ক–একটি টাইপ। তখন ব্রিটিশ স্টারমশাইদের সঙ্গে কিছু যখন ছােট ছিলাম। পড়িয়ে গেছেন, তার মধ্যে একজন। আমাদের বাংলা পড়ালেন । পড়লেন তিনি, কিন্তু উচ্চারণ শুনে।
সেরা সত্যজিৎ অন্য মাস্টারমশাইদের মধ্যে এক–একজন এক–একটি টাইপ। ত আমল। সরকারী ইস্কলের নিয়ম অনুযায়ী হিন্দু মাস্টারমশাইদের সঙ্গে এী ক্রিশ্চান থাকাটা ছিল স্বাভাবিক। মুসলমানদের মধ্যে মুসলমান ও কিছু বাঙালী ক্রিশ্চান থাকাটা ছিল স্বাভাবিক
জসীমউদ্দীন আহমেদ, যিনি কোডাককে বলেছিলেন ছিলেন আহমেদ স্যার, জসীমউদ্দীন আহমেদ, যিনি কোডার কোদক। এছাড়া আরাে দুজন আমাদের পড়িয়ে গেছেন, তার ১ হলেন কবি গােলাম মােস্তাফা । ইনি বছর খানেক আমাদের বাংলা পড়া একটি কবিতা আমাদের পাঠ্যের মধ্যে ছিল, যার প্রথম দু লাইন হল,
আনমনে একা একা পথ চলিতে
দেখিলাম ছােট মেয়ে ছােট গলিতে মােস্তাফা সাহেব পূর্ব বঙ্গের লােক, ‘চ’ আর ‘ছ’–কে ইংরিজি এস উচ্চারণ করেন। ভারী দরদের সঙ্গে কবিতাটি পড়লেন তিনি, কিন্তু উpমান কিছু ত্যাঁদড় ছেলে বুঝে নিল একে নিয়ে একটু রগড় করা যায় । আগ্রহের সঙ্গে প্রশ্ন করল, “আচ্ছা, এই যে সলােটো গলিতে সােটো মেয়ে চােখ কথা লিখেছেন, এটা সসােত্যি ঘটনা স্যার?
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়-
মােস্তাফা সাহেব সরল মানুষ, বললেন, হ্যাঁ, সত্যি সত্যিই আমি একটি গলি দিয়ে যেতে যেতে দেখি একটি ছােট্ট মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার পা দিয়ে যাবার সময় তার মাথায় টুক করে একটা টোকা মেরে দিলাম ।।
‘টোকা মারলেন স্যার? বাঃ!
কথা আর বেশি এগােলাে না, কারণ পিছন থেকে অ্যাই গােলা, বােস’ বলে। চাপা ফিসফিসে রব উঠেছে। – মাস্টারমশাইদের মধ্যে ক্রিশ্চান ছিলেন দুজন—বি. ডি. সাব মনােজবাবু। বি. ডি. অর্থাৎ বি. ডি. রায়। পুরাে নাম বােধহয় বিভদান বিধান।এমন নাম এর আগে বা পরে কখনাে শুনিনি। ইনি পড়াতেন ইংরিজি । ছােটখাটো মানুষ, ইংরিজি উচ্চারণ যাতে ঠিক হয় সেদিকে বিশেষ নজর । ঈশপের গল্প The 0x and the Frog পড়াবার আগে বলে নিলেন, ‘ভাওয়েলের আগে The –এর উচ্চারণ হবে দি, আর কনসােনেন্টের আগে দ্য। দি অক্স অ্যাণ্ড দ্য ফ্রগ। আর ইংরিজি দ–এর উচ্চারণ বাংলা দ–এর মতাে নয়। বাংলা দ বলার সময় জিভ আর টাকরার মধ্যে কোনাে ফাঁক থাকে না, কিন্তু ইংরিজির সময় সামান্য ফাঁক থাকবে যাতে খানিকটা হাওয়া বেরােয়। আসলে ইংরিজি দ–এর উচ্চারণ দ আর Z–এর মাঝামাঝি।
মনােজবাবুর এক ভাই পুলিশে কাজ করেন। তাঁর বাসস্থান ছিল আমাদের ইস্কুলের লাগােয়া থানায়। এই পুলিশ ভাইয়ের দুই ছেলে সুকুমার ও শিশির পড়ত আমাদের ক্লাসে। এরা ইস্কুলে আসত পাঁচিল টপকে।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়-
সুকুমার আমাদের ক্লাসের সেরা দৌড়বাজ, দুবার পর পর হাণ্ডেড ইয়ার্ডসে জিতেছে। শিশিরটা মিচকে বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, কিল চড় কানমলা তার দৈনিক বরাদ্দ, বিশেষ করে তার কাকার হাতে। মনােজবাবু পড়ানাের সময় চেয়ারে প্রায় বসেন না বললেই চলে ; টেবিলে ঠেস দিয়ে মাটিতে দাঁড়িয়ে হাতে বই নিয়ে ক্লাস নেন । একটা অদ্ভুত মুদ্রাদোষ—মাঝে মাঝে ডান কাঁধটা ঝাঁকানি দিয়ে ওঠে আর ঘাডটা ডাইনে। হেলে পড়ে, যেন মাছি তাড়াচ্ছেন। আর প্রচণ্ড অন্যমনস্ক । কখন যে কিসের। কথা ভাবেন সে এক রহস্য। তার উপর ঠোঁটের ডগায় লেগে আছে “ভেরি। গুড’ |—একটু বাইরে যাব স্যার ? ‘ভেরি গুড। আমরা চুপ। বাইরে যাবার মধ্যে ভেরি গুডের কী আছে ? পরক্ষণেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে দাঁতে দাঁত | চেপে বলেন, এই তাে গেলি বাইরে, আবার কেন ?
হেড পণ্ডিতমশাই ভটচায়্যি স্যারের কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে তাঁর হাতের লেখার জন্য। ব্ল্যাকবাের্ডে এত সুন্দর বাংলা লেখা আর কেউ লিখতে পারে বলে মনে হয় না ।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়-
সেকেণ্ড পণ্ডিতমশাইকে কেন যে সবাই ভ্যান পণ্ডিত বলত তার কারণ কোনােদিন জানতে পারিনি। নামকরণটা হয়ে গিয়েছিল আমি আসার আগেই। একেও কোনােদিন হাসতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তবে গােমড়া মেজাজ হওয়া সত্ত্বেও, উনি ছাত্রদের সামলানাের ব্যাপারে তেমন দুরস্ত ছিলেন না। এনার একটা ধমক এখনাে কানে লেগে রয়েছে—চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আমার গলা দিয়ে রক্তের গঙ্গা বয়ে গেল, তাও তােমরা মনােযােগ দিচ্ছ না ?
এনার হাত যে চলত খুব বেশি তা নয়, কিন্তু একবার অজয়কে কানের পাশে চড় মেরে প্রায় অজ্ঞান করে দিয়েছিলেন। সেদিন সারা ইস্কুল সরগরম । টিফিনের আগের ক্লাসে ঘটনাটা ঘটেছে, টিফিনের ঘণ্টা পড়ে গেছে, কিন্তু ক্লাস থেকে কেউ বেরােয়নি। অজয় মুখ লাল করে হাত দিয়ে কান ঢেকে মাথা হেঁট করে বসে আছে, ছেলেরা তাকে ঘিরে রয়েছে, পণ্ডিতমশাইকেও একরকম ক্লাসেই বন্দী করে রাখা হয়েছে। বাইরে থেকে ক্লাসরুমের বন্ধ দরজার খড়খড়ি ফাঁক করে অন্য ক্লাসের ছেলেরা ভ্যান ! ভ্যান ! করে টিটকিরি দিচ্ছে।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়-
প্রহার ছাড়া আরেক রকমের অস্ত্র কোনাে কোনাে মাস্টারমশাই ব্যবহার করতেন যেটা প্রহারেরও বাড়া। সেটা হল বাক্যবাণ। রমণীবাবু ছিলেন এ ব্যাপারে অদ্বিতীয়। তাঁর দাঁতখিচুনাে চেহারাটা ব্যঙ্গ বিদ্রুপের জন্য সব সময় তৈরি হয়ে থাকত। সঞ্জয় বলে একটি নতুন ছেলে ভর্তি হল—তখন আমরা বােধহয় ক্লাস এইটে। জানা গেল ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক আছে । ছেলেরা মস্করার এ সুযােগ ছাড়বে কেন ? আমার বেলাতেও ছাড়েনি। আমি যে সুকুমার সেরা সত্যজিৎ রায়ের ছেলে আর উপেন্দ্রকিশােরের নাতি এটা গােড়াতেই জানাজানি ।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়-
গিয়েছিল। তারপর ক্রমে বেরিয়ে পড়ল এইচ. এম. ভি–র আর্টিস্ট কনক দাশ আমার মাসি আর বাংলার সেরা ক্রিকেটার কার্তিক বােস আমার কাকা । কয়েকদিন বাদে আমাকে শুনতে হল, ‘হ্যাঁরে মানিক, অমল বলছিল পঞ্চম জk নাকি তাের দাদ ; সত্যি নাকি ? সেইরকম ‘রবিবাবু তাের কে হন যে, জ্যাঠামশাই ?‘—এ প্রশ্ন সঞ্জয়কে অনেকবার শুনতে হয়েছে । দোষের মধ্যে সঞ্জয়ের রংটা শুধু উগ্র রকম ফরসা নয়, তার সঙ্গে বেশ খানিকটা গােলাম ছােপ। যাকে বলে দুধে আলতা। তা ছাড়া ঠাকুরবাড়ির মেধার অংশও যেন ভাগে খুব বেশি পড়েনি সেটা কয়েকদিনের মধ্যেই বােঝা গেল ।