সেরা সত্যজিৎ Charade খেলা হয়, তাহলে শুধু মূকাভিনয় করে কথাগুলাে বােঝাতে হবে । আর যদি Talking Charade হয় তাহলে অভিনেতাদের কথবার্তার মধ্যে এক আধবার বাছাই করা কথাগুলাে ঢুকিয়ে দিতে হবে। দর্শকের দলকে। দৃশ্যের অভিনয় দেখে পুরাে কথাটা বার করতে হবে। বড় দল হলেই খেলাটা জমে। ভালাে। আমরা ছিলাম প্রায় দশবারাে জন । সন্ধেটা যে কোথা দিয়ে কেটে যেত তা টেরই পেতাম না।
আরেকটা স্মরণীয় ছুটি কেটেছিল স্টিম লঞ্চে করে সুন্দরবন সফরে । আমার এক মেসােমশাই ছিলেন একসাইজ কমিশনার। তাঁকে সুন্দরবনে কাজে যেতে হত। মাঝে মাঝে। একবার তিনি বেশ কয়েকজন আত্মীয়স্বজনকে সঙ্গে নিলেন, তার মধ্যে আমি আর মাও ছিলাম । মাসি আর মেসাে ছাড়া ছিলেন চার মাসতুতাে দিদি আর রণজিৎদা । রণজিৎদা বা রণদা ছিলেন শিকারী ; সঙ্গে নিয়েছিলেন বন্দুক আর অজস্র টোটা। মাতলা নদী ধরে যেতে হবে আমাদের একেবারে মােহানা। পর্যন্ত, আর তারই ফাঁকে সুন্দরবনের খাল বিলের মধ্যে দিয়ে ঘুরবে আমাদের লঞ্চ। সবশুদ্ধ পনেরাে দিনের ব্যাপার।
যখন ছোট ছিলাম-
” সফরের বেশির ভাগটা সময়ই ডেকে বসে দৃশ্য দেখে কেটেছে। মাতলা। বিশাল চওড়া নদী, প্রায় এপার ওপার দেখা যায় না। সারেঙরা মাঝে মাঝে জলে। বালতি নামিয়ে দেয়, আর তুললে পরে দেখা যায় জলের সঙ্গে উঠে এসেছে। প্রায়–স্বচ্ছ জেলিফিশ। যখন খালের ভিতরে ঢােকে লঞ্চ তখন দৃশ্য যায়। একেবারে বদলে। দূর থেকে দেখছি খালের পারে সার সার কুমীর রােদ পােহাচ্ছে, তার পিঠে বক বসে আসে দিব্যি, আর কাছে এলেই কুমীরগুলাে সড়াৎ সড়াৎ করে নেমে যায় জলে। যেদিকে কুমীর সেদিকে জঙ্গল পাতলা, বেশির ভাগ গাছই বেঁটে, আর অপর পারে বিশাল বিশাল গাছের গভীর জঙ্গল, তার মধ্যে হরিণের পাল চোখে পড়ে।তারাও লঞ্চের শব্দ শুনলেই ছুট লাগায়।
একদিন আমরা লঞ্চ থেকে নেমে নৌকো করে ডাঙায় গিয়ে গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চললাম এক আদ্যিকালের পােড় কালী মন্দির দেখতে। মাটি খুঁড়ে বল্লমের মতাে মাথা উঁচিয়ে রয়েছে একরকম শেকড়, হাতে লাঠিতে ভর করে তার ফাঁকে ফাঁকে পা ফেলে এগােতে হয়। সঙ্গে বন্দুকধারী আছেন দুজন, কারণ এ তল্লাটেই বাঘের আস্তানা, বাবাজী কখন দেখা দেন তা বলা যায় না ।। | বাঘ আমরা দেখিনি এ যাত্রায়, কিন্তু শিকারী রণদা একটা কুমীর মেরেছিলেন । এক জায়গায় খালের ধারে ডাঙায় কুমীরের প্রাচুর্য দেখে লঞ্চ থামানাে হল । রণদা নৌকো করে চলে গেলেন সঙ্গে তিনজন লােক নিয়ে। প্রায় আধ ঘণ্টা দম বন্ধ করে বসে থাকার পর একটা বন্দুকের আওয়াজ শােনা গেল। লঞ্চ থেকে বেশ দূরে চলে যেতে হয়েছিল শিকারীর দলকে ।
যখন ছোট ছিলাম-
লেবেলা কখন শেষ হয় ? অন্যদের কথা জানি না, আমার মনে আছে। হযেদিন ম্যাট্রিক পরীক্ষার শেষ পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে এসে টেবিলের উপর থেকে মেক্যানিসের বইটা তুলে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম, ঠিক সেই মুহূর্তেই মনে হয়েছিল আমি আর ছােট নেই, এর পর কলেজ, এখন থেকে আমি বড় হয়ে গেছি। | তাই আমি আমার ইস্কুল জীবনের কথা দিয়েই আমার ছেলেবেলার কথা শেষ করব। | আমি যখন ইস্কুলে ভর্তি হই তখন আমার বয়স সাড়ে আট । মামাবাড়িতে তখন আরেকটি মামা এসে ডেরা বেঁধেছেন। এর নাম লেবু। এর কথা আগেই বলেছি। একদিন সকালে লেবুমামার সঙ্গে গিয়ে হাজির হলাম বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে। যে ক্লাসে ভর্তি হব—ফিফথ ক্লাস (পরে নাম হয়েছিল ক্লাস সিক্স)—সেই ক্লাসের মাস্টার আমাকে কয়েকটি প্রশ্ন লিখে দিলেন, আর গােটা চারেক অঙ্ক কষতে দিলেন।
আমি অন্য একটা ঘরে বসে উত্তর লিখে আবার মাস্টারের কাছে গিয়ে হাজির হলাম। মাস্টার তখন ইংরিজির ক্লাস নিচ্ছেন। আমার উত্তরের দিকে চোখ বুলিয়ে তিনি মাথা নাড়লেন। তার মানে উত্তরে ভুল নেই। আর তার মানে আমার ইস্কুলে ভর্তি হওয়া হয়ে গেল। | কাঠের প্ল্যাটফর্মের উপর দাঁড়িয়ে মাস্টারের হাত থেকে খাতা ফেরত নিচ্ছি, এমন সময় ক্লাসের একটি ছেলে (পরে জেনেছিলাম তার নাম রাণা) গলা তুলে আমাকে জিগ্যেস করল, “তােমার নাম কী ভাই ? আমি বললাম আমার নাম।—“আর ডাকনাম ? জিগ্যেস করল মিচকে শয়তান রাণা দাশ।
যখন ছোট ছিলাম-
আমার কোনাে ধারণা নেই যে ইস্কুলে চট করে নিজের ডাকনাম বলতে নেই । আমি তাই সরল মনে ডাকনামটা বলে দিলাম । সেই থেকে আমার ক্লাসের বা ইস্কুলের কোনাে ছেলে আমাকে ভালাে নাম ধরে ডাকেনি। সে নামটা ব্যবহার করতেন শুধু মাস্টারমশায়রা। | বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলটা ছিল ল্যানসডাউন রােড পেরিয়ে বেলতলা রােড পুলিশ থানার পূর্ব গায়ে। ইস্কুলের পুবে যে রাস্তা, তার ওপারে ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ। সেখান থেকে বছরে একবার করে বি. টির ছাত্ররা এসে আমাদের ক্লাস নিত ।
উঁচু পাঁচিলে ঘেরা ইস্কুলের দক্ষিণ অংশটা খেলার মাঠ। আকাশ থেকে দেখলে ইস্কুলের বাড়িটাকে দেখাবে ইংরেজি T অক্ষরের মতাে। তলার ঝুলে থাকা অংশটা হল ইস্কুলের হলঘর আর মাথার লম্বা অংশটা ক্লাসরুমের সারি । গেট দিয়ে ঢুকে ডাইনে দারােয়ানের ঘর, বাঁয়ে একটু গেলেই একটা বট গাছ । তার ডিটাকে ঘিরে একটা সিমেন্ট বাঁধানাে বেদি। গাছের নিচে অনেকখানি জায়গা। জুড়ে ঘাস নেই, কারণ সেখানে টিফিন টাইমে মার্বেল খেলে ছেলেরা । খেলার। মধ্যে বড় মাঠে ফুটবল, ক্রিকেট, হকি সবই হয়। আর বছরে একদিন হয় স্পাের্টস। এছাড়া মার্বেল, ডাংগুলি, হাডুডু, লাটুর খেলা ইত্যাদিতাে আছেই। | দারােয়ানের ঘর পেরিয়ে মােরাম বিছানাে পথ দিয়ে খানিকটা গিয়ে তিনধাপ সিড়ি উঠে পূর্ব–পশ্চিমে টানা ইস্কুলের বারান্দা। বারান্দার ডাইনে সারবাঁধা। কাসরুম আর বাঁয়ে অর্ধেক পথ গিয়ে হলঘরের দরজা।
যখন ছোট ছিলাম-
গ্যালারিওয়ালা হলঘরে। সবচেয়ে বড় যে ঘটনাটা ঘটে সেটা হল বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী। এছাড়া। সরস্বতী পুজোয় পাত পেড়ে খাওয়া হয়, মাঝে মাঝে বক্তৃতা হয়, আর একবার। মনে আছে গ্রীনবার্গ অ্যাণ্ড সেলিম বলে দুই বিদেশী অভিনেতা এসে শেকসপিয়রের মার্চেন্ট অফ ভেনিস থেকে কয়েকটা দৃশ্য অভিনয় করেছিল। আমরা সবাই ফোল্ডিং চেয়ারে বসে জীবনে প্রথম শেকসপিয়র দেখছি,আর আমাদের কাছেই দাঁড়িয়ে ইংরিজির মাস্টার ব্রজেনবাবু চোখ বড় বড় করে স্টেজের দিকে চেয়ে। অভিনেতাদের সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট নাড়িয়ে চলেছেন—বােধ হয় যাচাই করে দেখছেন ছাত্র জীবনে পড়া নাটকটার কতখানি মনে আছে। একবার, বােধ হয় সরস্বতী পুজোর দিনেই, আমাদের হলে চার্লি চ্যাপলিনের ছবি দেখানাে হল। শশা যে হবে, তার নােটিস আগের দিন দারােয়ান এসে আমাদের ক্লাসে আহমেদ স্যারের হাতে তুলে দিল। আহমেদ স্যার পড়লেন, ‘দ্য কাইণ্ড কার্টসি অফ মেসারস কোদক কোম্পানি ইত্যাদি।