একবার লখনৌ গিয়ে কিছুদিন মা’র মাসতুতাে ভাই অতুলপ্রসাদ সেনের বাড়ি আর কিছুদিন অতুলপ্রসাদের বােন ছুটকি মাসির বাড়ি ছিলাম। অতুলমামার বাড়িতে খুব গান বাজনা হত সেটা মনে আছে। অতুলমামা নিজে গান লিখতেন, সে গান মাকে শিখিয়ে মা’র একটা কালাে খাতায় লিখে দিতেন। তখন রবিশঙ্করের গুরু আলাউদ্দীন খাঁ অতুলমামার বাড়িতে ছিলেন আর মাঝে মাঝে পিয়ানাে বাজাতেন। একদিন এলেন তখনকার নামকরা গাইয়ে শ্রীকৃষ্ণ।
রতনজনকার। তিনি গেয়ে শুনিয়েছিলেন বিখ্যাত ভৈরবী ভবানী দয়ানী’ সেটা। পরিষ্কার মনে আছে। এই গান ভেঙে অতুলমামা লিখলেন ‘শুন সে ডাকে। আমারে। | একদিন অতুলমামা আর মা’র সঙ্গে আমাকে যেতে হল এক বক্তৃতা শুনতে । ওস্তাদী গানের বিষয় বক্তৃতা, তার উপর আবার ইংরিজিতে। আমি বার বার ঘুমে ঢলে পড়ছি, আর তারপর অভদ্রতা হচ্ছে বুঝতে পেরে (কিম্বা মায়ের ধমক খেয়ে) জোর করে সােজা হয়ে বসে চোখ খুলে রাখতে চেষ্টা করছি । তখন কি আর জানি যে যিনি বক্তৃতা করছেন তাঁর নাম বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখণ্ডে, আর তাঁর মতাে। সংগীত বিশারদ পণ্ডিত ভারতবর্ষে খুব কমই জন্মেছে ?
ছুটকি মাসির বাড়িতে খুব একটা জমেনি এই কারণে যে মেসােমশাই শ্রীরঙ্গম। দেশিকাচার শেষাদ্রি আয়াঙ্গার ছিলেন মাদ্রাজি, আর তাঁর তিন ছেলেমেয়ে, আমার মাসতুতাে ভাইবােন অমরদা, কুন্তুদি আর রমলাদি, কেউই বাংলা বলত না বা জানত না। আমাকে তাই বেশির ভাগ সময়ই মুখ বন্ধ করে তাদের গড়গড় করে। বলা ইংরিজি শুনতে হত। শুধু সন্ধেবেলা ‘হ্যাপি ফ্যামিলি’ বলে একটা খেলা খেলার সময় তাদের সঙ্গে যােগ দিতে পারতাম।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
সেবার লখনৌতে ছােটমাসিও গিয়েছিল আমাদের সঙ্গে। যাবার সময় না। আসবার সময় মনে নেই, মা আর মাসি উঠে গেলেন ইনটার লেডিস
কামরায় ; আমার সেখানে জায়গা হল না বলে আমাকে কোনােরকমে উঠিয়ে দেওয়া হল পাশের এক সেকেন্ড ক্লাস কামরায়। উঠে দেখি কামরা বােঝাই লালমুখাে সাহেব মেম । আমার বুক ধুকপুক । মুখে রা নেই, উঠে পড়েছি, গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে, নামতেও পারি না। কী আর করি, একটা কোণে মেঝেতে বসে রইলাম চুপটি করে সারারাত । সাহেবরা যদি আমায় বসতে দিতে চেয়েও থাকে, তাদের ইংরিজি বােঝার সাধ্যি ছিল না আমার। আমার ধারণা তারা আমাকে গ্রাহ্যই করেনি ।। | লখনৌতে পরেও গিয়েছি বেশ কয়েকবার। মেজোমামা ছিলেন ওখানকার ব্যারিস্টার। তাঁর দুই ছেলে মন্টু বাচ্চু আমার চেয়ে বয়সে ছােট হলেও আমার খেলার সাথী। শহরটার উপরেও একটা টান পড়ে গিয়েছিল। নবাবদের শহরের বড়া ইমামবড়া, ছােটা ইমামবড়া, ছত্তর মঞ্জিল, দিলখুশার বাগান—এসব যেন মনটাকে নিয়ে যেত আরব্যোপন্যাসের দেশে।
সবচেয়ে আশ্চর্য লাগত বড়া ইমামবড়ার ভিতরের গােলকধাঁধা ভুলভুলাইয়া । গাইড সঙ্গে না থাকলে ভিতরে ঢুকে আর বেরােন যায় না। গাইড গল্প করত একবার এক গােরা পল্টন নাকি বড়াই করে একাই ঢুকেছিল গােলকধাঁধার ভিতরে । তারপর বাইরে বেরােবার পথ। না পেয়ে সেখানেই থেকে যায়, আর না খেতে পেয়ে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। রেসিডেন্সির ভগ্নস্তপের দেয়ালে কামানের গােলার গর্তে সিপাহী বিদ্রোহের চেহারাটা যেন স্পষ্ট দেখতে পেতাম। মাবেলের ফলক বলছে—এই ঘরে অমুক দিন অমক সময়ে কামানের গােলায় স্যার হেনরি লরেন্সের মৃত্যু হয়। ইতিহাস ভেসে ওঠে চোখের সামনে। এই লখনৌকে পরে আমি গল্পে আর ফিল্মে ব্যবহার করেছি। ছেলেবেলার স্মৃতি আমার কাজ অনেকটা সহজ করে দিয়েছিল। |
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
প্রথম লখনৌ যাবার পরেই মা’র সঙ্গে গিয়েছিলাম শান্তিনিকেতনে। সেবার গিয়ে মাস তিনেক ছিলাম। তখন আমার খেলার সাথী ছিল রথীন্দ্রনাথের পালিত মেয়ে পুপে।দুজনের বয়স কাছাকাছি ; রােজ সকালে পুপে চলে আসত, আমাদের ছােট কুটিরে ঘণ্টা খানেক খেলা করে চলে যেত। তখন শান্তিনিকেতনের চারিদিক খােলা। আশ্রম থেকে দক্ষিণে বেরােলেই সামনে দিগন্ত অবধি ছড়ানাে খােয়াই পূর্ণিমার রাতে খােয়াইতে যেতাম আর মা গলা ছেড়ে গান গাইতেন। | মা–ই আমাকে একটা ছােট্ট খাতা কিনে দিয়েছিলেন যেটা নিয়ে মাঝে মাঝে চলে যেতাম কলাভবনে। নন্দলালবাবু সে খাতায় চার দিনে চারটে ছবি একে দিয়েছিলেন আমায় । পেনসিলে গরু আর চিতাবাঘ, রঙ তুলি দিয়ে ভাল্লুক আর ডােরাকাটা বাঘ। বাঘটা একে সব শেষে ল্যাজের ডগায় তলির একটা ছােপ লাগিয়ে সেটা কালাে করে দিলেন। বললাম, “ওখানটা কালাে কেন ?
সেরা সত্যজিৎ নন্দলালবাবু বললেন, এই বাঘটা ভীষণ পেটুক। তাই ঢুকেছিল একটা বাড়ির রান্নাঘরে মাংস চুরি–করে খেতে। তখনই ল্যাজের ডগাটা ঢুকে যায় জ্বলন্ত উনুনের
বছর সাতেক বয়সে প্রথম গেলাম দার্জিলিং। থাকব তিন মাসির বাড়ি পালা করে। ক’দিন থাকব তার ঠিক নেই । মনে আছে যাবার পথে ভােরে ট্রেনে যখন ঘুম ভাঙল, আর জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে দেখলাম হিমালয়, তখন মুখের কথা। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । শিলিগুড়িতে মােটর গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন মায়ামাসিমা, কারণ তাঁর বাড়িতেই থাকব প্রথম । ড্রাইভার বাঙালী ভদ্রলােক। একেবেঁকে পথ। উপরে উঠে চলেছে পাহাড়ের গা দিয়ে । যতই উপরে উঠছি ততই মেঘ আর কুয়াশা বাড়ছে আর ততই জোরে গাড়ি চালাচ্ছেন আমাদের ড্রাইভার । বললেন তাঁর নাকি পুরাে রাস্তার প্রত্যেকটি মােড় নখদর্পণে, তাই ভয়ের কোনাে কারণ। নেই।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
মায়ামাসিমার স্বামী অজিত মেসােমশাই দার্জিলিং–এর নামকরা ডাক্তার (এরই কলকাতার বাড়িতে আমি যুযুৎসু শিখতে যেতাম), আর মাসতুতাে ভাই দিলীপদা আমার চেয়ে বছর পাঁচেক বড়াে, নেপালী বলে একেবারে নেপালীদের মতাে, বাড়ির গেটের ধারে পা ছড়িয়ে বসে নেপালীদের সঙ্গে তাস খেলে, আর ঘােড়া ছােটায় যেন চেঙ্গিস খাঁ। দিলীপদা পরে দার্জিলিং–এর লেবং রেসের মাঠে কিছুদিন। জকি ছিল। সম্ভবত দার্জিলিং–এর ইতিহাসে একমাত্র বাঙালী জকি।। | দিলীপদার সঙ্গে ক্যারাম খেলাটা জমত ভালাে, আর দিলীপদার কাছে ছিল একগাদা কমিকস বই । কমিকসের ভক্ত আমি খুব ছেলেবেলা থেকেই।
আমার জ্বর হলেই মা নিউ মার্কেট থেকে চার আনা দিয়ে দুটো নতুন কমিকস এনে দিতেন—তার মধ্যে সবচেয়ে ভালাে লাগত ‘কমিক কাটস’ আর ‘ফিল্ম ফান’ । | মায়ামাসির বাড়ি থেকে গেলাম মনুমাসির বাড়ি । এই মাসির স্বামী হলেন সেই মেসােমশাই, যাঁর ইনশিওরেন্স কোম্পানিতে সােনামামা কাজ করতেন। বাড়ির নাম এলগিন ভিলা, বাড়ির সামনে পাহাড়ের মাথা চেঁছে তৈরি করা টেনিস মাঠ ; মেসাের সঙ্গে তাঁর ছেলেরাও টেনিস খেলে।