হুমায়ূন আহমেদের লেখা মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-২২

 লম্বা হেলেটা!” 

‘ই। সাবেরের খুব শখ মীরার গ্রামের বাড়ি দেখা। ওর শখ দেখে আমি কথায় কথায় বলে ফেলেছি আমরা গ্রামের বাড়িতে গেলে তােমাকে খবর দেব, চলে এসাে।’ | আজহার সাহেব বললেন, ক্লাসফ্রেন্ডদের সঙ্গে মেলামেশা একটা পর্যায় পর্যন্তই ভালাে। এর বেশি ভালো না। মীরার কি ইচ্ছা ছেলেটা আসুক?

মীরার গ্রামের বাড়ি 

‘ওর ইচ্ছাও নেই অনিচ্ছাও নেই। আমি ভাবছিলাম মীরার কয়েকজন। ক্লাসফ্রেন্ড এসে যদি হৈ চৈ করে যায় মীরার ভালাে লাগবে।’ 

কয়েকজন আসবে? সাবের যখন আসতে চেয়েছিল তখন আমি বলেছিলাম তােমরা কয়েক বন্ধু মিলে চলে এসাে । মীরার গ্রামের বাড়ি খুব সুন্দর। তােমাদের ভালাে লাগবে। ওদের আবার পাখি শিকার খুব শখ। 

‘পাখি শিকার করতে পারবে না। আইন করে নিষেধ করা আছে। যা। হােক, আসিক পাখি দেখিয়ে আনব।’ 

তুমি যে গ্রামে স্কুল-টুল দিয়েছ, মীরা বড়গলায় বন্ধুদের সেইসব বলেছে। এরা দেখতে খুব আগ্রহী। 

আজহার সাহেব উৎসাহিত গলায় বললেন, আসুক না—অসুবিধা কী? দেলােয়ারকে বল দক্ষিণের দুটা ঘর ঠিকঠাক করে দিতে। একটা কম্বল আছে না কন আসবে? 

মীরা কঠিন গলায় বলল, তুমি সাবেরের সঙ্গে কথা বলতে চাও? 

মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-২২

হ্যা। কেন? “কেন মানে কী? এতবড় একটা ব্যাপার, আমি কথা বলব না?” 

‘তােমার ব্যাপারতো মা না। আমার ব্যাপার। আমি কথা যা বলার বলেছি। এর সঙ্গে কথা বলাবলির আর কিছু নেই।’ 

মনোয়ারা নিজের অজান্তেই মেয়ের গালে প্রচণ্ড চড় বসালেন। মীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলালো। তার চোখে গভীর বিস্ময় । মা তার গায়ে হাত তুলতে পারে এটা সে কখনাে ভাবেনি।’ 

মা আমাকে মারলে কেন? ‘তুমি এমন কিছু করনি যে তােমার গালে চুমু খেতে হবে। 

আমাকে মারতে হবে এমন কিছুও আমি করিনি। 

মনোয়ারা মেয়ের ওপর ঝাপিয়ে পড়লেন। মীর মাকে নিয়ে খাটের উপর পড়ে গেল। খাটের কোনা লেগে মীরার ঠোঁট কেটে গেছে । রক্ত পড়ছে। মীরা হাত দিয়ে ঠোট চেপে ধরে আছে। মীরা খুবই অবাক হয়ে বলল, মা তুমি আমাকে মরহু মারছি। আমি তোকে খুন করে ফেলব | 

 “বেশতাে খুন কর। খুন করে ডেডবডি বস্তায় ভরে পুকুরে পানিতে ডুবিয়ে লাশ। 

একটা কথা না। তুই আমার সঙ্গে আয় । এখন থেকে আমি যা বলব তাই করবি। ( মারা শােবার ঘর থেকে মা’র পেছনে পেছনে বারান্দায় এল। বারান্দায় দেলােয়ার ভীত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সে মীরার দিকে একবার তাকিয়েই চট করে চোখ নামিয়ে দিল। মনােয়ারা হিংস্র ভাঙ্গতে বললেন, আমি এখানে দাড়িয়ে আছ কেন? কী চাও? 

দেলোয়ার মণিৰূরে বলল কিছু চাইনা চাটার্জী। 

ড্রাইভারকে বল, আমি নেত্রকোনা যাব। চাচাজী আমি সাথে যবি?” হ্যা তুমি সঙ্গে যাবে।

মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-২২

 দেলােয়ার দাড়িয়ে আছে। বড় আপার ঠোট দিয়ে রক্ত পড়ছে। খয়েরি শাড়িতে রক্তের দাগ ভরে ভয়ংকর দেখাচ্ছে। এই তথ্যটা চাচীজীকে জানানো দরকার কিন্তু তার সাহসে কুলাচ্ছে না। 

মনােয়ারা বললেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন? কথা কী বলছি কানে যাচ্ছে না? দেলােয়ার ছুটে বের হয়ে গেল। 

মীরা বলল, মা তুমি পাগলের মতাে আচরণ করছ। পাগলের মতাে আচরণ করতে হলে আমি করব। তুমি করছ কেন? আমি তাে স্বাভাবিক আছি। 

তুই স্বাভাবিক আছিস কারণ তুই কী করেছিস বুঝতে পারছিল না। বুঝতে পারলে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে পড়তি।’ 

“তুমি কি এম আমি ল র আলী লেইক ল তাম চাল ‘গলা উঁচু করে কথা বলবি না। খবরদার গলা উঁচু করবি না। কেউ যেন। কিছু না জানে ‘মা তােমার মাথা এলােমেলাে হয়ে গেছে।’ 

আমার মাথা ঠিক আছে। কতটা ঠিক আছে জানতে চাস? প্রয়ােজনে আমি নিজের হাতে ইদুর-মারা বিষ হলে তােকে খাওয়াব। আমার হাত কাপবে না । যা ঘরে যা, কাপড় বদলে আয়।মীরা ঘরে ঢুকল। মনোয়ারা মেয়ের পেছনে পেছনে কুকলেন। তাঁকে হিংস্র লাগছে। তার ঠোটে কেনা জমে আছে। মা’র দিকে তাকিয়ে মীরার বুক কাঁপতে লাগল। এই মাকে সে চেনে না । এই মা তাকে সত্যি সত্যি ইদুর-মারা বিষ কিনে খাওয়াতে পারে। 

গাড়িতে মনােয়ারা সারাপথ চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলেন। তার নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে | বমি ভাব হচ্ছে ! মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে ব্রাস্তায় নেমে তিনি বমি করলেন। সঙ্গে পানি আনা হয়নি। কুলি করা হল না। মুখ ধােয়া হল না।

মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-২২

 দেলােয়ার একবার বলল, চাচাজী দৌড় দিয়া পানি নিয় আসি। মনােয়ারা বললেন, কিচ্ছ আনতে হবে না । 

তিনি রাস্তার পাশের ডোবার কাছে নেমে গেলেন। ডােবার নােংরা পানি মুখে দিলেন। মাথায় দিলেন। ড্রাইভার এবং দেলােয়ার দুজনই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। 

তা দেলােয়ারকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব ভয় পেয়েছে। মীরাও গাড়ি থেকে নেমে এসেছে। সে একবার শুধু বলল, মা তােমার শরীরটা কি খুব খারাপ লাগছে? মনােয়ারা মেয়ের দিকে তার দৃষ্টিতে তাকালেন। কিছু বললেন না। মীরা লক্ষ করল তার মা’র চোখ লাল হয়ে আছে। গাড়িতে ওঠার সময় চোখ লাল ছিল না। এখন চোখ লাল। কি গাড়িতে উঠে মনােয়ারা বেশ স্বাভাবিক হয়ে গেলেন।

দেলােয়ারের সঙ্গে গল্প শুরু করলেন। নানান ধরনের কথা। এখানকার এম. পি. কেমন এম. পি., রাস্তাঘাটের এই অবস্থা ঠিক করছে না। বর্ষাকালে মাঠগুলি কি পানিতে ডুবে যায়? এখানে হাটুবার কবে? পরের হাটে দেলােয়ার যেন খুঁজে দেখে ভেড়া পাওয়া যায় কি না। তার ছোট বেলা থেকে শখ তিন-চারটা বাচ্চা’ওয়ালা একটা মা ভেড়ার । Fন নেত্রকোনা শহরে পৌঁছেই তিনি দেলােয়ারকে বললেন, বাবা তুমি আমাকে আগে একটা টেলিফোন করার ব্যবস্থা করে দাও।

মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-২২

কয়েকটা জরুরি টেলিফোন করব আর এই ফাকে তুমি ভালাে দেখে দুই কেজি খাশির গােশত কিনবে। সিনা আর রান মিলিয়ে কিনবে। যদি টক দৈ পাওয়া যায় তাহলে এক হাঁড়ি টুক দৈ কিনবে। টিক দৈ না পাওয়া গেলে এক বোতল ভিনিগার । ভিনিগার কী জানাে তাে? সিরকা । এর সঙ্গে অবশ্যই তুমি ইদুর মারার যে অষুধ আছে রাটম! র্যাটম কিনবে। ইদুর মারার অষুধ পাওয়া যায় না? দেলোয়ার বলল, চুি পাওয়া যায়। 

‘দু প্যাকেট রটিম কিনবে। ঘরে খুব ইদুরের উপদ্রব । ব্রাতে এরা বড় যন্ত্রণা করে। এক ক জ কর । আমরা গাড়িতে বসছি, তুমি আগে ব্লাটুম নিয়ে এসাে। 

তারপর টেলিফোন করতে যাব। ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে যাও। তাকে এককাপ চা খাইয়ে আনাে। সারা রাস্তা ঝিমুচ্ছিল। 

দেলােয়ার ড্রাইভারকে নিয়ে চলে গেল । মনােয়ারা আগের মতাে সীটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে পরে আছেন। তার বুকের ব্যথাটা বেড়েছে। 

_ মীরা মা’র কাণ্ডকারখানা কিছু বুঝতে পারছে না। মা এমন করছে কেন? তাকে কি ব্র্যাটম লিয়ে ভয় দেখার চেষ্টা করছে? ভয় দেখাবার কিছু কি আর এখন আছে? টেলিফোনে মা কী বলবে তাও সে বুঝতে পারছে না। আর যা অবস্থা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে একটা কথাও তাে বলতে পারার কথা না। মীরা লক্ষ্য করল তার মা’র চোখ এখন আরো লাল হয়েছে। মনে হচ্ছে তার চোখ উঠেছে। 

# মীরা বলল, মা তুমি আমাকে এখানে আসতে বলছ আমি এসেছি। তুমি। টেলিফোন করতে চাচ্ছ, কর । তমি টেলিফোনে তাকে পাবে না। 

মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-২২

পাব না কেন?” ‘এখন প্রায় একটা বাজে। এই সময় সে বাসায় থাকে না । টেলিফোনটা উত্তরার বাসায়। 

কখন সে বাসায় থাকে, কখন থাকে না—সব তাের মুখস্থ। মীরা শােন তাকে যদি টেলিফোনে না-পাওয়া যায় তাহলে তােকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাব।’ = আমাকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাবে। 

‘হ্যা ঢাকায় যাব। দেলােয়ারকে দিয়ে তাের বাবার কাছে চিঠি লিখে যাব যে আমার হঠাৎ শরীর খারাপ করেছে। ডাক্তার আমাকে এক্ষুনি ঢাকায় নিয়ে যেতে বলেছে বলে তুই আমাকে নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হয়েছিস। তাের বাবা দুশ্চিন্তা করবে—করুক দুশ্চিন্তা । দুশ্চিন্তার সে দেখেছে কী? দুশ্চিন্তার তাে সবে 

মীরা বলল, মা তােমাকে সরল সাদাসিধা মেয়ে জানতাম। তুমি মোটেই তা না। তুমি ভয়ংকর একটা মানুষ। 

মনোয়ারা শান্ত গলায় বললেন, আমি যে কত ভয়ংকর সেই সম্পর্কে তার ক) | শারীতি নেই। 

একটা কথা তুমি ভুলে যাচ্ছ মা । আমি তােমার মেয়ে। আমি ও কিন্তু ‘ভয়ংকর। কে জানে হয়তোবা তোমার চেয়েও ভয়ংকর।’ 

ড্রাইভার এবং লিলায়ার ফিরে এসেছে। দেলোয়ারের হাতে কলা পলিথিনের একটা প্যাকেট | মনােয়ারা বললেন, পাহ? 

দেলােয়ার ভীত করে বলল, জ্বি।

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-২৩

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *