যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায় (পর্ব-৩)

পেরেকের তলা আর বারুদের মাঝখানে ইঞ্চি খানেকের একটা ফাঁক থাকে। 

এবার বাঁখারিটা হাতে শক্ত করে ধরে পেরেকের মাথাটা সজোরে দেয়ালেমারলেই বায়ুর চাপে চাবির ভিতরে বারুদ বােমার মতাে শব্দ করে ফেটে উঠত ।

যখন ছোট ছিলামএছাড়া ছেদি দইয়ের ভাঁড় দিয়ে একরকম লণ্ঠন তৈরি করত যেটা ভারী মজার লাগত আমার ভাঁড়ের তলার গােল অংশটা কেটে বাদ দিয়ে তার জায়গায় লাগিয়ে দিত একটা রঙীন কাচতারপর ভাঁড়ের ভিতর পাশটায় একটা মােমবাতি দাঁড় করিয়ে, সেটাকে জ্বালিয়ে ভাঁড়ের মুখটা বন্ধ করে দিত একটা ফুটোওয়ালা পিচবাের্ড দিয়েফুটোর দরকার, কারণ বাতাস না পেলে মােমবাতি জ্বলবে না| সবশেষে ভাঁড়ের কানায় বাঁধা দড়ি হাতে নিয়ে অন্ধকারে ঘােরাফেরা করলেই দেখা যেত বঙিন কাচের মধ্যে দিয়ে রঙিন আলাে বেরিয়ে পড়ে দিব্যি একটা বাহারের লণ্ঠনের চেহারা নিয়েছে। 

যখন ছােট ছিলাম ধর্মের ব্যাপারে ছাড়া, ঠাকুরদাদাদের ভাইয়ে ভাইয়ে মিল ছিল অনেকহিন্দু সারদা মুক্তিদা যেমন খেলাধুলা করতেন, মাছ ধরতেন, তেমনি করতেন ব্রাহ্ম কুলদাক্রিকেট শুরু করেন সারদা, তারপর সেটা রায় পরিবারে হিন্দু ব্রাহ্ম সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে| খেলাটা সত্যি করে শিকড় গেড়েছিল আমার সােনাঠাকুমার বাড়িতে সােনাঠাকুমা হলেন আমার ঠাকুরদাদার বােন এনার বিয়ে হয়েছিল ব্রাহ্ম বােস পরিবারে। স্বামী হেমেন বােসের ছিল পারফিউমারি বা গন্ধদ্রব্যের কারবার। কেশে মাখাে কুন্তলীন রুমালেতে দেলখােশপানে খাও তাম্বুলীন

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়

ধন্য হােক এইচ বােস এই চার লাইনের কবিতা দিয়ে বিজ্ঞাপন বেরােত তখন কাগজে কাগজেগন্ধদ্রব্য ছাড়াও এইচ বােস আরেকটা ব্যবসা চালিয়েছিলেন কিছুদিনসেটা ছিল এক ফরাসী কোম্পানীর সঙ্গে একজোটে গ্রামােফোন রেকর্ডের ব্যবসাসে রেকর্ড আমরা ছেলেবেলায় শুনেছিরেকর্ড ঘুরতাে উলটো দিকে, আর পিন সমেত সাউন্ড বক্স নড়ত মাঝখান থেকে বাইরের দিকে| সােনাঠাকুমা ছিলেন চোদ্দজন ছেলেমেয়ের মাগায়ের রং ধপধপে, আশী বছর বেঁচেছিলেন, শেষ দিন অবধি একটা চুল পাকেনি, একটা দাঁত পড়েনি| চার মেয়ের বড় মেয়ে মালতী তখনকার দিনের নামকরা গাইয়ে । বড় ছেলে হিতেনকাকা পাকা আঁকিয়ে, ওস্তাদী গানের সমঝদার, ফারসী জানেন, দামী দুষ্প্রাপ্যবই সংগ্রহ করেনটকটকে রং, সুপুরুষ চেহারাআরেক ভাই নীতীন (পুতুলকাকা) পরে নামকরা সিনেমা পরিচালক ক্যামেরাম্যান হয়েছিলেনআমার ছেলেবয়সে মনে আছে তিনি নিজেই ছােট মুভী ক্যামেরা দিয়ে আসামে খেদায় হাতি ধরার ছবি তুলে এনে দেখিয়েছিলেন, আর পরে সে ছবি বিলিতি কোম্পানীকে বিক্রী করেছিলেন। 

পরের ভাই মুকুলের পায়ের ব্যারাম, তিনি খুঁড়িয়ে হাঁটেনপড়াশুনা খুব বেশিদূর করেননি, কিন্তু যন্ত্রপাতির ব্যাপারে অসাধারণ মাথাউদ্ভিদবিজ্ঞানী 

মৰ উনিট সারাতে জঃ 

বি গবেষণার যন্ত্র কলকাতায় একমাত্র পারেনপরে ইনিই সিনেমা লাইনে গিয়ে সাউন্ড রেকর্ডিস্ট হিসেবে বিশেষ নাম করেছিলেন। 

তার পরের চার ভাই কার্তিক গণেশ বাপী বাবু সকলেই ক্রিকেট খেলেআমি যখন ছােট, তখন কার্তিক সবে নাম করেছে, আর সবাই বলছে বাঙালীদের মধ্যেএমন ব্যাটসম্যান হয়নিঅ্যামহাস্ট স্ট্রীটে ওদের বাড়িতে সন্ধেবেলা গেলেই দেখা 

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়

ঠাকুরদার পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে দুভাই ছাড়া সকলেই ব্রাহ্ম হয়েছিলেনসারদারঞ্জন মুক্তিদারঞ্জন|ছিলেন বড় এবং সেজো ভাই! ওঁদের বলতাম বড়দাদু আর মুক্তিদাদুওদের বাড়িতে গেলেই দেখতে পেতাম বৌয়েদের সিথেয় সিদুর, শাড়ি পরার ঢং আলাদা, পুরুষদের হাতে মাদুলিপুজোর ঘর থেকে শােনা যেত শাঁখ আর ঘণ্টার শব্দ, খুড়িমাঠাকুমারা প্রসাদ এনে খাওয়াতেন আমাদেরকিন্তু এই তফাত সত্ত্বেও ওঁদের পরপর মনে হয়নি কখনােসত্যি বলতে কী, এক ভবানীপুর সেরা সত্যজিৎ ক্রিসমাস ট্রী, আর যেটা সবচেয়ে বেশি চোখ টানছেগালফোলা হাসি নিয়ে দাড়িমুখাে লাল জামা লাল টুপি পরা তিন মানুষ সমান বড় ফাদার ক্রিসমাস| খেলনা যা আছে তা সবই বিলিতি তার মধ্যে থেকে আমাদের সাধ্যে কুলােয়

এমন এক বাক্স ক্র্যাকার নিয়ে বাড়ি ফিরলামসেরকম ক্র্যাকার আজকাল আর নেইতার যেমনি আওয়াজ, তেমনি সুন্দর তার ভিতরের খুদে খুদে জিনিসগুলাে| বড় আর বাহারের দোকান বলতে তখন যা ছিল তার বেশির ভাগই চৌরঙ্গীতে তার মধ্যে হােয়াইটআওয়ের কাছেই একটা দোকান ছিল যেটা বাঙালীর দোকানকার এন্ড মহলানবিশগ্রামােফোন আর খেলার সরঞ্জামের দোকানদোকানে বসতেন যিনি, তাঁকে আমরা কাকা বলতামবুলাকাকাএইদোকানে একটা বাহারের চেয়ার ছিল যেটা আসলে একটা ওয়েইং মেশিনচৌরঙ্গী অঞ্চলে গেলেই বুলাকাকার দোকানে ঢুকে চেয়ারে বসে ওজন হয়ে আসাটা একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়

বাবা মারা যাবার পরে এই বুলাকাকাই আমাকে এনে দিয়েছিলেন একটা গ্রামােফোনসেই থেকে আমার গ্রামােফোন আর রেকর্ডের শখআমার নিজের দুটো খেলনা গ্রামােফোন ছিলসেগুলােও সম্ভবত বুলাকাকারই দেওয়াএকটার নাম পিগমিফোন, একটার কিডিফোনতাদের সঙ্গে বেশ কিছু বিলিতি গানবাজনার রেকর্ডও ছিললুচির সাইজের| কলকাতার রেডিও স্টেশন চালু হবার কিছুদিনের মধ্যে বুলাকাকাই আমাকে জন্মদিনে একটা রেডিও উপহার দিয়েছিলেনসে রেডিও আজকের দিনের রেডিওর মতাে নয়তাকে বলত ক্রিস্টাল সেটকানে হেডফোন লাগিয়েশুনতে হত ; অর্থাৎ এক সঙ্গে একজনের বেশি শুনতে পেত না রেডিও প্রােগ্রাম| বুলাকাকার সঙ্গেই আমরা একবার গিয়েছিলাম উটরাম রেস্টোরান্টে উটরাম ঘাটে এই বাহারের রেস্টোরান্টটা জলের উপর ভাসতদেখতে ঠিক জাহাজের ডেকের মতােএখন উটরাম ঘাটে গেলে আগের সেই চেহারাটা আর দেখা যাবে। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *