যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়-(পর্ব-১৬)

একটি টাইপতখন ব্রিটিশ স্টারমশাইদের সঙ্গে কিছু যখন ছােট ছিলাম। পড়িয়ে গেছেন, তার মধ্যে একজন। আমাদের বাংলা পড়ালেন পড়লেন তিনি, কিন্তু উচ্চারণ শুনে

যখন ছোট ছিলাম সেরা সত্যজিৎ অন্য মাস্টারমশাইদের মধ্যে একএকজন একএকটি টাইপআমলসরকারী ইস্কলের নিয়ম অনুযায়ী হিন্দু মাস্টারমশাইদের সঙ্গে  এী ক্রিশ্চান থাকাটা ছিল স্বাভাবিকমুসলমানদের মধ্যে মুসলমান কিছু বাঙালী ক্রিশ্চান থাকাটা ছিল স্বাভাবিক 

 জসীমউদ্দীন আহমেদ, যিনি কোডাককে বলেছিলেন ছিলেন আহমেদ স্যার, জসীমউদ্দীন আহমেদ, যিনি কোডার কোদকএছাড়া আরাে দুজন আমাদের পড়িয়ে গেছেন, তার হলেন কবি গােলাম মােস্তাফা ইনি বছর খানেক আমাদের বাংলা পড়া একটি কবিতা আমাদের পাঠ্যের মধ্যে ছিল, যার প্রথম দু লাইন হল

আনমনে একা একা পথ চলিতে 

দেখিলাম ছােট মেয়ে ছােট গলিতে মােস্তাফা সাহেব পূর্ব বঙ্গের লােক, আর কে ইংরিজি এস উচ্চারণ করেনভারী দরদের সঙ্গে কবিতাটি পড়লেন তিনি, কিন্তু উpমান কিছু ত্যাঁদড় ছেলে বুঝে নিল একে নিয়ে একটু রগড় করা যায় আগ্রহের সঙ্গে প্রশ্ন করল, আচ্ছা, এই যে সলােটো গলিতে সােটো মেয়ে চােখ কথা লিখেছেন, এটা সসােত্যি ঘটনা স্যার

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়-

মােস্তাফা সাহেব সরল মানুষ, বললেন, হ্যাঁ, সত্যি সত্যিই আমি একটি গলি দিয়ে যেতে যেতে দেখি একটি ছােট্ট মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার পা দিয়ে যাবার সময় তার মাথায় টুক করে একটা টোকা মেরে দিলাম । 

টোকা মারলেন স্যার? বাঃ

কথা আর বেশি এগােলাে না, কারণ পিছন থেকে অ্যাই গােলা, বােসবলেচাপা ফিসফিসে রব উঠেছেমাস্টারমশাইদের মধ্যে ক্রিশ্চান ছিলেন দুজনবি. ডি. সাব মনােজবাবুবি. ডি. অর্থাৎ বি. ডি. রায়পুরাে নাম বােধহয় বিভদান বিধানএমন নাম এর আগে বা পরে কখনাে শুনিনিইনি পড়াতেন ইংরিজি ছােটখাটো মানুষ, ইংরিজি উচ্চারণ যাতে ঠিক হয় সেদিকে বিশেষ নজর ঈশপের গল্প The 0x and the Frog পড়াবার আগে বলে নিলেন, ভাওয়েলের আগে The এর উচ্চারণ হবে দি, আর কনসােনেন্টের আগে দ্যদি অক্স অ্যাণ্ড দ্য ফ্রগআর ইংরিজি এর উচ্চারণ বাংলা এর মতাে নয়বাংলা বলার সময় জিভ আর টাকরার মধ্যে কোনাে ফাঁক থাকে না, কিন্তু ইংরিজির সময় সামান্য ফাঁক থাকবে যাতে খানিকটা হাওয়া বেরােয়আসলে ইংরিজি এর উচ্চারণ আর Zএর মাঝামাঝি। 

মনােজবাবুর এক ভাই পুলিশে কাজ করেনতাঁর বাসস্থান ছিল আমাদের ইস্কুলের লাগােয়া থানায়এই পুলিশ ভাইয়ের দুই ছেলে সুকুমার ও শিশির পড়ত আমাদের ক্লাসেএরা ইস্কুলে আসত পাঁচিল টপকে

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়-

সুকুমার আমাদের ক্লাসের সেরা দৌড়বাজ, দুবার পর পর হাণ্ডেড ইয়ার্ডসে জিতেছেশিশিরটা মিচকে বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, কিল চড় কানমলা তার দৈনিক বরাদ্দ, বিশেষ করে তার কাকার হাতেমনােজবাবু পড়ানাের সময় চেয়ারে প্রায় বসেন না বললেই চলে ; টেবিলে ঠেস দিয়ে মাটিতে দাঁড়িয়ে হাতে বই নিয়ে ক্লাস নেন একটা অদ্ভুত মুদ্রাদোষমাঝে মাঝে ডান কাঁধটা ঝাঁকানি দিয়ে ওঠে আর ঘাডটা ডাইনেহেলে পড়ে, যেন মাছি তাড়াচ্ছেনআর প্রচণ্ড অন্যমনস্ক কখন যে কিসেরকথা ভাবেন সে এক রহস্যতার উপর ঠোঁটের ডগায় লেগে আছে ভেরিগুড|একটু বাইরে যাব স্যার ? ভেরি গুডআমরা চুপবাইরে যাবার মধ্যে ভেরি গুডের কী আছে ? পরক্ষণেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে দাঁতে দাঁত | চেপে বলেন, এই তাে গেলি বাইরে, আবার কেন

 হেড পণ্ডিতমশাই ভটচায়্যি স্যারের কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে তাঁর হাতের লেখার জন্যব্ল্যাকবাের্ডে এত সুন্দর বাংলা লেখা আর কেউ লিখতে পারে বলে মনে হয় না

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়-

সেকেণ্ড পণ্ডিতমশাইকে কেন যে সবাই ভ্যান পণ্ডিত বলত তার কারণ কোনােদিন জানতে পারিনিনামকরণটা হয়ে গিয়েছিল আমি আসার আগেইএকেও কোনােদিন হাসতে দেখেছি বলে মনে পড়ে নাতবে গােমড়া মেজাজ হওয়া সত্ত্বেও, উনি ছাত্রদের সামলানাের ব্যাপারে তেমন দুরস্ত ছিলেন নাএনার একটা ধমক এখনাে কানে লেগে রয়েছেচেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আমার গলা দিয়ে রক্তের গঙ্গা বয়ে গেল, তাও তােমরা মনােযােগ দিচ্ছ না

এনার হাত যে চলত খুব বেশি তা নয়, কিন্তু একবার অজয়কে কানের পাশে চড় মেরে প্রায় অজ্ঞান করে দিয়েছিলেনসেদিন সারা ইস্কুল সরগরম টিফিনের আগের ক্লাসে ঘটনাটা ঘটেছে, টিফিনের ঘণ্টা পড়ে গেছে, কিন্তু ক্লাস থেকে কেউ বেরােয়নিঅজয় মুখ লাল করে হাত দিয়ে কান ঢেকে মাথা হেঁট করে বসে আছে, ছেলেরা তাকে ঘিরে রয়েছে, পণ্ডিতমশাইকেও একরকম ক্লাসেই বন্দী করে রাখা হয়েছেবাইরে থেকে ক্লাসরুমের বন্ধ দরজার খড়খড়ি ফাঁক করে অন্য ক্লাসের ছেলেরা ভ্যান ! ভ্যান ! করে টিটকিরি দিচ্ছে

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়-

প্রহার ছাড়া আরেক রকমের অস্ত্র কোনাে কোনাে মাস্টারমশাই ব্যবহার করতেন যেটা প্রহারেরও বাড়াসেটা হল বাক্যবাণরমণীবাবু ছিলেন ব্যাপারে অদ্বিতীয়তাঁর দাঁতখিচুনাে চেহারাটা ব্যঙ্গ বিদ্রুপের জন্য সব সময় তৈরি হয়ে থাকতসঞ্জয় বলে একটি নতুন ছেলে ভর্তি হলতখন আমরা বােধহয় ক্লাস এইটেজানা গেল ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক আছে ছেলেরা মস্করার সুযােগ ছাড়বে কেন ? আমার বেলাতেও ছাড়েনিআমি যে সুকুমার সেরা সত্যজিৎ রায়ের ছেলে আর উপেন্দ্রকিশােরের নাতি এটা গােড়াতেই জানাজানি

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়-

গিয়েছিলতারপর ক্রমে বেরিয়ে পড়ল এইচ. এম. ভিআর্টিস্ট কনক দাশ আমার মাসি আর বাংলার সেরা ক্রিকেটার কার্তিক বােস আমার কাকা কয়েকদিন বাদে আমাকে শুনতে হল, হ্যাঁরে মানিক, অমল বলছিল পঞ্চম জk নাকি তাের দাদ ; সত্যি নাকি ? সেইরকম রবিবাবু তাের কে হন যে, জ্যাঠামশাই ?প্রশ্ন সঞ্জয়কে অনেকবার শুনতে হয়েছে দোষের মধ্যে সঞ্জয়ের রংটা শুধু উগ্র রকম ফরসা নয়, তার সঙ্গে বেশ খানিকটা গােলাম ছােপযাকে বলে দুধে আলতাতা ছাড়া ঠাকুরবাড়ির মেধার অংশও যেন ভাগে খুব বেশি পড়েনি সেটা কয়েকদিনের মধ্যেই বােঝা গেল 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *