এর সহজ কারণ হচ্ছে, আমার মতাে স্টেজভীতি সচরাচর দেখা যায় না। কোনাে বিষয়ে প্রাইজ পাচ্ছি শুনলে আমার গায়ে জ্বর আসে, কারণ অতগুলাে লােকের সামনে আমার নাম ডাক হবে,আমি জায়গা ছেড়ে উঠে গিয়ে হােমরা–চোমরা কারুর হাত থেকে প্রাইজ নেবাে, তারপর আবার হেঁটে আমার জায়গায় ফিরে আসব, এটা আমার কাছে একটা আতঙ্কের ব্যাপার। কাজেই মিউজিক ড্রইং–এর ভার শেষ পর্যন্ত পড়ল সুরঞ্জনের উপর । ছবি একই : নদীতে সাদা পাল তােলা নৌকো, আকাশে থােকা থােকা সাদা মেঘ, মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্য অস্ত যাচ্ছে ওপারের গাছপালার পিছন দিয়ে—কিন্তু হরিপদদার পারিপাট্য আর হাতের জোর নেই। | অনুষ্ঠানের সূচীর মধ্যে আমি থাকার শেষ তিন বছর দুটি জিনিস কখনাে বাদ পড়েনি। এক হল মাস্টার ফুলুর তবলা, আরেক হল জয়ম্ভর ম্যাজিক। ফুলু আমাদের চেয়ে ক্লাস তিনেক নিচে পড়ত । ৭ বছর বয়স থেকে তবলা বাজায়। পরে আরেকটু বড় হয়ে আসর–টাসরেও বাজিয়েছিল ।
জয়ন্ত আমার চেয়ে দু’ক্লাস উপরে পড়ত, পর পর দুবার ফেল করে আমাদের ক্লাসে এসে যায়। পরীক্ষায় যে সে পাশ করবে না সেটা বুঝেছিলাম যখন সে আমাদের সঙ্গে এক ক্লাসে বসে পরীক্ষা দিচ্ছে। আমরাও লক্ষ করছিলাম সে খাতার দিকে না চেয়ে বার বার নিজের কোলের দিকে চাইছে। কোলে বই খােলা আছে কি ? যে মাস্টারমশাই গার্ড দিচ্ছিলেন তিনিও ব্যাপারটা দেখে হনহনিয়ে এগিয়ে গেলেন জয়ন্তর দিকে।—নিচে কী দেখা হচ্ছে ? জয়ন্ত হাত তুলে দেখিয়ে দিল তাতে একটি আস্ত মর্তমান কলা।—“টিফিনে খাব স্যার । তাই দেখে নিচ্ছিলাম ঠিক আছে। কিনা।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
জয়ন্ত ম্যাজিক অভ্যাস করছে দশ–এগারাে বছর বয়স থেকে। স্টেজের ম্যাজিক ছাড়াও আরাে ভেলকি জানে সে । আমাদের ক্লাসে আসার কয়েকদিনের মধ্যেই দেখি ক্লাসে বসে বসেই পরিমল হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। কী ব্যাপার ? —না, জয়ন্ত কয়েক মিনিট ধরে পরিমলের গলার দুদিকের দুটো রগ টিপে ধরে বসে ছিল। তার থেকেই এই কাণ্ড । জয়ন্ত বুঝিয়ে দিল ও দুটো রগকে বলে carotid| arteries । ওগুলাে টিপে রাখলে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল কমিয়ে দিয়ে মানুষকে অজ্ঞান করে দেয়। তবে রগ ছেড়ে দেবার কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই আবার রক্ত চলাচল শুরু হয়ে যায়, আর জ্ঞান ফিরে আসে।
হাত সাফাই–এর ম্যাজিকে জয়ন্ত ছিল সিদ্ধহস্ত। তবে সে যে আরাে অনেক ছবি দিতে আরম্ভ করেছে । ছবিগুলাে একটা সিরিজের অন্তর্গত, নাম ওয়ানডারস অফ দ্য ওয়ার্লড। নেসলেই অ্যালবাম বার করেছে, সেই অ্যালবামে ছবিগুলাে সেঁটে রাখতে হয়। আমাদের সকলের মধ্যে কম্পিটিশন লেগে গেল কার অ্যালবাম আগে ভরতি হয়। মুশকিল হচ্ছে কী, প্রত্যেক প্যাকেটেই যে নতুন ছবি পাওয়া যাবে এমন কোনাে কথা নেই। অনিলের পয়সা আছে, সে একসঙ্গে একশাে প্যাকেট চকোলেট কিনে একদিনেই প্রায় অ্যালবাম ভরিয়ে নিল। ওর সঙ্গে পাল্লা দেবে কে ? অবিশ্যি যে ছবি একটার বেশি হয়ে যাচ্ছে সেগুলাে সে। অন্যদের বিলিয়ে দিল অকাতরে, কিন্তু নিজে কিনে পাবার মতাে মজা আছে কি তাতে ?
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
আমরা ডেস্কের মাঝখানে বসানাে নীল কালির দোয়াতের মধ্যে রেড ইঙ্ক আর রিলিফ নিব ডুবিয়ে লিখি, আর অনিল লেখে পাকার ফাউনটেন পেনে।। আমরা পাঁচ টাকার বক্স ক্যামেরায় ছবি তুলি, অনিল হঠাৎ একদিন একটা পাঁচশাে টাকার জার্মান লাইকা ক্যামেরা নিয়ে এল, সঙ্গে সাউথ ক্লাবের টেনিস টুর্নামেন্টের এনলার্জ করা ছবি। কলকাতায় যখন প্রথম ইয়াে ইয়াে বেরােল, অনিল এক সঙ্গে গােটা আষ্টেক কিনে নিয়ে এল ইস্কুলে। তারপর অবশ্য অনেকেই কিনল এই মজার খেলার জিনিসটা।
একদিন তাে দেখি অনিল এক জোড়া রােলার স্কেটস কিনে নিয়ে এসেছে। টিফিনের ঘণ্টা পড়তেই ক্লাস থেকে বেরিয়ে এসে চাকা লাগানাে জুতাে পরে বারান্দার এ–মাথা ও–মাথা গড়িয়ে বেড়াতে লাগল। | টিফিনের এক ঘণ্টার মধ্যে খাওয়া এবং খেলা দুটোই চলত। অনেক ছেলে। বাড়ি থেকে টিফিন বাক্সে খাবার নিয়ে আসত। আমরা খেতাম এক পয়সায় একটা করে আলুর দম। শালপাতার ঠোঙায় বিক্রী হত এই আলু, সঙ্গে একটি কাঠি, সেই কাঠিতে আলুটা বিধিয়ে মুখে পুরে দিতে হত । একদিন টিফিনের সময়। দেখি অদ্ভুত এক নতুন খাবারের আমদানি হয়েছে । কাগজে মােড়া মাখনের
বেশি অগ্রসর হচ্ছে সেটা জেনেছিলাম আমাদেরই ক্লাসের অসিতের জন্মদিনের নেমন্তন্নে। অসিত জয়ন্তকে ডেকেছিল ম্যাজিক দেখানাের জন্যই । খাওয়ার পর ম্যাজিক হবে, খাওয়ার মধ্যে কাচের জলের গেলাস হাতে নিয়ে জল খেয়ে হঠাৎ গেলাসটাকেই কডমডিয়ে চিবিয়ে খেতে আরম্ভ করে দিল জয়ন্ত । কাচ খাওয়া। পেরেক খাওয়া, এ সবই ইস্কুলে থাকতেই শিখেছিল। ইস্কুল ছাড়ার বছর দুয়েকের। মধ্যেই শুনলাম অ্যাসিড খেয়ে ম্যাজিক দেখাতে গিয়ে জয়ন্ত মারা গেছে । | আমাদের ক্লাসের ছেলেদের মধ্যে অনিলের কথাটা আলাদা করে বলা দরকার, কারণ তার মধ্যে কিছু বিশেষত্ব ছিল।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
অনিল খুব অল্প বয়সে বেশ কিছুদিন সুইজারল্যাণ্ডে ছিল একটা কঠিন ব্যারাম সারানাের জন্য। সেরে উঠে দেশে ফিরে। ১৯৩৩–এ ভর্তি হয় আমাদের ক্লাসে। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। সঞ্জয়ের যেমন ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, অনিলেরও পূর্বপুরুষের মধ্যে একজন বিখ্যাত বাঙালী ছিলেন । একবার বি. টি.র এক ছাত্র আমাদের ক্লাস নিচ্ছেন, রােমান ইতিহাস পড়াতে গিয়ে এটুরিয়ার রাজা লার্স পােরসিনার নাম উল্লেখ করামাত্র মিচকে ফররুখ বলে উঠেছে, কী বললেন স্যার, লর্ড সিনহা ? পিছনেই। বসেছিল অনিল ।
সে ফররুখের মাথায় মারল এক গাঁট্টা । কারণ আর কিছুই না, এই লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ ছিলেন অনিলের দাদামশাই। অনিল নিজে ছাত্র ছিল। খুব চতুর ; বহুদিন বিদেশে থাকার জন্য বাঙলায় খুব কাঁচা, কিন্তু পুষিয়ে নিত ইংরিজি আর অঙ্কে । বাবার একমাত্র ছেলে আর অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে বলে। অনিলের ভাগ্যে কিছু জিনিস জুটে যায় যেটা আমরা কল্পনাই করতে পারি না।