পাঁচ জনে গােল হয়ে বসে খেলা । একজন তার বাঁয়ের লােকের কানে ফিসফিস্ করে একটা কথা বলল। একবারের বেশি বলা চলবে না। সেই একবারে বাঁয়ের লোেক যা শুনল, সেটাই সে তাঁর বাঁয়ের লােককে বলল।এই ভাবে কান থেকে কান ঘুরে কথা আবার যে শুরু করেছিল তার কানেই ফিরে এল। মজাটা হচ্ছে কথা শেষ। পর্যন্ত কী–তে দাঁড়াল তাই নিয়ে । আমি একবার শুরু করে বাঁয়ের লােকের কানে। বললাম, হারাধনের দশটি ছেলে। সেটা যখন শেষে আমার কানে ফিরে এল, তখন হয়ে গেছে ‘হ্যাংলা কানে হাতি হাসে। দশ বারােজন লােক হলে খেলাটা আরাে বেশি জমে।
হাজারিবাগের পরে গিয়েছি দ্বারভাঙ্গা, আর তারও পরে আরা। এই দুটো। জায়গাই হাজারিবাগের তুলনায় কিছুই না, কিন্তু তাতে ফুর্তিতে কোনাে কমতি হয়নি। ইতিমধ্যে নিনি রুবির আরেক খুড়তুতাে বােন ডলি এসে খেলার সাথী। আরেকজন বেড়ে গেছে।
দ্বারভাঙ্গাতে প্রকাণ্ড কম্পাউন্ডওয়ালা বাংলাে টাইপের একতলা বাড়ি। কম্পাউন্ডেব একদিকে লম্বা লম্বা শিশু গাছ, আম গাছ আর আরাে কত কী। গাছ। বাড়ির বাঁ পাশে খােলা জায়গায় আরেকটা বড় আম গাছ। সেটা ছিল দোলনার গাছ ।
সেরা সত্যজিৎ আমরা যখন গিয়েছি তখন বর্ষাকাল। এক পশলা বৃষ্টির পর দোলনার গাছের তলার ঘাসবিহীন জমিতে সরু সরু খাল নালা দিয়ে বৃষ্টির জল বেগে গিয়ে পড়ত। নর্দমায়। আমরা কাগজের নৌকো তৈরি করে নালার জলে ভাসিয়ে দিতাম। নালা এখন নদী ; নৌকো নদীর স্রোতে ভেসে গিয়ে পড়ত নর্দমার সমুদ্রে । ( মাঝে মাঝে এই নোকো হয়ে যেত ভাইকিং–এর নৌকো । হাজার বছর আগে নরওয়েতে জলদস্যু ছিল—তাদের বলা হত ভাইকিং।
যখন ছোট ছিলাম-
আমরা মনে করে নিতাম। যে ভাইকিংদের মধ্যে কেউ জলপথে মারা গেলে তাকে নৌকোতেই দাহ করা হয়। আমরা কাগজের জলদস্যু তৈরি করে কাগজের নৌকোয় তাকে শুইয়ে দিয়ে তার মুখে আগুন দিয়ে নৌকো ছেড়ে দিতাম বৃষ্টির জলে । এটা ছিল ‘ভাইকিংস ফিউনারেল। অবিশ্যি ভাইকিং–এর সঙ্গে নৌকোও দাহ হয়ে যেত । ( আরায় যখন গিয়েছি তখন আমার বয়স নয় । লাল ইটের বিশাল বাড়ি। পিসেমশাইয়ের । মাঝখানে উঠোন ঘিরে বেশ অনেকগুলি ঘর ; যদূর মনে পড়ে, তার কয়েকটা ব্যবহারই হত না। দোতলার ছাতের সঙ্গে কিছু ঘরও ছিল, তারই। একটা ছিল পিসেমশাইয়ের কাজের ঘর।
বাড়ির সঙ্গে মানানসই বাগানও ছিল। ” কল্যাণদা যদিও আমার চেয়ে বছর ছয়েকের বড়, সে তখন আমার বিশেষ বন্ধু। সে স্ট্যাম্প জমায় ; তার দেখাদেখি আমিও জমানাে শুরু করেছি, হিঞ্জ। কিনেছি, টুইজারস (চিমটে) কিনেছি,এমন কি একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাসও জোগাড় করেছি স্ট্যাম্পে কোনাে ছাপার ভুল আছে কি না দেখার জন্য । ভুল থাকলেই সে টিকিটের দাম অনেক বেড়ে যায়।দিশি বিলিতি যে কোনাে টিকিট হাতে পেলেই চোখে ম্যাগনিফাইং গ্লাস। নাঃ—এটাতে তাে কোনাে ভুল নেই। এটাতেও না । কোনাে টিকিটে কোনােদিনই ছাপার কোনাে ভুল পাইনি। তাই বােধহয় শেষ। পর্যন্ত নিরুৎসাহ হয়ে টিকিট জমানাে ছেড়ে দিই। কল্যাণদার আরেকটা ভূমিকা ছিল সেটা এখানে বলা দরকার। ক্রিসমাস ব্যাপারটার উপর ছেলেবেলা থেকেই একটা টান ছিল সেটা আগেই বলেছি। ফাদার ক্রিসমাস বলে যে একটা বুড়াে দাড়িওয়ালা লােক আছে, আর সে।
যখন ছোট ছিলাম
যে ক্রিসমাসের আগের দিন রাত্তিরে ছােট ছােট ছেলেমেয়েদের ঘরে ঢুকে, খাটের রেলিং–এর ঝােলানাে তাদের মােজাতে খেলনা ভরে দিয়ে যায়, এটা বােধহয় পুরােপুরি বিশ্বাস করতাম । | মেজোপিসিমার বাড়িতে যত ফুর্তি, তেমন তাে আর কোথাও নেই। তাই সে ফুর্তি থেকে ক্রিসমাসটা বাদ পড়ে কেন ? ডিসেম্বর মাসের দরকার কী ? যে। কোনাে মাসেই তাে হতে পারে ক্রিসমাস ! ( আরাতে তাই জুন মাসে কল্যাণদা হয়ে গেল ফাদার ক্রিসমাস । আমার খাটের। রেলিং–এ মােজা ঝুলিয়ে দেওয়া হল। রাত্তিরে আমি মটকা মেরে পড়ে রইলাম
যখন ছােট ছিলাম বিছানায় । তুলাে দিয়ে দাঁড়িগোঁফ করে আঠা দিয়ে লাগিয়ে পরে নিল কল্যাণদা । পিঠে একটা থলি চাই, কারণ তাতে জিনিস থাকবে ; আর ফাদার ক্রিসমাস যে আসছেন সেটা জানান দেওয়া চাই। তাই থলিতে অন্য জিনিসের সঙ্গে পুরে দেওয়া হয়েছে বেশ কিছু খালি টিনের কৌটো ।।
আধ ঘণ্টা খানেক চুপটি করে শুয়ে থাকার পর শব্দ পেলাম ঝম ঝম ঝম ঝম।
যখন ছোট ছিলাম
একটু পরে আবছা অন্ধকারে আধ বােজা চোখে দেখলাম ফাদার–ক্রিসমাসবেশী কল্যাণদা থলি নিয়ে ঢুকল, খাটের রেলিং–এর পাশে এসে থামল, আর তার পরেই খুটখাট শব্দে বুঝলাম আমার মােজার মধ্যে কী জানি পুরে দেওয়া হচ্ছে। সব ফাঁকি সেটা নিজেও জানি, কিন্তু তাও মজার শেষ নেই।
সেবার ধনদাদুও এসেছিলেন আরাতে আমরা থাকতে থাকতেই । আমরা ভাই বােনের দল সবাই বিকেলে বেড়াতে বেরােতাম দাদুর সঙ্গে। আরা স্টেশন ছিল। আমাদের বাড়ি থেকে মাইল দেড়েক। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সন্ধের সময়ে দেখতাম ইম্পিরিয়াল মেল আমাদের সামনে দিয়ে দশ দিক কাঁপিয়ে সিটি মারতে মারতে ছুটে বেরিয়ে গেল। এই জাঁদরেল ট্রেনের কামরার বাইরেটা ছিল হালকা হলদে রঙের ; আর তার উপর ছিল সােনালী রঙের নকশা। আর কোনাে ট্রেনের এত বাহার বা দাপট ছিল না ।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
একদিন সবাই যাচ্ছি স্টেশনের দিকে, দাদু সােলাটুপি ও হাতে লাঠি সমেত পুরােদস্তুর সাহেবী পােশাক পরে আমাদের সামনে সামনে চলেছেন। এমন সময় কোত্থেকে এক গরু শিঙ বাগিয়ে চোখ রাঙিয়ে ধেয়ে এল আমাদের দিকে। এমন হিংস্র গরু আর আমি দেখিনি কখনাে। দাদু তক্ষুনি বললেন, তােমরা মাঠে নেমে যাও। | মাঠে নামতে হলে যে ফণীমনসার বেড়া ভেদ করে যেতে হয় সে খেয়াল দাদুরও নেই, আমাদেরও নেই । মনসার ঝােপের মধ্যে দিয়েই মাঠে গিয়ে নামলাম। হাতে পায়ে কাঁটার আঁচড়ে জখমটা যে কতদুর হয়েছে সেটা সে অবস্থায় বুঝতেই পারিনি। আমরা ঝােপের ফাঁক দিয়ে দম বন্ধ করে দেখছি দাদু গরুর দিকে মুখ করে দু পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে হাতের লাঠিটা এরােপ্লেনের প্রপেলারের মতাে বন বন করে ঘােরাচ্ছেন, আর গরুটাও শিঙ বাগিয়ে হাত পাঁচেক দূরে দাঁড়িয়ে এই অদ্ভুত মানুষটার অদ্ভুত কাণ্ড দেখে থমকে গেছে।