মাংস-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

মাংস-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সকালবেলায় মেঘ ছিল, তাতে বাচ্চাদের মন খারাপ। আজ যেন বৃষ্টি না হয়, আজ যেন বৃষ্টি না হয়! তবু সেই কালো মেঘ যেন ঝুঁকে এল শ্মশানতলায় বড় বটগাছটার মাথায়।

গ্রামের নাম ছোট সাতুড়ি। বিভুপদ গড়াইয়ের দু-খানা খড়ের ঘর, সামনে একচিলতে উঠোন। সেই উঠোনে দাঁড়িয়ে তিনটে ছেলেমেয়ে, তারা আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘ তাড়াতে চাইছে। লেবুপাতা করমচা, দূরের বৃষ্টি দূরে যা! লেবুপাতা করমচা, দূরের বৃষ্টি দূরে যা!


মেঘ সেই শিশুদের কথা শোনে। তবে এত কাছে এসে কিছুটা বর্ষণ না হলে মেঘেরও তো মান থাকে না।

প্রথমে ছিল গুমোট হঠাৎ হাওয়া উঠল শনশনিয়ে, বড়-বড় ডালপালা উথালপাতাল। তারপর গুরু-গুরু গর্জন বলল, আসছি। এল একেবারে বড়-বড় ফোঁটায় ঝমঝমিয়ে। বড়জোর মিনিটদশেক, আবার আকাশ একেবারে ফরসা। ঝলমলিয়ে দেখা দিল সূর্য। ঠিক যেন হাসছে। হাসবেই তো, মাত্র মাসদুয়েক আগেই ছিল বৃষ্টির জন্য কত হাহাকার কত প্রার্থনা কত ব্যাং মেরে উলটে দেওয়া, আর এর মধ্যেই আবার বলে কি না, বৃষ্টি চাই না। মানুষ বড় বিচিত্র।

ও মেঘ আবার ফিরে আসবে, এখন শুধু এই বাচ্চাদের আবেদনে সরে গেল কিছুটা দূরে। আজ ওরা বেড়াতে যাবে। রাস্তাঘাট এমনিই থিকথিকে কাদা, বৃষ্টি চলতেই এখন বেরবার প্রশ্নই ছিল না। বাচ্চারা আর ধৈর্য ধরতে পারছে না।

বিভুপদ দাঁড়িয়ে আছে বাইরে, সুরবালার একটু দেরি হচ্ছে। বিভুপদ একবার হাঁক দিল, কই রে, আর দেরি করলে…বেলাবেলি পৌঁছাতে হবে তো।

মেয়েটাও চেঁচিয়ে বললে,, আয়। মা, আয় মেয়েটার বয়েস সাত, ভাই দুটোর একটা নয়, একটা ছয়। একেবারে ছোটটাকে নেড়া করা হয়েছে কিছুদিন আগে, খুব উকুন হয়েছিল।

হাতে একটা পুঁটুলি নিয়ে বড় ঘরখানি থেকে বেরিয়ে এল সুরবালা, দরজায় শেকল তুলে একটা ছোট তালাও লাগাল।

সুরবালার বয়েস তিরিশের এধারে-ওধারে, ঢ্যাঙা চেহারা, অদ্ভুত নিথর ধরনের মুখ, সে মুখে রাগ, দুঃখ-আনন্দ, অভিসার কিছুই যেন ফোটে না।

চাবিটা বিভুপদকে দিয়ে সে বলল, তাহলে চলা করো।

একটু আগে পত্নীকে সে তাড়া দিচ্ছিল, এবার সে চাবিটা হাতে নিয়ে একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে জিগ্যেস করলে, সত্যি যাবি?

সুরবালা বলল, হ্যাঁ, যাব ঠিক করিছি।

বিভু আবার জিগ্যেস করল, ছেলেমেয়েদের নিয়ে যাওয়া।


সুরবালা বলল, হ্যাঁ, চলুক ওরা। তিনটি বাচ্চাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, আমরা যাব, আমরা যাব!

ঠিক পাশাপাশি আর কোনও ঘরবাড়ি নেই। গ্রামের প্রান্তসীমায় খালপাড়ের জমিতে ছড়ানো ছিটানো কয়েক ঘর বসতি।

সোজা রাস্তাটা শ্মশানতলার দিকে। ছেলেমেয়ে তিনটে দিনের বেলাতেও এখান দিয়ে যেতে ভয় পায়। মানুষের হাড়-গোড় এদিক-সেদিক পড়ে থাকে। কাঠ কেনার পয়সার অভাবে যারা পুরো লাশ পোড়াতে পারে না, তারা শুধু মুখে আগুন দিয়ে ফেলে রেখে যায়, তারপর তাই নিয়ে ভোজ হয় শেয়াল-শকুনের।

আজ বাবা-মায়ের সঙ্গে যাচ্ছে, আজ আবার ভয় কী? বাবা-মা আর তিন সন্তান, এই পুরো পরিবার এর আগে কোনওদিন একসঙ্গে কোথাও বেড়াতে যায়নি। বাবার সঙ্গে দু-একবার হাটে গেছে বটে, তাও মেয়েটা বাদ, মা-ও যায় না।

বটতলায় কোথা থেকে এক সাধু এসে ত্রিশূল গেড়ে বসেছে। সবাই সেখানে দাঁড়াল। সুরবালা এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে প্রণাম জানাল সাধুবাবাকে। তিনি হাত তুলে বিড়বিড় করে কিছু একটা আশীর্বাদ শোনালেন, কিন্তু প্রণামী দেবার মতন কিছু নেই সুরবালার সঙ্গে।

সে ফিরে আসার পর মেয়েটা জিগ্যেস করল, মা, সন্নিসি ঠাকুররা গায়ে ছাই মাখে কেন?


সুরবালা তাকাল তার স্বামীর দিকে। এইসব প্রশ্নের উত্তর পুরুষদের দিতে হয়।

বিভু বলল, উমম সন্নিসি ঠাকুররা সবাই শিবঠাকুরের চ্যালা। শিবঠাকুর বলে দিয়েছেন, গায়ে ছাই না মাখলে আমার চ্যালা হতে পারবি না।

ছোট ছেলেটা জিগ্যেস করল, বাবা, ঠাকুরের মাথায় সাপ থাকে কেন?

বিভু বলল, উমম, সাপ থাকে, মানে, এমনিই সাপ থাকে। এখন চল তো তাড়াতাড়ি।

ছেলেমেয়েরা দৌড়ে-দৌড়ে অনেকটা এগিয়ে যায়। আবার তাদের ডেকে থামাতে হয়।

এরপর রথতলা। এ অঞ্চলে মোটামুটি সম্পন্ন লোকেদের বাস। দোল-দুর্গোৎসবও হয় এখানেই। এক পাশে রয়েছে কয়েকটা ভ্যানগাড়ি।

অনেকটা দূরের পথ। হেঁটে যাওয়া যেতে পারে বটে, তাতে ফিরতে-ফিরতে ঢের রাত হয়ে যাবে। তা ছাড়া বিকেলের আগেই গন্তব্যস্থানে পৌঁছবার কথা।

এক ভ্যানগাড়ির চালক পাশে দাঁড়িয়ে ছোট কাচের গেলাসে চা খাচ্ছে, তার কাছে গিয়ে বিভুপদ সারা শরীর মুচড়ে বলল, ভালো আছ তো গোবিন্দদা? তোমার গাড়ি এখন ছাড়বে?

গোবিন্দর সঙ্গে আগেই কথা বলে গেছে বিভুপদ। এ গাড়ি ভাড়া করার সামর্থ তার নেই। সনাতনপুরের হাট থেকে দশখানা গুড়ের নাগরি নিয়ে আসার অর্ডার আছে গোবিন্দর। এখান। থেকে যাওয়ার পথে যদি প্যাসেঞ্জার না পায়, খালি গাড়ি যায়, তা হলে সে বিভুপদর পরিবারকে খানিকটা দূর পৌঁছে দেবে।


গোবিন্দ যেন সে-কথা ভুলেই গেছে। সে বলল, প্যাসেঞ্জার তো দেখছি না। গাড়ি ছাড়তে হবে। কিন্তু তোদের এতগুলোনকে তো বিনি ভাড়ায় নিতে পারব না! এত লোড থাকলে গাড়ি টানতে পরিশ্রম হয় না?

বিভুপদ মুখ চুন করে চুপ করে রইল।

গোবিন্দ বলল, অন্তত যা নায্য ভাড়া হয়, তার অর্ধেক তো দিবি? পার হেড পাঁচ টাকা।

বিভু বলল, ঠিক আছে, দেব। একেবারে ছোটটারও কি?

গোবিন্দ বলে, পনেরোটা টাকাই দে।

সে হাত বাড়াল বিভুর দিকে।

বিভু খুবই সংকুচিতভাবে বলল, এখন তো দিতে পারব না। পরে শোধ করে দেব। মা কালীর দিব্যি বলছি।

গোবিন্দ ভারিক্কি চালে বলল, ধার? আজ নগদ, কাল ধার। একবার দিলে ধার, এ পথে সে চলে না আর। কত দেখলাম।

বিভু বলল, আমার কথার খেলাপ হবে না। মা কালীর কিরে বললাম তো।

গোবিন্দ অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, যা দিনকাল পড়েছে, লোকে ঠাকুর-দেবতার কিরেও মানে না। নে, ওঠ।

বাচ্চাগুলো জুলজুল করে তাকিয়ে সব শুনছিল, এবার তারা লাফালাফি করে উঠে পড়ল ভ্যানগাড়িতে। সুশীল বয়েসে বড়, সুতরাং স্থান নির্বাচনে তারই অগ্রাধিকার। সে একবার সামনে, একবার পাশে দেখতে লাগল কোনটা সুবিধেজনক। সুধা আর ছোটুকে পা ঝুলিয়ে বসতে দেওয়া হল না, তারা ভেতরে বসল বাবু হয়ে।

সুশীল তবু এর আগে কয়েকবার চলন্ত ভ্যানের সঙ্গে দৌড়ে-দৌড়ে উঠে বসেছে, আবার চালকের তাড়া খেয়ে নেমেও পালিয়েছে। সুধা আর ছোটুর এমন সৌভাগ্য এই প্রথম। হাঁটতে হয় না, অথচ রাস্তা ফুরিয়ে যায়, এ কী মজা! রাস্তা দিয়ে অন্য লোকরা যাচ্ছে, তারা কেমন পিছিয়ে যাচ্ছে, তারপর আর তাদের দেখাই যায় না!


তিনজনেরই এই প্রথম নিজেদের গ্রামের বাইরে যাওয়া! ওদের কাছে উন্মোচিত হচ্ছে নতুন জগৎ। এদিককার সব গ্রামের চেহারাই প্রায় এক, ওদের চোখে যেন বৈচিত্র্যের শেষ নেই।

ও মা, দ্যাখ দ্যাখ, একটা তালগাছের গা দিয়ে আর-একটা অন্য গাছ উঠেছে। একসঙ্গে দুটো গাছ।

একটা কুকুর ওই বড়-বড় পাখিগুলোকে তাড়া করে খাচ্ছে, ওগুলো কী পাখি?

শকুন।

শকুন বুঝি মাটিতে নামে?

বাবা, কাঁধে দু-খানা বাঁশ নিয়ে ওই লোকটা কোথায় যাচ্ছে?

যাচ্ছে, নিজের বাড়িতে।

বাবা, ওই মন্দিরটা ভাঙা কেন?

কেন আবার কী? ভেঙে গেছে, তাই ভাঙা। একটু চুপ করে বোস।

ছোটটারই প্রশ্ন বেশি। সে চুপ করে থাকতে পারে না। একটু পরেই সে আবার কিছু জানতে চায়। তাকে ধমকও খেতে হয় সেইজন্য।

খানিক দূরে যাওয়ার পর গোবিন্দ জিগ্যেস করল, মাগ ছেলেপুলে নিয়ে কোথায় চললি রে বিভু?

বিভু বলল, যাব রণকালীপুর। ইয়ে, মানে বউয়ের বাপের বাড়ি। কয়েকটা দিন থাকবে?

গোবিন্দ বলল, বউয়ের বাপের বাড়ি। তোর শ্বশুর বাড়ি। ছেলেমেয়েগুলোর মামার বাড়ি। বাঃ, ভালোই কাটাবি। মামাবাড়ির ভারি মজা, কিল, চড় নাই। মামাবাড়ি দুধভাত দুয়ারে বসে খাই!

বিভু ঘরামির চেয়ে ভ্যানরিকশা চালক গোবিন্দর সামাজিক অবস্থান খানিকটা উঁচুতে। তার কথায় সেই সুর ফুটে ওঠে।

সুধার কোঁচড়ে বাঁধা ছিল মুড়ি। এখন তিন ভাইবোন খাচ্ছে।

সুশীল ফিসফিস করে মাকে জিগ্যেস করল, মা, আমরা মামাবাড়ি যাচ্ছি? কতদিন থাকব?

সুরো তাকাল বিভুর দিকে।

বিভু বলল, সে দেখা যাবে তখন। গাড়িটা লাফাচ্ছে, দেখিস, মুড়ি পড়ে না যায়।

সুধা জিগ্যেস করল, বাবা, তুমি খাবে?

বিভু বলল, নাঃ! তোরা শেষ কর।

ছোটু আবার শুরু করল প্রশ্নমালা।

চিল আর শকুনের মধ্যে কে বেশি উঁচুতে ওড়ে?

ওই মেয়েটা কাঁদছে কেন?

মোষ কি গরুর বাবা?

ভাইবোনেরা হাসে কিন্তু মা-বাবারা কেউ হাসে না। বিভু ধমক দিয়ে বলে, তুই থাম তো। আবার কথা বললে কান ছিঁড়ে দেব।

রাস্তা খোদলে ভরতি, তার মধ্যে আবার একটা লরি ঢুকে পড়েছে। ভ্যানরিকশার যাওয়ার পথ নেই। গোবিন্দ নেমে গিয়ে হল্লা শুরু করল।

ছোটদের কাছে এটাও বেশ রোমাঞ্চকর ব্যাপার। লরিটা কত বড়, তেমনই বড় চেহারার ড্রাইভার, তার সঙ্গে টক্কর দিচ্ছে গোবিন্দ। কে জিতবে?

গোবিন্দ ফিরে এসে ভ্যানরিকশাটাকে প্রায় ধানখেতে নামিয়ে দিয়ে উঠল গিয়ে লরিটাকে ছাড়িয়ে রাস্তার অন্য দিকে। তা হলে গোবিন্দ জিতেছে, গোবিন্দ জিতেছে, তিনজনে হাততালি দিয়ে উঠল।


সুরো তার স্বামীর একেবারে ঘাড়ের কাছে মুখ দিয়ে নীচু গলায় জিগ্যেস করল, তুমি ওদের রেখে খাওয়াতে পারবে?

বিভু বলল, ফেন-ভাত ফুটিয়ে দেব। সে আর এমনকী কথা।

সুরো বলল, এই সময় আলু সস্তা হবে। সুধাও একটু-একটু পারবে। শুধু ওকে চুলো ধরাতে দিও না।

বিভু বলল, সে তুমি চিন্তা করো না। বড়টাকে এবার ইস্কুলে পাঠাব।

সুধা জিগ্যেস করলে, মা, তোর পুঁটুলিটায় কী?

সুরো বলল, দু-খানা শাড়ি।

বকুনি খেয়ে একটু চুপ করে থাকা ছোটু আবার ফস করে বলে উঠল, মামাবাড়িতে আমাদের কটা মামা?

সুশীলই এবার বলে উঠল, গ্যালেই তো দেখতে পাবি। বোকা।

এরা কেউই আগে মামাবাড়িতে যায়নি। মামাবাড়ি নামক রহস্যময় জায়গা সম্পর্কে কিছু শোনেওনি।

অদূরে সনাতনপুরের হাট। ভ্যানরিকশা থামিয়ে গোবিন্দ জিগ্যেস করল, তোরা তো রণকালীপুরে যাবি বললি? এইখানে নেমে যা, বাঁ-দিকে রাস্তা। বেশি দূর না। বিভু, মনে থাকে যেন!

এই রাস্তাটা অপেক্ষাকৃত ভালো। অত ফুটোফাটা নয়। পাশ দিয়ে পাশ দিয়ে চলেছে কেলেঘাই নদী, যাতে প্রচুর কচুরিপানার ফুল ফুটে আছে।

গ্রামের মূল বসতি থেকে বেশ কিছুটা দূরে, নদীর ধারেই এক জায়গায় টালির চালের আট দশখানা ঘর। গোটা দু-এক মনোহরির দোকান।

সমানে বাঁশের কঞ্চির বেঞ্চে বসে গুলতানি করছে কয়েকজন পুরুষ।

খানিকটা দূরে ওরা থমকে দাঁড়াল। চেয়ে রইল সেই ঘরগুলির দিকে।

বিভু তার পত্নীর একটা হাত ধরে কিছুটা আবেগের সঙ্গে বলল, সুরো, সত্যিই যদি?

সুরোর নিরেট মুখে কোনও রেখা নেই, গলা কাঁপে না। সে বলল, হ্যাঁ, যাব তো।

বিভু বলল, এখনও ফিরে যাওয়া যায়।

সুরো বলল, আমি যাব ঠিক করিচি।

বিভু বলল, আমি কিন্তু তোকে জোর করিনি।

সুরো বলল, না, তুমি জোর করোনি, আমিই ঠিক করিচি।

উতলা হয়ে যাচ্ছে বাচ্চারা। ওই তো দেখা যাচ্চে মামারবাড়ি, তবু দেরি কেন?

সুশীল বলল, বাবা, চলো।

বিভু এবার খাঁকরি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, শোন রে তোরা। মামাবাড়িতে তোদের মা, এখন একলা যাবে। আমরা বাড়ি ঘুরব।

তিনজনের একই প্রশ্ন, কেন, কেন, আমরা যাব না কেন?

বিভু বলল, ওখানে ছোটদের যেতে নেই। মা আবার আসবে। ততদিন তোরা আমার সঙ্গে থাকতে পারবি না?

মেয়েদের বুদ্ধি আগে পাকে। ছোটদের মামাবাড়ি যেতে নেই, এটা সুধার কাছে ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হল না। মামার বাড়িতে দুধভাত তা হলে কারা খায়। শুধু বড়রা?

তার প্রশ্নের উত্তরে বিভু বলল, উমম, মামাবাড়িতে একজনের খুব অসুখ। তাই ছোটদের যেতে নাই। সুরো, তুই হলে এগিয়ে পড়, বেলা পড়ে আসতেছে।

ছোটু ওসব বুঝল না। সে মায়ের উরু জড়িয়ে ধরে শাড়ির মধ্যে মুখ গুঁজে খুব কাতরভাবে আবেদন করল, মা, আমি তোমার সঙ্গে যাব। একটুও চেঁচাব না।

স্বামী ও অন্য দুই সন্তানের দিকে ক্রমান্বয়ে তাকাল সুরো। তারপর ছোটুকে আস্তে-আস্তে ছাড়িয়ে নিয়ে সে বলল, তোকে পরে নিয়ে যাবে ছোটু। আজ বাড়িতে যা। বাড়িতে লক্ষ্মী হয়ে থাকবি।

সুধাকে বলল, ভাইকে ধর। তুই ছোটুকে সামলে রাখবি।

নীচু হয়ে সে স্বামীর পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। তিনটি সন্তানকে জড়িয়ে ধরল একসঙ্গে দু-হাত দিয়ে ঘিরে। আর কোনও কথা নেই।

তারপরই হঠাৎ ওদের ছেড়ে দিয়ে সে হনহন করে এগিয়ে গেল ঘরগুলোর দিকে। একটু পরে থেমে, মুখ ঘুরিয়ে বলল, তোমরা এখনি যেও না।

একটু থাকো।


গুলতানি করা লোকগুলোর পাশ দিয়ে যেতেই একজন আঙুল দেখিয়ে বলল, এই পাশ দিয়ে যাও, দেখবে একটা বড় ঘরের দাওয়া—

গলিতে প্যাঁচপেচে কাদা। ঘরগুলোর পাশ দিয়ে যেতে সুরো দেখল, সব জানলা দিয়ে উঁকি মারচে নানান বয়সের মেয়েরা।

এক জায়গায় গলিটা তিন ভাগ হয়ে গেছে, কোন দিকে যাবে বুঝতে না পেরে সুরো দাঁড়িয়ে পড়তেই একজন কেউ বলল, ওই তো ডান দিকে গো। রণকালীপুরের রণচণ্ডীকে দেখতে পাচ্ছনি?

বড় দাওয়ায় একটা পানের বাটা নিয়ে পা ছাড়িয়ে বসে আছে এক বিশালবপু রমণী। তার পাশে একজন একেবারে শালিকের মতন রোগা মেয়ে।

শালিকটিই বলল, ও মাসি, এরই তো আজ আসবাব কথা ছিল না?

মুখ ভরতি পানের পিক, রসস্থ গলায় সেই মাসি বলল, এসো গো, এসো বাছা।

বোসো। সর্বাঙ্গে কয়েকবার দৃষ্টি বুলিয়ে নরম গলায় মাসি বলল, কপাল পুড়েছে?

এয়োনা বেধবা?

সুরোর উত্তর না শুনেই সে আবার বলল, সিঁদুর রয়েছে তো, আগে দেখিনি, আমি কি চোখের মাথা খেয়েচি? তা সে লোকটি বুঝি ভেগে পড়েছে?

সুরো বলল, না, বাড়িতেই থাকে।

মাসি বলল, বুঝিচি। মাজা ভাঙা। রোজগার করে খাওয়াতে পারে না। খাওয়ার মুখ আর কটা।

সুরো বলল, আমার তিনটি ছেলেমেয়ে।

চোখ কপালে তুলে মাসি বলল, অ্যাঁ? বলিস কি, তিনটে?

আবার সুরোর সর্বাঙ্গে চোখ বুলিয়ে মাসি বলল, মেয়ের বয়েস কত?

সুরো বলল, ছয়-সাত হবে!

মাসি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আহা রে! তার তো বিয়ের বয়েস হতে ঢের দেরি। অতদ্দিন পালতে হবে। গভ্যে ছেলেমেয়েদের ধরি, তারা আমাদের খেতে আসে। এটা দাও, সেটা দাও। তারপর ডানা গজালেই ফুড়ুত করে উড়ে যায়। আমরাও তো দুই ছেলে ছেলো। আজ কোথায় তারা, মায়ের খোঁজ রাখে?

শালিক-মেয়েটি বলল, আমার ছেলেটাও।

নিজে একখিলি পান মুখে পুরে, এক খিলি সুরোর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নে খা! কী করবি বল, সবই নিয়তি। বাবা-মা খরচা করে বিয়ে দেয়, তার পরেও সোয়ামি যদি দু-বেলা দুটো ভাত দিতে না পারে, তার ওপর ছেলেপুলের হাঁ, সবসময় খাই-খাই। তা সে লোকটা জোর করে তোকে এখানে পাঠাল?


সুরো বলল, না, আমি নিজেই এসেছি।

মাসি বলল, বেশ করেছিস। বাঁচাতে হবে তো। কথায় বলে, আপনি বাঁচলে বাপের নাম। এমনি এমনি ফৌত হয়ে গেলে কেউ চোখের জল ফেলতেও আসবে নাকো। সে লোকটা যদি কখনও এদিক পানে আসে, তাকে জোড়া পায়ে নাতি মারবি। আমার লোকও তাকে ধোলাই দিয়ে ভাগাবে।

সুরো বলল, তার কাশির অসুখ।

মাসি মস্ত একটা হাত নেড়ে বলল, থাক, থাক, ওসব কথা ঢের শুনিচি। আর শুনতে ইচ্ছে করে না। পুটুলিটায় কী?

শাড়ি দুটো দেখে মুখ ভেটকে মাসি বলল, ও চলবেনি। কাজের সময় একখানা অন্তত জড়ি পার শাড়ি লাগবে। এখেনেই দোকান আছে। আজ কিনতে পারবি?

সুরো দু-দিকে মাথা নাড়ল।

মাসি তাতে বিরক্ত না হয়ে বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমার কাছে পুরোনো আছেদু একখানা, তা দিয়ে কটা দিন কাজ চলে যাবে। এখেনে বাপু খাওয়ার ব্যবস্থা যার-যার নিজের। আমার কোনও দায় নেই। এই শেফালি তোকে বুঝিয়ে দেবে। তবে, আজই তোকে ঘর দিতে। পারব না, থাকবি মোক্ষদার সঙ্গে। মোক্ষদার উদরি হয়েছে, কোনও খাওয়ার দ্রব্যই সহ্য হয় না। তার দরুন মেজাজ খিটখিটে, হাড়-মাসে একটু রস নেই। খদ্দেরদের সঙ্গেও মেজাজ দেখায়। তিন-চারজন নালিশ করেছে আমার কাছে। বোঝে ঠ্যালা, ঠিকমতন যত্ন-আত্যি করবে না। তার। ওপর খ্যাট-খ্যাট করবে। ছ্যা-ছ্যা-ছ্যা। খদ্দেরদেরই নাকি দোষ! খদ্দের হল লক্ষ্মী, তাদের কোনও দোষ ধরতে আছে? মোক্ষদা আড়াল থেকে যদি শোনে তো শুনুক, তাকে আমি এবার তাড়াব। দু তিন দিনের মধ্যেই। দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল অনেক ভালো। সে যদি তোর ওপরেও চোপা করে, তুই কিছুটি বলবি না। মুখ বুজে থাকবি। যা বিহিত করার আমি করব। যা, এখন শেফালির সঙ্গে যা, ও ঘর দেখিয়ে দেবে।

সুরো তবু বসে রইল মাসির মুখের দিকে চেয়ে।


মাসি বলল, কী হল ওঠ! হাই ভাঙার সময় হল। এবার খদ্দেররা আসবে।

মাটির দিকে মুখ নীচু করে পুরো বলল, আমায় দুশো টাকা দেবেন?

এবার মাসির মুখের ভাব বদলে গেল একেবারে। মেঝেতা ভরা মুখে যেন আগুনের আঁচ।

কড়া গলায় সে বলল, টাকা? কীসের টাকা! আমি বাপু, তোমার পায়ে ধরে সেধে আনিনি। নিজে এসেচ, কাজ-কাম করতে চাও তো করো। আমার এখানে ফেলো কড়ি মাখো তেল। রোজগার করবে খাবে। এখনও যার রোজগার শুরুই হল না, সে টাকা চায় কোন মুখে।

সুরো বলল, আমার আজই টাকার খুব দরকার।

মুখঝামটা দিয়ে মাসি বলল, টাকার কার না দরকার। বল না, বিশ্বসংসার কে না টাকার জন্য হ্যাজাচ্ছে? আমি কি এখানে দানছত্তর খুলে বসিচি? তোমার বাপু এখেনে যদি না পোষায় তুমি চলে যেতে পারো। আমি কারুকে ধরে রাখি না।

সুরো বলল, ছেলেমেয়েগুলো বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, ওদের হাতে কিছু না দিতে পারলে কাল ওদের কিছু খাওয়া জুটবে না।

আরও কিছু ধমক দিতে গিয়ে থমকে গেল মাসি। এবার তার চক্ষুতে ফুটে উঠল বিস্ময়।

সে বলল, ছেলেমেয়েরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে? তাদের সঙ্গে এনিচিস? এ কেমন ধারা আক্কেল? এসব হল পাপী-তাপীদের জায়গা। গুণ্ডা-বদমায়েশেরা ঘোরাফেরা করে, ছোট বাচ্চাদের এখান। থেকে দূরে রাখতে হয়। এইটুকু অন্তত ধম্মেজ্ঞান তো থাকবে। ওরে, এখানকার রাঙ্কোসরা সাত বছরের বাচ্চা মেয়েকেও খেয়ে ফেলতে চায়।

সুরো আবার বলল, দয়া করো। কিছু টাকা না পেলে।

মাসি বলল, দয়া? দয়া-টয়া করলে এ কারবার চলে না। ওরে শেফালি আমাকে একটু ধর তো।

শেফালি এক হাত ধরে টেনে তুলল মাসিকে তারপর মাসি নিজেই থপথপিয়ে চলে গেল ঘরের মধ্যে।

মুখ নীচু করে বসে রইল সুরো।

তার স্বামী তাকে জোর করে পাঠায়নি, সে নিজের ইচ্ছেতেই এসেছে, এটা ঠিক কথা। বিভুর কাশরোগ, তার শরীর দুর্বল হয়ে গেছে, মাঝে-মাঝে গলা দিয়ে রক্তের ছিটে বেরোয়। সরকারি হাসপাতালের ওষুধ খেয়ে সারে না। তারা পুষ্টিকর খাদ্য খেতে বলে।

শরীর দুর্বল, তাই ঘরামির কাজ আর ভালো পারে না বিভু। ইদানীংকাজ তেমন জোটেও না। তাকে ডাকে না কেউ। ইট-সিমেন্টের কাজও শেখেনি বিভু। দিনের-পর-দিন বাড়িতে বসে থাকলে স্ত্রী-সন্তানরা খাবে কী?

সুরো নিজে উপার্জনের চেষ্টা করেছে। মুড়ি ভাজা, লোকের বাড়িতে বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার করা। তার জন্য বাবুদের পাড়ায় যেতে হয়। তারা কেউ ঠিকা লোক চায় না। বাড়িতে থেকে। সবরকম কাজকম্ম করবে, বাচ্চাদের গু-মুত পরিষ্কার থেকে রান্নাবান্না, তবে তো। তাও খোরাকির সঙ্গে মাত্র কয়েকটা টাকা। তাতে কি পোয়? দিনের-পর-দিন এমন চলছে, নিজেরা তবু না খেয়ে, আধপেটটা খেয়ে চালিয়ে দিতে পারে। কিন্তু ছেলেমেয়ে তিনটে, ওদের খিদের কান্না সহ্য করা যায় না। ওদের এই পৃথিবীতে আনা হয়েছে, ওরা ইচ্ছে করে আসেনি, ওদের দোষ কী!

ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়লে বিভু আর সুরো গালে হাত দিয়ে ভবিষ্যতের কথা ভেবে-ভেবে কুল পায়নি। বাড়িতে ঘটি-বাটি যা ছিল সব বিক্রি হয়ে গেছে। বিক্রি করার মতন আর কিছুই নেই। শুধু সুরোর গায়ের মাংস ছাড়া। এত অনাহারেও সুরোর শরীর একেবারে চিমসে হয়ে যায়নি। মা হয়ে সে সন্তানদের জন্য এইটুকু করতে পারবে না?


দু-টাকা পাঁচ টাকার নোট মিলিয়ে শখানেক টাকা আর একটা জড়ির পাড় বসানো ঝ্যালঝেলে শাড়ি নিয়ে ফিরে এল মাসি।

টাকাসুদু হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে মাসি বলল, যা দিয়ে আয়। এর আগে আমি কাউকে আগাম দিইনি, এই শেফালিরা জানে। এগুলো দিয়ে এসে কাজে লেগে পড়। আর যেন কখনও সে মিনসে আর কাচ্চাবাচ্চারা এদিক পানে না আসে, এই বলে দিলাম!

সুরো আবার বাইরে এসে দেখল, একটা পাকুড়গাছের তলায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বিভু। তার হাত ধরে সুধা। ছেলে দুটো মনোহরির দোকানের সামনে ঘুরঘুর করছে হ্যাংলার মতন।

মাকে দেখে তারা দৌড়ে ফিরে এল।

টাকাগুলো বিভুর হাতে দিয়ে পুরো বলল, বেশি করে চাল কিনে নিও।

বিভু বলল, এখানকার হাটে একটুও সস্তা হবে।

সুরো বলল, নতুন চালে ফেনাভাত ভালো হয়। পেটও ভরে। আলু-আদা এখন সস্তা। নুন নিও মনে করে। আজকের দিনটায় অন্তত ছেলেমেয়েরা যেন ভালো করে খায়।

সুধা বলল, মা, মামাবাড়িটা ভেতরটা একবার দেখে আসতে পারব না? আমরা একটাও কথা বলব না।

সুরো বলল, আজ না। আর-একদিন।

বিভু বলল, মা তো ফিরে আসছেই। বেশিদিন নয়।

সুরো বলল, হ্যাঁ। ফিরে আসব।

ছোটু হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

সুরো বলল, ওদের কটালজেঞ্চস কিনে দাও। সুধা, ভাইয়ের হাত ধর।

লজেঞ্চুসের কথা উচ্চারিত হতেই সুশীল সঙ্গে-সঙ্গে দোকানটার দিকে। তার পরেই সুধা আর ছোটু।

বিভুর মুখোমুখি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সুররা। তার নিরেট মুখে কোনও ভাবলেশ নেই।

একটু পরে সে বলল, যাই। সাবধানে থেকো। রক্ত পড়লে নুনজলে কুলকুচি করবে।

সুরোর বদলে বিভুই চোখ ছলছল করছে। এরকম সময়ে কী বলতে হয়, তা সে জানে না। সে জামার খুঁট দিয়ে চোখ মুছল, তারপর আবার মুখ তুলতেই দেখল, সুরো ফিরে গেছে অনেকখানি।

একটা করে লজেন্স মুখে, একটা হাতে। অমৃতের স্বাদ নিতে-নিতে লাফিয়ে-লাফিয়ে এগিয়ে চলল তিনটি ছেলেমেয়ে। একটা পা তুলে-তুলে, নাচের ছন্দে দুলে-দুলে ছোটা। এরকমভাবে ছুটতে শুধু বাচ্চারাই পারে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *