যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়-(পর্ব-৬)

 বিয়ে করেননিযদি করতেনতবে গিন্নীপনাতে মামাকে হার মানাতে পারে এমন মেয়ে পাওয়া যেত কিনা সন্দেহমামা সেলাই এবং রান্না দুটোতেই ছিলেন ওস্তাদপরের দিকে চামড়ার কাজ শিখে তার উপর একটা বইলিখে ফেলেছিলেনবাঙালীর মিষ্টি বলে একটা বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা বেরােল না কেন

যখন ছোট ছিলামসেরা সত্যজিৎ দোকানে গিয়ে গ্রুপ ছবি তােলানাের রেওয়াজ ছিলবাঙালী দোকানও যে ছিল তা নয়, তবে তার বেশির ভাগই উত্তর কলকাতায়সাহেব দোকানের মধ্যেএককালে দুটি ছিল কলকাতার সবচেয়ে নাম করাবাের্ন অ্যান্ড শেপার্ড আর জনস্টন অ্যান্ড হফম্যানতখন এই দুটো দোকানের বয়স প্রায় সত্তর বছর, আরঅবস্থাও আগের মতাে নেইতার জায়গায় নাম করেছে হালের কোম্পানি এড়নালরেঞ্জ এদের দোকান হল চৌরঙ্গী আর পার্ক স্ট্রীটের মােড়ে চৌরঙ্গী ম্যানসনেআমরা দিদিমা মা মামা মাসিমা মামী মেসাে মামাতাে মাতুতাে ভাইবােনসবশুদ্ধ আঠারাে জন গিয়ে হাজির হলাম এডনা লরেঞ্জের দোকানে। 

আগে থেকে বলা ছিল, তাই সাহেব গ্রুপ ছবি তােলার সব আয়ােজন করেই রেখেছিলপ্রকাণ্ড হলঘরে পাশাপাশি চেয়ার রাখা হয়েছিল খানাতারই মাঝামাঝি একটায় বসলেন দিদিমাপুরুষরা সকলেই সার বেঁধে পিছনে দাঁড়াল, মা মাসি মামীরা বাকি চেয়ারগুলােয় বসলেন, বড়মামার অল্পবয়সী দুই মেয়ে বসলসামনে টুলে, আর আমি দাঁড়ালাম মা আর দিদিমার মাঝখানেঘরের মধ্যে ছবিভােলা হচ্ছে, ফ্ল্যাশ বা আলাে ব্যবহার করবেন না সাহেবরা (হয়ত তখনরেওয়াজও ছিল না), এক পাশে জানালার সারি দিয়ে যা আলাে আসছে তাতেই হবেঢাউস ক্যামেরা, লেসের সামনে ক্যাপ বসানাে, সেই ক্যাপ হয়ত দুসেকেন্ডের জন্য খুলে আবার বন্ধ করে দেওয়া হবে, আর সেই দুসেকেন্ডে ছবি উঠে যাবেওই সময়টুকুতে নড়াচড়া চলবে না। 

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়

সাহেব রেডি বলতে সবাই আড়ষ্ট হল, দৃষ্টি ক্যামেরার দিকেযিনি ছবিতুলবেন, তাঁর পাশে আরেকজন সাহেব, তাঁর হাতে করতালওয়ালা সংপুতুল, তার পেট টিপলে হাত দুটো খটাং খটাং করে করতাল বাজায়এই পুতুলের দরকারআমার মেজোমামার ছােটছেলে বাচ্চুর জন্যতার মাত্র কয়েক মাস বয়স, সে তার মায়ের কোলে বসেছেতার দৃষ্টি যাতে ক্যামেরার দিকে থাকে, তাই সাহেব ক্যামেরার পিছনে দাঁড়িয়ে করতাল বাজাতে শুরু করলেন, আর সময় বুঝে অন্য সাহেব লেন্সের ক্যাপ খুলে আবার বন্ধ করে ছবি তুলে নিলেন| এই ছবি তােলার বছর চার পাঁচের মধ্যে আমার দিদিমা, বড়মামা আরবড়মাসির ছেলে মানুদা মারা যানএই একই গ্রুপ ফোটো থেকে এই তিন জনের ছবিই আলাদা আলাদা করে এনলার্জ করে দেন আমার ধনদাদু। 

যখন ছােট ছিলাম একদিন শুনলাম ছােটমাসির গান বেরােবে হিজ মাস্টারস ভয়েস রেকর্ডে, আর সেই গান রেকর্ড করার জন্য ছােটমাসিকে যেতে হবে গ্রামােফোন কোম্পানির আপিসেব্যবস্থাটা করেছেন বুলাকাকা। কলকাতার সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত গ্রামােফোনের দোকানের মালিক বলে বােধ হয় বুলাকাকার সঙ্গে গ্রামােফোনকোম্পানির বেশ খাতির ছিল| বুলাকাকার লাল রঙের টিমডেল ফোর্ড গাড়িতে করে মাসির সঙ্গে আমিও গেলাম কোম্পানির আপিসে । আপিস তখন বেলেঘাটায় ; দমদমে যায় আরাে পরেসাহেব কোম্পানিতে গিয়ে গান দিতে হবে বলে দুদিন থেকে মাসির ঘুম খাওয়া বন্ধ

ক্রমাগত আশ্বাস দিয়ে চলেছেন বুলাকাকাকিচ্ছু ভয় নেই, ব্যাপারটা খুব সােজা, সব ঠিক হয়ে যাবেবুলাকাকা নিজে কোনােদিন গানটান শেখেনি, তবে বাঁশিতে রবীন্দ্রসংগীত বাজায়,আর দুহাতে দারুণ অগ্যান বাজায়| সাহেব কোম্পানির সাহেব ম্যানেজার, সাহেব রেকর্ডিস্টতখনকার দিনে মাইক্রোফোন ছিল না ; একটা চোঙার দিকে মুখ করে গান গাইতে হত, সেই গান পাশের ঘরে ছাপা হয়ে যেত ঘুরন্ত মােমের চাকতির উপর। 

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়

ছােটমাসি সকাল থেকে যে গেলাস জল খেয়েছে তার হিসেব নেইওখানে গিয়ে চোঙার সামনে দাঁড়াতে হয়েছে, আমি পাশের ঘরে কাচের জানালার পিছন থেকে ব্যাপারটা দেখছিছােকরা রেকর্ডিস্ট এসে চোঙাটাকে নেড়েচেড়ে মাসিকে ঠিক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিলতারপর মাসির সামনেই প্যাকেট থেকে সিগারেট বার করে সেটা শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে ঠোঁট দিয়ে লুফে নিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলবুলাকাকা পরে বুঝেছিলেন কোনাে মহিলা গাইয়ে এলেই নাকি রেকর্ডিস্ট তাঁদের দেখিয়ে দেখিয়ে এই ধরনের সব চালিয়াতি করেনআমার বিশ্বাস সাহেবের সিগারেট জাগলিং দেখে মাসির গলা আরাে শুকিয়ে গিয়েছিল। 

যাই হােক, গান গাইলেন ছােটমাসি, শুনে বুঝতে পারছি আড়ষ্টভাব পুরােকাটেনি, তবে সেই গানই একদিন রেকর্ড হয়ে বাজারে বেরােলতারপর অনেক দিন ধরে অনেক গান রেকর্ড করেছিলেন ছােটমাসিপ্রথমে ছিলেন কনক দাশ ; | বিয়ের পর হলেন কনক বিশ্বাস। 

বকুলবাগানে আমাদের বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ শ্যামানন্দ রােডে থাকতেন আমার মেজকাকা সুবিনয় রায় এই কাকাই তখন একদিন নতুন করে বার করলেন সন্দেশ পত্রিকা ১৯২৩এর সেপ্টেম্বরে বাবা মারা যাবার পর বছর দুয়েকের মধ্যেই সন্দেশ উঠে যায়তখনও আমার সন্দেশ পড়ার বয়স হয়নিটাটকা বেরােনাের সঙ্গে সঙ্গে হাতে নিয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা হল এই দ্বিতীয় পর্বেমলাটে তিনরঙা ছবি, হাতি দাঁড়িয়ে আছে দুপায়ে, খুঁড়ে ব্যালান্স করা সন্দেশের 

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়

বকুলবাগানে আমাদের সঙ্গে থাকতেন আমার ছােট মাসিতাঁর গাইয়ে হিসেবে খুব নাম ছিল অবিশ্যি ছােটমাসির গান আমরা যেমন শুনেছি, তেমনকোনাে বাইরের লােকে কোনােদিন শশানেনি, কারণ ললাকের সামনে গাইতে গেলেই ছােটমাসির গলা শুকিয়ে যেত। 

যখন ছােট ছিলাম কিনেছি, ভীষণ শখ তার প্রথম পাতায় রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে একটা কবিতা লিখিয়ে নেবাে। 

এক সকালে মাসঙ্গে গোলাম উত্তরায়ণে খাতাটা দিতে রবীন্দ্রনাথ বললেন, এটা থাক আমার কাছে ; কাল সকালে এসে নিয়ে যেও। 

কথা মতাে গেলাম পরের দিন টেবিলের উপর চিঠিপত্র খাতা বইরের ডহি, তার পিছনে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ, আর আমায় দেখেই আমার ছােট্ট বেগুনীখাতাটা খুঁজতে লেগেছেন সেই ভীড়ের মধ্যে মিনিট তিনেক হাতড়ানাের পরে বেরােল খাতাটা সেটা আমায় দিয়ে মার দিকে চেয়ে বললেন, এটার মানে আরেকটু বড় হলে বুঝবেখাতা খুলে পড়ে দেখি আট লাইনের কবিতা, যেটা |

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *