মধ্যাহ্ন-পর্ব-(১)-হুমায়ূন আহমেদ

মধ্যাহ্ন

আমার সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা তার নিজের লেখালেখির একটা নাম দিয়েছেআবজাবসে যালেখে তানাকি আবজাব! আমি আমার লেখার আলাদা কোনাে নাম দিতে পারলে খুশি হতামযেমন খুশি সাজোমতাে যেমন খুশি লেখাআমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সেরকমই আমি লিখি নিজের খুশিতে

আমার লেখায় সমাজ, রাজনীতি, কাল, মহান বােধ (!) এইসব অতি প্রয়ােজনীয় (?) বিষয়গুলি এসেছে কি আসে নি তা নিয়ে কখনাে মাথা ঘামাই নিইদানীং মনে হয় আমার কোনাে সমস্যা হয়েছেহয়তােবা ব্রেনের কোথাও শর্ট সার্কিট হয়েছেযেকোনাে লেখায় হাত দিলেই মনে হয় চেষ্টা করে দেখি সময়টাকে ধরা যায় কিনামধ্যাহ্নেও একই ব্যাপার হয়েছে১৯০৫ সনে কাহিনী শুরু করে এগুতে চেষ্টা করেছিপাঠকরা চমকে উঠবেন নাআমি ইতিহাসের বই লিখছি নাগল্পকার হিসেবে গল্পই বলছিতারপরেও … 

মধ্যাহ্ন-পর্ব-(১)-হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ নুহাশ পল্লী, গাজীপুর 

হরিচরণ সাহা তাঁর পাকাবাড়ির পেছনে পুকুরঘাটে বসে আছেন। 

তাঁর বয়স পঞ্চাশশরীর শক্তগড়পড়তা মানুষের তুলনায় বেশ লম্বা বলেই হাঁটার সময় কিংবা বসে থাকার সময় ঝুঁকে বসেনতাঁকে তখন ধনুকের মতাে দেখায়তাঁর মাথাভর্তি ধবধবে শাদা চুলহঠাৎ হঠাৎ তিনি চুলে কলপ দেন, তখন তাকে যুবাপুরুষের মতাে দেখায়তার পরনে শান্তি পুরী ধুতিগরমের কারণে ধুতি লুঙ্গির মতাে পরেছেনখালি গাতাঁর গাত্রবর্ণ শ্যামলাআজ কোনাে এক বিচিত্র কারণে তাকে ফর্সা দেখাচ্ছে। 

সকাল দশটার মতাে বাজেএই সময়ে হরিচরণ সােহাগগঞ্জ বাজারে তার পাটের আড়তে বসেনবাজারে তাঁর তিনটা ঘর আছেপাটের আড়তের ঘর তুলনামূলকভাবে ছােটএই ঘরের গদিতে বসতেই তাঁর ভালাে লাগেএখান থেকে নদীর একটা অংশ দেখা যায়। নদীর নাম বড়গাঙ ! বর্ষায় এই নদী কানায় কানায় পূর্ণ থাকেবড় বড় লঞ্চও নিয়মিত আনাগােনা করেতারা কারণে অকারণে ভেবাজায়সেই শব্দ শুনতেও তাঁর ভালাে লাগেআজ বাজারে যাচ্ছেন না, কারণ তার মন সামান্য বিক্ষিপ্তপুকুরঘাটে কিছুক্ষণ বসে থাকলে মন শান্ত হবেএই আশায় তিনি বসে আছেনঘাট বাঁধানাে

তিনি নিজেই গৌরীপুর থেকে কারিগর এনে ঘাট বাঁধিয়েছেনকারিগরের কাজ তার পছন্দ হয়েছেঘাটের ধাপ সে যথেষ্ট পরিমাণে চওড়া করেছেভাদ্রমাসের গরমে অতিষ্ঠ হলে তিনি এই ঘাটে এসে শুয়ে থাকেনঠাণ্ডা পাথরের স্পর্শ বড় ভালাে লাগেপাথরের গা থেকে এক ধরনের গন্ধ এসে তার নাকে লাগেপাথরের কোনাে গন্ধ থাকে না, কিন্তু এই গন্ধ কীভাবে আসে? বিষয়টা নিয়ে তিনি মাঝে মাঝে চিন্তাও করেন

মধ্যাহ্ন-পর্ব-(১)-হুমায়ূন আহমেদ 

এখন আষাঢ় মাসের শুরুগতরাতে বিরামহীন বৃষ্টি পড়েছে বলে আজ আবহাওয়া শীতলআষাঢ় মাসের কড়া রােদ অবশ্যি আছেসেই রােদ তাকে স্পর্শ করছে নাঘাটের সঙ্গে লাগােয়া বাদাম গাছ তাকে ছায়া দিয়ে আছেএই গাছের পাতা কাঠগােলাপের পাতার মতাে ছায়াদায়িনী। 

হরিচরণের মনের বিক্ষিপ্ত ভাব কমল না, বরং বাড়ল এই সঙ্গে তার সামান্য শ্বাসকষ্ট শুরু হলােশ্বাসকষ্টের উপসর্গ কিছুদিন হলাে শুরু হয়েছেমনমেজাজ ঠিক না থাকলেই শ্বাসকষ্ট হয়ঘুমের অসুবিধা হলে শ্বাসকষ্ট হয় কালরাতে তার ঘুমের কোনাে অসুবিধা হয় নিসারারাত টিনের চালে বৃষ্টি পড়েছেশীত শীত ভাব ছিলতিনি পাতলা সুজনি দিয়ে নিজেকে ঢেকে রেখে সুখন্দ্রিায় গেছেনতবে ঘুমের কোনাে এক পর্যায়ে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছেনস্বপ্নটাই তার মন বিক্ষিপ্ত হবার একমাত্র কারণ| স্বপ্নে তিনি চারপাঁচ বছর বয়সি একটি শিশুকে কোলে নিয়ে ঘুরছেনশিশুর মাথায় সােনার মুকুটতার গাত্রবর্ণ ঘন নীল স্বপ্নে তার কাছে মনে হলাে, শিশুটি তারই সন্তানআবার এও মনে হলাে, এই শিশু শ্রীকৃষ্ণতার নিজের সন্তান শ্রীকৃষ্ণ হতে পারে না স্বপ্নে এটা মনে হলাে নাকোলের শিশুটি একসময় বলল, ব্যথা

মধ্যাহ্ন-পর্ব-(১)-হুমায়ূন আহমেদ

তিনি বললেন, কোথায় ব্যথা ? সে তার হাত দেখালহাতটা কনুইয়ের কাছে কাটা, সেখান থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছেরক্তের রঙও নীলতিনি রক্ত বন্ধ করার জন্যে খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়লেনতখন ঘুম ভাঙলতার বিস্ময়ের সীমা রইল নাহরিচরণের কোনাে ছেলেমেয়ে নেই প্রথম যৌবনে একটা মেয়ে হয়েছিলতিন বছর বয়সে মেয়েটা দিঘিতে ডুবে মারা যায়পুরােহিতের কী এক বিধানে মেয়েটাকে দাহ করা হয় নিমুসলমানদের মতাে কবর দেয়া হয়েছেযেখানে কবর দেয়া হয়েছে সেখানে তিনি একটা শিউলি গাছ লাগিয়েছিলেনসেই গাছ আজ এক মহীরুহএই অঞ্চলে এত বড় শিউলি গাছ আছে বলে তিনি জানেন নাতাঁর মেয়ের নামও ছিল শিউলিএই গাছ বৎসরের পর বৎসর হলুদ বোঁটার শাদা ফুল ফুটিয়েই যাচ্ছে। 

প্রথম সন্তানের মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন কোনাে সন্তানাদি না হওয়ায় তিনি আরেকটি বিবাহ করেনসেই ঘরেও কোনাে সন্তান হয় নিহরিচরণের দুই স্ত্রীই গত হয়েছেনতার বিশাল পাকাবাড়ি এখন শূন্যপাকাবাড়িতে তিনি এখন বাসও করেন নাপাকাবাড়ির দক্ষিণে টিনের দোচালা বানিয়েছেনটিনের ঘর রাতে দ্রুত শীতল হয়, ঘুমাতে আরামবর্ষায় টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ হয়সেই শব্দ তার কানে আরাম দেয়। 

মধ্যাহ্ন-পর্ব-(১)-হুমায়ূন আহমেদ

অম্বিকা ভট্টাচার্যকে আসতে দেখা যাচ্ছে। হরিচরণ স্বপ্ন বিষয়ে তার সঙ্গে আলাপ করতে চান বলে খবর দিয়েছেনঅম্বিকা ভট্টাচার্য এই অঞ্চলের একমাত্র ব্রাহ্মণশাস্ত্র জানেনপূজাপাঠ করেনতাঁর বয়স হরিচরণের চেয়ে কম হলেও তিনি বুড়িয়ে গেছেনশরীর থলথলে হয়েছেহাঁটেন কুঁজো হয়ে লাঠিতে ভর 

দিয়েতার বাড়ি হরিচরণের বাড়ি থেকে খুব দূরে না, দশবারাে মিনিটের পথএই পথ পাড়ি দিয়েই তিনি ক্লান্তঘাটের পাশে তার জন্যে রাখা কাঠের চেয়ারে বসতে বসতে তিনি বললেন, আগে জল খাওয়াও, তারপর কথা । 

জলের সঙ্গে কিছু মিষ্টান্ন দিব ? ………অবশ্যইমিষ্টান্ন বিনা জলপান নিষেধ, জানাে না ? সামান্য গুড় হলেও মুখে দিতে হয়তবে ফল নাস্তিজলপানের পরে ফল খাওয়া যাবে না। 

 

মধ্যাহ্ন-পর্ব-(২)-হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *