ডগায় আঁটকে থরথর করে কাঁপতে লাগল । | ম্যাজিক দেখার কয়েকদিন পরে হঠাৎ জাদুকরের সঙ্গে দেখা বকুলবাগান আর শ্যামানন্দ রােডের মােড়ে | বয়স পঞ্চাশ–পঞ্চান্ন, পরনে ধুতি আর শার্ট, দেখলে কে বলবে ভদ্রলােকের এত ক্ষমতা। আমার ম্যাজিকের ভীষণ শখ, মনে মনে আমি তাঁর শিষ্য হয়ে গেছি। ভদ্রলােককে বললাম আমি তাঁর কাছে ম্যাজিক শিখতে চাই। নিশ্চয়ই শিখবে’ বলে ভদ্রলােক তাঁর পকেট থেকে এক প্যাকেট তাস বার করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আমাকে একটা খুব মামুলি ম্যাজিক শিখিয়ে দিলেন। তারপর আর ভদ্রলােকের সঙ্গে দেখা হয়নি। হঠাৎ সামনে পড়ে ঘাবড়ে গিয়ে ওর ঠিকানাটাও নেওয়া হয়নি। পরে ম্যাজিকের বই কিনে হাত সাফাইয়ের অনেক ম্যাজিক আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই অভ্যেস করে শিখেছিলাম। কলেজ অবধি ম্যাজিকের নেশাটা ছিল।।
সাকাস তাে এখনও প্রতি বছরই আসে, যদিও তখনকার দিনে হার্মস্টোন সাকাসে সাহেবরা খেলা দেখাত, আর আজকাল বেশির ভাগই মাদ্রাজী সাকাস । যেটা আজকাল দেখা যায় না সেটা হল কার্নিভ্যাল। আমাদের ছেলেবেলায় সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ–এর দুধারে ছিল বড় বড় মাঠ । কলকাতার প্রথম ‘হাইরাইজ দশ তলা টাওয়ার হাউস তখনও তৈরি হয়নি, ইলেকট্রিক সাপ্লাই–এর ভিক্টোরিয়া হাউস তৈরি হয়নি। এই সব মাঠের একটাতে সাকাসের কাছেই বসত কার্নিভ্যাল।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
কার্নিভ্যালের মজাটা যে কী সেটা আজকালকার ছেলেমেয়েদের বােঝানাে মুশকিল। মেলায় নাগরদোলা সকলেই দেখেছে, কিন্তু কার্নিভ্যালের নাগরদোলা বা জায়ান্ট হুইল হত পাঁচ তলা বাড়ির সমান উঁচু। বহু দূর থেকে দেখা যেত। ঘুরন্ত হুইলের আলাে। এই নাগরদোলা ছাড়া থাকত মেরি–গাে–রাউন্ড, এরােপ্লেনের ঘূর্ণি, খেলার মােটর গাড়িতে ঠোকাঠুকি, ঢেউখেলানাে অ্যালপাইন রেলওয়ে, আর আরাে কত কী। এসবেরই চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত নানা রকম জুয়ার স্টল। এত লােভনীয় সব জিনিস সাজানাে থাকত এই সব স্টলে যে। খেলার লােভ সামলানাে কঠিন হত।
শেষ পর্যন্ত প্রকাশ্যে জুয়া খেলাটা সরকার বেআইনী করে দেওয়ার ফলে কলকাতা শহর থেকে কার্নিভ্যাল উঠে গেল । আসল রােজগারটা হত বােধহয় এই জুয়া থেকেই।ভবানীপুরে যখন প্রথম আসি তখনও ফিল্মে কথা আসেনি। তখনকার বিলিতি হাউসগুলােতে ছবির সঙ্গে কথার বদলে শােনা যেত সাহেবের বাজানাে পিয়ানাে বা সিনেমা অগ্যান। এই সিনেমা অগ্যান জিনিসটা কলকাতায় মাত্র। একটা থিয়েটারেই ছিল। সেটা হল ম্যাডান, বা প্যালেস অফ ভ্যারাইটিজ। আজকাল এর নাম হয়েছে এলিট সিনেমা । অগ্যানের নাম ছিল Wurlitzer. আর তার আওয়াজ ছিল ভারী জমকালাে। যে সাহেব এই যন্ত্রটি বাজাতেন তাঁর নাম ছিল বায়রন হপার । রােজ কাগজে দেওয়া থাকত হপার সাহেব সেদিনের ছবির সঙ্গে কী কী সংগীত বাজাবেন তার তালিকা ।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
এই সময় দেখা ছবিগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি মনে আছে Ben Hur, Count of Monte Cristo, Thief of Bagdad o Uncle Tom‘s Cabin। গ্লোবে তখন ছবির সঙ্গে স্টেজে নাচ–গানের বন্দোবস্ত ছিল। আজকাল যেমন সিনেমা থিয়েটারে গিয়ে দেখা যায় কাপড়ের পর্দা ঝুলছে, তখন তা ছাড়া আরেকটা বাড়তি পদ থাকত। বিজ্ঞাপনে ভরা এই পদাকে বলত সেফটি কাটেন। সবচেয়ে প্রথমে উঠত এই পদা, তার কিছুক্ষণ পরে কাপড়ের পদা । গ্লোবে কাপড়ের পর্দা উঠলে পরে বেরিয়ে পড়ত স্টেজ। তাতে রঙতামাশা শেষ হলে পর নেমে আসত সিনেমার সাদা স্ক্রীন । তারপর ছবি শুরু । পদার সামনে এক পাশে থাকত পিয়ানাে । ছবির ঘটনার মেজাজের সঙ্গে তাল রেখে সাহেব বাজনা চালিয়ে যেতেন যতক্ষণ ফিল্ম চলে ।
Uncle Tom‘s Cabin ছবি দেখতে গিয়ে এক মজা হল। বাড়ির সবাই মিলে গিয়েছি গ্লোব সিনেমায় । নিগ্রো দাস আংকল টম তার নৃশংস মনিব সাইমন লেগ্রীর চাবুক খেয়ে দোতলার সিড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে মরে গেছে। আমাদের সকলের রাগ পড়ে আছে লেগ্রীর উপর । ছবির শেষ দিকে টম ভুত হয়ে ফিরে আসে মনিবের কাছে। মনিব সেই ভূতের দিকেই চাবুক চালায়, টম হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে তার দিকে। কালুমামা আমার পাশে বসে হাঁ করে ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ আর থাকতে না পেরে হল–ভর্তি লােকের মধ্যে সীট ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে চীৎকার শুরু করে দিলেন—‘হালায় এহনাে চাবুক মারে ? এহনাে চাবুক মারে ? শয়তান !—এইবার বুঝবি তর পাপের ফল !
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
১৯২৮ সালে হলিউডে প্রথম সবাক ছবি তৈরি হল। কলকাতায় প্রথম টকি। এল তার এক বছর পরেই। তার পরেও বছর খানেক ধরে এমন বেশ কিছু ছবি। এসেছে যেগুলাের কিছু অংশে শব্দ আছে, কিছুতে নেই। যার পুরােটাতে শব্দ আছে কাগজে সেটার বিজ্ঞাপন হত ‘100% Talkie বলে । আমার দেখা প্রথম টকি সম্ভবত ‘টার্জন দি এপ ম্যান’ । গ্লোবে এসেছে ছবি, প্রথম দিন দেখতে গিয়ে টিকিট পাওয়া গেল না । আমায় নিয়ে গেছেন আমার এক মামা ।
আমার মুখ দেখে তাঁর বােধহয় দয়া হল, বুঝলেন আজ একটা কিছু না দেখে বাড়ি ফেরা উচিত হবে না ।। কাছেই ছিল অলবিয়ন থিয়েটার, যেটার নাম এখন রিগ্যাল । সেখানে টিকিট ছিল, কিন্তু সেটা বাংলা ছবি, আর মােটেই সবাক নয়। ছবির নাম ‘কাল পরিণয়’ ।সেটা যে ছােটদের উপযােগী নয়, সেটা আমিও খানিকটা দেখেই বুঝেছিলাম । মামা আমার দিকে ফিরে চাপা গলায় বার কয়েক জিগ্যেস করলেন বাড়ি যাবে ? আমি সে–প্রশ্নে কানই দিলাম না। একবার যখন ঢুকেছি তখন কি আর পুরােটা না দেখে বেরােনাে যায় ? অবিশ্যি এই ‘কাল পরিণয়’ দেখে আমার মনে একটা নাক–সিটকোন ভাব জেগেছিল যেটা বহুকাল আমাকে বাংলা ছবির দিকে ঘেঁষতে দেয়নি।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
যে মামার সঙ্গে ছবি দেখতে গিয়েছিলাম তিনি ছিলেন লেবুমামা। মা’র মাসতুতাে ভাই । কালুমামার মতাে ইনিও ঢাকা থেকে এসেছিলেন কলকাতায় চাকরির খোঁজে। এরও স্থান হয়েছিল আমার মামার বাড়িতেই।এখানে মার আরেক মাতুতাে ভাইয়ের কথা বলা দরকার, কারণ ননীমামার মতাে ঠিক আরেকটি লােক আমি বেশি দেখিনি। ছ‘ফুট লম্বা, তীরের মতাে সােজা, পরনে মালকোঁচা মারা খাটো ধুতি আর থ্র–কোয়ার্টার হাতা খাটো খদ্দরের পাঞ্জাবি।
ইনি হাটতেন হনহনিয়ে একেবারে মিলিটারি মেজাজে আর বাঙাল ভাষায় কথা বলতেন ভয়ংকর চেঁচিয়ে । যারা গাঁয়েদেশে মানুষ হয় তাদের স্বভাবতই মাঠেঘাটে গলা ছেড়ে কথা বলতে হয়। সেই অভ্যাসটাই হয়ত বেশি বয়সে শহরে এসেও থেকে যায়। তবে, চেঁচিয়ে কথা বললেও ননীমামার কথার মধ্যে একটা মেয়েলি টান ছিল। আর তিনি কাজের মানুষ ছিলেন বটে, কিন্তু যে কাজগুলাে সত্যিই ভালাে করতেন সেগুলাে সবই মেয়েলি কাজ।