু শেখ বলল, সত্যি লঞ্চ কিনে দিবেন ? হ্যালা ইলাহা ইল্লালাহুএইগুলা কী বলেন

পর্দার আড়াল থেকে কমলা মুখ বের করেছেসে মনের উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছে নাহরিচরণ বললেন, মা, ভালাে আছাে

কমলা হাসূচক মাথা নাড়লতার মুখে কথা আটকে গেছে। 

ধনু শেখ বলল, আমার কেমন জানি লাগতেছেশরীর দিয়া গরম ভাপ বাইর হইতেছেআপনে কিছু মনে নিবেন নাআমি নদীতে একটা ঝাপ দিব। 

ধনু শেখ ঝাঁপ দিয়ে নদীতে পড়ে গেল। 

জমিদার বাবু শশাংক পাল পরের বছরের সদর জমা দিতে পারলেন নাতার জমিদারি বসতবাটিসহ নিলামে উঠলহরিচরণ সাহা নগদ অর্থে সেই জমিদারি কিনে নিলেন। 

এক সন্ধ্যায় দুটা হাতি নিয়ে কালু মিয়া হরিচরণের বাড়িতে উপস্থিত হলােহরিচরণ বললেন, কালু, ভালাে আছ

কালু মিয়া বলল, কর্তা, আপনে আপনের বেটির কাছে গিয়া দাড়ানদেখেন আপনের বেটি আপনেরে মনে রেখেছে। 

হরিচরণ হাতির পাশে দাঁড়াতেই হাতি তার ঘাড়ে শুড় তুলে দিলহরিচরণের চোখ ভিজে উঠল। 

এই অঞ্চলের প্রথম স্কুল (পরে কলেজ) হলাে জমিদার বাবু শশাংক পালের বসত বাড়িহরিচরণের নাম হলাে ঋষি হরিচরণতিনি তার জীবনযাত্রা পদ্ধতিও সম্পূর্ণ বদলে ফেললেনএকবেলা স্বপাক নিরামিষ আহার সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত পূজার ঘরে চোখ বন্ধ করে আসনবিলাস তার জীবনে আগেও ছিল না, এখন আরাে কমলতবে নতুন ধরনের একটা বিলাস যুক্ত হলােতিনি হাতির পিঠে চড়ে সপ্তাহে একদিন মনার হাওর পর্যন্ত বেড়াতে যাওয়া শুরু করলেন। 

মধ্যাহ্ন-পর্ব-(১২)-হুমায়ূন আহমেদ

হাতি হেলতে দুলতে তাকে নিয়ে যায়মনার হাওরের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়ঘণ্টাখানিক চুপচাপ দাড়িয়ে থেকে আবার ফিরে আসে। 

জমিদারি কেনার কিছুদিনের মধ্যে ন্যায়রত্ন রামনিধি হরিচরণের সঙ্গে দেখা করতে এলেনতিনি হরিচরণকে বললেন, আপনার জন্যে সুসংবাদ আছেবিরাট সুসংবাদ আমি গয়াতে বিশেষ কাজে গিয়েছিলামদিকপাল এক বেদান্তকারের কাছ থেকে বিধান নিয়ে এসেছি। 

হরিচরণ বললেন, কী বিধান ? আমি আবার জাতে উঠতে পারব

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *