আজ অনেকেরই জানা সেরা সত্যজিৎ হাঁডি। এই সন্দেশেই ধারাবাহিক ভাবে প্রথম সংখ্যা থেকে বেরােয় রবীন্দ্রনাথের ‘সে’, আর এই সন্দেশেই প্রথম গল্প লিখলেন লীলা মজুমদার। ওনার গল্পের সঙ্গে মজার ছবিগুলাে উনি তখন নিজেই আঁকতেন। অন্য আঁকিয়েদের মধ্যে ছিলেন। এখনকার নামকরা শৈল চক্রবর্তী, যাঁর হাতেখড়ি সম্ভবত হয় এই সন্দেশেই ।” আরেকটা ছােটদের বাংলা মাসিক পত্রিকা তখন বেরােত যেটা বেশ ভালাে। লাগত, সেটা হল রামধনু।
রামধনুর আপিস ছিল বকুলবাগান রােড় আর শ্যামানন্দ রােডের মােড়ে, আমাদের বাড়ি থেকে দুশ গজ দূরে । এই কাগজের সম্পাদক মনােরঞ্জন ভট্টাচার্যের সঙ্গে আলাপ করে ভীষণ খুশি হয়েছিলাম, কারণ। ওঁর লেখা জাপানী গােয়েন্দা হুকাকাশির গল্প ‘পদ্মরাগ’ আর ‘ঘােষ চৌধুরীর ঘড়ি’ আমার দারুণ ভালাে লেগেছিল। | বকুলবাগানে থাকতেই প্রথম সাঁতার শিখতে যাই পদ্মপুকুরে ভবানীপুর সুইমিং ক্লাবে ।
তখন প্রফুল্ল ঘােষ সবে গায়ে চর্বি মেখে ৭৬ ঘণ্টা একটানা সাঁতার কেটে ওয়লর্ড রেকর্ড করেছেন, আর প্রায় একই সময় ওয়র্লড চ্যাম্পিয়ন আমেরিকান সাঁতারু জনি ওয়াইসমুলার টাজানের ভূমিকায় অভিনয় করে আমাদের তাক লাগিয়ে দিয়েছে। সুইমিং ক্লাবের ঘরে গিয়ে দেয়ালে ওয়াইসমুলারের সই করা বাঁধানাে ছবি দেখে ক্লাব সম্পর্কে ভক্তি বেড়ে গিয়েছিল। রবিবার সকালটা বেশ কয়েক বছর বাঁশ ধরে জলে পা ছোঁড়া থেকে আরম্ভ করে শেষ পর্যন্ত সাঁতার দিয়ে। দিব্যি পুকুর এপার ওপার করে কেটেছে।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
ছেলেবয়সে স্বাস্থ্য ভালাে করার জন্য ব্যায়ামের রেওয়াজটা আজকাল কতটা আছে জানি না, কিন্তু আমাদের সময় ছিল। সকালে ডন বৈঠক অনেকেই দিত। যারা শরীর নিয়ে একটু বেশি সচেতন তারা ডামবেল, চেস্ট এক্সপ্যান্ডারও বাদ দিত না। আমার নিজের ব্যায়ামের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ ছিল না, কিন্তু ছােটদাদু প্রমদারঞ্জন রায়ের পাল্লায় পড়ে সেটা থেকে আর রেহাই পাইনি। ছােটদাদু নিজে দুর্গম পাহাড়ে জঙ্গলে জরীপের কাজ করেছেন, দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চারের জীবন। পুরুষের মধ্যে মেয়েলিপনা তিনি একদম বরদাস্ত করতে পারেন না ; এমনকি রবীন্দ্রনাথের ঘাড় অবধি ঢেউ খেলানাে চুলেও তাঁর আপত্তি । ছােটদাদুর অনেক ছেলে, সকলেই আমার চেয়ে বয়সে বড়, সকলেই ব্যায়াম। করে। আমি গিয়ে তাদের দল ভারী করলাম ।
ব্যায়ামের কথাই যখন উঠল তখন এই ফাঁকে আমার যুযুৎসু শেখার ঘটনাটাও বলে নিই, যদিও সেটা ঘটেছিল ১৯৩৪ সালে, যখন আমি বকুলবাগান ছেড়ে চলে। গেছি বেলতলা রােডে।
যুযুৎসু জিনিসটা প্রথম দেখি শান্তিনিকেতনে। তখন আমার বছর দশেক বয়স। গিয়েছিলাম শান্তিনিকেতনে পৌষ মেলায়। নতুন অটোগ্রাফের খাতা
কবি বহু দেশ এতে দেখতে গি৮ে পায়ন
মঠে সি সি। দে ৫ নাই চফ লেগ – এ ই হতে শুধু দুই পালে ১কা নেয় শি৫ে উপত্রে ৭৫ ৪ে ১৩১১ একটি শিশির বিন্দু। মপগুনিকেতন গীত্ব থঠা
সেইবারই দেখলাম যুযুৎসু বা জুদোর নমুনা। প্রাচীন যুগে চীনের বৌদ্ধ লামারা দস্যুদের বিরুদ্ধে প্রয়ােগ করার জন্য হাতিয়ার ছাড়া লড়াই ও আত্মরক্ষার এই কৌশলটা উদ্ভব করেছিল। চীন থেকে যায় জাপানে, তারপর জাপান থেকে । সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এই জুদো। রবীন্দ্রনাথ জাপান গিয়ে জুদো দেখে ঠিক করেন শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের এই জিনিসটা শেখানাের ব্যবস্থা করতে হবে। কিছুদিনের মধ্যেই জুদো এক্সপার্ট তাকাগাকি চলে আসেন শান্তিনিকেতনে, আর জুদের ক্লাস শুরু হয়ে যায়। কী কারণে জানি না, এই ক্লাস বছর চারেকের বেশি চলেনি। শেষে তাকাগাকি শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায়, আর বালিগঞ্জের সুইনহাে স্ট্রীটে আমারই এক মেলােমশাই ডাঃ অজিতমােহন
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
সেরা সত্যজিৎ বােসের বাড়ির একতলাটা ভাড়া নিয়ে সেখানে জুদো শেখানাের ব্যবস্থা করেন। | কথা নেই বার্তা নেই, ছােটকাকা সুবিমল রায় হঠাৎ একদিন আমাদের বাড়ি। এসে বললেন, ‘জুদো শিখলে কেমন হয় ?
ছােটকাকাকে যারা দেখেছে তারাই জানবে যে ওঁর সঙ্গে ব্যায়াম বা কুস্তি বা ওই জাতীয় কোনাে কিছুর কোনােরকম সম্বন্ধ কল্পনা করা কত কঠিন। রােগা পটকা আলাভােলা মানুষ, এম-এ পাশ করার পর থেকেই ইস্কুল মাস্টারি করছেন, এমন লােকের যুযুৎসু শেখার দরকারই বা হবে কেন বা এমন ইচ্ছে মাথায় আসবেই বা কেন ? কিন্তু সেই ইচ্ছেই একদিন দেখি ফলতে চলেছে, আর আমিও চলেছি ছােটকাকার সঙ্গে ট্রামে বালিগঞ্জে সুইনহাে স্ট্রীটে জাপানী জুদো-নবিশের সঙ্গে কথা বলতে। আজকের বালিগঞ্জ আর ১৯৩৪-এর বালিগঞ্জে যে কত তফাত সেটা যে না। দেখেছে তার পক্ষে কল্পনা করা কঠিন। রাসবিহারী এভিনিউ দিয়ে কিছুদূর গিয়ে মহানিবাণ মঠ ছাড়াবার পর পাকা বাড়ি প্রায় চোখেই পড়ে না, আর রাস্তার দু’পাশে আম জাম কাঁঠাল আর ঝােপঝাড় মিলিয়ে প্রায় পাড়াগাঁয়ের চেহারা !
গড়িয়াহাটের মােড়ে নেমে ডােবা বাঁশঝাড় তাল নারকেল ভরা মাঠ পেরিয়ে তবে সুইনহাে স্ট্রীট। বােধহয় টেলিফোনে আগে থেকে জানানাে ছিল, তাই মেশােমশাইদের বাড়ি খুঁজে বার করে একতলার বৈঠকখানায় বসে বেগুনী কিমােনাে পরা জুদো-এক্সপার্ট তাকাগাকির সঙ্গে কথাবার্তা পাকা করে নিতে কোনাে অসুবিধা হল না। ভদ্রলােকের বয়স আন্দাজ চল্লিশ, কুচকুচে কালাে কদমছাঁট চুলের সঙ্গে মানানসই ঘন কালাে ভুরু আর গোঁফ । আমার ধারণা ছিল। ছােটকাকা জুদো শিখতে চান জেনে তাকাগাকি হয়ত হেসেই ফেলবেন। কিন্তু সেরকম কিছু তাে করলেনই না, বরং ভাব দেখালেন যে জুদোর ছাত্র হিসেবে ছােটকাকা একেবারে আইডিয়াল।