যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়-(পর্ব-১৩)

দাদুর এই তেজ পাগলা গরু মিনিট খানেকের বেশি সহ্য করতে পারেনি। 

গরু হটে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই আমরাও সাহস পেয়ে সাবধানে বাড়তি জখম বাঁচিয়ে বেরিয়ে এলাম ঝােপের পেছন থেকেযখন ছোট ছিলামসেরা সত্যজিৎ 

সেই বারই পরের দিকে আরাতে আরেকটা বড় দল গিয়ে হাজির হয়েছিল এরা ছিল আমার ছােটদাদু প্রমদারঞ্জন রায়ের আট ছেলেমেয়ের মধ্যে জনাচারেকআমরা যখন ভবানীপুরে ছােটদাদুও তখন রিটায়ার করে ভবানীপুরেই থাকেন, চন্দ্রমাধব ঘােষ রােডেছােটদাদু সরকারী জরিপ বিভাগে কাজ করতেন, আর সেই কাজ তাঁকে নিয়ে যেত আসামবার দুর্গম জঙ্গলে পাহাড়ে আমি অবিশ্যি ছােটদাদুকে ভালাে ভাবে চিনি তিনি চাকরি থেকে অবসর নেবার পরে নিজে দারুণ শক্ত মানুষ ছিলেন বলেই বােধহয় শরীর চর্চার দিকে ভয়ানক দৃষ্টি দিতেনকাউকে কুঁজো হয়ে হাঁটতে দেখলেই পিঠে মারতেন এক খোঁচা

এনার প্রাণখােলা অট্টহাসির শব্দ রাস্তার এমােড় থেকে ওমােড় শােনা যেত, আর ইনি একরকম ভাবে শিস দিতে পারতেন, যেটা পাড়ার সব লােকের পিলে চমকে দিত| কাকা পিসীদের মধ্যে সকলেই পড়াশুনায় ভীষণ ভালাে ছিলতিন বােনের মধ্যে মেজো লীলুপিসীকে (যিনি এখন সন্দেশের একজন সম্পাদিকা) তখনচিনতাম আঁকিয়ে হিসেবে এক ভাই কল্যাণ চুপচাপ মানুষ, ভাের চারটেয় ঘুম থেকে ওঠে, আর রাত্তিরে বাইশটা হাতে গড়া রুটি খায় পরের ভাই অমির ছিল দুর্দান্ত স্ট্যাম্পের কালেকশন ; সরােজ ছিল তখন রায় পরিবারের সবচেয়ে লম্বা মানুষ ; ছােট যতু নিজের চেহারা সম্বন্ধে বেশ খানিকটা সচেতন, কাছে আয়না পেলে একবার আড়চোখে নিজেকে দেখে নেবার লােভ সামলাতে পারে না। 

যখন ছোট ছিলাম

সবচেয়ে বড় ভাই প্রভাতকাকার অঙ্কের মাথা দুদান্ত আর তার সঙ্গেই আমারসবচেয়ে বেশি ভাবতার একটা কারণ এই যে ছােটকাকার মতাে যখন ছােট ছিলাম প্রভাতকাকারও অভ্যাস ছিল আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখা করে আসাএই কাজটা অনেক সময়েই তিনি হেঁটে করতেন ; সাত মাইল হাঁটাটা প্রভাতকাকার কাছে কিছুই ছিল না ; আমাদের বাড়িতেও আসতেন মাঝে মাঝে, আর টার্জানের গল্প পড়ে বাংলা করে শােনাতেন আমাকে প্রভাতকাকা ডাকতেন খুড়াে বলে

 চতুর্থ ভাই সরােজ তখন সবে ম্যাট্রিক পাশ করেছে একটা নতুন ইস্কুল থেকে, আর ছােট যতু তখনও সেই ইস্কুলে পড়েআট বছর বয়স অবধি আমি মাকাছে বাড়িতেই পড়েছি ; নতুন ইস্কুলটা ভালাে শুনে মা ঠিক করলেন আমাকে ওখানেই ভর্তি করবেন| ইস্কুলের কথায় পরে আসছি, কিন্তু একটা কথা এইবেলা বলে রাখিছুটি জিনিসটা যে কী, আর তার মজাটাই বা কী, সেটাইস্কুলেভর্তি হবার আগে জানা যায় নাএক তাে রবিবার আর নানান পরবের ছুটি আছে, তাছাড়া আছে গ্রীষ্মের আর পুজোর ছুটিএই দুটো বড় ছুটি আসার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই মনটা খুশির সুরে বাঁধা হয়ে যেতছুটির মধ্যে কলকাতায় পড়ে আছি, জিনিস তখন কমই হত ।। 

খুব বেশি করে মনে পড়ে দুটো ছুটির কথা । 

একবার আমাদের বাড়ির লোেক, লখনৌয়ের মেজোমামামামী আর মামাতাে ভাইয়েরা, আমার ছােটকাকা আর আরাে কয়েকজন আত্মীয়স্বজন মিলে এক বিরাট দল গেলাম হাজারিবাগে Kismet নামে এক বাংলাে ভাড়া করে ছিলাম আমরাখাবারদাবার টাটকা সস্তা, চমৎকার স্বাস্থ্যকর আবহাওয়াক্যানারি হিলের চুড়ােয় ওঠা, রাজরাপ্পায় পিকনিক, বােখারাে জলপ্রপাত দেখতে যাওয়াসব মিলিয়ে যেন সােনায় মােড়া দিনগুলাে সন্ধ্যাবেলা পেট্রোম্যাক্সের আলােয় দল করে নানান রেশারেশির খেলাসবচেয়ে আমাদের খেলা ছিল Charade

যখন ছোট ছিলাম

খেলার বাংলা নাম আছে কিনা জানি না, তবে এটা জানি যেরবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলায় ঠাকুরবাড়িতেও এ খেলার চল ছিলদু দলে ভাগ করে খেলতে হয়পালা করে এক দল অভিনেতা, এক দল দর্শকযারা অভিনয় করবে তারা এমন একটা কথা বেছে নেবে যেটা দুটো বা তারও বেশি কথার সমষ্টিযেমন করতাল (কর+তাল), সন্দেশ (সন+দেশ), সংযমশীল (সং++শিল) ; সংযমশীল কথাটা যদি বেছে থাকে অভিনয়ের দল, তাহলেতাদের পর পর চারটে ছােট ছােট দৃশ্য অভিনয় করে দেখাতে হবে দর্শকের দলকেপ্রথম দৃশ্যে সং, দ্বিতীয় দৃশ্যে যমআর তৃতীয় দৃশ্যে শিলকথাটা বুঝিয়ে সব শেষে পুরাে কথাটা অভিনয় করে বােঝাতে হবেদুরকম Charade হয়Dumb Charade আর Talking Charade

যখন ছােট ছিলাম আরাে আধ ঘণ্টা পরে নৌকো ফিরল এক কুমীরের লাশ সঙ্গে নিয়ে সে কুমীরের ছাল ছাড়ানাে হল লঞ্চের নিচের ডেকে সে ছাল দিয়ে রণদা সুটকেস বানিয়েছিলেন| সাত দিনের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম টাইগার পয়েন্ট সামনে অগাধ সমুদ্র, বাঁয়ে ছােট্ট একটা দ্বীপ, আর তার উপরে বালির পাহাড়আমরা ঢেউবিহীন সমুদ্রের জলে স্নান করে বালির পাহাড়ে অনেকটা সময় কাটিয়ে ফিরে এলাম আমাদের লঞ্চে | লােকালয় থেকে যে বহুদূর চলে এসেছি সেটা আর বলেদিতে হয় নানির্ভেজাল আনন্দের কথা বলতে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে সুন্দরবনসফরের এই কটা দিনের স্মৃতি আমার মনে অনেকটা জায়গা দখল করে রয়েছে। 

 

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়-(পর্ব-১২)

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *