যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়-(পর্ব-৯)

নিজে বাড়াবাড়ি রকম ধার্মিক না হলেও, সাধু সন্ন্যাসীদের সম্পর্কে ছােটকাকার একটা স্বাভাবিক কৌতূহল ছিলতাঁদের জীবনী পড়তেন, আর জীবিতদের মধ্যে যাঁদের উপর ছােটাকাকার শ্রদ্ধা ছিল, তাঁরা শহরে এলেই তাঁদের সঙ্গে গিয়ে দেখা করে আসতেনতিব্বতী বাবা, তৈলঙ্গ স্বামী, বিজয়কৃষ্ণ গােস্বামী, সন্তদাস বাবাজী, রামদাস কাঠিয়া বাবাএই সব সাধুদের সম্বন্ধে কত গল্পই না শুনেছি ছােটকাকার কাছে

যখন ছোট ছিলাম একা মানুষ, নিজের ধান্দায় থাকেন, অল্পেই সন্তুষ্ট, তাই ছােটকাকাকেও মাঝে মাঝে এক রকম সন্ন্যাসী বলেই মনে হততাছাড়া ওর কিছু বাকি ছিল যেটা সাধারণ মানুষের মধ্যে বড় একটা দেখা যায় নামুখে গ্রাস নিয়ে বত্রিশবার চিবােনােরকথাতাে আগেই বলেছি ; সকালে মুখ ধােবার সময় বেশ কিছুক্ষণ চলত নাক দিয়ে জল টেনে মুখ দিয়ে বারকরাএটার নাম ছিল নাকী মুদ্রা এটা ছাড়া কাকী মুদ্রা বলেও একটা ব্যাপার ছিল, সেটা যে কী তা আর মনে নেইবিকেলে শবাসন করে শুয়ে থাকতেন বেশ কিছুক্ষণ, আর তার পরেই ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন| খাওয়া, বিশ্রাম, কাজ, বেড়ানাে, গল্প করাসব কিছুরই ফাঁকে ফাঁকে চলত ছােটকাকার ডায়রি লেখাএটা জোর দিয়ে বলতে পারি যে এমন ডায়রি কেউ কোনাে দিন লেখেনি

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়

এতে থাকত সকালে কাগজে পড়া জরুরী খবরের শিরােনাম থেকে শুরু করে প্রায় প্রতি ঘণ্টায় কী করলেন, কী পড়লেন, কী খেলেন, কোথায় গেলেন, কী দেখলেন, কে এলসব কিছুর বিবরণট্রেনে করে বাইরে গেলে এনজিনের কী টাইপসেটাও লিখে রাখতেনএনজিনের যে যখন ছােট ছিলাম১০) জনসাধারণভােগ্য চা (বৈশিষ্ট্যহীন, চলনসই চা)১১) নারদভােগ্য চা (সঙ্গীতানুরাগবর্ধক, তত্ত্বজ্ঞানপ্রসাদক, ভক্তিরসােদ্দীপক চা)। ১২) হনুমানভােগ্য চা (বিশ্বাসযােগ্যতাবর্ধক, সমস্যাসমুদ্রলঙ্ঘনের শক্তিদায়ক, বিক্রমপ্রদ চা)। 

শ্রেণীবিভাগ হয় সেটাও ছােটকাকার কাছেই প্রথম জানি XP, HPs. sp HBএসব হল টাইপের নামতখনকার দিনের কয়লার এনজিনের গায়েটসেটা লেখা থাকতকোথাও যেতে হলে ছােটকাকা স্টেশনে হাজির হতেন হাতে খানিকটা সময় নিয়ে, কারণ কামরায় মাল তুলেই ঝট করে গিয়ে এনজিনের টাইল জেনে আসতে হবেযদি কোনাে কারণে দেরি হয়ে যেত, তাহলে প্রথম বড় জাংশন এলেই কামরা থেকে নেমে সে কাজটা সেরে আসতেন। 

এই ডায়রি লেখা হত চার রকম রঙের কালিতেলাল, নীল, সবুজ আর কালাে। একই বাক্যে চার রকম রঙই ব্যবহার হচ্ছে, এই নমুনা ছােটকাকারডায়রিতে অনেক দেখেছিএই রঙ বদলের একটা নিয়ম ছিল, তবে সেটা কোনােদিনই আমার কাছে খুব পরিষ্কার হয়নিএইটুকু জানতাম যে প্রাকৃতিকবর্ণনা সবুজ কালিতে লেখা হবে, আর বিশেষ্য হলে তাতে লাল কালি ব্যবহার হবেযেমন, আজ তুমুল বৃষ্টি | মানিকদের বাড়ি যাওয়া হল নাএই যদি হয় দুটো পর পর বাক্য, তাহলে প্রথমটা লেখা হবে সবুজ কালিতে, দ্বিতীয়টার প্রথম দুটো কথা হবে লাল, আর বাকিটা কালাে কিম্বা নীলখাটের উপর চৌকি, আর তার উপরে কালি কলমের দোকান সাজিয়ে যখন ভীষণ মনােযােগ দিয়ে ছােটকাকা ডায়রি লিখতেন, তখন সেটা হত একটা দেখবার মতাে জিনিস। 

এখানে ডায়রির আরেকটা জিনিসের কথা না বললেই নয়। 

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়

ছােটকাকা পেটুক না হলেও, খেতেন খুব তৃপ্তি করে রােজ এবাড়ি ওবাড়ি গিয়ে চা খাওয়ার ব্যাপারটা ছিল একটা বিশেষ ঘটনা ডায়রিতে এর উল্লেখ থাকত, তবে মামুলিভাবে নয়যে চাটা খেলেন তার একটা বিশেষণ, আর ব্র্যাকেটের মধ্যে সেই বিশেষণের একটা ব্যাখ্যা চাই। 

একমাসের ডায়রি থেকে বারােটা উদাহরণ দিচ্ছিব্যাপারটা পরিষ্কার হবে— 

) নৃসিংহভােগ্য চা (ভৈরবকান্তিজনক হুহুঙ্কার প্রসাদক, জোরালাে চা) ) বৈষ্ণবভােগ্য চা (নিরীহ, সুমিষ্ট, সুকোমল, অহিংসক চা) ) বিবেকানন্দভােগ্য চা (কর্মযােগস্পৃহাবর্ধক, বাগবিভূতিপ্রদ, তত্ত্বনিষ্ঠার 

 অনুকূল উপাদেয় চা) ) ভট্টাচার্যভােগ্য চা (বিজ্ঞতাবর্ধক, গাম্ভীর্যপ্রদ, অনুগ্র, হৃদ্য চা) ) ধন্বন্তরিতভাগ্য চা (আরােগ্যবর্ধক, আয়ুষ্য, রসায়নগুণসম্পন্ন চা) ) পাহারাদারভােগ্য চা (সতর্কতাবর্ধক, উত্তেজক, তন্দ্রানাশক চা) ) মজলিসী চা (মগুলমগুল ভাববাদ্রেককারী চা) ) কেরানিভােগ্য চা (হিসাবের খাতা দেখায় উৎসাহবর্ধক, বাদামী, স্বাদু চা) ) হাবিলদারভােগ্য চা (হিম্মপ্রদ, হামবড়াভাবের প্রবর্তক চা)। 

ছুটিতে বাইরে 

Nডপার থেকে ভবানীপুর আসার দুএক বছরের মধ্যেই মা বিধবাদের ইসল বিদ্যাসাগর বাণীভবনে চাকরি নেনতার জন্য মাকে বাসে করে রােজ সেই গড়পারেরই কাছাকাছি যেতে হতআমার পড়াশুনার ভারও তখন মায়েরই উপর ; আমি ইস্কুলে ভর্তি হই বছর বয়সেগ্রীষ্মে আর পুজোয় মাযখন ছটি হত, তখন আমরা দুজন মাঝে মাঝে বাইরে যেতাম চেঞ্জে। 

এর আগে গড়পারে থাকতে বাবা মারা যাবার পরও বারকয়েক বাইরে গেছি, তার মধ্যে দুবারের কথা অল্প অল্প মনে আছে। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *