এই বাড়ি ওর। মাঝে-মাঝে নিজের কাছেই কেমন অস্বস্তিকর মনে হয়। চার কামরার দোতলা এই বাড়িটা সে কিনেছে বারো হাজার পাউন্ডে। দোতলাটা কাঠের কিন্তু সর্বত্র কার্পেট পাতা। ওটা আগে থেকেই ছিল। এমনকী বাথরুমের আধুনিক ব্যবস্থাও। নিচের ঘরের রঙিন টিভি, স্টিরিও, ভি সি আর, কিচেনের যাবতীয় আধুনিকীকরণ যার যে-কোনও একটার দিকে তাকালে দেশে থাকতে চমকে উঠত। পনেরো বছর বিলেতে থেকে এসবের মালিকানা পেয়ে গেছে সে। বাড়ির পেছনে একটা সরু প্যাসেজে গাড়িটা। গাড়িতে এসি না থাকলে এদেশে বাস করা যায় না, কিন্তু গাড়ি চালাতে-চালাতে সে বাংলা গানের ক্যাসেট শোনে। এটুকুই তার নিজস্বতা। লেক ডিস্ট্রিক্টের চওড়া হাইওয়েতে গাড়ির গতি বাড়িয়ে হেমন্ত মুখার্জির গলা চারপাশে ছড়িয়ে দিলে মনে চমৎকার আরাম হয়। বাড়িটার মতো গাড়িটা অবশ্য এমন কিছু অভিনব নয়। এমনকী তার রেস্টুরেন্টের হেড ওয়েটার আমাদেরও একটা গাড়ি আছে। আমেদকে সে মাইনে দেয় সপ্তাহে দুশো পাউন্ড। এখানে এক পাউন্ড মানে উনিশ টাকা নয়, আমেদ বলে একটা টাকাই। যাই হোক এখন সে বেশ সুখে আছে। প্রতি মাসে হাইলাকান্দিতে টাকা পাঠায়। সিলেট থেকে বিতাড়িত হয়ে এসে সে একদা মা-বাবার সঙ্গে ওখানেই আশ্রয় নিয়েছিল। তাঁরা রয়ে গেছেন। আসামেই।
ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে কেউ বলতে পারে না কার কীরকম কাটবে। ওসব হাত দেখা কিংবা ঠিকুজি বিচার যদি ঠিক হত তাহলে এতদিনে তো তার মরে যাওয়ার কথা। তিরিশের একটা অতিরিক্ত দিন তার বেঁচে থাকার কথা নয়। কিন্তু সে দিব্যি বেঁচে আছে ব্রিটিশ পাশপোর্টের মালিক হয়ে।
হাইলাকান্দি থেকে কি করে সে ইংলন্ডে এসে পড়েছিল, এত জায়গা থাকতে কেমন করে এই লেক ডিস্ট্রিক্টের গ্রামের রেস্টুরেন্টে কাজ পেয়েছিল, ক্রমশ মালিক অসুস্থ হয়ে পড়লে সে পার্টনার হয়ে গেল এবং সবশেষে মালিক হয়ে দোকানটাকে ভারতীয় খাবারের দোকানে রূপান্তরিত করে ফেলল সেটা প্রায় রূপকথার মতো। কিন্তু এখন এটা সত্যি। সে যে রেস্টুরেন্টের মালিক তার নাম প্রেম। সবরকম ইন্ডিয়ান ডিশ পাওয়া যায়। তার খদ্দেরদের নব্বই ভাগ ব্রিটিশ। দিনের বেলা বন্ধ থাকে। শুক্র শনি সারারাত আর অন্য দিন রাত বারোটা পর্যন্ত খোলা। সাতজন কর্মচারী তার। তিনজন নিচের কিচেনে, তিনজন সার্ভ করে আর একজন ডোরম্যান। সে নিজে থাকে কাউন্টারে, ড্রিঙ্কস মেপে দেয়, ক্যাশ গুনে নেয়।
রাত্রে যখন রেস্টুরেন্ট থেকে ক্যাশ নিয়ে বাড়ি ফেরে তখন তার ভয় লাগে। যদিও এই গ্রামে আজ পর্যন্ত কোনও ডাকাতি হয়নি তবু ওটা তার ভারতীয় অভ্যাসেই থেকে গেছে। এমনি দিনের গড় বিক্রি সাত-আটশোর বেশি হয় না। শুক্র শনি ওটা প্রায় সতেরো-আঠারোশোতে পৌঁছয়। পরের দিন ব্যাঙ্ক না খোলা পর্যন্ত দারুণ অস্বস্তি। একটা পাউন্ড তখন তার কাছে উনিশটা টাকাই হয়ে যায়।
আজ শুক্রবার। দুপুর অবধি ঘুমিয়ে তৈরি হয়ে নিল সে। কে কবে ভেবেছিল দুটোয় ঘুম থেকে উঠে ইলেকট্রিক কেটলিতে জল চাপিয়ে দিয়ে টিভি দেখতে-দেখতে খবরের কাগজের পাজল পাতাটা পেনসিলে ভরবে সে? তারপর চা আর হট ক্রিম পাই খেয়ে বাজারে বেরুবে? ইদানীং নিজের রেস্টুরেন্টে সে খায় না। পেটে সইছেনা। সিলেটি রান্না সিলেটের ছেলের পেটে সয় না। পনেরো বছরের অভ্যাসে, ভাবা যায়! আজ রেস্টুরেন্ট খুলবে আটটায়। ছটা নাগাদ ডিনার কাম লাঞ্চ তৈরি করবে সে ঢ্যাঁড়স ভাজা, মুগের ডাল, রুইমাছের কালিয়া দিয়ে। ছিমছাম খাবার। এদেশে মানুষের দাম বড্ড বেশি। হারানের বউ বা বাসুর মা জাতীয় কাউকে পাওয়া গেলে এসব ঝঞ্ঝাট কে পোয়াতো! দরজা খুলে বাইরে বের হল সে। এখন একটা পুলওভারই যথেষ্ট। সামার শেষ হতে চলেছে। এবার তেমন রোদ ওঠেনি। কিন্তু হাওয়ার দাঁত ধারালো হয়েছে এরই মধ্যে। তা ছাড়া গাড়ির মধ্যে ঢুকে গেলে আর ঠান্ডা কি! গাড়ির দিকে এগোতে সে থমকে দাঁড়াল। অনেকদিন পরে ববকে দেখতে পেল। দুটো বাড়ির পরে বব থাকে। এই গ্রামের একজন কর্তাব্যক্তি। কিছুদিন আগে হিপিরা যখন এই গ্রামে এসেছিল তখনই বব ছন্নছাড়া হয়ে গেল। ওর বউ লিজা হিপিদের সঙ্গে চলে গেল কাউকে না জানিয়ে। পঞ্চাশ বছর স্বামীর সঙ্গে বাস করে কোনও বৃদ্ধা যে এমন করবে তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল গ্রামবাসীদের। বব কদিন যাকে পেত তাকেই জিজ্ঞাসা করত, আমার দোষটা কি বলতে পারো? আমি তো ওর ওপর কোনও অত্যাচার করতাম না। হয়তো আলাদা করে গুরুত্ব দেওয়ার কথা আমি ভাবিনি কিন্তু আমাদের সময়ের। মানুষেরা সবসময় বউ-বউ করতে তো অভ্যস্ত ছিলাম না। আমি যেহেতু ওকে নিয়ে খুব একটা ঘোরাঘুরি করিনি তাই পৃথিবী দেখতে বেরিয়ে গেল? আচ্ছা বলো তো, কার বউ সংসার সামলায় না, বাচ্চাদের জন্ম দেয় না? কিন্তু সেই কারণে কেউ কি নিজেকে নিঃস্ব ভাবে? লিজাটা এতটা পাগল ছিল, বুঝলে! কিন্তু আমার দোষটা কি?
হাই বব! সুদেব যতটা পারল সহজ গলায় ডাকল।
হ্যালো দেব! মাথাটা ঝাঁকাল বব। সত্তর ছোঁয়া বৃদ্ধ এখন যেন আরও জরাগ্রস্ত। এই কয়েক মাসেই ওঁর শরীর যেন দ্রুত ভাঙছে। বব সেই ইংরেজ যিনি এখনও হাই বলেন না। অন্যায়কে অন্যায় বলতে যাঁর জিব অসাড় হয় না। ব্রিটিশ টিম হেরে গেলে তিনদিন খুব মন খারাপ হয়ে যায় ওঁর।
বব, তোমার শরীর কি ভালো নেই?
নো ইয়ংম্যান, আমি ঠিকই আছি। সন্ধেবেলায় আকাশে কী করে সূর্য থাকবে বলো! বব হাসলেন।
টেডের দোকানে আজকাল আড্ডা হয় না?
না, কোথাও যাই না। আসলে ভালো লাগা বোধটাই আমার হারিয়ে গিয়েছে। বেঁচে থাকাটা বড় ক্লান্তিকর দেব।
সুদেব একটু ইতস্তত করল। তারপর খুব ঘনিষ্ঠ গলায় জিজ্ঞাসা করল, লিজার কোনও খবর পেলে?
ও হ্যাঁ! মাসখানেক আগে লিখেছিল একটা চিঠি। কেমন আছে লেখেনি তবে আমার কী-কী করা উচিত তাই জানিয়েছে। কোথায় আছে তাও লেখেনি। আই নো শী উইল কাম ব্যাক। পঞ্চাশ বছরের অভ্যেস যে-কোনও ড্রাগের চেয়ে শক্তিশালী। নইলে চিঠি দিয়ে আমাকে সচেতন করাত না। গুডবাই দেব।
বাই বব। শব্দদুটো বলে সুদেব লক্ষ করল বব কোনও দিকে না তাকিয়ে নিজের বাড়ির দিকে এগোচ্ছেন, ওঁর হাঁটার ভঙ্গিটা মোটেই ভালো লাগল না তার।
অস্কার ছোঁকরা দাঁড়িয়েছিল ফুটপাতে। নিজের দোকানের চেয়ে ফুটপাতে দাঁড়াতেই যেন বেশি ভালোবাসে ও। বব চলে যেতে সোজা সামনে এসে দাঁড়াল, তুমি লক্ষ্য করেছ লোকটা যেন কবরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই জন্যেই বলে মেয়েরা হল সব সর্বনাশের মূলে। তুমি বিয়ে না করে বেঁচে গেছ।
তুমিও তো বিয়ে করোনি।
এবার করতে হবে। জেন উঠে পড়ে লেগেছে। আমি জানি বিয়ে করাটা ঠিক হচ্ছে না কিন্তু জেনকে তুমি তো জানো, ও একবার যা ভাবে তা থেকে সরানো মুশকিল।অস্কার মাথা নাড়ল।
বিয়ে করাটা ঠিক হচ্ছে না কেন? সুদেবের মজা লাগছিল।
বিয়ে মানেই তো অ্যাডজাস্টমেন্ট। তোমার ভালো না লাগলেও শান্তি ঠিক রাখার জন্যে বউ-এর কথা শুনতে হবে। পঞ্চাশ বছর ঘর করার পরও তো লিজা চলে গেল। আচ্ছা লোকে বলে পঞ্চাশ, বছরটা কি ঠিক পঞ্চাশ?
আমি ওদের বিয়ে দিইনি অস্কার যে তোমাকে বলতে পারব। আজ রাতে প্রেমে আসছ? ওকে কাটাবার জন্যেই সুদেব হাঁটার চেষ্টা করল।
মাথা নড়ল অস্কার, না। আমার মায়ের শরীর খারাপ। ওঁর ইচ্ছে একসঙ্গে ডিনার করি। লিজার ঘটনাটার পর মাকে নিয়ে প্রবলেমে পড়ে গেছি।
অবাক হয়ে দাঁড়াল সুদেব, কেন? কি হয়েছে ওঁর?
অস্কার কাঁধ নাচাল, মা বলছে লিজা ঠিকই করেছে। সারাজীবন সংসারের পেছনে ব্যয় করে মাও নাকি কিছু পাননি। শুধু বাবা বেঁচে নেই বলে মা লিজার মতো যেতে পারছেন না।
সুদেব আর দাঁড়াল না। এই গ্রামে এখন বৃদ্ধাদের খাতির বেড়ে যাবে। লিজা বাড়িয়ে দিয়েছে। কবে কোন বৃদ্ধা উধাও হয়ে যায় সংসার বৈরাগ্যে তাই নিয়ে সবাই চিন্তিত। সঙ্গে-সঙ্গে তার একটা মজার কথা মনে হল। ছেলেবেলা থেকেই দেশে শুনত অমুকের ছেলে বা বাবা সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছে। দীর্ঘদিন বাদে খোঁজ পাওয়া গেছে উত্তরকাশীতে কিংবা হরিদ্বারে তাঁকে দেখা গেছে। কিন্তু কখনও শোনেনি কারও বোন বা মা সন্ন্যাসিনী হয়ে গেছেন। কেন? মেয়েদের মনে সংসারাসক্তি অত্যন্ত বেশি। ভারতবর্ষে তো মেয়েরা সবচেয়ে বেশি শোষিত ছিল এককালে। বৈরাগ্য তো তাদেরই প্রথমে আসা স্বাভাবিক!
গাড়ির ভেতর আরামে বসে লাইটারের সুইচটা অন করে সিগারেট ধরিয়ে নিল সুদেব। এই গাড়ি এখানে জগাইমাধাইও চাপে কিন্তু ভারতবর্ষে কটা মানুষের আছে? এখানে সবাই তাকিয়ে থাকে রোলসের দিকে। সম্রাটের সম্মান ওর। যে মালিক তার টাকা আছে বলেই মালিকানা। লিটারে। চার যাবে বা পার্টস পালটাতে সর্ষের ফুল দেখতে হবে বলে যাদের ভাবনা তাদের জন্যে রোলস নয়। মাঝে-মাঝে হাইওয়েতে সে দেখছে অন্য গাড়িগুলো রোলসের জন্যে পথ ছেড়ে দিচ্ছে। এমন দিন কি হবে মা তারা যেদিন সেও রোলস কিনতে পারবে? এক লাখ পাউন্ডের বাক্স!
গাড়ি চালাতে বড় আরাম, একটুও টেনশনে ভুগতে হয় না। রাস্তায় অবাঞ্ছিত পদাতিক নেই, শুধু নিয়মটুকু মাথায় রেখে চালিয়ে যাও। একটা কুটো পড়ে নেই কোথাও। এখন পাব কিংবা ক্লাব বন্ধ। স্ন্যাক্সের দোকান খোলা। ফুটে লোকজন বেশ। গ্রামের বিপরীত প্রান্তে পৌঁছে প্যাটেলের পার্কিং লটে গাড়ি দাঁড় করাল সুদেব। মিষ্টি রোদ উঠেছে এখন। কিন্তু ঠান্ডাটাও জানান দিচ্ছে। প্যাটেলের দোকানে ঢুকে সে চারপাশে তাকিয়ে নিল। সামনের হলঘরে যাবতীয় ভারতীয় মশলা এবং তরিতরকারি সাজানো। এলাচ কিংবা দারুচিনির দাম হাইলাকান্দির তুলনায় অর্ধেকের কম। ওগুলো আসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে। বাঁদিকের ঘরে শাড়ি এবং জামাকাপড়ের একজিবিশন। প্যাটেলের সমস্ত আত্মীয় সেজেগুঁজে সেগুলো বিক্রি করে আর সারাদিন টেপে হিন্দি গান বাজায়। এখানে ঢুকলে কে বলবে বিলেতে আছি! মুদির দোকানে কোনও হেলপার নেই। যেযার পছন্দ নিয়ে আসছে ট্রলিতে করে। কাউন্টারে বসে তাই দেখে মেশিনে দাম যোগ করে টাকা নিচ্ছে প্যাটেল। একটু ফাঁকা হতে সুদেব তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই প্যাটেল বলল, হাই দেব!
গতবারে চালটা খারাপ ছিল। ওই মাল এবার দিয়ো না।
প্যাটেল কাঁধ নাচাল, অত ভালো চাল অথচ তোমার অপছন্দ। আসলে বাংলাদেশের মানুষের কাছে চাল বিক্রি করতে ঝকমারি!
সুদেব বলল, আমি যখন দেশ ছেড়েছি তখন জায়গাটার নাম ছিল পাকিস্তান। এই নাও গত সপ্তাহের চেক। তুমি গলা কাটছ জেনেও এখানে আসছি কারণ আমি আমার ব্রিটিশ খদ্দেরদের সেরা জিনিস সার্ভ করতে পছন্দ করি।
প্যাটেল কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর ইশারায় কাছে ডাকল, তুমি কি খবরটা শুনেছ?
কোন খবর?
ইন্ডিয়া কমনওয়েলথ থেকে ব্রিটেনকে বাদ দিয়ে দিতে চাইছে।
আই অ্যাম নট ইন্টারেস্টেড ইন পলিটিক্স!
ওহ গড! এর রেজাল্ট তো আমাদের ভুগতে হবে।
কেন?
ব্রিটিশরা খুব খচে গেছে। মিসেস থ্যাচার বলেছেন এখন থেকে ইন্ডিয়ান বাংলাদেশিদের ব্রিটেনে ঢুকতে ভিসা লাগবে। অর্থাৎ আমার ভাইপোকে চাইলেই আমি এখানে হুট করে আনতে পারব না।
সুদেব এই মুহূর্তে তার কেউ আসবে কিনা মনে করতে পারল না। তবে মাকে এখানে একবার নিয়ে আসার ইচ্ছে তার অনেকদিনের। সে বলল, ট্যুরিস্ট ভিসা তো পাওয়া যাবে।
সেটা ওদের ইচ্ছে হলে। এদেশে আমাদের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে তাতে নাকি সরকার খুব উদ্বিগ্ন। লন্ডনের একটা মিউনিসিপ্যাল ইলেকশনে তিনজন ইন্ডিয়ান ইলেকটেড হয়েছে। এখন সারা দেশে আমরা ছড়িয়ে। ওরা ভয় পাচ্ছে একদিন আমরা কমন্সে মেজরিটি পেয়ে যাব। তুমি ভাবতে পারো, ব্রিটেনের প্রাইম মিনিস্টারের নাম যদি দেশাই হয় তাহলে ব্রিটিশদের কী অবস্থা হবে? তাই ওরা চাইছে আমরা এদেশ থেকে চলে যাই।
আমাদের তো ব্রিটিশ পাশপোর্ট আছে। চাইলেই হল।
জানি না। এরা দু-শো বছর আমাদের শাসন করেছে। আমরা যুদ্ধ না করে এদের দেশদখল করে নেব তা এরা বরদাস্ত করবে না। নিশ্চয়ই কোনও কায়দা বের করবে।
চলে যেতে বললে তখন দেখা যাবে।
বাঃ চমৎকার! এই যে ছোট সুইচটা, দেশে এর দাম বড়জোর পাঁচটাকা। এখানে বিক্রি করছি। এক পাউন্ডে। চোদ্দো টাকা প্রফিট। দেশে তা পাব?গভর্নমেন্ট কিছু করলে কেস করতে পারে, কিন্তু শুনছি ওরা আমাদের তাড়াতে ইয়াং ছোঁকরাদের লেলিয়ে দেবে। কী যে করি!
প্যাটেলের দোকান থেকে জিনিসপত্র গাড়িতে চাপিয়ে সুদেব চারপাশে তাকাল। এখন এই গ্রাম তার নিজের হয়ে গিয়েছে! ওরা তাদের তাড়াবে?হ্যাঁ, এখন ভারতীয়রা সংখ্যায় হু-হুঁ করে বাড়ছে। লন্ডনের টেলিফোন ডিরেক্টরির কয়েকটা পাতা জুড়ে শুধু ইন্ডিয়ান নাম। একটা পাড়ায় ঢুকলে মনে হয় গুজরাটিদের এলাকায় এসে গেছি। হিথরো এয়ারপোর্টের পোর্টার থেকে সুইপার ইন্ডিয়ান। ইংলন্ডের অনেক টাকা প্রতি মাসে ইন্ডিয়ায় চলে যাচ্ছে। একসময় বিহার থেকে আসা শ্রমিকদের দিকে তাকিয়ে পশ্চিমবাংলার বাঙালিদের এইরকম অনুভূতি হত। হঠাৎ বুকের মধ্যে। একটা অসহায় বোধ ছড়িয়ে পড়ল। এই দেশে সব আরামের, শুধু দেশটাকে নিজের বলে ভাবতে পারার অভ্যেসটাই পায়ের তলায় কাঁপুনি ছড়ায়। ফেরার পথে ফুটপাতে মানিকে দেখে সে গাড়িটা থামাল। মানি হাসছে একটা ঢ্যাঙা ব্রিটিশের হাত ধরে। দেড় ফুট বেশি লম্বা ছেলেটার পাশে কালো মানিকে অদ্ভুত লাগছিল। সুদেব চিৎকার করল, হাই মানি।
মুখ ফিরিয়েই মানির মুখ উদ্ভাসিত। চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাচ্ছ?
প্রথমে প্রেমে, তারপর বাড়ি।
আমাকে তুমি লিফট দেবে?
আপত্তি নেই।
কথাটা শোনামাত্র মানি তার ঢ্যাঙা বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল, আঃ, আমি টায়ার্ড!
কোন চুলোয় গিয়েছিলে?
ওঃ দেব। আই ডিড ইট। খুব ভয় হচ্ছিল যদি না পারি! কিন্তু পেরে গেলাম।
তুমি মরবে। খামোকা কেউ প্যারাসুটার হয়?
মরব তো একবারই। কিন্তু কি থ্রিল তা তুমি বুঝবে না। ব্যাপারটা কীরকম হয় জানো? আমরা আটজন বসে আছি প্লেনের ফ্লোরে। কোনও চেয়ার-টেয়ার নেই। ট্রেনার এক-একজনকে ডেকে দরজায় নিয়ে যাচ্ছে। তারপর সামান্য পুশ আর তোমার শরীর শূন্যে ভাসছে। প্যারাসুটটা নিজে থেকেই খুলে যাওয়ার পর নিচে তাকাও, ও কি দারুণ লাগে পৃথিবীটা! গাড়ির সিটে মানির শরীরটা নেচে উঠল।
এসব করে কী হবে মানি, চাকরি-বাকরির চেষ্টা করো।
কি হবে চাকরি করে? আমাকে যা বেকার ভাতা দিচ্ছে তাতে চমকার চলে যাচ্ছে। চাকরি করলে ওই ফ্ল্যাট আমাকে ছাড়তে হবে। তিন ডবল ভাড়াতেও আর আমি ওরকম ফ্ল্যাট পাব না।
সুদেব চুপ করে গেল। মানি এককালে ওর রেস্টুরেন্টে কাজ করত। সপ্তাহে দেড়শো পাউন্ড পেত। ওর ব্যবহারে তার খদ্দের বেড়ে গিয়েছিল বেশ। এখন চাকরি না করেও ও সমান টাকা পাচ্ছে বেকারভাতা হিসেবে সরকারের কাছ থেকে। দক্ষিণ ভারতের এই মেয়েটি তিন বছর বয়সে এসেছি মা-বাবার সঙ্গে। এ দেশের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বড় হয়ে তাদের মতোই আঠারো পেরিয়ে আলাদা হয়ে একা আছে মা-বাবাকে ছেড়ে। দু-বার দুটো প্রেম করেছিল ভারতীয় ছেলের সঙ্গে। প্রসঙ্গ উঠলেই কাঁধ নাচায়, ম্যাড! আর নয়। প্রেমট্রেম আমার দ্বারা আর হবে না। আর। ইন্ডিয়ান ছেলে? রক্ষা করো। ওরা সবসময় ডাবল ক্রশ করে। গাছেরও খাব আবার তলারও। কুড়োব। এর সঙ্গে মিশবে না, ওর সঙ্গে কথা বলবে না, আর আমি সাদা মেয়ে দেখে যখন ছোঁক ছোঁক করব তখন চোখ বন্ধ করে বসে থাকবে। ননসেন্স।
ইংরেজ ছেলেরা তো আজকাল কালো মেয়ে পছন্দ করে। নিগ্রোদের তাই এখন খুব ডিম্যান্ড। ওদের সঙ্গে–।
দূর! ওরা শুধু চমৎকার ঘুমাতে জানে কিন্তু কথা বলতে গেলেই বোবা হয়ে যায়।
হঠাৎ মানি ওর দিকে ঘুরে বসল, হেই দেব, তুমি কাউকে বিয়ে করছ না কেন?
সুদেব হাসল, সেম প্রবলেম। এই দ্যাখো না, তুমি সেবার সারারাত আমার একতলার সোফায় ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলে অথচ আমি দোতলা থেকে নেমেই এলাম না। আমার দ্বারা কিছুই হবে না।
তুমি খুব ভদ্রলোক, তোমাকে বিশ্বাস করা যায়। আমি তোমার সঙ্গে একটা মেয়ের আলাপ করিয়ে দিতে পারি। শী ইজ সামথিং। শী লাইকস ইন্ডিয়ান বয়েজ।
আই অ্যাম নট ইন্ডিয়ান, আই অ্যাম হোল্ডিং ব্রিটিশ পাসপোর্ট।
রাবিশ! বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থেকে নেমে গেল মানি।
হেসে ফেলল সুদেব, এখানকার কট্টর ইংরেজমনা ভারতীয় যুবতীও মনে করে না সে ব্রিটিশ। অথচ এই দেশ ছেড়ে যাওয়ার কোনও বাসনা তার নেই। মনে-মনে সে হঠাৎ মার্গারেট থ্যাচারকে সমর্থন করল। এদেশের বুকে বসে এদেরই দাড়ি ওপড়ানোর স্বভাব এরা কেন সহ্য করবে?
নিচে ব্যাঙ্ক। তার পাশে হেয়ার ড্রেসার। মাঝখান দিয়ে সিঁড়িটা উঠে গেছে সোজা ওপরে। সিঁড়ির শেষে ভারী কাঁচের দরজা। দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকে ডোরম্যান। ইংলন্ডের প্রায় প্রতিটি বার রেস্টুরেন্ট কিংবা ক্লাবে ডোরম্যান রাখতেই হয়। এই গ্রামে ডোরম্যানদের একটা। অ্যাসোসিয়েশন আছে। মোটা বুদ্ধির ছেলেরা পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে সেখানে স্বাস্থ্যচর্চা করে। হাতে পায়ের পেশি ফুলিয়ে নানারকম কায়দা-কৌশল শেখে যাতে শত্রুকে কাবু করা যায়। এরাই। ডোরম্যান সাপ্লাই করে। প্রেমের ডোরম্যানের নাম জিমি। বছর চল্লিশেক বয়স, চওড়া কাঁধ, বিশাল বুক, হাতের পেশিগুলো বুঝিয়ে দেয় ওর শক্তির পরিমাণ। কিন্তু জিমি খুব বেশি লম্বা নয়। আর ওর মুখে হাসি লেগেই আছে। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ হলেই জিমি দরজা খুলে দাঁড়ায়। অত্যন্ত ভদ্র গলায় বলে, গুড ইভনিং!
তিরিশটি টেবিল এবং একশো কুড়িটি চেয়ার। প্রতিটি নতুন খদ্দেরের জন্যে সাদা টেবিল ক্লথ পালটানো হয়। আমেদ, ফারুক আর পল সেজেগুঁজে তিনটে রো দেখাশোনা করে। প্রত্যেকের পরনে সাদা জ্যাকেট কালো বো, কাউন্টারে ওই একই পোশাকে সুদেব দাঁড়িয়ে। এখন আটটা। বাজে। নিচের কিচেনের চার্জে আছেন আকবর ভাই। সিলেটের লোক। বয়স হয়েছে। খুব ভালো রান্না করেন। আমেদের বউ এদেশি। আকবরভাই বিয়ে করেননি। সত্তর সাল থেকে দেশে ফিরে যাননি। কারণ ওঁর পাসপোর্ট নেই। লুকিয়ে জাহাজে করে চলে এসেছিলেন এদেশে। বেআইনি ঢোকার অভিযোগে একটার-পর-একটা কেস চলছিল। ব্রিটেন এখন কোথায় ফেরত পাঠাবে। ওকে? বাংলাদেশ না পাকিস্তানে?মাঝে-মাঝে ছুটি নিয়ে আদালতে ছছাটেন আকবরভাই। পল ছোঁকবার বয়স আঠারো। মিষ্টি চেহারা। খুব হাসিখুশি। ইয়ান বথামের ফ্যান। ওকে সাসপেন্ড করার পর পল দু-দিন কথা বলেনি। বিরিয়ানি খেতে খুব ভালোবাসে। রেস্টুরেন্টের সবাই রাতের খাওয়াটা এখানেই সেরে নেয়। পল আর আমেদ একসঙ্গে ট্যাক্সিতে ফেরে। রাত্রে গাড়ি নিয়ে। আসে না আমেদ। ফারুক ছেলেটা নিরীহ। আমেদের মতো চৌখস কিংবা পলের মতো হাসিখুশি নয়, কিন্তু খুব বিশ্বাসী। খাটতে পারে বেশ। এখন ইংরেজদের উচ্চারণ বুঝে নিয়েছে। ও থাকে আকবরভাই-এর সঙ্গে।
প্রথম খদ্দের এল আটটা পাঁচে। জিমি দরজা খুলে ধরে হাসল, গুড ইভনিং।
হাই জিমি!
হাই।
আমেদ এগিয়ে গেল, গুড ইভনিং মিসেস হাটন।
সুন্দর হাসলেন মিসেস হাটন। তাঁর শরীরে দুধসাদা স্কার্ট, সোয়েটার। আমেদ বলল, শুক্রবারের সন্ধ্যায় প্রথম অতিথি হওয়ার গৌরব আপনার। বলুন, কোন টেবিলে বসলে আপনার ভালো লাগবে?
সো নাইস অফ ইউ। হোয়্যার ইজ দেব? ও দেব! মাইনটি বয়! হাউ আর ইউ? বালিকার মতো ছুটে এলেন মিসেস হাটন। মিস্টার হাটন অন্তত কোটিপতি। মহিলা এলেই চল্লিশ পাউন্ডের নিচে বিল দেন না। সুদেব খুশি হল, বউনি ভালো হলে রাতটা খারাপ যাবে না। কাউন্টার থেকে প্রসারিত হাতের আঙুলগুলো সযত্নে তুলে ঠোঁটে ছোঁয়াল সে, এতক্ষণ মন খারাপ ছিল, এখন ভালো হয়ে গেল।
হাত ফিরিয়ে নিয়ে ঠোঁট ফোলালেন মিসেস হাটন, ওঃ, এত মন রেখে কথা বলতে পারো! অল্প বয়স হলে নির্ঘাত প্রেমে পড়ে যেতাম আমি।
সুদেব মুখ গম্ভীর করল, আই অ্যাম সরি, কিন্তু আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি আমাকে আঘাত দেওয়া ঠিক হচ্ছে না।
থতমত হয়ে গেলেন মিসেস হাটন, আঘাত দিলাম? আমি! কি বলছ?
নিশ্চয়ই। আপনার দিকে তাকালে আমার বয়সের কথা মনেই থাকে না, আর আপনি সেটা মনে করিয়ে দেন।
ওঃ। হাউ নটি, হাউ সুইট! খিলখিলিয়ে হেসে হাত নাড়লেন মিসেস হাটন, গিভ মি এ ভদকা উইদ টনিক। অ্যান্ড হোয়াট ইজ ইওর স্পেশ্যাল টু-নাইট?
প্রেম স্পেশ্যাল। ইউ নো দ্য মিনিং অফ প্রেম।
সো নটি ইউ আর! পে-রেম, লব। ইউ ইন্ডিয়ান আর পোয়েট। বৃদ্ধার মুখে রক্তাভা।
এক্সকিউজ মি ম্যাডাম, আই অ্যাম নো মোর ইন্ডিয়ান। হ্যাভ টু অবটেন ভিসা টু গো দেয়ার।
ও। যেন খুব খারাপ কথা শুনলেন এমনভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে কোণের টেবিলে বসলেন মিসেস হাটন।
কাউন্টারের ওপাশেদাঁড়িয়ে পল সংলাপগুলো শুনছিল। এবার বলল, দেব, আমার মনে হচ্ছে বুড়ি আজ চল্লিশ পাউন্ড খরচ করবে না। তুমি ভুল করলে।
কেন? সুদেব পলের দিকে তাকাল। ওই বয়সে সে ভালো করে কথাই বলতে পারত না। এই ইংরেজ ছোঁকরা তাদের সঙ্গে চমৎকার মিশে গেছে। কিছু-কিছু বাংলা শব্দ আয়ত্তে। অবশ্য আমেদ নির্বাচিত শব্দ শিখিয়েছে।
ও তোমাকে ভারতীয় ভাবতেই পছন্দ করে। তারপর দরজার দিকে তাকিয়ে পরিষ্কার বাংলা বলল, শালা!
জিমি যার জন্য দরজা খুলেছে তার নাম এরা দিয়েছে হাড়কেপ্পন। সবচেয়ে কম দামের খাবার। নিয়ে বুড়ো অনবরত খুঁত ধরার চেষ্টা করে। টিপস দেওয়ার সময় হাত কাঁপতে থাকে। পল এগিয়ে গেল, গুড ইভনিং মিস্টার জোন্স। ডু ইউ থিংক রাইস উইথ ড্রাই মিট উইল বি ফাইন ফর ইউ?
মিস্টার জোন্স কথার জবাব না দিয়ে চারপাশে নজর বোলালেন। তারপর মিসেস হাটনের দিকে তাকিয়ে টুপিটা তুলে বাউ করলেন। মাঝখানের টেবিলে বসে টুপিটা পলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ওয়াইন।
পল হকচকিয়ে গেল, এক্সকিউজ মি, ডিড ইউ সে ওয়াইন!
ডরু আই এন ই। হোয়াই ডোন্ট ইউ টেক হেল্প অফ হিয়ারিং এইড?
শালা বদমাশ। বলে হেসে মাথা নামাল পল। তারপর টুপিটার্যালকে রেখে দিয়ে সোজা সুদেবের কাছে পৌঁছাল, শাইলক ওয়াইন চাইছে আজ। সামথিং রঙ। আই ডোন্ট নো হোয়াই!
সুদেব কোনও কথা বলল না। কর্মচারীদের সঙ্গে তরল ব্যবহার সাধারণত করে না সে। খদ্দেরদের সামনে তো নয়ই। এই সময় টেলিফোন বাজল, রিসিভার তুলে সুদেব অভ্যস্ত গলায় বলল, প্রেম।
ওপাশ থেকে জুডির গলা ভেসে এল, হাই দেব।
হাই জুডি।
লুক! তোমাকে একটা ওয়ার্নিং দেওয়ার জন্য এই ফোন করছি। নাইট সারভিস আমরা চালু। রেখেছি গ্রামের মানুষের সুবিধের জন্য। কিন্তু তোমার রেস্টুরেন্ট থেকে প্রায়ই ফলস কল আসছে! আমাদের ড্রাইভাররা ওখানে গিয়ে কাস্টমার না পেয়ে ফিরে আসছে।
সেটা যদি পাবলিক করে আমার দোষ কি?
পাবলিককে আমরা চিনি না, ফোনটা আসছে তোমার রেস্টুরেন্ট থেকে।
ও কে। আমি দেখছি। বাট জুডি, কতদিন তোমাকে দেখিনি। তোমার মুখটা কেমন আছে?
সেটা জানতে হলে তোমাকে এসে দেখতে হবে। হেসে জুডি লাইন কেটে দিল।
সুদেব দরজার পাশে পাবলিক টেলিফোনটার দিকে তাকাল। পয়সা ফেলে যে কেউ ওখান থেকে ট্যাক্সি নাইট-সার্ভিসকে ডাকতে পারে। কিন্তু ওরা যদি জেনুইন কল অ্যাকসেপ্ট করা বন্ধ করে। দেয় তাহলে নির্ঘাত খদ্দের কমে যাবে। কী করা যায়! পাশাপাশি সিগারেট বক্স। পয়সা ফেললে। সিগারেটের প্যাকেট বেরিয়ে আসে। এসবই খদ্দেরদের সুবিধের জন্য। ব্যাপারটা নজরে রাখতে হবে।
এগারোটা নাগাদ আজ রেস্টুরেন্ট ভরতি। এই গ্রামের সম্মানিত ইংরেজ পুরুষ-রমণী সুসজ্জিতা হয়ে বিভিন্ন টেবিলে। আমেদরা প্রত্যেক টেবিলে মোমবাতি জ্বেলে দিয়েছে রঙিন জারে। কিন্তু খুব ধীরে দেওয়ালে লুকানো স্পিকারে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে। ভারতীয় খাবার খেতে হলে ভারতীয় সঙ্গীত শুনতে হয় এমন ধারণা নিতে চায় সুদেব। মিসেস মাঝে গজগজ করছে, হাড়কিপটের খাওয়া কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। এই সময় দুজন সুন্দরী এহাটন চলে গেছেন অনেকক্ষণ। তার বিল আজ দশ পাউন্ড ছাড়ায়নি। কিন্তু তার জন্য দুঃখ নেই। পল মাঝেলেন। জিমি দরজা খুলে বিগলিত গলায় তাদের বলল, গুড ইভনিং।
হাই জিমি! সোনাইস অফ ইউ জিমি বয়।
জিমি খুব খুশি হল, একটু বসুন, এখনই সেরা টেবিলটা খালি হয়ে যাবে।
অ্যান বলল, মাই গড। পুরো গ্রামটাই তো এসে গেছে। দেবের খুব ভালো দিন যাচ্ছে তাহলে!
জিমি বলল, এই আর কী! সে দুটো চেয়ার এগিয়ে দিল। মার্গারেটকে সেখানে বসতে বলে অ্যান এগিয়ে গেল কাউন্টারের দিকে। দুই বান্ধবীর বয়স চল্লিশের গায়ে। কিন্তু শরীরের। বন্দোবস্ত এবং চামড়ার তোয়াজ তাদের তরুণী রেখেছে। অ্যানের মুখে একটা মাদকতা আছে এবং সেটা সে চমক্কার কাজে লাগায়। কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে অ্যান ঘোষণা করল, দিস ইজ মি।
দেব হাসল, আঃবিউটিফুল।
ডোন্ট বি সিলি। এই সপ্তাহে তোমার একবারও ফোন করার সময় হল না?
তোমার বন্ধুর স্বামী যে গোয়েন্দা অফিসার তা আমি জানতাম না।
তাতে আমার কি?
এবার সুদেবের মনে হল, সত্যিই তো, তাতে অ্যানের কি? অ্যানের স্বামীর তো ব্যাঙ্ক ম্যানেজার। অ্যান বলল, ইউ ইন্ডিয়ান্স আর স্টিল ইন স্টোন এজ। রোজ দুপুরে তোমার জন্য অপেক্ষা করে আমার লাইফ হেল হয়ে গেল। আই ওয়ান্ট এ টেবল, রাইট নাই।
সুদেব চোখ তুলে তাকাল। কোনও টেবিল খালি নেই। শুধু হাড়কিপটে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। সেপলকে ডাকল, টেল মিস্টার জোন্স টু পে দ্য বিল।
পল অ্যানের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসল, আমার কথা শুনবে না।
অ্যান কাঁধ নাচাতে সুদেব উত্তেজিত হল। কাউন্টারের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসে সে জোন্সের সামনে দাঁড়াল, এক্সকিউজ মি মিস্টার জোন্স।
খাবারের প্লেট শেষ করে একটা টেবিল দখলে নিয়ে বুড়ো চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। সুদেবের ডাকটা শুনতেই পেলেন না যেন। সুদেব উষ্ণ হল। সে খুব আস্তে একটা চামচ তুলে প্লেটে ঠুকল, মিস্টার জোন্স!
চোখদুটো খুব ছোট করে খুললেন জোন্স। কোনও কথা বললেন না।
সুদেব বলল, আপনার যদি খাওয়া শেষ হয়ে থাকে তাহলে দয়া করে ভদ্রমহিলাদের জন্যে টেবিল ছেড়ে দিন।
জোন্স ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলেন, লুক লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন, এই ইন্ডিয়ানটা আমাকে অপমান করছে। আমাকে এই রেস্টুরেন্ট থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। এদেশে ওদের বাস করতে দিয়ে বিনিময়ে কী ব্যবহার পাচ্ছি তা আপনারা দেখুন।
সঙ্গে-সঙ্গে নিঃশব্দ হয়ে গেল রেস্টুরেন্ট। সবাই অবাক হয়ে দেখছে। থতমত ভাবটা চটপট কাটিয়ে উঠল সুদেব, আমি আপনাকে অপমান করিনি। আপনি চারঘণ্টা ধরে টেবিল দখল করে আছেন সেটাই মনে করিয়ে দিয়েছি। এবং আপনি জেনে রাখুন আমি ব্রিটেনের নাগরিক।
জোন্স বেরিয়ে এলেন। তারপর খিকখিক করে হাসলেন সময় নিয়ে, ব্রিটিশ। ব্যাঙাচিও নিজেকে মাছ ভাবে। বাট আই উইল লজ কমপ্লেন এগেনস্ট ইউ।
তিন পাউন্ডের নোট টেবিলে ফেলে দিয়ে টুপিটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন জোন্স। পল তাড়াতাড়ি টেবিল ঠিক করে ডাকতেই অ্যান এসে বসল মার্গারেটকে নিয়ে। জিমি এসে দাঁড়াল সুদেবের পাশে, লোকটা এত বুড়ো যে আমি কিছু করতে সাহস পেলাম না। ছুঁলেই যদি মরে যায়।
সুদেব বিরক্ত গলায় বলল, ও-কে। তুমি তোমার কাজ করো।
অ্যান বলল, একটু বসো দেব। লোকটার বয়স হয়েছে, বুড়োরা বেশি কথা বলে। বলে সে মদির হাসল।
সুদেব চেয়ার টেনে নিল। ভেতরে-ভেতরে সে অত্যন্ত উত্তেজিত বোধ করছিল। অনেক বড় গুন্ডাকে সে এই রেস্টুরেন্ট থেকে বের করে দিয়েছে, কিন্তু এভাবে অপমানিত কখনও হয়নি।
অ্যান বলল, মার্গারেটকে তোমার কেমন লাগছে দেব?শী ইজ রিয়েল লোনলি।
সুদেব মুখ তুলে তাকাল। সাধারণ চেহারা মেয়েটার। সে ভদ্রভাবে বলল, আচ্ছা!
মার্গারেট বলল, অ্যান ইজ ডায়িং ফর ইউ!
সুদেবের আর এদিকে মন ছিল না। সে লক্ষ করছিল খুব দ্রুত রেস্টুরেন্ট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। এই সময় পল এসে তার কানে-কানে বলল, কাম হিয়ার বস।
ক্ষমা চেয়ে নিয়ে টেবিল ছাড়ল সুদেব। পল বলল, হাড়কিপটে নিচে দাঁড়িয়ে লোক জড়ো করছে। তারা নতুন খদ্দেরদের ভেতরে ঢুকতে নিষেধ করছে।
মাথায় আগুন জ্বলে গেল সুদেবের। সে দরজা খুলে অর্ধেক সিঁড়ি নেমে এল। অন্তত জনাদশেক লোক জমা হয়েছে। বুড়ো সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। সুদেব বলল, মিস্টার জোন্স, আপনি এইরকম করতে পারেন না। আমার বিরুদ্ধে কিছু বলার থাকলে পুলিশ স্টেশনে যান।
পুলিশ স্টেশন? লোকটা আমার দেশে থেকে আমাকেই আইন দেখাচ্ছে! জোন্স চিৎকার করল।
সুদেব বলল, আপনারা আমাকে চেনেন। জোন্স যা বলছে সেরকম করতে পারি বলে মনে হয়?
জনতা কিছু বলল না। খানিক বাদে তারা চলে যেতে জোন্স বিদায় নিলেন।
সেই রাত্রে দরজা বন্ধ করার সময় দেখা গেল শুক্রবারের বিক্রি সোমবারের চেয়েও কম। প্রেমে। গোলমাল হয়েছে খবরটা কানে যাওয়ামাত্র খদ্দেররা অন্যমুখো হয়েছে। কিন্তু সুদেবের মনে। হচ্ছিল না জোন্সকে টেবিল ছাড়তে বলে সে কোনও অন্যায় করেছে। আজ আমেদ পল আর। ফারুক তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেল। দরজা বন্ধ করার পর সুদেব সোফায় বসে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। খুব ক্লান্ত লাগছে, নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে।
সকালে ঘুম ভাঙল টেলিফোনের আওয়াজে। পুলিশ স্টেশন থেকে তাকে তাড়াতাড়ি রেস্টুরেন্টে যেতে অনুরোধ করা হচ্ছে। কোনওমতে তৈরি হয়ে গাড়ি নিয়েই সে পৌঁছে গেল। এর মধ্যে বেশ ভিড় জমে গেছে। পুলিশ চারপাশে। অফিসার এগিয়ে এসে বললেন, সরি দেব।
সমস্ত রেস্টুরেন্টটায় কেউ যেন দুরমুশ চালিয়েছে। একটা প্লেট ডিশ চেয়ার টেবিল এবং কয়েক হাজার পাউন্ডের মদের বোতল আস্ত নেই। এমনকী কার্পেটগুলোতেও আগুন ধরানো হয়েছিল। বুকের পাঁজর গুড়ো হয়ে যাচ্ছিল সুদেবের। এবং তখনই তার মনে পড়ল এসবই ইনসুরেন্সের আওতায় আছে। যা গেছে তার অনেক বেশি পাওয়া যাবে। অফিসার তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কাউকে সন্দেহ হয়?
কি বলবে সুদেব। সে শেষপর্যন্ত নামটা বলল। অফিসার দ্রুত মাথা নাড়লেন, নো-নো। ইটস ইমপসিবল। জোন্সের বয়স যা তাতে এসব তার পক্ষে সম্ভব নয়। তা ছাড়া গতরাত্রে সে তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে গিয়েছে। সেটা করার পর এসব। অন্য কারও কথা ভাবো।
সুদেব বলল, এই গ্রামের কোনও মানুষ আমার শত্রুতা করবে তা ভাবতে পারছি না।
পুলিশ স্টেশন থেকে বের হতে দেরি হয়ে গেল। যা-যা ক্ষতি হয়েছে তা লিপিবদ্ধ করে একটা। কপি নিয়ে নিয়েছে সে। ইনস্যুরেন্স কোম্পানির লোক এসে দোকানটা সিল করে দিয়েছে। ওরা ক্ষতির মূল্যায়ন করবে। গাড়িটা বাড়ির পেছনে রেখে কয়েক-পা এগোতে সে ফারুক, আকবরভাই এবং আমেদকে দেখতে পেল। প্রত্যেকের মুখ শুকনো। বাড়িতে ঢোকার পর সে বলল, সাতদিন বন্ধ থাকবে। এর মধ্যে ঠিকঠাক করে নেব। আপনাদের মাইনে পাবেন। কিন্তু কে করল?
আকবরভাই বলল, দেব ভাই, খবর ভালো নয়।
কি খবর?
গ্রামে অ্যান্টি ইন্ডিয়ান ফিলিং জোরদার। সকালে প্যাটেলের দোকানে হামলা হয়েছে।
কিন্তু আমি তো ব্রিটিশ সিটিজেন।
ফারুক বলল, সেকথা তো বেশি লোক জানে না। আমি বাংলাদেশের লোক, আমাকেও ইন্ডিয়ানদের মধ্যে ফেলেছে ওরা। কদিনের জন্যে এখান থেকে চলে গেলে ঠিক হয়।
আকবরভাই বলল, কোথায় যাবে? আস্তে-আস্তে সমস্ত ইংলন্ডেই এই হবে। তোমাদের অবশ্য দেশ আছে, আমার তো তাও নেই।
আমেদ চুপচাপ বসেছিল। এবার বলল, আমারও অস্বস্তি হচ্ছে। আসবার সময় দুটো ছোঁকরা আমার দিকে তাকিয়ে সিটি দিচ্ছিল। বউ বলছে কদিন লন্ডন থেকে ঘুরে আসতে।
সুদেব তাকাল। আমেদের বউ ইংরেজ। এখনও সিটিজেনশিপ পায়নি। তবে পেয়ে যাবে। তবু ও ভয় পাচ্ছে। হঠাৎ তার মনে হল হিন্দু-মুসলমানদের রায়টের সময় এইরকম ভয়ার্ত হয়ে থাকত দুই ধর্মের মানুষ। আর আজ দুই ধর্মের মানুষ একসঙ্গে ভয় পাচ্ছে সাদা চামড়াকে। ধর্মের চেয়ে অস্তিত্ব এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে বলল, আমরা মিছিমিছি ভয় পাচ্ছি। ব্রিটেনের ডেমোক্রেসি বিশ্ববিখ্যাত। সরকার নিশ্চয়ই আমাদের প্রোটেকশন দেবে। তা ছাড়া এই গ্রামের সবাইকে আমি চিনি। সামনাসামনি কেউ কিছু করতে সাহস পাবে না। এই সময় ফোন বাজল। সুদেব রিসিভার তুলে বলল, হ্যালো।
হাই দেব। অস্কার।
ও, অস্কার! বলো, কী খবর?
কাল রাত্রে যা ঘটেছে তার জন্যে আমি দুঃখিত।
রিসিভারে হাত চাপা দিয়ে সুদেব আমেদকে বলল, দ্যাখো অস্কার সমবেদনা জানাচ্ছে। সবাই। এক গোত্রের নয়। তারপর হাত সরিয়ে বলল, অনেক ধন্যবাদ। আমি এটাকে দুর্ঘটনা বলে ধরে নিচ্ছি।
না, না। এটা দুর্ঘটনা নয়, অ্যান্টি ইন্ডিয়ান ফিলিং ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। খুব দুঃখের কথা, কিন্তু বাস্তবকে তো মানতেই হবে। বাই দ্য বাই, আমি শুনলাম তুমি নাকি তোমার রেস্টুরেন্ট বিক্রি করে দিতে চাইছ! আমার মনে হয় আমি তোমাকে ঠিক দাম দিতে পারব।
বিক্রি?
হ্যাঁ, তাই তো শুনলাম। তুমি বিপদে পড়েছ ভেবে সবাই দাঁও মারতে চাইবে। আমি সেই দলে নই।
সরি অস্কার, আমি রেস্টুরেন্ট বিক্রি করতে চাই না।
কি যা-তা বলছ? তুমি ওখানে ব্যাবসা করতেই পারবে না!
সেটা আমি বুঝব।
ঠিক আছে। তবে যদি কখনও বাধ্য হও, টেল মি। লাইন কেটে দিল অস্কার।
হাওয়া গরম হয়ে উঠল। সুদেবের বাড়ির সামনে পুলিশ পোস্টেড। এখন শুধু এই গ্রাম নয়, সমস্ত দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আমেরিকা অথবা এশিয়ার অন্য দেশের মানুষ নয়, ভারতীয় এবং তাদের মতো দেখতে বাংলাদেশি এবং পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ। কোথাও-কোথাও সংঘর্ষ হচ্ছে। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক কাঠামো ভারতীয়দের জন্যে দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে বিক্ষোভকারীদের ধারণা। টিভি-তে এই ব্যাপারটা স্পষ্ট দেখানো হচ্ছে। একজন বৃদ্ধ বললেন, কুড়ি বছর ভারতবর্ষে কাটিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলাম শান্তিতে থাকব বলে। কিন্তু মনে হচ্ছে না ফিরলেই ভালো হত। কারণ, ব্রিটেন আর ইন্ডিয়ার কোনও পার্থক্য নেই। রাস্তায়। হাঁটলে তিনজনের মধ্যে একজন ইন্ডিয়ান। দেশে এসে লাভ কি হল। লন্ডনের উপকণ্ঠে একটা ভারতীয় এলাকায় গুলি চলেছে। প্রধানমন্ত্রী সমস্ত দেশবাসীর কাছে আবেদন করেছেন শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্যে। পুলিশকে কঠোর হতে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারি নীতি খুব শিগগির ঘোষণা করা হবে। সম্প্রতি ব্রিটেনে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। সমস্ত পৃথিবী থেকে কলোনি উঠে যাওয়ায় চাকরি কমে গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকাতে সমর্থনের প্রশ্ন নিয়েও জটিলতা দেখা দিয়েছে। বেকার সমস্যা যখন প্রবল হতে চলেছে তখন ভারতীয়দের সংখ্যা বেড়ে চলেছে এবং তারা ব্যাবসা করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছে–এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাববার সময় এসেছে।
সকালে পুলিশ স্টেশন থেকে টেলিফোন এল। গ্রামের সমস্ত ইন্ডিয়ান এবং বাংলাদেশি লন্ডনে চলে গিয়েছে। শুধু সুদেবকে নিয়ে পুলিশ চিন্তিত। যদি সে চায় তাহলে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত তার। এসকর্টের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এখানে সে ব্যাঙ্কে যেতে পারছে না, দোকানে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না কিন্তু লন্ডনে অবস্থা খুব ভালো। সেখানে যা গোলমাল হয়েছিল তা শহরতলিতে কিন্তু তাও থিতিয়ে গিয়েছে। সুদেব চিন্তা করার সময় চাইল।
টিভি খুলল সুদেব। ভারতীয় বাংলাদেশিরা দলে-দলে ব্রিটেন ছাড়ছে। সরকার যতই প্রতিবাদ করুন, কিন্তু সুদেবের মনে হচ্ছিল যতটা কঠোর হওয়া উচিত ততটা হচ্ছে না। যদিও আজ অবধি তার বাড়িতে কেউ কিছু করেনি কিন্তু সুদেব ঠিক করল এইভাবে বোকার মতো সে বসে। থাকবে না। মন হালকা করার জন্যে সে অ্যানকে ফোন করল। কিছুক্ষণ বাজার পর অ্যান ফোন ধরল।
হাই অ্যান, দিস ইজ দেব।
ও মাই গড। ইউ আর স্টিল হেয়ার! অ্যানের গলায় বিস্ময়।
বাঃ আমি কোথায় যাব! আমি তো ব্রিটেনের নাগরিক।
বাট–!
না-না, কোনও কিন্তু নেই। কেমন আছ বলো! দেখা হতে পারে? এখন তো আমার কোনও কাজ নেই। সুদেব খুব মন-খোলা কথা বলার চেষ্টা করল।
কিন্তু দেব, আমি যে ভীষণ ব্যস্ত!
ব্যস্ত?
হুঁ। মাইক এসেছে। মাইককে চেনো? ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেই লম্বা ছেলেটি যে দারুণ নাচে। আমরা দুপুরটাকে এনজয় করছি। বাই দেব।
টেলিফোনটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল দেব। তারপর উঠে জামাকাপড় পরে নিল। ব্রিটিশ সিটিজেনশিপের প্রমাণস্বরূপ পাসপোর্টটা হিপ পকেটে ভরে নিল। তারপর বাইরে বেরিয়ে এল। যে পুলিশটি দাঁড়িয়েছিল সে অবাক চোখে তাকাল, তুমি বাইরে যাচ্ছ? পারমিশন নিয়েছ?
আমারটা আমি বুঝব। তোমার এখানে থাকার দরকার নেই। কথাটা বলে সে জোরে-জোরে পা ফেলে গাড়িতে উঠল। ববের বাড়ির সামনে এসে সে গাড়ি থামাল। বব একা নন। তাঁর পাশে যে বর্ষীয়সী সুন্দরী দাঁড়িয়ে তাঁর নাম ডোরা। ববের একদা প্রেমিকা।
সুদেব বলল, হ্যালো বব!
বব ঘুরে দাঁড়ালেন, হ্যালো! দেব না?
ইয়েস।
ববকে আরও বৃদ্ধ দেখাচ্ছে। বব বললেন, ইউ নো ডোরা! ওয়ান্স আপন এ টাইম উই লভড ইচ। আদার। অ্যান্ড নাউ শী ওয়ান্টস টু স্টে উইদ মি।
আই সি।
দেব, ডোন্ট ইউ থিঙ্ক শী ইজ বিউটিফুল?
ও হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
কিন্তু আমার তো লিজার জন্যে অপেক্ষা করা উচিত, তাই না?
ও বব! লিজা তোমাকে ছেড়ে গিয়েছে। বেটার লেট দ্যান নেভার।
ডোরা এবার সুদেবের দিকে তাকাল, বাট হি ইজ ইন্ডিয়ান, ইজন্ট হি?
ইয়েস। হি ওনস দি রেস্টুরেন্ট, প্রেম। ভেরি নাইস বয়।
বাট হি ইজ ইন্ডিয়ান! ডোরা যেন আঁতকে উঠল। আর তখনই পরিবর্তন এল ববের।
হে দেব! ইউ শুড নট স্টে হেয়ার।
আই নো বব। গাড়িটা চালানো সুদেব। রাস্তা পরিষ্কার। চারধার যেমন কাজকর্ম চলছে তেমন চলছে। কেউ তাকে কিছু বলছে না। ক্রমশ মনে বেশ আস্থা এসে গেল তার। প্রেমে-র সামনে এসে সে দেখল দোকানটা তেমনই বন্ধ। চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল সে গাড়ি থেকে নেমে। হঠাৎ তিনটে ছেলে যেন ভগবানের মতো নেমে এল সামনে। আত্মরক্ষার জন্যে প্রাণপণে চেষ্টা করতে করতে সে চেতনাশূন্য হল।
জ্ঞান ফিরল যখন তখন সে হাসপাতালে। ডাক্তার বললেন, ও কে, নাউ ইউ আর আউট অফ ডেঞ্জার। লাকি বয়।
তার মাথায় ব্যান্ডেজ। সমস্ত শরীরে ব্যথা। সে ধীরে-ধীরে হাতটা নিয়ে গেল হিপ-পকেটে। বুকের ধড়ফড়ানি শান্ত হল। পাসপোর্টটা ঠিকঠাক আছে। হঠাৎ খুব কান্না পেয়ে গেল তার। এই গ্রামটাকে সে নিজের মনে করত। প্রতিটি মানুষকে সে জানে, প্রতিটি ফুটপাত তার চেনা। পাসপোর্টটা পাওয়ার পর থেকেই তার মনে হত সে সবচেয়ে সভ্যদেশে আছে। ছেলেবেলা থেকে যা-যা পায়নি তা পাওয়ার জন্যে চেষ্টা চালাচ্ছিল সে। আর এই দেশটাই রাতারাতি অচেনা হয়ে গেল। সে কি করবে? হাইলাকান্দিতে ফিরে যাবে? তার যা টাকা আছে তা নিয়ে হাইলাকান্দিতে গেলে লোকে তাকে বড়লোক বলবে। সে সিদ্ধান্ত নিল, কালই দেশে ফিরবে। আর তখনই তার। মনে পড়ল সে ইন্ডিয়ায় হুট করে যেতে পারে না। ইন্ডিয়ায় ঢুকতে গেলে সে-দেশের সরকারের কাছে ভিসা লাগবে। ইন্ডিয়ার চোখে সে বিদেশি। বুকের ভেতর আর একটা কষ্ট পাক দিয়ে উঠল। কিন্তু তবু সে চেষ্টা করবে। এই সময় নার্স আসতেই তাকে সে জিজ্ঞাসা করল, কটা বাজে?
এখন রাত এগারোটা।
আমার গাড়িটা কোথায়?
হাসপাতালের কম্পাউন্ডে। কেন?
না, এমনি।
আরও আধঘণ্টা পরে সে টলতে-টলতে গাড়িতে উঠে বসল। মাথায় লাগছে। কিছুক্ষণ পরে সেটা কমতে সে হাসপাতালের দিকে তাকাল। সে যে বেরিয়ে এসেছে তা কেউ লক্ষ করেনি। চাবি বোর্ডেই ছিল। সেটা ঘোরাতেই ইঞ্জিন সাড়া দিল।
রাতের গ্রাম জনমানবহীন। খুব ধীরে-ধীরে সে গাড়ি চালাচ্ছিল। আজ শুক্র কিংবা শনিবার নয় যে রাস্তায় লোক থাকবে। যেন এক মৃত্যুপুরীর মধ্যে দিয়ে সে নিঃশব্দে বেরিয়ে এল বাইরে। আর একটু এগোলেই হাইওয়ে। গাড়িটাকে সে দাঁড় করাল টেলিফোন বুথের পাশে। তার শীত করছিল খুব। হাসপাতালের বিছানায় কেউ গরমজামা পরে শোয় না। এয়ারকন্ডিশন্ড থেকে বেরিয়ে এখন সারা শরীরে কাঁপুনি আসছে। নাম্বার টিপে সে লন্ডনের অপারেটরের সঙ্গে কথা বলল, গিভ মি ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসি।
ওপাশে ফোন বাজল। এবং সঙ্গে-সঙ্গে উত্তর এল। এত রাত্রে এটা আশা করতে পারেনি সুদেব। ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসি।
দেখুন, আমি ভারতবর্ষে ফিরে যেতে চাই। ওখানে আমার মা-বাবা আছেন। আসামে।
যান না, কে মানা করেছে। তবে প্লেনের টিকিটের ব্যবস্থা আমরা করতে পারব না। হেভি রাশ।
কিন্তু আমি ব্রিটিশ পাসপোর্ট হোল্ডার। আমার ভিসা চাই।
আপনি ভারত থেকে আসেননি?
না। বললাম তো আমি ভারতে যাওয়ার জন্যে ভিসা চাই।
সরি! এই মুহূর্তে আমরা ভারতে যাওয়ার জন্যে ভিসা দিচ্ছি না। আপনি কয়েকদিন পরে যোগাযোগ করুন। আমরা এখন ভারতীয়দের নিয়ে ব্যস্ত।
টেলিফোন রেখে হেলান দিয়ে দাঁড়াল সে। আমি তাহলে কি? আমি ভারতীয় নই, পাসপোর্ট থাকা সত্বেও ব্রিটিশরা ব্রিটিশ বলে মনে করে না। আমি এখন কী করব? ফারুক আমেদরা ইচ্ছে। করলেই ওদের দেশে ফিরে যেতে পারে, হয়তো গিয়েছে এতদিনে। হঠাৎ একটা কান্না তার। শরীরকে আচ্ছন্ন করল। তার ঝকঝকে বাড়ি, গাড়ি, রেস্টুরেন্ট, ব্যাঙ্কব্যালেন্স, রঙিন টিভির পাশে হাইলাকান্দির মধ্যবিত্ত বাড়িটা যার বাথরুমে কমোড না থাকায় অসুবিধে হয়, তার স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল।
হঠাৎ একটি মানুষের অস্তিত্ব টের পেয়ে তার সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। মানুষটা তার গাড়ির বনেটে হাত রেখে দাঁড়িয়ে। কি করবে এখন সে? টেলিফোন বুথ থেকে বের হলেই ও আক্রমণ করবে নিশ্চয়ই। মানুষটা এবার এগিয়ে আসছে। চোখ বড় করে সে তাকাতে অবাক হল। মহিলা, বৃদ্ধা। বৃদ্ধারা কি কখনও খুনি হয়?
সে দরজাটা খুলতেই চমকে উঠল। কোনওরকমে উচ্চারণ করল, ইউ?
মহিলার চোখে বিস্ময়। ব্যান্ডেজে মোড়া মুখটাকে চিনতে চেষ্টা করছিলেন তিনি। এগিয়ে এসে হাত ধরল সুদেব, কোত্থেকে আসছ তুমি? একি চেহারা হয়েছে তোমার?
আমি ফিরে আসছি। অনেকটা হেঁটে আসছি। আমি আর পারছি না। কিন্তু তুমি কি আমাকে চেনো? বৃদ্ধার গলায় প্রশান্তি।
ও আমি সুদেব, দেব, ওনার অফ প্রেম।
হায় ভগবান! তোমার চেহারা এরকম কে করল?কী হয়েছে তোমার? বৃদ্ধা ওকে জড়িয়ে ধরলেন।
আমাকে মেরেছে। আমার রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দিয়েছে। দে ওয়ান্ট টু কিল মি।
কিন্তু কেন?
বিকজ, বিকজ–। এক মুহূর্ত ভাবল সুদেব, বিকজ আই অ্যাম ইন্ডিয়ান!
সো হোয়াট?
সুদেব কাঁধ নাচাল। বৃদ্ধা বিড়বিড় করলেন, কি অমানুষ হয়ে যায় মানুষ! তুমি, তুমি কোত্থেকে আসছ?
আই অ্যাম কামিং ব্যাক। আই ওয়ান্ট টু সি বব। ডু ইউ নো ও কেমন আছে? বৃদ্ধা আকুল হলেন।
ভালো। কিন্তু–!
কিন্তু কি?
ডোরা ওর কাছে আছে।
ডোরা! হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন বৃদ্ধা মুখে হাত চাপা দিয়ে। সুদেব বলল, লিজা, আই কান্ট গিভ ইউ এ লিফট। ওই গ্রামে ঢুকলে আমাকে মেরে ফেলবে।
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালেন লিজা, কোথায় যাচ্ছ তুমি?
আই ডোন্ট নো। বলেই সে দূরে গাড়ির আলো দেখতে পেল। গাড়িটা এগিয়ে আসছে। সে চঞ্চল হল, আমি যাই।
লিজা বাধা দিল, তুমি, তুমি ড্রাইভ করতে পারবে?
চেষ্টা করছি।
দাঁড়াও, আমি তোমার হয়ে ড্রাইভ করব।
লিজা গাড়ি চালাচ্ছে। ওরা উলটো পথে যাচ্ছে। পাশে মাথা হেলিয়ে সুদেবের মনে হল এর চেয়ে আরাম কিছুই নেই। লিজার একটা হাত তার হাঁটুতে। হঠাৎ সে জিজ্ঞাসা করল, হিপিরা কেমন?
মানুষের মতো।
গেলে যখন চলে এলে কেন?
দেখা হয়ে গেল। নতুন করে দেখতে ফিরেছিলাম।
তাহলে গ্রামে যাচ্ছ না কেন?
আমার সহ্যশক্তি কম, তাই। নিশ্বাস ফেললেন লিজা, তুমি এখন একটু ঘুমিয়ে পড়ো দেব।
চোখ বন্ধ করেছিল সুদেব। এবার খুলল। হিপি হয়ে যাওয়ার পর লিজার চেহারাটা বিদিকিচ্ছিরি দেখাচ্ছে। চুল যেভাবে ছাঁটা তা সহ্য করা মুশকিল। কিন্তু ড্যাসবোর্ডের আলোয় ওর দিকে। তাকিয়ে থাকতে ওর মনে হল হাইলাকান্দির উঠোনটায় এসে দাঁড়িয়েছে। সে কোনওমতে বলল, লিজা, গাড়ি চালাতে তোমার নিশ্চয়ই কষ্ট হবে। লিজার হাতটা স্নেহ ঝরাল, ননা মাই বয়। লেটস ফরগেট এভরিথিং। ফরগেট ইওর উন্ড। ফরগিভ দেম। কিন্তু তোমার স্পর্শের জায়গাটা খুলে রেখো মানুষের মতো।
শেষ কথাগুলো কানে যাওয়ার পরই একটু গুনগুনানি শুনতে পেল সুদেব। নিশুতি রাতের হাইওয়ে ধরে ছুটে যাওয়া গাড়িতে বসে সে কোনও-কোনও কথা বুঝতে পারছিল না। কিন্তু সুরটা আজন্ম চেনা। দ্রুত ঘুম এনে দিল তাকে।