যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়-(পর্ব-১২)

পাঁচ জনে গােল হয়ে বসে খেলা একজন তার বাঁয়ের লােকের কানে ফিসফিস্ করে একটা কথা বললএকবারের বেশি বলা চলবে নাসেই একবারে বাঁয়ের লোেক যা শুনল, সেটাই সে তাঁর বাঁয়ের লােককে বললযখন ছোট ছিলামএই ভাবে কান থেকে কান ঘুরে কথা আবার যে শুরু করেছিল তার কানেই ফিরে এলমজাটা হচ্ছে কথা শেষপর্যন্ত কীতে দাঁড়াল তাই নিয়ে আমি একবার শুরু করে বাঁয়ের লােকের কানেবললাম, হারাধনের দশটি ছেলেসেটা যখন শেষে আমার কানে ফিরে এল, তখন হয়ে গেছে হ্যাংলা কানে হাতি হাসেদশ বারােজন লােক হলে খেলাটা আরাে বেশি জমে। 

হাজারিবাগের পরে গিয়েছি দ্বারভাঙ্গা, আর তারও পরে আরাএই দুটোজায়গাই হাজারিবাগের তুলনায় কিছুই না, কিন্তু তাতে ফুর্তিতে কোনাে কমতি হয়নিইতিমধ্যে নিনি রুবির আরেক খুড়তুতাে বােন ডলি এসে খেলার সাথীআরেকজন বেড়ে গেছে। 

দ্বারভাঙ্গাতে প্রকাণ্ড কম্পাউন্ডওয়ালা বাংলাে টাইপের একতলা বাড়িকম্পাউন্ডেব একদিকে লম্বা লম্বা শিশু গাছ, আম গাছ আর আরাে কত কীগাছবাড়ির বাঁ পাশে খােলা জায়গায় আরেকটা বড় আম গাছসেটা ছিল দোলনার গাছ । 

সেরা সত্যজিৎ আমরা যখন গিয়েছি তখন বর্ষাকালএক পশলা বৃষ্টির পর দোলনার গাছের তলার ঘাসবিহীন জমিতে সরু সরু খাল নালা দিয়ে বৃষ্টির জল বেগে গিয়ে পড়তনর্দমায়আমরা কাগজের নৌকো তৈরি করে নালার জলে ভাসিয়ে দিতামনালা এখন নদী ; নৌকো নদীর স্রোতে ভেসে গিয়ে পড়ত নর্দমার সমুদ্রে ( মাঝে মাঝে এই নোকো হয়ে যেত ভাইকিংএর নৌকো হাজার বছর আগে নরওয়েতে জলদস্যু ছিলতাদের বলা হত ভাইকিং

যখন ছোট ছিলাম-

আমরা মনে করে নিতামযে ভাইকিংদের মধ্যে কেউ জলপথে মারা গেলে তাকে নৌকোতেই দাহ করা হয়আমরা কাগজের জলদস্যু তৈরি করে কাগজের নৌকোয় তাকে শুইয়ে দিয়ে তার মুখে আগুন দিয়ে নৌকো ছেড়ে দিতাম বৃষ্টির জলে এটা ছিল ভাইকিংস ফিউনারেলঅবিশ্যি ভাইকিংএর সঙ্গে নৌকোও দাহ হয়ে যেত ( আরায় যখন গিয়েছি তখন আমার বয়স নয় লাল ইটের বিশাল বাড়িপিসেমশাইয়ের মাঝখানে উঠোন ঘিরে বেশ অনেকগুলি ঘর ; যদূর মনে পড়ে, তার কয়েকটা ব্যবহারই হত নাদোতলার ছাতের সঙ্গে কিছু ঘরও ছিল, তারইএকটা ছিল পিসেমশাইয়ের কাজের ঘর

বাড়ির সঙ্গে মানানসই বাগানও ছিলকল্যাণদা যদিও আমার চেয়ে বছর ছয়েকের বড়, সে তখন আমার বিশেষ বন্ধুসে স্ট্যাম্প জমায় ; তার দেখাদেখি আমিও জমানাে শুরু করেছি, হিঞ্জকিনেছি, টুইজারস (চিমটে) কিনেছি,এমন কি একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাসও জোগাড় করেছি স্ট্যাম্পে কোনাে ছাপার ভুল আছে কি না দেখার জন্য ভুল থাকলেই সে টিকিটের দাম অনেক বেড়ে যায়দিশি বিলিতি যে কোনাে টিকিট হাতে পেলেই চোখে ম্যাগনিফাইং গ্লাসনাঃএটাতে তাে কোনাে ভুল নেইএটাতেও না কোনাে টিকিটে কোনােদিনই ছাপার কোনাে ভুল পাইনিতাই বােধহয় শেষপর্যন্ত নিরুৎসাহ হয়ে টিকিট জমানাে ছেড়ে দিই। কল্যাণদার আরেকটা ভূমিকা ছিল সেটা এখানে বলা দরকারক্রিসমাস ব্যাপারটার উপর ছেলেবেলা থেকেই একটা টান ছিল সেটা আগেই বলেছিফাদার ক্রিসমাস বলে যে একটা বুড়াে দাড়িওয়ালা লােক আছে, আর সে

যখন ছোট ছিলাম

যে ক্রিসমাসের আগের দিন রাত্তিরে ছােট ছােট ছেলেমেয়েদের ঘরে ঢুকে, খাটের রেলিংএর ঝােলানাে তাদের মােজাতে খেলনা ভরে দিয়ে যায়, এটা বােধহয় পুরােপুরি বিশ্বাস করতাম | মেজোপিসিমার বাড়িতে যত ফুর্তি, তেমন তাে আর কোথাও নেইতাই সে ফুর্তি থেকে ক্রিসমাসটা বাদ পড়ে কেন ? ডিসেম্বর মাসের দরকার কী ? যেকোনাে মাসেই তাে হতে পারে ক্রিসমাস ! ( আরাতে তাই জুন মাসে কল্যাণদা হয়ে গেল ফাদার ক্রিসমাস আমার খাটেররেলিংমােজা ঝুলিয়ে দেওয়া হলরাত্তিরে আমি মটকা মেরে পড়ে রইলাম 

যখন ছােট ছিলাম বিছানায় তুলাে দিয়ে দাঁড়িগোঁফ করে আঠা দিয়ে লাগিয়ে পরে নিল কল্যাণদা পিঠে একটা থলি চাই, কারণ তাতে জিনিস থাকবে ; আর ফাদার ক্রিসমাস যে আসছেন সেটা জানান দেওয়া চাইতাই থলিতে অন্য জিনিসের সঙ্গে পুরে দেওয়া হয়েছে বেশ কিছু খালি টিনের কৌটো । 

আধ ঘণ্টা খানেক চুপটি করে শুয়ে থাকার পর শব্দ পেলাম ঝম ঝম ঝম ঝম। 

যখন ছোট ছিলাম

একটু পরে আবছা অন্ধকারে আধ বােজা চোখে দেখলাম ফাদারক্রিসমাসবেশী কল্যাণদা থলি নিয়ে ঢুকল, খাটের রেলিংএর পাশে এসে থামল, আর তার পরেই খুটখাট শব্দে বুঝলাম আমার মােজার মধ্যে কী জানি পুরে দেওয়া হচ্ছেসব ফাঁকি সেটা নিজেও জানি, কিন্তু তাও মজার শেষ নেই। 

সেবার ধনদাদুও এসেছিলেন আরাতে আমরা থাকতে থাকতেই আমরা ভাই বােনের দল সবাই বিকেলে বেড়াতে বেরােতাম দাদুর সঙ্গেআরা স্টেশন ছিলআমাদের বাড়ি থেকে মাইল দেড়েকস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সন্ধের সময়ে দেখতাম ইম্পিরিয়াল মেল আমাদের সামনে দিয়ে দশ দিক কাঁপিয়ে সিটি মারতে মারতে ছুটে বেরিয়ে গেলএই জাঁদরেল ট্রেনের কামরার বাইরেটা ছিল হালকা হলদে রঙের ; আর তার উপর ছিল সােনালী রঙের নকশাআর কোনাে ট্রেনের এত বাহার বা দাপট ছিল না

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়

একদিন সবাই যাচ্ছি স্টেশনের দিকে, দাদু সােলাটুপি হাতে লাঠি সমেত পুরােদস্তুর সাহেবী পােশাক পরে আমাদের সামনে সামনে চলেছেনএমন সময় কোত্থেকে এক গরু শিঙ বাগিয়ে চোখ রাঙিয়ে ধেয়ে এল আমাদের দিকেএমন হিংস্র গরু আর আমি দেখিনি কখনােদাদু তক্ষুনি বললেন, তােমরা মাঠে নেমে যাও| মাঠে নামতে হলে যে ফণীমনসার বেড়া ভেদ করে যেতে হয় সে খেয়াল দাদুরও নেই, আমাদেরও নেই মনসার ঝােপের মধ্যে দিয়েই মাঠে গিয়ে নামলামহাতে পায়ে কাঁটার আঁচড়ে জখমটা যে কতদুর হয়েছে সেটা সে অবস্থায় বুঝতেই পারিনিআমরা ঝােপের ফাঁক দিয়ে দম বন্ধ করে দেখছি দাদু গরুর দিকে মুখ করে দু পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে হাতের লাঠিটা এরােপ্লেনের প্রপেলারের মতাে বন বন করে ঘােরাচ্ছেন, আর গরুটাও শিঙ বাগিয়ে হাত পাঁচেক দূরে দাঁড়িয়ে এই অদ্ভুত মানুষটার অদ্ভুত কাণ্ড দেখে থমকে গেছে

 

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়-(পর্ব-১১)

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *