অলিভার ক্রমওয়েলের সময়ের কাহিনী। কমনওয়েলথ সেনাবাহিনীতে তার সমসাময়িক পদস্থ অফিসারদের মধ্যে ত্রিশ বছর বয়স্ক কর্নেল মেফেয়ার ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। সতের বছর বয়সে সামরিক জীবনের শুরু করে যুদ্ধে দীর্ণ পিঙ্গল শরীর নিয়ে তখন কর্নেল এই অল্প বয়সেও একজন নিপুণ সৈনিক।
বহু রণক্ষেত্রে তিনি যুদ্ধ করেছিলেন এবং নিজের শৌর্য প্রদর্শন করে ক্রমে ক্রমে সেনাবাহিনীতে উচচপদ ও সাধারণ্যে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। কিন্তু তবু এই মুহূর্তে গভীর অস্থিরতায় নিমগ্ন, তার ভাগ্যের ওপর কোথেকে এক ছায়া নেমে এসেছে।শীতার্ত সন্ধ্যায় তখন বাইরে ঝড়ের মাতলামো আর অন্ধকার। ভেতরে বিষন্ন নির্জনতা।
কারণ, কর্নেল এবং তার তরুণী স্ত্রী তখন কথার উত্তাপে তাদের বেদনাকে অপসারিত করার চেষ্টা করে নিশ্চুপ। অপরাহ্নের পাঠের অধ্যায় আর প্রার্থনা সমাপ্ত করে তখন তাদের হাতে হাত রেখে নির্জন হয়ে বসে চুল্লির আগুনের দিকে চেয়ে থাকা, চিন্তার আলস্যে নিজেদের সমর্পিত করে অপেক্ষায় দীর্ঘ প্রহর গোনা ছাড়া আর কোনো কাজ ছিল না।
তারা জানতেন, তাদের অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে আর সে-কথা চিন্তা করেই কর্নেলের স্ত্রী থরথর করে কেঁপে উঠল এক সময়। সাত বছর বয়সের কন্যা অ্যাবি ছিল তাঁদের প্রাণপ্রতিম একমাত্র সন্তান। এক্ষুণি হয়তো সে আসবে শুভরাত্রির বিদায়-চুমু খেতে। আর সেজন্যই বোধ হয় কর্নেল এই বিষন্ন নীরবতা ভাঙলেন। বললেন, : অন্তত ওর জন্যে তোমার চোখের পানি এবার মুছে ফেল।
এস, আমরা সব ভুলে সুখী হই। অল্পক্ষণের জন্য হলেও যা ঘটবে, তাকে ভুলে থাকতে হবে আমাদের। বেশ, তাই হবে। কান্নায় ভেঙে পড়লেও আমি সব ভুলে যাব। নিঃসঙ্গ হয়ে অন্ধকারে ডুবে থাকব।।: হ্যা, আমাদের নিয়তিকে আমরা গ্রহণ করব, বহন করৰ অবিচলিত ধৈর্যে। জানব তিনি যা করেন, তা-ই সত্যিকারের ন্যায় আর সত্যিকারের দয়া।
: তার ইচ্ছাই পূর্ণ হবে। আমার সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে আমি তাই কামনা করি— আমার সমস্ত হৃদয় দিয়ে আমি যদি তাই বলতে পারতাম! যদি পারতাম, এই প্রিয় হাত যাকে আমি শেষবারের মতো স্পর্শ করছি, চুমু খাচ্ছি— : লক্ষ্মীটি চুপ কর, ওই সে আসছে।
রাত্রিবাস পরিহিত কোঁকড়ানো চুল ছোট্ট একটি শরীর দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। ছুটে গেল বাবার দিকে। আর ছোট্ট মেয়েকে বুকে চেপে ধরে বারবার চুমু খেলেন কর্নেল মেফেয়ার। : তুমি আমাকে ওভাবে চুমু খাচ্ছ কেন বাবা? আমার চুল যে নষ্ট হয়ে যাবে।: না মা, আমাকে ক্ষমা কর। আমি আর ওভাবে চুমু খাব না।
: সত্যি বাবা, সত্যি করে বল, তুমি দুঃখ পেয়েছ? : তুই নিজে বুঝতে পারছিস না, মা। কর্নেল এবার নিজের দু-হাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন।বাবার এই করুণ অবস্থা দেখে ছোট্ট মেয়ে এবার কেঁদে উঠল। বাবার হাত-দুটো নিজের হাত দিয়ে টেনে বলল, : না বাবা তুমি কেঁদো না, কেঁদো না। আমি তোমাকে দুঃখ দিতে চাইনি বাবা। আমি আর কোনোদিন এমনটি বলব না। বাবা তুমি কেঁদো না।
বাবার হাত দুটো টেনে এবার খানিকটা সরিয়ে আনল অ্যাবি। বাবার চোখ-দুটো দেখতে পেল। আর দেখেই উচ্চকণ্ঠে বলে উঠল, ; তুমি কী দুষ্টু বাবা! তুমি একটুও কাঁদছ না। তুমি একটুও দুঃখ পাওনি। তুমি শুধু শুধু আমাকে বোকা বানাচ্ছে। আমি আর তোমার কাছে থাকব না। এই আমি মায়ের কাছে চললাম। এই বলে অ্যাবি সত্যি বাবার কোল থেকে নেমে যাচ্ছিল। কিন্তু ওর বাবা এবার ওকে দু-হাতে কাছে টেনে আনলেন। জড়িয়ে ধরে বললেন,
: না মা, তুই আমাকে ছেড়ে যাবি না। আমি দুষ্টু ছিলাম, এটা স্বীকার করছি কিন্তু আর আমি দুষ্ট থাকব না, মা। আর তুই আমাকে যা শাস্তি দিবি, আমি তা মেনে নেব। বল মা, বল।ছোট্ট মেয়ে অ্যাবি তক্ষুনি শান্ত হয়ে এল। আগের সেই প্রফুল্লতা ফিরে এল তার মুখে। বাবার গালে সে তার ছোট্ট হাত দিয়ে আদর করতে করতে বলল, : তবে একটা গল্প বল-না বাবা, একটা খুব ভালো গল্প।
বাইরে কেমন একটা শব্দ হল অকস্মাৎ। সবারই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল প্রায়! উৎকর্ণ হল সবাই। বাতাসের উদ্দামতার মধ্যে সহসা বুঝি ক্ষীণ পায়ের শব্দ শোনা গেল। ক্রমশ সেই শব্দ নিকট থেকে নিকটতর হল, তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। নিঃসঙ্গ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল সবাই। আর কর্নেল তার ছোট্ট মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, : একটা গল্প, না মা? খুশির গল্প? : না বাবা, খুশির গল্প নয়, একটা খুব ভয়ানক গল্প।
বাবা একটা খুশির গল্প বলতে চাইলেন। কিন্তু মেয়ে নাছোড়বান্দা। সে ভয়ানক একটা গল্প শুনবেই। বাবার সঙ্গে তার শর্ত ছিল সে যা চাইবে তাই হবে। বাবা তার একজন খ্যাতনামা সৈনিক। তিনি কথা দিয়েছেন সে কথা রাখতেই হবে। ছোট্ট মেয়ে এবার বলল, না বাবা, আমাদের সবসময় খুশির গল্প শোনা উচিত নয়। ধাই-মা বলে, মানুষের সব সময় খুশিতে কাটে না।
আচ্ছা বাবা, এটা কি সত্যি? ধাই-মা তাই বলে বাবা। তুমি বল-না, সত্যি কি না? মা কেমন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তাঁর সমস্ত চিন্তা তার আগেকার সেই অস্থিরতায় নিমজ্জিত হল। শান্ত গলায় বললেন, হ্যা মা এটা সত্যি। আমাদের দুঃখ আসে। করুণ, কিন্তু তবু এটা সত্যি মা।তাহলে সেই রকম একটা গল্প বল, বাবা।
যেন আমরা ভাবতে পারি আমরাই সেই গল্পের লোক। এমন গল্প বাবা, যাতে আমরা ভয়ে কাঁপতে থাকি। মা, তুমি আরো কাছে এসে বস। আমার একটা হাত ধর। যাতে আমরা ভয়টাকে কাটাতে পারি। এবার তুমি শুরু কর, বাবা।কর্নেল নিজেই ইচ্ছে করে একটু নড়েচড়ে বসলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, একদা এক সময়ে তিনজন কর্নেল ছিলেন!
: হ্যায় আল্লাহ। আমি কর্নেলদের জানি। তুমিই তো একজন কর্নেল, বাবা। বল।: একবার এক যুদ্ধে সেই কর্নেলরা একটা আইন ভঙ্গ করলেন।বাবার কথা শুনে ছোট্ট মেয়ে অ্যাবি আনন্দিত হয়ে লাফিয়ে উঠল। বাবার দিকে মুখ তুলে বলল, : কী ভাঙল, বাবা? কোনো খাওয়ার জিনিস? মা আর বাবা দুজনেই এবার স্মিতভাবে প্রায় হেসে উঠলেন। তারপর বাবা বললেন : না মা, ঠিক তার উল্টো! সেই কর্নেলরা তাদের যা করা উচিত নয়, তাই করেছিলেন।
: কী করেছিলেন? : না মা! যুদ্ধে যখন হেরে যাচ্ছে ঠিক তেমনি সময় ওদেরকে বলা হয়েছিল শত্রুসৈন্যের ওপর একটা প্রচণ্ড আক্রমণের ভান করতে যাতে করে কমনওয়েলথ বাহিনী নিরাপদে পশ্চাদপসরণ করবার সুযোগ পায়। কি অতি উৎসাহী সেই তিনজন কর্নেল আক্রমণের ভান না কর্নেল নিজেই ইচ্ছে করে একটু নড়েচড়ে বসলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, একদা এক সময়ে তিনজন কর্নেল ছিলেন!
: হ্যায় আল্লাহ। আমি কর্নেলদের জানি। তুমিই তো একজন কর্নেল, বাবা। বল।: একবার এক যুদ্ধে সেই কর্নেলরা একটা আইন ভঙ্গ করলেন।বাবার কথা শুনে ছোট্ট মেয়ে অ্যাবি আনন্দিত হয়ে লাফিয়ে উঠল। বাবার দিকে মুখ তুলে বলল, : কী ভাঙল, বাবা? কোনো খাওয়ার জিনিস? মা আর বাবা দুজনেই এবার স্মিতভাবে প্রায় হেসে উঠলেন।
তারপর বাবা বললেন : না মা, ঠিক তার উল্টো! সেই কর্নেলরা তাদের যা করা উচিত নয়, তাই করেছিলেন। : কী করেছিলেন? : না মা! যুদ্ধে যখন হেরে যাচ্ছে ঠিক তেমনি সময় ওদেরকে বলা হয়েছিল শত্রুসৈন্যের ওপর একটা প্রচণ্ড আক্রমণের ভান করতে যাতে করে কমনওয়েলথ বাহিনী নিরাপদে পশ্চাদপসরণ করবার সুযোগ পায়।
কি অতি উৎসাহী সেই তিনজন কর্নেল আক্রমণের ভান না করে শুক্রসৈন্যের ওপর সত্যি সত্যি আক্রমণ করে বসল। আর ঋড়ের মতন সেই আক্রমণে শত্রুসৈন্য বিপর্যস্ত হয়ে পরাজিত হল। লর্ড জেনারেল তাই তাদের ওপর খুব বিরক্ত হলেন, তালের প্রশংসাও করলেন খুব–তারপর তাদের অপরাধের বিচারের জন্য তিনজনকেই লন্ডনে পাঠিয়ে দিলেন।
: তুমি কি মহান ক্রমওয়েলের কথা বলছ, বাবা? : হ্যা, মা।।: আমি তাকে দেখেছি, বাবা। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যখন তিনি বিরাট ঘোড়ায় চড়ে রাজসিকভাবে চলে যান তার সমস্ত সৈন্য-সামন্ত নিয়ে—তখন দেখতে কী অপূর্ব লাগে। আমি ঠিক তোমাকে বোঝাতে পারব না বাবা। কিন্তু মনে হয় যেন তিনি পরিতৃপ্ত নন। তাকে দেখে সবাই ভয় পায়।আমার কিন্তু একটুও ভয় লাগে না, বাবা। একটুও না।
: তারপর সেই কর্নেলদের বন্দি করে নিয়ে আসা হল লন্ডনে। শেষবারের মতো তাদের নিজেদের পরিজনের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেয়া হল।হঠাৎ আবার সেই পায়ের শব্দ শোনা গেল। সবাই উৎকর্ণ হয়ে উঠল। আবার সেই পায়ের শব্দ শোনা গেল। আর ক্রমশ আবার তা মিলিয়ে গেল ঝড়ের শব্দের সঙ্গে অন্ধকারে। কর্নেলের তরুণী স্ত্রী এবার তার স্বামীর কাধে মাথা রেখে নিজের চেহারার বিবর্ণতাকে গোপন করার প্রয়াস পেল।
: আজ সকালে তারা এসেছে। এবার ছোট্ট অ্যাবি বিস্ফারিত চোখে বলল, : হ্যাঁ, বাবা, এটা কি সত্যি কাহিনী? : হ্যা মা।: আঃ, কী ভালো! বল বাবা, এটা আরো সুন্দর। বল বাবা, তুমি বলে যাও। এ কী মা! তুমি কাঁদছ? : না বাছা, তুমি কিছু ভেব না। ও কিছু নয়। আমি হতভাগ্য পরিবারগুলোর কথা ভাবছিলাম।
: কিন্তু তুমি কেঁদো না, মা। দেখবে, এখনি সব ঠিক হয়ে যাবে। গল্পের প্রথমে এমনই হয়। তারপর সবাই সুখী হয়। তুমি বলে যাও, বাবা ও মায়ের কান্না থামুক।: বাড়ি যেতে দেবার আগে ওদেরকে একবার দুর্গের চুড়োয় নিয়ে যাওয়া হল।: আমাদের বাড়ি থেকে তো সেই দুর্গের চুড়া দেখা যায়, বাবা।
: তারপর সেই দুর্গের চুড়োয় সামরিক আদালতে তাদের ঘণ্টাব্যাপী বিচার হল। তারা বিচারে দোষী প্রমাণিত হল আর পরিণামে তাদের হত্যা করার আদেশ দেয়া হল।; হত্যা।হ্যাঁ বাবা? : হ্যা, হত্যা-বাবার কণ্ঠ এবার কেমন গম্ভীর হয়ে এল।: আঃ, কী অলুক্ষণে! তুমি আবার কাঁদছ মা। না মা, তুমি কেঁদো না। দেখবে, এবার গল্পের ভালো অংশ শুরু হবে। হ্যা বাবা, এবার খুব তাড়াতাড়ি বলতো। দেখছ-না, মা কেমন অধৈর্য হয়ে উঠেছে।
: হা মা, সত্যি। আমি মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছি বলেই হয়তো এমন হয়েছে।: তাইতো বলছি বাবা, তুমি থেমো না।: বেশ তাই হোক। সেই তিনজন কর্নেল, : তুমি কি তাদের চেন, বাবা? : হ্যা, মা।: আহা, আমিও যদি চিনতাম! আমি কর্নেলদের ভালোবাসি, বাবা। তাঁরা কি আমাকে চুমু খেতে দেবে? এবার জবাব দেওয়ার সময় কর্নেল মেফেয়ারের কণ্ঠ থরথর করে কেঁপে উঠল।
বললেন, তাদের একজন নিশ্চয়ই দেবে, মা! নে মা, ওর কথা ভেবে আমার হাতে চুমু খা।: ওঁদের তিনজনের জন্যেই আমি চুমু খেলাম, বাবা। ওঁরা নিশ্চয়ই আমাকে চুমু খেতে দিতেন। আমি বলতাম, আমার বাবাও একজন কর্নেল—ওঁদের মতোই সাহসী। আর তাহলে নিশ্চয়ই ওঁরা আমাকে না বলতে পারতেন না। তুমি কী বল, বাবা?
: হ্যা মা, প্রভু জানেন, নিশ্চয়ই তারা দিত। : না মা, তুমি ওভাবে আর কেঁদো না। এইতো বাবা গল্পের ভালোর দিকে এসে পড়লেন! বল, বাবা।: সবাই দুঃখিত হল ওদের জন্য। সামরিক আদালতেরও সবাই। তারপর তারা সবাই মিলে সেই মহান জেনারেলের কাছে গেল। জানাল, তারা তাদের কর্তব্য পালন করেছে।
তুই বুঝতে পারিস মা, এটাই তাদের কর্তব্য ছিল। আরো প্রার্থনা জানাল, ওদের যে-কোনো দুইজনকে মৃত্যু থেকে রেহাই দেয়া হোক। কারণ, সৈন্যবিভাগে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য একজনের মৃত্যুই যথেষ্ট, কিন্তু জেনারেল অতি কঠোর লোক। তিনি সামরিক আদালতের সদস্যদের তিরস্কার করলেন।
কারণ, তারা তাদের কর্তব্য শেষ করার পর এবং নিজেদের বিচার-বুদ্ধি মতে সিদ্ধান্তে পৌঁছার পর তার কর্তব্য সীমিত করার জন্য তাকে প্রভাবিত করতে চাইছে যা তার সৈনিক-সুলভ মর্যাদার ওপর কলঙ্ক লেপন করবে। কিন্তু তারা জেনারেলকে জানাল যে, তারা তাঁর কাছ থেকে এমন বিশেষ কিছুই চাইছে না।
কারণ, তারা যদি তার জায়গায় থাকত এবং এই অসীম ক্ষমতা ও ক্ষমা করার অধিকারী হত, তাহলে তারা তাই করত। সব শুনে জেনারেল কী যেন ভাবলেন, স্থির হয়ে দাঁড়ালেন কিছুক্ষণ আর তাঁর চেহারার কাঠিন্য ক্রমশ কমে এল। তাদের অপেক্ষা করতে বলে জেনারেল তার গোপন কক্ষে চলে গেলেন প্রার্থনার জন্য। তারপর ফিরে এসে বললেন, তাদের ভাগ্য তাদের নিজেদেরই ঠিক করতে হবে।
এই ভাগ্য-পরীক্ষাতেই সব স্থির হবে। এবং তাদের মধ্যে দুজনকে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই দেয়া হবে।: তারা কী ঠিক করেছে, বাবা? কে, কে তাদের মধ্য থেকে মরবে? : না, মা তারা অস্বীকার করেছে।: তারা এটা করবে না, বাবা? : না। : কিন্তু কেন বাবা? : কারণ, তাদের মধ্যে যে মারা যাবে তার মৃত্যু আত্মহত্যার শামিল হবে, মা।
সত্যিকার খ্রিস্টানের জন্যে আত্মহত্যা নিষিদ্ধ ও মহাপাপ। তাই তারা ওটা প্রত্যাহার করেছে। সামরিক আদালতের আদেশই পালিত হোক। তারা সবাই মৃত্যুর জন্য তৈরি। : এর অর্থ কী, বাবা! : তাদের সবাইকে গুলি করে মারা হবে, মা। বলতে বলতে ভারি শোনাল কর্নেলের কণ্ঠ।
আবার অকস্মাৎ সেই শব্দ। বাতাসের শব্দ নয়। সেই পায়ের শব্দ সৈনিকদের ভারি পদশব্দ। ক্রমশ নিকটতর হল। তারপর এক সময় দরজায় গম্ভীর কন্ঠের আওয়াজ শোনা গেল। : দরজা খুলুন। : ও আবার অকস্মাৎ সেই শব্দ। বাতাসের শব্দ নয়। সেই পায়ের শব্দ সৈনিকদের ভারি পদশব্দ। ক্রমশ নিকটতর হল। তারপর এক সময় দরজায় গম্ভীর কন্ঠের আওয়াজ শোনা গেল।
: দরজা খুলুন। : ওই দ্যাখ, বাবা, সৈন্যরা এসেছেন। আমি সৈন্যদের ভালোবাসি, বাবা, আমাকে ভেতরে নিয়ে যেতে দাও ওঁদের। তারপর ছোট্ট মেয়ে অ্যাবি লাফিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে দিল। আর আনন্দে চিৎকার করে ওদেরকে ভেতরে আসতে বলল। সারি সারি সৈন্য ভেতরে প্রবেশ করে দাঁড়াল।
সামরিক অফিসারটি কর্নেলকে কুর্নিশ করল আর হতভাগ্য কর্নেল সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সে অভিবাদন গ্রহণ করল। বেদনাহত কর্নেলের বিষন্ন স্ত্রীও দাঁড়াল কর্নেলের পাশে। শঙ্কায় সাদা হয়ে গেছে ওর মুখমণ্ডল। শুধু ছোট্ট অ্যাবি আনন্দিত চঞ্চল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সমস্ত দৃশ্যটার দিকে। মা, মেয়ে আর পিতার দীর্ঘ আলিঙ্গনের পর ভারি কণ্ঠের আওয়াজ আবার ধ্বনিত হল ; দুর্গের দিকে।
আর সমস্ত সৈন্যের সঙ্গে তালে তালে পা ফেলে কর্নেল মেফেয়ার চললেন সেই দুর্গের দিকে। যে দুর্গের চুড়ো দেখা যায় ওদের বাড়ি থেকে।: মা, কী সুন্দর হল বল তো! আমি তোমাকে আগেই বলেছি না। ওই দেখ ওরা দুর্গের দিকে যাচ্ছে। বাবা সেই কর্নেলদের দেখতে পাবে। : আয়, মা। আমার কাছে আয়, আয়। বলে দুহাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ভেঙে পড়ল কর্নেলের স্ত্রী অবরুদ্ধ কান্নায়।
পরদিন আর্ত মা আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারল না। ডাক্তার আর নার্সেরা তার বিছানার পাশে বসে তার অসুস্থতা সম্পর্কে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করতে লাগলেন ফিসফিসিয়ে। অ্যাবিকে কিন্তু ঘরের ভেতরে আসতে দেয়া হল না। তাকে জানানো হল, মায়ের খুব অসুখ। কাজেই সে যেন ভেতরে না-এসে বাইরে খেলাধুলো করে।
ছোট্ট মেয়ে সেই শীতে গায়ে একটা র্যাপার জড়িয়ে বাইরে পথে কিছুক্ষণ খেলে বেড়াল। তারপর এক সময় অতি অদ্ভুতভাবে মনে হল অ্যাবির, মায়ের এই দুঃসহ অসুস্থতার সময় বাবা কেন কিছু না-জেনে পড়ে আছেন সেই দুর্গের চুড়োয়। এটা সত্যি অন্যায়। এটা হতে দেয়া উচিত নয়। যে-করেই হোক বাবাকে খবর দিতে হবে। সে নিজেই দেবে।
Read more