বাজারের একমাত্র স্বর্ণকারের দোকানের মালিক শ্রীধর বলল, এর মধ্যে সােনা বলতে কিছু নাই। সবই ক্ষয়া গেছে।
ধনু শেখ বলল, কর্তা! না খায়া আছি। স্ত্রীর সন্তান হবে।
শ্রী ধর বলল, তােমার সাথে বাণিজ্য করব না। তুমি জাত নিয়া অন্দ মন্দ কথা বলাে। তােমার সাথে বাণিজ্য করলে শ্রী গণেশ বেজার হবেন। দোকান লাটে উঠব । আমিও তােমার মতাে না খায়া থাকব।
বন্দক রাইখা কিছু দেন।। বন্দক রাখতে হয় ভগবানের নামে, তােমার আবার ভগবান কী ? ধনু শেখ বলল, তাও তাে কথা।
ভাদ্র মাসের একদিন ধনু শেখকে সত্যি সত্যি উপাসে যেতে হলাে। সারাদিনে দুই মুঠ চিড়া ছাড়া খাওয়ার নেই। তাও ভালাে কমলা খেতে পেরেছে। চাল যা ছিল তাতে একজনের মতাে ভাত হয়েছে। ফ্যান ভাতে লবণ ছিটিয়ে কমলা এত আগ্রহ করে খেল যে ধনু শেখের চোখে পানি এসে গেল। সে গম্ভীর গলায় বলল, বউ, একটা জটিল সিদ্ধান্ত নিয়েছি ?
কমলা আগ্রহ নিয়ে বলল, কী সিদ্ধান্ত ? ডাকাতি করব । ডাকাতি বিনা পথ নাই ।
কমলা হাসতে শুরু করেই হাসি বন্ধ করে ফেলল । ধনু শেখের মুখ গম্ভীর। চোখ জ্বল জ্বল করছে।
ডাকাতি করবেন ?
ডাকাইতের দল থাকে। আপনের দল কই ? দল লাগে না। কমলা বলল, আমার সন্তানের কসম দিয়া একটা কথা বলি। ধনু শেখ কিছু বলল না। আপনি সত্যই ডাকাতি করবেন ? হুঁ। এই সময় ঘাট থেকে কেউ একজন ডাকল, এটা কি ধনু শেখের নাও ?
মধ্যাহ্ন-পর্ব-(১২)-হুমায়ূন আহমেদ
ধনু নৌকা থেকে বের হয়ে দেখে হরিচরণ পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ধনু বলল, বাবু আদাব।
আদাব। তােমার সঙ্গে গল্প করার জন্যে আসছি। নায়ে উঠি ?
উঠেন। আমার সাথে কী গফ করবেন ? আমি একজন ছলু। জুতার শুকতলি।
হরিচরণ নৌকায় উঠলেন। ধনু শেখ পাটাতনে গামছা বিছিয়ে দিল। হরিচরণ বসতে বসতে বললেন, কুকুরের বাচ্চা এবং মানুষের বাচ্চা নিয়া তুমি যে এক মীমাংসা দিয়েছ, মীমাংসাটা আমার মনে লেগেছে।
মীমাংসার উত্তর কি আপনের কাছে আছে ? আছে। বলেন শুনি।
হরিচরণ বললেন, মানুষের তুলনা মানুষের সাথে হবে। অন্য কোনাে প্রাণীর সঙ্গে হবে না। একটা মন্দ মানুষের সঙ্গে অন্য একটা মন্দ মানুষের বিবেচনা হবে। কোনাে মন্দ প্রাণীর সঙ্গে হবে না। বুঝেছ ?
বােঝার চেষ্টা নিতেছি। হরিচরণ বললেন, আরাে একটা কথা আছে। বলেন শুনি।
মানুষের তুলনায় পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী তুচ্ছের তুচ্ছের তুচ্ছ। ধুলিকনার চেয়েও তুচ্ছ। ধুলিকনা গায়ে তুললেও কিছু না, গা থেকে ফেলে দিলেও কিছু।
ধনু বলল, আপনি জ্ঞানী মানুষ। জ্ঞানী মানুষের জ্ঞানী কথা। আমি তুচ্ছ, তুচ্ছের কথাও তুচ্ছ।
শুনেছি তুমি দুদর্শায় পড়েছ। তােমার চাকরি চলে গেছে। আমার কাছ থেকে সাহায্য নিবে ?
ধনু বলল, কী সাহায্য করবেন ? কী ধরনের সাহায্য তুমি চাও?
ধনু বিরক্ত গলায় বলল, পারলে একটা লঞ্চ কিন্যা দেন। সােহাগগঞ্জ নারায়ণগঞ্জ রুটে চলবে। লঞ্চের নাম এমএল কমলা।
কমলা কে ? আমার পরিবারের নাম।
হরিচরণ বললেন, আমি তােমাকে লঞ্চ কিনে দিব। তুমি লঞ্চ ব্যবসার সঙ্গে অনেকদিন ছিলে। এই ব্যবসা তুমি জানাে । তােমার বুদ্ধি আছে। চিন্তাশক্তি আছে। তুমি পারবে। আমি ব্যবসায়ী মানুষ। না বুঝে কিছু করি না।
মধ্যাহ্ন-পর্ব-(১২)-হুমায়ূন আহমেদ
হতভম্ব ধনু শেখ বলল, সত্যি লঞ্চ কিনে দিবেন ? হ্যা। লা ইলাহা ইল্লালাহু। এইগুলা কী বলেন?
পর্দার আড়াল থেকে কমলা মুখ বের করেছে। সে মনের উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছে না। হরিচরণ বললেন, মা, ভালাে আছাে ?
কমলা হা–সূচক মাথা নাড়ল। তার মুখে কথা আটকে গেছে।
ধনু শেখ বলল, আমার কেমন জানি লাগতেছে। শরীর দিয়া গরম ভাপ বাইর হইতেছে। আপনে কিছু মনে নিবেন না। আমি নদীতে একটা ঝাপ দিব।
ধনু শেখ ঝাঁপ দিয়ে নদীতে পড়ে গেল।
জমিদার বাবু শশাংক পাল পরের বছরের সদর জমা দিতে পারলেন না। তার জমিদারি বসতবাটিসহ নিলামে উঠল। হরিচরণ সাহা নগদ অর্থে সেই জমিদারি কিনে নিলেন।
এক সন্ধ্যায় দু’টা হাতি নিয়ে কালু মিয়া হরিচরণের বাড়িতে উপস্থিত হলাে। হরিচরণ বললেন, কালু, ভালাে আছ ?
কালু মিয়া বলল, কর্তা, আপনে আপনের বেটির কাছে গিয়া দাড়ান। দেখেন আপনের বেটি আপনেরে মনে রেখেছে।
হরিচরণ হাতির পাশে দাঁড়াতেই হাতি তার ঘাড়ে শুড় তুলে দিল। হরিচরণের চোখ ভিজে উঠল।
এই অঞ্চলের প্রথম স্কুল (পরে কলেজ) হলাে জমিদার বাবু শশাংক পালের বসত বাড়ি। হরিচরণের নাম হলাে ঋষি হরিচরণ। তিনি তার জীবনযাত্রা পদ্ধতিও সম্পূর্ণ বদলে ফেললেন। একবেলা স্বপাক নিরামিষ আহার । সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত পূজার ঘরে চোখ বন্ধ করে আসন। বিলাস তার জীবনে আগেও ছিল না, এখন আরাে কমল। তবে নতুন ধরনের একটা বিলাস যুক্ত হলাে। তিনি হাতির পিঠে চড়ে সপ্তাহে একদিন মনার হাওর পর্যন্ত বেড়াতে যাওয়া শুরু করলেন।
মধ্যাহ্ন-পর্ব-(১২)-হুমায়ূন আহমেদ
হাতি হেলতে দুলতে তাকে নিয়ে যায়। মনার হাওরের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়। ঘণ্টাখানিক চুপচাপ দাড়িয়ে থেকে আবার ফিরে আসে।
জমিদারি কেনার কিছুদিনের মধ্যে ন্যায়রত্ন রামনিধি হরিচরণের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তিনি হরিচরণকে বললেন, আপনার জন্যে সুসংবাদ আছে। বিরাট সুসংবাদ । আমি গয়াতে বিশেষ কাজে গিয়েছিলাম। দিকপাল এক বেদান্তকারের কাছ থেকে বিধান নিয়ে এসেছি।
হরিচরণ বললেন, কী বিধান ? আমি আবার জাতে উঠতে পারব ?