কোভ্যাক কোম্পানির নাম স্যারের জানা নেই, তিনি ভাবলেন নামটা দিশি, মােদকের জাতভাই–টাই হবে আর কী!
যখন ছােট ছিলাম। বারান্দার শেষ মাথায় পৌঁছে সিঁড়ি দিয়ে নামলেই সামনে দেখা যায় ছাউনি তলায় দুটো পাশাপাশি জল খাবার ট্যাঙ্ক | ঘাড় নিচু করে কল খুলে আঁজলা ক, জল খেতে হয়। ট্যাঙ্ক দুটোর ওপারে পশ্চিমের দেওয়ালের লাগােয়া হল কার্পেন্টি ক্লাস, যেখানে তরফদার স্যারের আধিপত্য। হাতুড়ি, বাটালি, রেদা, করাত, ফ্রেটওয়র্ক মেশিন কোনােটারই অভাব নেই সেখানে, আর সব সময়ই ক্লাসের ভিতর থেকে নানারকম যান্ত্রিক শব্দ শােনা যায় ।
দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠে সামনেই দেখা যায় বারান্দার রেলিং–এর উপর। ঝুলছে ইস্কুলের ঘন্টা। দারােয়ান ছাড়া এই ঘণ্টা বাজায় কার সাধ্য। দড়ি ধরে ঘণ্টায় কাঠি মারলে ঘণ্টা ঘুরে যায়—একটার বেশি ঢং বেরােয় না ঘণ্টা থেকে । দারােয়ান যে কী করে ম্যানেজ করে সেটা আমাদের সকলের কাছেই রহস্য। সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাঁয়ে ঘুরলে আপিস ঘর পেরিয়ে হেডমাস্টারমশাইয়ের ঘর । আপিসে একটি আলমারি ভর্তি বই। সেটাই হল ইস্কুলের লাইব্রেরি । বইয়ের মধ্যে তিনটে—সিন্ধবাদ, হাতেমতাই আর দাগগাবার্ট—এত পপুলার যে হাত ঘুরে ঘুরে তাদের অবস্থা শােচনীয়। তিনটে একই সিরিজের বই ।
যখন ছোট ছিলাম-
সিন্ধবাদ তাে সবাই জানে, আর হাতেমতাই–এর নাম এখনাে মাঝে মাঝে শােনা যায়, কিন্তু। দাগােবার্টের নাম ইস্কুল ছাড়ার পরে আর শুনেছি বলে মনে পড়ে না ।। | ইস্কুলের দপ্তরীর কাজও এই আপিস ঘরেই।গােল ডাণ্ডার মতাে রুলার গড়িয়ে গড়িয়ে খাতায় লাল নীল কালি দিয়ে সমান্তরাল লাইন টানা দেখতে ভারী অদ্ভুত লাগত সেটা এখনাে মনে আছে । সিড়ি উঠে ডাইনে গেলে প্রথমে পড়বে মাস্টারমশাইদের কমনরুম, তারপর সারবাধা ক্লাসরুম। একতলা দোতলা মিলিয়ে সবসুদ্ধ আটটা ক্লাস থ্রী থেকে টেন । প্রত্যেক ক্লাসে দুজন পাশাপাশি বসার যােলােটাকরে ডেস্ক, কোনাে ক্লাসেই ত্রিশ বত্রিশ জনের বেশি ছাত্র নেই।
দশটায় ইস্কুল বসে। একটায় এক ঘণ্টা টিফিনের ছুটি, তারপর চারটে পর্যন্ত ক্লাস । গ্রীষ্মের ছুটির পর মাসখানেক মর্নিং ইস্কুল। সকাল সাতটায় ক্লাস বসে। উত্তরায়ণের রােদ তখন জানালা দিয়ে ক্লাসে ঢুকে ক্লাসের চেহারা একেবারে পালটে দেয় । মাস্টারমশাইদেরও কেন জানি সকালে কম ভীতিজনক বলে মনে হয় । সূর্য মাথার উপর উঠলেই বােধ হয় মানুষের মেজাজটা আরাে তিরিক্ষি হয়ে যায় । মর্নিং ইস্কুলটা তাই অনেক বেশি স্নিগ্ধ বলে মনে হত ।।
| অবিশ্যি এ থেকে যদি মনে হয় যে মাস্টারমশাইদের বেশির ভাগেরই মেজাজ তিরিক্ষি ছিল, সেটা কিন্তু ঠিক হবে না। বরং এটাই ঠিক যে কিছু বাছাই করা দুষ্ট ছেলেদের উপর কিছু মাস্টারের রাগ গিয়ে পড়ত মাঝে–মধ্যে । মাস্টার বুঝে এবং অপরাধ বুঝে শাস্তিরও রদবদল হত । কিল, চড়, কানমলা, ঝুলপি ধরে উপরে
যখন ছোট ছিলাম-
যখন ছােট ছিলাম থেকেই এই জামার নাম, যেটা ওদের দেশে খালাসীরা পরত ।। | যােগেশবাবু আরাে বললেন যে বাঙালীরা এককালে এক ধরনের ওভারকোট। পরত যাকে তাঁরা বলতেন অলেস্টার । এই কোর্টের আসল নাম নাকি Ulster, আর এ নামটাও এসেছে একটা জায়গার নাম থেকে। আয়ারল্যাণ্ডের আলস্টার নামে একটি শহরে এই কোট প্রথম চালু হয়।। | এর পরে যােগেশবাবু যেটা করলেন সেটা আমাদের বেশ তাক লাগিয়ে দিল। ব্ল্যাকবাের্ডে গিয়ে উনি প্রথমে লিখলেন—
এফ দুই তিন স্তার পাস ২য় সাতপ্রায়
তারপর প্রত্যেকটা কথা থেকে খানিকটা অংশ মুছে দিয়ে ব্যাপারটা দাঁড়াল—
১
২
৩
৪
৫ ৬
৩
ও ৯।
সেরা সত্যজিৎ টান, বেঞ্চে দাঁড়ানাে, কান ধরে এক পায়ে দাঁড়ানাে—সব রকমই দেখেছি আমরা। তবে আমি নিজে কোনােদিন এসব ভােগ করেছি বলে মনে পড়ে না। ভালাে ছেলে, শান্ত শিষ্ট (কেউ কেউ জুড়ে দিত ‘লেজ বিশিষ্ট) ছেলে হিসেবে গােড়া থেকেই একটা পরিচয় তৈরি হয়ে গিয়েছিল আমার। | আমি ছ’বছর ইস্কুল জীবনে দুজন হেডমাস্টারকে পেয়েছিলাম। প্রথম যখন ভর্তি হই তখন ছিলেন নগেন মজুমদার। তােমরা সন্দেশে ননীগােপাল মজুমদারের গল্প পাও মাঝে মাঝে ; নগেনবাবু ছিলেন ননীগােপালের বাবা ৷
তিনি যে হেডমাস্টার সেটা আর বলে দিতে হত না। অন্তত আমার কল্পনার হেডমাস্টারের সঙ্গে তাঁর চেহারার মিল ছিল ষােলাে আনা। মাঝারি হাইট, ফরসা। রঙ, ঝুপপা সাদা গোঁফ, সাদা চুল, পরনে গলাবন্ধ কোট আর প্যান্ট। মেজাজ যে। শুধু গম্ভীর তা নয়, স্কুলে তাঁর মুখে কেউ কোনােদিন হাসি দেখেছে কিনা সন্দেহ। বছরের শেষে বাৎসরিক পরীক্ষার পর একটা বিশেষ দিনে তিনি প্রত্যেকটি ক্লাসে। গিয়ে হাতের লিস্ট দেখে পরীক্ষায় প্রথম দ্বিতীয় আর তৃতীয় কে হয়েছে সে নামগুলাে পড়ে শােনাতেন। ক্লাসের বাইরে ‘নগা’র জুতাের আওয়াজ পেলেই বুকের ভেতর যে ধড়ফড়ানি শুরু হত তার কথা কোনােদিন ভুলব না।
যখন ছোট ছিলাম-
” নগেনবাবুর পরে এলেন যােগেশবাবু, যােগেশচন্দ্র দত্ত। এর চেহারা। নগেনবাবুর চেয়ে কিছুটা চিমড়ে আর গোঁফটা ঠোঁটের নিচে অনেকটা কম জায়গা। দখল করে ; কিন্তু ইনিও মাকা–মারা হেডমাস্টার। এর প্যান্টটা ছিল ঢােলা। | গােছের। তখন আমরা ক্লাসে রিপ ভ্যান উইংকলের গল্প পড়ছি ; তাতে একরকম। প্যান্টের কথা আছে যার নাম গ্যালিগ্যাসকিন। তিন চারশাে বছর আগে। আমেরিকায় এই প্যাণ্ট চালু ছিল। এই গাল ভরা নামওয়ালা প্যান্টটি যে আসলে। কিরকম দেখতে সেটা আমাদের কারুরই জানা নেই, কিন্তু আমরা ঠিক করে। নিলাম যে ওটা যােগেশবাবুর ঢােলা প্যান্টের মতােই হবে। তাই যােগেশবাবুর প্যান্ট তখন থেকে আমাদের কাছে হয়ে গেল গ্যালিগ্যাসকিন।
| এই যােগেশবাবুর নাম যে কেন ‘গাঁজা হল সেটার কারণ আর এখন মনে। নেই। হয়ত যােগেশ থেকে যগা থেকে গজা থেকে গাঁজা। তবে এনার সম্বন্ধে। আমাদের ভীতি খানিকটা কেটে গিয়েছিল যখন একদিন ইনি আমাদের একটা ক্লাস নিলেন। কোনাে একজন মাস্টারমশাই অনুপস্থিত ছিলেন, তাই এই ব্যবস্থা। আশ্চর্য, সেদিনের ক্লাসে যতটা মজা পেয়েছিলাম, যত নতুন জিনিস শিখেছিলাম, সেরকম আর কখনাে হয়নি। গেঞ্জি কথাটা কোথা থেকে এসেছে কে বলতে পারে ? এই ছিল যােগেশবাবুর প্রথম প্রশ্ন । আমরা কেউই বলতে পারলাম না । যােগেশবাবু বললেন, ‘কথাটা আসলে ইংরিজি—Guernsey। ইংলিশ চ্যানেলে ফ্রান্সের উপকূলের কাছাকাছি একটি ছােট্ট দ্বীপের নাম Guernsey।
যখন ছোট ছিলাম-
সেখান এই ঘটনার পরে গাঁজা হয়ে গেলেন আমাদের বেশ কাছের মানুষ । | হেডমাস্টারমশাইয়ের পরেই যাঁকে সবচেয়ে বেশি সমীহ করতাম তিনি হলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার জ্যোতির্ময় লাহিড়ী । একে আমরা লাহিড়ী স্যার বা জ্যোতির্ময়বাবু না বলে সব সময়েই মিস্টার লাহিড়ী বলতাম, তার কারণ মাস্টারমশাইদের মধ্যে এনার মতাে সাহেব আর কেউ ছিলেন না । লম্বা সুপুরুষ চেহারা, গায়ের রঙ ধপধপে, দাড়ি গোঁফ কামানাে, পরনে সুট আর টাই। সুটের কোটটা একটু বেঁটে, এছাড়া খুঁত ধরার জো নেই।
হলঘরে কোনাে অনুষ্ঠান হলে ইনি দাঁড়িয়ে থাকতেন হাত দুটো পেটের উপর জড়াে করে । হাততালির প্রয়ােজন হলে দুটো হাত উঠত না কখনাে ; একটা হাত পেটের উপরেই থাকত, অন্যটা তার পিঠে মৃদু মৃদু আঘাত করত। | মিঃ লাহিড়ীর ইংরিজি উচ্চারণ ছিল সাহেবের মতাে। ওয়লটর স্কটের আইভান হাে পড়ানাের সময় স্কটের ফরাসী নামগুলাের উচ্চারণ শুনে ভক্তি একেবারে সপ্তমে চড়ে গেল। Front–de–Boeuf–এর উচ্চারণ যে ফঁদবো হতে পারে, সেটা কে জানত ? | যােগেশবাবুর পরে ইনিই হেডমাস্টার হয়েছিলেন । কিন্তু ততদিনে ইস্কুলের পাট শেষ হয়ে গেছে।