নেসলে কোম্পানি তখন তাদের এক–আনার চকোলেটের প্যাকেটে এক ধরনের প্যাকেটের মতাে দেখতে আইসক্রীম—নাম ‘হ্যাপি বয়’ । বাঙালী কোম্পানি। রাস্তায় ফেরি করা আইসক্রীম সেই প্রথম।কিছুদিনের মধ্যেই শহরের সর্বত্র দেখা যেতে লাগল হ্যাপি বয় আইসক্রীমের ঠেলা গাড়ি । হ্যাপি বয় উঠে যাবার পর এল ম্যাগনােলিয়া, আর তারও অনেক পরে কোয়ালিটি–ফ্যারিনি। টিফিন টাইমের খেলার মধ্যে গুলি–ডাংগুলি ছাড়া যেটা বিশেষভাবে চালু ছিল। সেটা হল লাটু ।
যগুবাবুর বাজারের কাছে মিত্র মুখার্জির দোকানের সিড়িতে বিকেলে দোকান পেতে বসতেন কলকাতার সেরা লাট্ট বানানেওয়ালা গুপীবাবু । লাট্ট যে কত ভালাে ঘুরতে পারে সেটা গুপীবাবুর লাট্ট ঘূর্ণি যে দেখেনি সে জানতে পারে না। সেই লাটু গচ্চা মেরে অন্যের লাটু ফাটিয়ে দেবার খেলা চলত। টিফিনে। তাছাড়া হাত লেত্তি, উড়ন লেত্তি, ঘুরন্ত লাটুকে হাত থেকে লেত্তিতে। ঢেলে নিয়ে আবার হাতে তুলে নেওয়া—এসব তাে আছেই।
একবার গচ্চা লাট্টর গায়ে না লেগে লাগল অমলের পায়ে, আর পায়ের পাতা থেকে তৎক্ষণাৎ গলগলিয়ে রক্ত। | খেলতে গিয়ে এই ধরনের বিপত্তি আরাে হয়েছে—যেমন হল অ্যানুয়্যাল। স্পাের্টসে সুশান্তর । আমাদেরই ক্লাসের ছেলে, স্পাের্টস আর পড়াশুনা দুটোতেই। ভালাে। স্পাের্টসে একটা আইটেম ছিল ব্লাইণ্ডফোল্ড রেস। মাঠের এক কোণ। থেকে আরেক কোণে একশাে গজ দৌড়ে আসতে হত চোখ বাঁধা অবস্থায় । রেস। শুরু হল ; সুশান্ত যে লাইন রাখতে পারেনি, মাঝপথে বাঁয়ে সরে এসেছে, সেটা। দেখতেই পাচ্ছি। কে একজন তার নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠল তাকে সাবধান করে দেবার জন্য। সুশান্ত ভড়কে গিয়ে এক মুহূর্তের জন্য থেমে পরমুহূর্তেই দেরি হয়ে। যাচ্ছে ভেবে প্রচণ্ড বেগে দৌড়ে গিয়ে ফিনিশিং পােস্ট থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাত বাঁয়ে চোখ বাঁধা অবস্থায় সােজা ধাক্কা খেল ইস্কুল কম্পাউণ্ডের দেয়ালে।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়-
সেই দৃশ্য, আর ধাক্কার সেই শব্দের কথা ভাবলে এখনাে গা শিউরে ওঠে। তার পরের বছর থেকে অবিশ্যি ব্লাইণ্ডফোল্ড রেস ব্যাপারটাই উঠে যায়।। পাড়ায় একটা ছেলেদের ক্লাব আছে, আমি বেলতলা যাবার দু‘একদিনের মধ্যে ক্লাবের ছেলেরা দল করে এসে আমাকে ধরে নিয়ে গেল। মানু –মন্টুও সেই ক্লাবের সভ্য। আমাদের দুটো বাড়ি পরেই আরেক ব্যারিস্টার নিশীথ সেনের বাড়ি, সে বাড়ির বড় মাঠে ক্রিকেট হকি খেলা হয়, আর মানুদের ছােট মাঠে হয়। ব্যাডমিন্টন । নিশীথ সেনের ছেলে ভাইপাে চুনি, ফুনু, অনু সবাই ক্লাবের মেম্বর। আরাে মেম্বরদের মধ্যে আছে চাটুজ্যেদের বাড়ির নীলু, বলু, অনাথ, গােপাল। ইস্কুলে থাকতেই সঙ্গী–সাথী হয়েছিল—তারা বাড়ির বাইরে এসে রাস্তা থেকেই আমার ঘরের দিকে মুখ করে পাড়া কাঁপিয়ে হাঁক দিত—“মানিক, বাড়ি আছিস ? এখন তাদের সঙ্গে আরাে নতুন সাথী যােগ হল ।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়-
আরেকটি ছেলে ছিল, সে সাউথ সুবারবন ইস্কুলেপড়ে আমাদের একই ক্লাসে, যদিও আমার চেয়ে বছর চারেকের বড়। পর পর কয়েক বছর ফেল করেই বােধহয় এই দশা। এই অরুণ, ডাকনাম পান, হল ময়মনসিংহের অখিলবন্ধ। গুহদের বাড়ির ছেলে ; থাকে নিশীথ সেনের উল্টোদিকের বাড়িতে। আমাদের ক্লবের সভ্য হওয়া সত্ত্বেও বুদ্ধি কম বলে তাকে বিশেষ কেউ পাত্তা দেয় না। সেই পানুও হঠাৎ একদিন দমদমের ফ্লাইং ক্লাবে ভর্তি হয়ে এরােপ্লেন চালানাে শিখে ফেলল । তারপর ফ্লাইং ক্লাবের বাৎসরিক উৎসবে সে আমাদের দমদমে নেমন্তন্ন করে নিয়ে গিয়ে টু–সীটার প্লেনে আকাশে উঠে পর পর ভীষণ শব্দে আমাদের দিকে ডাইভ করে নেমে এসে আবার উঠে গিয়ে আমাদের তাক লাগিয়ে দিল।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়-
এর পর থেকে অবিশ্যি আমরা পানুকে বেশ সমীহ করে চলতাম। | আমাদের সময় একটা সরকারী নিয়ম ছিল যে পনেরাে বছর বয়সের কমে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়া চলবে না। আমাদের পরীক্ষা হবে ১৯৩৬–এর মার্চ ইস্কুলের প্রথম চারটি বছর আমি বকুলবাগান রােডেই ছিলাম। ক্লাস নাইনে থাকতে সােনামামা বাড়ি বদল করে চলে গেলেন বেলতলা রােডে। এবাড়ি। আগের বাড়ির চেয়ে কিছুটা বড় বেলতলায় আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতেন। চিত্তরঞ্জন দাশের জামাই ব্যারিস্টার সুধীর রায়। তাদের হাল্কা হলদে রঙের। গাড়িই আমার প্রথম দেখা ডাকসাইটে জার্মান গাড়ি মার্সেডিজ বেস।। সুধীরবাবুর ছেলে মানু ও মন্টু আমার বন্ধু হয়ে গেল। মানুও পরে ব্যারিস্টারি । করে, আর আরাে পরে রাজনীতি করে বাংলার কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রী হয়। তখন। লােকে তাকে জানে সিদ্ধার্থশংকর রায় নামে।