মুন অব ইজরায়েল-পর্ব-(১)-স্যার হেনরী রাইডার হ্যাগার্ড

মুন অব ইজরায়েল

শয়তাটার দাড়ি টেনে ধরলাম আমি। 

এখন ভাবতেও অবাক লাগে, এমন দুঃসাহসের কাজ কী করে করলাম আমি? যুবরাজ শেঠির প্রাসাদ না হয়ে অন্য যেকোনাে জায়গা হলে, এর জন্যে গর্দান যাক, দশবিশ ঘা বেত আমি অনায়াসে পেতে পারতাম। 

একথা অবশ্য খুবই ঠিক যে আমাকে মরিয়া করে তুলেছিল ঐ বুড়াে শয়তানটার নিজেরই আচরণদেখা করিয়ে দেব! দেব দেখা করিয়ে!”-বলে বলে দফায় দফায় কি কম ঘুষ নিয়েছে আমার কাছ থেকে! ঐ ঘুষ দিয়ে দিয়েই তাে ফতুর হয়ে গেলাম আমি! গরিব নকলনবিশ, কত আর এনেছিলাম মেম্ফিস থেকে আসবার সময়! হােটেল খরচা সামন্যই দিয়েছি তা থেকে, বাদবাকি সবই গিয়েছে বদমাইশ বুড়াের জঠরেআজ নয় কাল, কাল নয় পরশু”—করে করে আজ এমন অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে আমাকে যে আর একটা দিনও ট্যানিসে টিকে থাকবার মতাে সম্বল আজ আর আমার নেই। 

অথচ মেম্ফিস থেকে ট্যানিসে এসেছি আমি খােদ যুবরাজেরই আমন্ত্রণেপৈতৃক পেশা লিপিকর্ম, নকলনবিশিআমিও তাই দিয়েই জীবনযাত্রা শুরু করেছিলামেকিন্তু কী জানি কী খেয়ালে একদিন শুরু করলাম গল্প লিখতেপরের লেখা নকল করাও ছাড়লাম না অবশ্য, কারণ রােজগার যা কিছু, তা তাে থেকেই। কিন্তু ওর সঙ্গে সঙ্গে লিখতে থাকলাম নিজের মগজ থেকে বার করা নানান রকম কাহিনি, আর তারই এক একটা নকল পাঠাতে থাকলাম দেশের সব শহরের গ্রন্থাগারেউদ্দেশ্য, বিদ্বজ্জনেরা পড়ুন সেসব। তাদের কারও যদি ভাল লেগে যায় দৈবাৎ, একটা স্বীকৃতি যদি পাই কারও কাছ থেকে, আখেরে তা কাজ দিতে পারে আমার। 

মুন অব ইজরায়েল-পর্ব-(১)

পাঠিয়েছিলাম ঐ রকম একটা ভাসাভাসা উদ্দেশ্য নিয়েতখন কি জানি যে আশাতীত সুফল ফলবে তাতে! হঠাৎ একদিন মেম্ফিসের প্রদেশপাল আমায় পাঠিয়ে দিলেন একখানা চিঠিচিঠি লিখছেন স্বয়ং যুবরাজ শেঠি মেনাপ্টাতিনি পড়েছেন আমার গল্প, আমায় ডেকে পাঠিয়েছেন ট্যানিসে। 

আমি তক্ষুনি সেচিঠির একটা জবাব দিয়ে দিলামলিখলাম—আমি সম্মানিতমুন অব ইজরায়েল পুলকিত, মিশর যুবরাজের অনুগ্রহলিপি লাভ করে। যতশীঘ্র সম্ভব আমি ট্যানিস আসছি, তবে অনিবার্য ভাবেই তাতে কিছু বিলম্ব ঘটতে পারে, কারণ এখানকার কাজকর্ম শেষ না করে তাে পারি না যেতে! অনেকের অনেক জরুরী নকলের কাজও তাে রয়েছে আমার হাতে! 

বস্তুত মেম্ফিসের কাজকর্ম শেষ করে ট্যানিসে পৌছােতে আমার প্রায় মাস তিনেক দেরি হয়ে গেল। পোঁছােলাম যখন, তখনই কি তড়িঘড়ি সাক্ষাৎ করতে পারলাম যুবরাজের সঙ্গে! যুবরাজ থাকেন সুরক্ষিত প্রাসাদের অভ্যন্তরে, বাইরে গিজগিজ করছে রক্ষী ও ভৃত্যের দল। সেই রক্ষী আর ভৃত্যেরা সঙ্গে করে ভিতরে না নিয়ে গেলে সাধারণ নাগরিকের সাধ্য কী যে যুবরাজের কাছে পৌঁছােবে? 

আমায় কাজে কাজেই রােজই এসে ধর্না দিতে হচ্ছে যুবরাজপ্রাসাদে। খােসামােদ করতে হচ্ছে এর-ওর-তার—“কি করে দেখা হতে পারে, বলে দাও ভাই?” “দেখা ?”—তারা অনেকে কথাই কইছে না, কারণ তারা জানে যে দেখা করিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। আবার দুই-একজন কইছেও কথা। তাদের সকলেরই বক্তব্য একই। তা হল এই যে পাম্বাসা ছাড়া অন্য কারও অধিকারই নেই বাইরের দর্শনার্থীকে যুবরাজের কাছে নিয়ে যাওয়ার। 

মুন অব ইজরায়েল-পর্ব-(১)

“কে পাম্বাসা?” 

এক বুড়াে, আন্দাজ ষাট হবে তার বয়স। এই বয়সেও বেশ শক্তসমর্থ। মুখে লম্বা দাড়ি, দুধের মতাে সাদা। হাতে একখানা সােনা বাঁধানাে খাটো লাঠি। তার কাছে আমার প্রার্থনা জানাতেই সে মৃদু হেসে বলল—“যুবরাজ? তার সঙ্গে দেখা করতে হলে পায়ে পায়ে মােহর ছড়াতে হবে বাপধন! পারবে?” 

না পেরে উপায় কী? সেই থেকে শুরু হল মােহর ছড়ানাে। দৈনিক একটা। দেখা হলেই পাম্বাসা হাত বাড়িয়ে দেয়, আমি একটা মােহর তুলে দিই সেই হাতে। “দাঁড়াও” বলে সে চলে যায় ভিতর পানে, এক চক্কোর ঘুরে এসে বলে –“আজ উনি বড় ব্যস্ত, কাল হবে।” 

এইভাবে কতকাল যে মহাকাশে বিলীন হল, তার হিসাব দিলে কেউ বিশ্বাস করবে না। অবশেষে, পকেটে আর মােহর নেই দেখে, একদিন মরিয়া হয়ে পাম্বাসার সেই সুদীর্ঘ সাদা দাড়ি আমি টেনে ধরলাম—“আজ দেখা করবই আমি। যদি 

পাই দেখা, চেঁচিয়ে বলব সবাইকে কত মােহর তুমি আমার কাছে ঘুষ নিয়েছ। মিথ্যে আশা দিয়ে !” 

প্রাসাদ চত্বরে লােকারণ্য, যেমন প্রতিদিনই থাকে। রক্ষীরা আমাকে তেড়ে এল ঠিকই, কিন্তু বাইরের লােক যারা উপস্থিত ছিল, তারা এগিয়ে এল হই ইই করে-“কী হয়েছে? হয়েছে কী?”। 

আমি পাম্বাসার ঘুষ নেওয়ার ইতিহাস তাদের কাছে খুলেই বলতে যাচ্ছি।

দেখে দমে গেল বদমাইশটা। কানে কানে বলল আমায়—-“থাক, থাক, আর নালিশ ফরিয়াদে দরকার নেই। চল, দেখা করিয়েই দিচ্ছি তােমায়।” 

এই বলে সে ভিতরে ঢুকল চওড়া সিঁড়ি বেয়ে। আমি তার পিছু নিলাম। কত মহল, কত কক্ষ, কত অঙ্গন যে পেরুতে হল, তার লেখাজোখা নেই। অবশেষে একখানা ঘরের দোরগােড়ায় আমায় দাঁড় করিয়ে রেখে পাম্বাসা ঢুকল ঘরের ভিতরে। দরােজায় পর্দা ঝুলছে, তার পাশে ফাঁকও রয়েছে একটু। আমি ভিতরটা দেখতে পাচ্ছি সেই ফাক দিয়ে। 

মুন অব ইজরায়েল-পর্ব-(১)

ঘরখানা ছােট্ট। বলতে গেলে আমি যে দীনহীন নকলনবিশ মানুষ, আমার লেখার ঘরখানাও এর চাইতে ছােট নয়। টেবিলে খাগড়ার কলম, স্ফটিকের দোয়াত, রং-দানি থরেথরে সাজানাে। কাঠের ফ্রেমে পিন দিয়ে সাঁটা প্যাপিরাসের কাগজ । আর দেয়ালের গায়ে গায়ে কাঠের তাক, তাতে সুশৃঙ্খলভাবে সাজানাে, প্যাপিরাসে লেখা তাড়া তাড়া পাণ্ডুলিপি। 

ঘরে আগুন জ্বলছে সুগন্ধি সীডার কাঠের। আর সেই আগুনের ধারে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং যুবরাজ। আমি অবশ্য আগে কখনাে দেখিনি তাঁকে। কিন্তু তা বলে চিনতে কেন অসুবিধা হবে? মেম্ফিসের উদ্যানে তার মূর্তি দেখেছি না? 

যুবরাজের হাতে একখানা প্যাপিরাসের পাণ্ডুলিপি। তিনি সেটা মেলে ধরে আছেন চোখের সামনে, আর সেই সুযােগে আমি লক্ষ্য করছি তাকে। দেখতে তাকে আমার চেয়ে অন্তত তিন-চার বছরের ছােট দেখায়, যদিও তার আর আমার জন্ম হয়েছিল একই দিনে। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *