যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়-(পর্ব-৪)

 তখন ঘাটের উল্টোদিকে ইডেন গার্ডেনের চারদিকে বাহারের গ্যাসের বাতি জ্বলত, আর বাগানের মাঝখানে ব্যান্ডস্ট্যান্ডে সন্ধ্যাবেলা বাজত গােরাদের ব্যান্ড। উটরাম রেস্টোরান্টে আমি জীবনে প্রথম আইসক্রীম খাই। অবিশ্যি এই নিয়ে পরে অনেকদিন ঠাট্টা শুনতে হয়েছিল ; কারণ প্রথম চামচ মুখে দিয়ে দাঁত ভীষণ সিরসির করায় আমি বলেছিলাম আইসক্রীমটা একটু গরম করে দিতে।যখন ছোট ছিলামমন্দেশ পত্রিকা বন্ধ হবার কিছুদিন পরেই যে ইউ রায় অ্যান্ড সনসের ব্যবসাও ‘কেন উঠে গেল, সেটা অত ছেলেবয়সে আমি জানতেই পারিনি। শুধু শুনলাম মা একদিন বললেন আমাদের এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। 

গড়পার ছেড়ে, আর সেই সঙ্গে উত্তর কলকাতা ছেড়ে, আমরা দুজন চলে এলাম ভবানীপুরে আমার মামার বাড়িতে। আমার বয়স তখন ছয়ের কাছাকাছি। আমার মনে হয় না সে বয়সে বড় বাড়ি থেকে ছােট বাড়ি, বা ভালাে অবস্থা থেকে সাধারণ অবস্থায় গেলে মনে বিশেষ কষ্ট হয় । “আহা বেচারা কথাটা ছােটদের সম্বন্ধে বড়রাই ব্যবহার করে ; ছােটরা নিজেদের বেচারা বলে ভাবে না । 

ভবানীপুরে বকুলবাগানের বাড়িতে এসেই যেটা আমাকে অবাক করেছিল সেটা হল চীনে মাটির টুকরাে বসানাে নকশা করা মেঝে। এ জিনিস এর আগে কখনাে দেখিনি । অবাক হয়ে দেখতাম, আর মনে হত, বাপরে বাপ, না জানি কত পেয়ালা পিরিচ প্লেট ভেঙে তৈরি হয়েছে এই মেঝে! টুকরােগুলাের বেশির ভাগই সাদা, তবে তার মধ্যে হঠাৎ একএকটার কোণে হয়ত এক চিলতে ফুল, বা তারা, বা ঢেউখেলানাে লাইন। কিছু করার না থাকলে এই চীনে মাটির টুকরােগুলাে দেখে অনেকটা সময় কেটে যেত । 

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়

আরেকটা ভালাে জিনিস ছিল এ বাড়িতে যেটা গড়পারে পাইনি। সেটা হল রাস্তার দিকে বারান্দা। শােবার ঘর থেকে বেরিয়েই বারান্দা, সকাল দুপুর বিকেলভরে দেখতাম রাস্তায় কতরকম লােকের চলাফেরা। দুপুরে যেত ঠেলা 

গাড়িতে রঙবেরঙের জিনিস নিয়ে ফেরিওয়ালা—‘জামান ওয়ালা দোআনা, জাপান ওয়ালা দোআনা। সপ্তাহে দু’দিন না তিনদিন যেত মিসেস উডের বাক্সওয়ালা । বারান্দা থেকে মা-মাসি ডাক দিতেন ‘এই বাক্সওয়ালা, এখানে এস’ । মনটা নেচে উঠত, কারণ বিকেলের খাওয়াটা জমবে ভাল ; বাক্সে আছে। মেমসাহেবের তৈরি কেক, পেস্ট্রি, প্যাটি। 

সন্ধে যখন হব-হব, তখন শােনা যেত সুর করে গাওয়া ‘ম্যায় লাহু মজেদার, চানাচার গরম’; আর কিছু পরেই শুরু হয়ে যেত রাস্তার ওপারে চাটুজ্যেদের বাড়ি থেকে হারমােনিয়াম বাজিয়ে কর্কশ গলায় কালােয়াতি গানের রেওয়াজ। | গ্রীষ্মকালের দুপুরে যখন শােবার ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে দেওয়া হত, তখনও কেমন করে জানি খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে আলাে আসার দরুন দিনের একটা। বিশেষ সময় রাস্তার উল্টো ছবি পড়ত জানালার বিপরীত দিকের দেওয়ালের অনেকখানি জায়গা জুড়ে। বন্ধ ঘরে ম্যাজিকের মতাে রাস্তার লােক চলাচল দেখা 

সেরা সত্যজিৎ 

আরেকটা খেলার যন্ত্র ছিল আমার, সেটাও আর আজকাল দেখতে পাওয়া যায় না। সেটা হল ম্যাজিক ল্যানটান। বাক্সের মতাে দেখতে, সামনে মো.es মধ্যে লেন্স, মাথার উপর চিমনি আর ডান পাশে একটা হাতল । তাছাড়া তা দুটো রীল, একটায় ফিল্ম ভরতে হয়, সেই ফিল্ম হাতল ঘােরালে অন্য রীলে গিয়ে জমা হয়। ফিল্মটা চলে লেন্সের ঠিক পিছন দিয়ে। বাক্সের ভিতর জলে কেরােসিনের বাতি, তার ধোঁয়া বেরিয়ে যায় চিমনি দিয়ে, আর তার আলাে ঘর ফিল্মের চলন্ত ছবি ফেলে দেয়ালের উপর। কে জানে, আমার ফিল্মের নেশা হয়ত এই ম্যাজিক ল্যানটার্নেই শুরু। | মামার খেলার সাথীদের মধ্যে ছিলেন আরেক মামা, যিনি আমাদের বাড়িতেই থাকতেন এক তলার পুবদিকের ঘরে। আসলে ইনি আত্মীয় নন। ঢাকায় মামাবাড়ির পাশেই ছিল এদের বাড়ি। সেই সূত্রে বন্ধু, আর তাই আমি বলি। মামা। কালুমামা। কলকাতায় এসেছিলেন চাকরির খোঁজে ।

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়

চাকরি পাবার কিছু দিনের মধ্যে কিনে আনলেন ত্রিশ টাকা দামের একটা ঝকঝকে নতুন র্যালে সাইকেল। ছ’মাস ব্যবহারের পরেও এই সাইকেল ছিল ঠিক নতুনের মতােই ঝকঝকে, কারণ রােজ সকালে ঝাড়া আধ ঘণ্টা ধরে কালুমামা সাইকেলের। পরিচর্যা করতেন। সােনামামা আমুদে লােক ছিলেন বলেই বকুলবাগানে এসে মাঝে মাঝে বায়স্কোপ, সাকাস, ম্যাজিক, কার্নিভ্যাল ইত্যাদি দেখার সুযােগ আসত । একবার এম্পায়ার থিয়েটারে (যেটা এখন রক্সি) এক সাহেবের ম্যাজিক দেখতে গেলাম । নাম শেফালাে। খেলার পর খেলা দেখিয়ে চলেছেন, আর তার সঙ্গে কথার ফোয়ারা ছুটছে। পরে জেনেছিলাম জাদুকরের এই বুকনিকে বলা হয় ‘প্যাটার’ । এই প্যাটারের গুণে দর্শকের দৃষ্টি চলে যায় জাদুকরের মুখের দিকে, আর তার ফলে হাতের অনেক কারসাজি দৃষ্টি এড়িয়ে যায় ।

কিন্তু শেফালাের দলে ছিলেন এক জাদুকরী, নাম মাদাম প্যালার্মো। তিনি ম্যাজিক দেখালেন একেবারে বােবা সেজে। এ জিনিস আর কখনাে দেখিনি। ” এর কিছুদিন পরে এক বিয়ে বাড়িতে একজন বাঙালীর ম্যাজিক দেখেছিলাম যার কাছে শেফাললা সাহেবের স্টেজের কারসাজি কিছুই না। স্টেজ ম্যাজিকে নানান যন্ত্রপাতির ব্যবহার হয়, আলাের খেলা আর প্যাটারের জোরে লােকের চোখ মন ধাঁধিয়ে যায়। ফলে জাদুকরের কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। এই ভদ্রলােক ম্যাজিক দেখালেন প্যান্ডেলের তলায় ফরাসের উপর বসে, তাঁর চারিদিক ঘিরে চার পাঁচ হাতের মধ্যে বসেছেন নিমন্ত্রিতরা। এই অবস্থাতে একটার পর একটা এমন খেলা দেখিয়ে গেলেন ভদ্রলােক যা ভাবলে আজও তাজ্জব বনে। যেতে হয়। এই জাদুকরকে অনেক পরে আমার একটা ছােট গল্পে ব্যবহার। 

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়

যখন ছােট ছিলাম করেছিলাম । ফরাসের উপর দেশলাইয়ের কাঠি ছড়িয়ে দিয়েছেন ভদ্রলােক, নিজের সামনে রেখেছেন একটা খালি দেশলাইয়ের বাক্স। তারপর ‘তােরা আয় একে একে বলে ডাক দিতেই কাঠিগুলাে গড়িয়ে গড়িয়ে এসে বাক্সয় ঢুকছে। আমাদেরই চেনা এক ভদ্রলােকের কাছ থেকে চেয়ে নিলেন একটা রুপাের টাকা, আর আরেকজনের কাছ থেকে একটা আংটি। প্রথমটাকে রাখলেন হাত চারেক দূরে, আর দ্বিতীয়টাকে নিজের সামনে। তারপর আংটিটাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘যা, টাকাটাকে নিয়ে আয়।

বাধ্য আংটি গড়িয়ে গেল টাকার কাছে, তারপর দুটো একসঙ্গে গড়িয়ে এল ভদ্রলােকের কাছে। আরেকটা ম্যাজিকে এক। ভদ্রলােকের হাতে এক প্যাকেট তাস ধরিয়ে দিয়ে আরেকজনের হাত থেকে লাঠি নিয়ে ডগাটা বাড়িয়ে দিলেন তাসের দিকে। তারপর বললেন, ‘আয়রে ইস্কাপনের টেক্কা ! প্যাকেট থেকে সড়াৎ করে ইস্কাপনের টেক্কাটা বেরিয়ে এসে লাঠির ডগায় আঁটকে থরথর করে কাঁপতে লাগল । |

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *