বিয়ে করেননি। যদি করতেন। তবে গিন্নীপনাতে মামাকে হার মানাতে পারে এমন মেয়ে পাওয়া যেত কিনা সন্দেহ। মামা সেলাই এবং রান্না দুটোতেই ছিলেন ওস্তাদ। পরের দিকে চামড়ার কাজ শিখে তার উপর একটা বই–ই লিখে ফেলেছিলেন। বাঙালীর মিষ্টি বলে একটা বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা বেরােল না কেন
সেরা সত্যজিৎ দোকানে গিয়ে গ্রুপ ছবি তােলানাের রেওয়াজ ছিল। বাঙালী দোকানও যে ছিল তা নয়, তবে তার বেশির ভাগই উত্তর কলকাতায়। সাহেব দোকানের মধ্যে। এককালে দুটি ছিল কলকাতার সবচেয়ে নাম করা—বাের্ন অ্যান্ড শেপার্ড আর জনস্টন অ্যান্ড হফম্যান। তখন এই দুটো দোকানের বয়স প্রায় সত্তর বছর, আর। অবস্থাও আগের মতাে নেই। তার জায়গায় নাম করেছে হালের কোম্পানি এড়না। লরেঞ্জ । এদের দোকান হল চৌরঙ্গী আর পার্ক স্ট্রীটের মােড়ে চৌরঙ্গী ম্যানসনে। আমরা দিদিমা মা মামা মাসিমা মামী মেসাে মামাতাে মাতুতাে ভাই–বােন। সবশুদ্ধ আঠারাে জন গিয়ে হাজির হলাম এডনা লরেঞ্জের দোকানে।।
আগে থেকে বলা ছিল, তাই সাহেব গ্রুপ ছবি তােলার সব আয়ােজন করেই রেখেছিল। প্রকাণ্ড হলঘরে পাশাপাশি চেয়ার রাখা হয়েছিল ছ’খানা। তারই মাঝামাঝি একটায় বসলেন দিদিমা। পুরুষরা সকলেই সার বেঁধে পিছনে দাঁড়াল, মা মাসি মামীরা বাকি চেয়ারগুলােয় বসলেন, বড়মামার অল্পবয়সী দুই মেয়ে বসল। সামনে টুলে, আর আমি দাঁড়ালাম মা আর দিদিমার মাঝখানে। ঘরের মধ্যে ছবি। ভােলা হচ্ছে, ফ্ল্যাশ বা আলাে ব্যবহার করবেন না সাহেবরা (হয়ত তখন। রেওয়াজও ছিল না), এক পাশে জানালার সারি দিয়ে যা আলাে আসছে তাতেই হবে। ঢাউস ক্যামেরা, লেসের সামনে ক্যাপ বসানাে, সেই ক্যাপ হয়ত দু’সেকেন্ডের জন্য খুলে আবার বন্ধ করে দেওয়া হবে, আর সেই দু’সেকেন্ডে ছবি উঠে যাবে। ওই সময়টুকুতে নড়াচড়া চলবে না।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
সাহেব রেডি বলতে সবাই আড়ষ্ট হল, দৃষ্টি ক্যামেরার দিকে। যিনি ছবি। তুলবেন, তাঁর পাশে আরেকজন সাহেব, তাঁর হাতে করতালওয়ালা সংপুতুল, তার পেট টিপলে হাত দুটো খটাং খটাং করে করতাল বাজায়। এই পুতুলের দরকার। আমার মেজোমামার ছােটছেলে বাচ্চুর জন্য। তার মাত্র কয়েক মাস বয়স, সে তার মায়ের কোলে বসেছে। তার দৃষ্টি যাতে ক্যামেরার দিকে থাকে, তাই সাহেব ক্যামেরার পিছনে দাঁড়িয়ে করতাল বাজাতে শুরু করলেন, আর সময় বুঝে অন্য সাহেব লেন্সের ক্যাপ খুলে আবার বন্ধ করে ছবি তুলে নিলেন। | এই ছবি তােলার বছর চার পাঁচের মধ্যে আমার দিদিমা, বড়মামা আর। বড়মাসির ছেলে মানুদা মারা যান। এই একই গ্রুপ ফোটো থেকে এই তিন জনের ছবিই আলাদা আলাদা করে এনলার্জ করে দেন আমার ধনদাদু।
যখন ছােট ছিলাম একদিন শুনলাম ছােটমাসির গান বেরােবে হিজ মাস্টারস ভয়েস রেকর্ডে, আর সেই গান রেকর্ড করার জন্য ছােটমাসিকে যেতে হবে গ্রামােফোন কোম্পানির আপিসে। ব্যবস্থাটা করেছেন বুলাকাকা। কলকাতার সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত গ্রামােফোনের দোকানের মালিক বলে বােধ হয় বুলাকাকার সঙ্গে গ্রামােফোন। কোম্পানির বেশ খাতির ছিল। | বুলাকাকার লাল রঙের টি–মডেল ফোর্ড গাড়িতে করে মাসির সঙ্গে আমিও গেলাম কোম্পানির আপিসে । আপিস তখন বেলেঘাটায় ; দমদমে যায় আরাে পরে। সাহেব কোম্পানিতে গিয়ে গান দিতে হবে বলে দু’দিন থেকে মাসির ঘুম খাওয়া বন্ধ ।
ক্রমাগত আশ্বাস দিয়ে চলেছেন বুলাকাকা—কিচ্ছু ভয় নেই, ব্যাপারটা খুব সােজা, সব ঠিক হয়ে যাবে। বুলাকাকা নিজে কোনােদিন গানটান শেখেনি, তবে বাঁশিতে রবীন্দ্রসংগীত বাজায়,আর দু’হাতে দারুণ অগ্যান বাজায়। | সাহেব কোম্পানির সাহেব ম্যানেজার, সাহেব রেকর্ডিস্ট। তখনকার দিনে মাইক্রোফোন ছিল না ; একটা চোঙার দিকে মুখ করে গান গাইতে হত, সেই গান পাশের ঘরে ছাপা হয়ে যেত ঘুরন্ত মােমের চাকতির উপর।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
ছােটমাসি সকাল থেকে যে ক’ গেলাস জল খেয়েছে তার হিসেব নেই। ওখানে গিয়ে চোঙার সামনে দাঁড়াতে হয়েছে, আমি পাশের ঘরে কাচের জানালার পিছন থেকে ব্যাপারটা দেখছি। ছােকরা রেকর্ডিস্ট এসে চোঙাটাকে নেড়েচেড়ে মাসিকে ঠিক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর মাসির সামনেই প্যাকেট থেকে সিগারেট বার করে সেটা শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে ঠোঁট দিয়ে লুফে নিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বুলাকাকা পরে বুঝেছিলেন কোনাে মহিলা গাইয়ে এলেই নাকি রেকর্ডিস্ট তাঁদের দেখিয়ে দেখিয়ে এই ধরনের সব চালিয়াতি করেন। আমার বিশ্বাস সাহেবের সিগারেট জাগলিং দেখে মাসির গলা আরাে শুকিয়ে গিয়েছিল।
যাই হােক, গান গাইলেন ছােটমাসি, শুনে বুঝতে পারছি আড়ষ্টভাব পুরাে। কাটেনি, তবে সেই গানই একদিন রেকর্ড হয়ে বাজারে বেরােল। তারপর অনেক দিন ধরে অনেক গান রেকর্ড করেছিলেন ছােটমাসি। প্রথমে ছিলেন কনক দাশ ; | বিয়ের পর হলেন কনক বিশ্বাস।
বকুলবাগানে আমাদের বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ শ্যামানন্দ রােডে থাকতেন আমার মেজকাকা সুবিনয় রায় । এই কাকাই তখন একদিন নতুন করে বার করলেন সন্দেশ পত্রিকা । ১৯২৩–এর সেপ্টেম্বরে বাবা মারা যাবার পর বছর দুয়েকের মধ্যেই সন্দেশ উঠে যায়। তখনও আমার সন্দেশ পড়ার বয়স হয়নি। টাটকা বেরােনাের সঙ্গে সঙ্গে হাতে নিয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা হল এই দ্বিতীয় পর্বে। মলাটে তিনরঙা ছবি, হাতি দাঁড়িয়ে আছে দু’পায়ে, খুঁড়ে ব্যালান্স করা সন্দেশের
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
বকুলবাগানে আমাদের সঙ্গে থাকতেন আমার ছােট মাসি। তাঁর গাইয়ে হিসেবে খুব নাম ছিল । অবিশ্যি ছােটমাসির গান আমরা যেমন শুনেছি, তেমন। কোনাে বাইরের লােকে কোনােদিন শশানেনি, কারণ ললাকের সামনে গাইতে গেলেই ছােটমাসির গলা শুকিয়ে যেত।
যখন ছােট ছিলাম কিনেছি, ভীষণ শখ তার প্রথম পাতায় রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে একটা কবিতা লিখিয়ে নেবাে।
এক সকালে মা’র সঙ্গে গোলাম উত্তরায়ণে । খাতাটা দিতে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘এটা থাক আমার কাছে ; কাল সকালে এসে নিয়ে যেও।
কথা মতাে গেলাম পরের দিন । টেবিলের উপর চিঠি–পত্র খাতা বইরের ডহি, তার পিছনে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ, আর আমায় দেখেই আমার ছােট্ট বেগুনী। খাতাটা খুঁজতে লেগেছেন সেই ভীড়ের মধ্যে । মিনিট তিনেক হাতড়ানাের পরে বেরােল খাতাটা । সেটা আমায় দিয়ে মার দিকে চেয়ে বললেন, ‘এটার মানে ও আরেকটু বড় হলে বুঝবে। খাতা খুলে পড়ে দেখি আট লাইনের কবিতা, যেটা |