এই মেসাের বিষয় একটু আলাদা করে বলা দরকার, কারণ ছেলেবেলার আমাদের স্মৃতির অনেকটাই এর কলকাতায় আলিপুরে নিউ রােডের বিশাল বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
অবিনাশ মেসােমশাই একেবারে কেরানি অবস্থা থেকে বিরাট এম্পায়ার অফ ইন্ডিয়া লাইফ ইনশিওরেন্স কোম্পানীর মালিকের পদ অবধি উঠেছিলেন। তখন তিনি হাবভাবে একেবারে সাহেব ; তাঁকে দেখে তাঁর প্রথম অবস্থা কল্পনা করা
যখন ছােট ছিলাম অসম্ভব। মেশাের ছেলেমেয়ে অনেকগুলি, তার মধ্যে বড় ছেলে অমিয় আমার সােনামামার বন্ধু । দু’জনকে এক সঙ্গে মুগার সুতাে দিয়ে ঘুড়ি ওড়াতে দেখেছি। বকুলবাগানের ছাত থেকে, যদিও ঘুড়ি ওড়ানাের বয়স তখন ওঁদের নয়, আমার নিউ রােডের বাড়িতে বিয়ে হলে যা ধুমধাম হত, তেমন আমি আর কোথাও দেখিনি। শুধু লােকজন খাওয়ানাে নয়, সেই সঙ্গে আমাদের ব্যবস্থাও থাকত।
যখন ছোট ছিলাম-
একবার বড় মেয়ের বিয়েতে মেসসা ব্যবস্থা করলেন প্রােফেসর চিত্তরঞ্জন গােস্বামীর কমিকের। সেই সময়ে কলকাতার সবচেয়ে নামকরা কমিক অভিনেতা ছিলেন গােস্বামী মশাই । এ জিনিসটা আজকাল ক্রমে উঠে যাচ্ছে। ঘণ্টাখানেক ধরে একজন লােক নানান রংতামাসা করে দর্শককে জমিয়ে রাখবে, এমন ক্ষমতা আজ আর কারুর নেই। চিত্তরঞ্জন গােস্বামী সেটা অনায়াসে পারতেন । আলিপুরের বিয়েতে তাঁর একটা কমিক আমার এখনাে মনে আছে, তার কারণ সেটা শুনে আমার লক্ষ্মণের শক্তিশেলের কথা মনে হয়েছিল ।
যখন ছোট ছিলাম-
‘রাবণ আসিল যুদ্ধে পরে বুট জুতাে (আর) হনুমান মারে তারে লাথি চড় গুতাে
(নামের কী মহিমা, রামনামের কী মহিমা !) এই দিয়ে শুরু, আর শেষের দিকে ছিল—
গ্যাঁক করে বিধল বাণ দশাননের বুকে। বাপরে বাপ ডাক ছাড়ে ধুয়াে দেখে চোখে
(নামের কী মহিমা !) বিশ হাতে পটল তােলে, দশ মুখে বাজে শিঙে। দেখতে দেখতে রাবণ রাজা তুলে ফেলল ঝিঙে।
(নামের কী মহিমা !) এ জিনিস অবশ্য চিত্তরঞ্জন গােস্বামীর মতাে কেউ গাইতে পারবে না। কমিক দেখিয়ে আমাদের পেটে খিল ধরিয়ে দিয়ে সব শেষে ভদ্রলোেক টপাটপ খেয়ে ফেললেন উনিশটা রসগােল্লা। | অবিনাশ মেসােমশাইর একটা আলিসান ইটালিয়ান গাড়ি ছিল যার নাম ল্যানসিয়া। গাড়ি যখন চলত তখন বনেটের ডগায় দপ দপ করে গােলাপী আলাে বেরােত একটা কাচের ফড়িং–এর গা থেকে। | আমরা যখন দার্জিলিং গেছি, মা’র তখনাে কলকাতার চাকরি হয়নি। দার্জিলিঙে কিছুদিন থাকার পরেই হঠাৎ মাস্টারির চাকরি নিয়ে ফেললে মহারানী। গার্লস স্কুলে, আর সেই সঙ্গে আমিও সেই স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলাম | অদ্ভুত ইস্কুল, ক্লাসে ক্লাসে ভাগ নেই ; আমি একটা বড় হলঘরের এক জায়গায় বসে পড়ছি, দূরে ওই কোণে দেখতে পাচ্ছি আরেকটা ক্লাসে মা অঙ্ক কষাচ্ছেন।
যখন ছোট ছিলাম-
ক’দিন সেরা সত্যজিৎ পড়েছিলাম স্কুলে তা মনে নেই। সত্যিই কিছু পড়েছিলাম, না চুপচাপ বসিয়ে রাখা হত আমাকে যতক্ষণ না মা’র ছুটি হয় তাও মনে নেই।
এদিকে মনটা ভারী হয়ে আছে, কারণ মেঘ আর কুয়াশার জন্য এসে অবধি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা হয়নি। কলকাতার বাড়ির দেয়ালে টাঙানাে আছে ঠাকুরদাদার আঁকা রঙিন কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি ; মন ছটফট করছে মিলিয়ে দেখার জন্য ছবির কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে আসল কাঞ্চনজঙ্ঘা। অবশেষে এলগিন ভিলাতে একদিন ভােরবেলা ঘুম ভাঙিয়ে দিলেন । ছুটে গেলাম জানালার ধারে ।।
ঠাকুরদাদার ছবিতে ছিল বরফের উপর বাঁ দিক থেকে পড়ছে বিকেলের রােদ, আর এখন চোখের সামনে দেখছি ডানদিক থেকে রঙ ধরা শুরু হয়েছে । ” হাঁ করে চেয়ে রইলাম যতক্ষণ না সূর্যের রঙ গােলাপী থেকে সােনালী, সােনালী থেকে রূপালী হয়। এর পরে নিজের দেশে আর বাইরে পৃথিবীর বহু দেশে বহু নাম করা সুন্দর দৃশ্য দেখেছি, কিন্তু সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের কাঞ্চনজঙ্ঘার মতাে সুন্দর দৃশ্য আর কোথাও দেখিনি।
গাড়িতে কোথাও যাবার না থাকলে সবাই মিলে হেঁটে বেড়াতে বেরােতাম। সন্ধ্যাবেলা । ফিরতাম খাবার সময়ের ঠিক আগে । টিমটিমে লণ্ঠন আর কেরােসিন। ল্যাম্পের আলাে, তার মধ্যে বসে গল্প আর খেলা দারুণ জমত। তাসের খেলা। ছিল, “আয়না মােহর’ আর ‘গােলাম চোর’ । গােলাম চোর সকলেই জানে, কিন্তু আয়না মােহর খেলা আর কাউকে কখনাে খেলতে দেখিনি। আর সে খেলার যে কী নিয়ম সেটাও আজ আর মনে নেই।
যখন ছোট ছিলাম-
ছুটিতে বাইরে সবচেয়ে বেশি ফুর্তি হত মেজোপিসিমার বাড়িতে। পিসেমশাই ছিলেন সদর ডেপুটি অফিসার। তাঁর কাজের জায়গা ছিল বিহার। বদলির চাকরি—কখনাে হাজারিবাগ, কখনাে দ্বারভাঙ্গা, কখনাে মজঃফরপুর, কখনাে আরা—এইভাবে ঘুরে ঘুরে কাজ। আমি যখন প্রথম যাই ওদের কাছে তখন ওরা ছিলেন হাজারিবাগে । পিসিমার দুই মেয়ে—নিনি আর রুবি, আর তাদের বাপ–মা–হারা খুড়তুতাে ভাই বােন কল্যাণ আর লতু। সবাই আমার চেয়ে বয়সে। বড় আর সবাই আমার বন্ধু।। | হাজারিবাগে এর পরে আরাে কয়েকবার গেছি। প্রথম বার যাওয়া থেকে মনে আছে পিসেমশাই–এর সবুজ রঙের ওভারল্যান্ড গাড়ি । তখনকার গাড়ির লটখটে চেহারা দেখে এখনকার লােকের হাসি পাবে, কিন্তু এই ওভারল্যান্ড যে কত তাগড়াই গাড়ি ছিল, আর কত ঝঞার মধ্যেও সে তার বাহনের কর্তব্য পালন করে। এসেছে সেটা পিসেমশাই–এর মুখে শুনতাম।
এই গাড়িতে করেই আমরা গিয়েছিলাম রাজরাপ্পা। হাজারিবাগ থেকে মাইল চল্লিশেক দূরে ভেড়া নদী পেরিয়ে মাইল খানেক হাঁটার পর রাজরাপ্পা। সেখানে গা ছমছম করা ছিন্নমস্তার মন্দিরকে ঘিরে দামােদর নদীর ওপর জলপ্রপাত, বালি, দূরের বন আর পাহাড় মিলিয়ে অদ্ভুত দৃশ্য।
ফেরার পথে গাড়ি খারাপ হয়ে গেল ব্রাহ্মণবেড়িয়া পাহাড়ের ধারে। পাহাড়ে নাকি অনেক বাঘ ভাল্লুক । গাড়ি সারাতে সারাতে রাত হয়ে গেল, কিন্তু বাঘ। ভালুকের দেখা পেলাম না।
অন্য খেলার মধ্যে একটা মজার খেলা ছিল ‘হুইস্পারিং গেম’ ।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়-(পর্ব-১০)