ষষমাদের ছেলেবেলায় এমন অনেক কিছু ছিল যা এখন আর নেই। বাড়ির বারান্দার রেলিং থেকে To Let লেখা বাের্ড ঝুলতে এখন আর কেউ, দেখে কি ? তখন পাড়ায় পাড়ায় দেখা যেত।
ছেলেবেলায় দেখেছি ওয়ালফোর্ড কোম্পানির লাল ডবল ডেকার বাসের ওপরে ছাত নেই। সে বাসের দোতলায় চড়ে হাওয়া খেতে খেতে যাওয়ার একটা আলাদা মজা ছিল । রাস্তাঘাট তখন অনেক নিরিবিলি ছিল, ট্রাফিক জ্যামের বিভীষিকা ছিল না বললেই চলে, কিন্তু সবচেয়ে বড় তফাত ছিল মােটর গাড়ির চেহারায় । কত দেশের কত রকম মােটরগাড়ি যে চলত কলকাতা শহরে তার ইয়ত্তা নেই।
সে সব গাড়ির প্রত্যেকটার চেহারা এবং হর্নের আওয়াজ আলাদা। ঘরে বসে হর্ন শুনে গাড়ি। চেনা যেত । ফোর্ড শেভ হাম্বার ভক্সহল উলসলি ডজ ব্যুইক অস্টিন স্টুডিবেকার। মরিস ওসমােবিল ওপ্যাল সিত্রোয়—এসব গাড়ি এখন শহর থেকে লােপ পেয়ে গেছে। হুড খােলা গাড়ি ক’টা দেখা যায় । খুদে গাড়ি বেবি অস্টিন কালেভদ্রে এক–আধটা চোখে পড়ে। আর সাপের মুখওয়ালা ‘বােয়া হন লাগানাে বিশাল ল্যানসিয়া, লাসাল—এসব আমীরী, গাড়ি তাে মনে হয় স্বপ্নে দেখা। কচ্ছপের খােলের মতাে দেখতে প্রথম স্ত্রীমলাইনড গাড়ি যখন কলকাতায় এলাে, সেও তাে প্রায় এক যুগ আগে। আর ঘােড়ার গাড়ি জিনিসটাও প্রায় দেখাই যায়।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
আমাদের গড়পারের বাড়িতে মােটরগাড়ি ছিল না, তাই ঘােড়ার গাড়িতে। আমরা অনেক চড়েছি । বাক্সগাড়িতে আরাম কোনাে দিনই ছিল না, তবে ফীটনে | চড়ে বেশ মজা লাগত এটা মনে আছে। | আজকাল আকাশ কাঁপিয়ে জেট প্লেন যাতায়াত করে শহরের উপর দিয়ে। তখন এ শব্দটা ছিল মানুষের অচেনা। দুটো একটা টু সীটার প্লেন আকাশে দেখা যেত মাঝে মধ্যে। তখন দমদম আর বেহালায় ফ্লাইং ক্লাব চালু হয়েছে, বাঙালীরা প্লেন চালাতে শিখছে। এই সব প্লেন থেকে মাঝে মাঝে বিজ্ঞাপনের কাগজ ফেলা হত।
হাজার হাজার কাগজ এক সঙ্গে ছেড়ে দিলে সেগুলাে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে শহরের নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়ত। একবার খানকতক পড়ল আমাদের বকুলবাগানের বাড়ির ছাতে ; তুলে দেখি বাটার বিজ্ঞাপন। | দৈনিক ব্যবহারের জিনিস, ওষুধপত্র ইত্যাদি যে কত বদলেছে তা ভাবলে অবাক হতে হয়। নাইলনের আগের যুগের সাদা রঙের কলিনােজ টুথব্রাশ আজকাল আর কেউ ব্যবহার করে না। আমরা তাই করতাম, আর সেই সঙ্গে কলিনােজ টুথপেস্ট । কালাে রঙের Swan আর Waterman ফাউন্টেন পেন
সেরা সত্যজিৎ যা দিয়ে তৈরি হত তাকে বলত Gutta Percha | পুড়লে বিশ্রী গন্ধ বেরােত। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে যে সেসব কলম আজকের দিনের কলমের চেয়ে ঢের বেশি টেকসই ছিল। | কোয়ালিটি–ফ্যারিনির যুগে বাড়িতে Freezer দিয়ে আইসক্রীম আর কে তৈরি করে ? আমাদের ছেলেবেলায় কাঠের বালতির গায়ে লাগানাে লােহার হাতলের ঘড় ঘড় শব্দ শুনলে মনটা নেচে উঠত। কারণ বাড়ির তৈরি ভ্যানিলা আইসক্রীমের স্বাদের সঙ্গে কোনাে ঠেলাগাড়ির আইসক্রীমের স্বাদের তুলনা চলে না।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
মনে আছে ছেলেবেলায় অসুখ করলে ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখে দিতেন। আর সেই প্রেসক্রিপশনে দেখে মিক্সচারের শিশি দিয়ে দিত ডাক্তারখানা থেকে । সবচেয়ে মজা লাগত শিশির গায়ে আঠা দিয়ে লাগানাে দাগ কাটা কাগজের ফিতে । এ জিনিস আজকাল প্রায় দেখা যায় না বললেই চলে। সেকালে সর্দি। হলে ফুট বাথ নিতে হত। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে গামলায় গরম জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে হত। তাতে সর্দি সারত কিনা সেটা অবিশ্যি মনে নেই ।
জোলাপের জন্য তখন খেতে হত Castor oil—যার স্বাদে গন্ধে নাড়ীভুডি উলটে আসত। ম্যালেরিয়ার জন্য কুইনীনের বড়ি ছাড়া গতি ছিল না। আমি আবার বড়ি গিলতে পারতাম না। একবার ঢাকা যাবাে, সেখানে ম্যালেরিয়া, কুইনীন খেতে হবে । চিবিয়ে খেয়েছিলাম সেই বড়ি। তার বিষ তেতাে স্বাদ এখনাে যেন যায়নি মুখ থেকে। ক্যাপসুল আসার পর থেকে ওষুধ জিনিসটা যে। বিস্বাদ হতে পারে সেটা ভুলে গেছি আমরা।
একেবারে শিশু বয়সের কথা মানুষের খুব বেশি দিন মনে থাকে না। আমার বাবা যখন মারা যান তখন আমার বয়স আড়াই বছর। সে ঘটনা আমার মনে। নেই । কিন্তু বাবা যখন অসুস্থ, আর আমার বয়স দুই কিম্বা তারও কম, তখনকার দুটো ঘটনা আমার পরিষ্কার মনে আছে ।। ” বাবা অসুখে পড়েন আমি জন্মাবার কিছুদিনের মধ্যেই। এ অসুখ আর সারেনি, তবে মাঝে মাঝে একটু সুস্থ বােধ করলে বাবাকে বাইরে চেঞ্জে নিয়ে যাওয়া হত। বাবার সঙ্গেই আমি গিয়েছিলাম একবার সােদপুর আর একবার গিরিডি ।
গঙ্গার উপর সােদপুরের বাড়ির উঠোনটা মনে আছে। একদিন বাবা ছবি আঁকছেন ঘরে। জানালার ধারে বসে, এমন সময় হঠাৎ বললেন, ‘জাহাজ যাচ্ছে। আমি দৌড়ে উঠোনে বেরিয়ে এসে দেখলাম ভোঁ বাজিয়ে একটা স্টীমার চলে গেল । | গিরিডির ঘটনায় বাবা নেই ; আছে আমাদের বুড়াে চাকর প্রয়াগ । আমি আর প্রয়াগ সন্ধ্যাবেলা উশ্রীর ধারে বালিতে বসে আছি। প্রয়াগ বলল, বালি খুঁডলে জল বেরােয় ।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
আমি ভীষণ উৎসাহে বালি খুঁড়তে শুরু করলাম । খোঁড়ার জন্য খেলনার দোকানে কেনা কাঠের খােন্তা ছিল, সেটাও মনে আছে । খোঁড়ার ফলে জল বেরিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেই সময় কোথেকে একটা দেহাতি মেয়ে এসে সেই জলে হাত ধুয়ে গেল যে জল আমরা খুঁড়ে বার করেছি তাতে অন্য লােক এসে হাত খুয়ে যাবে এটা ভেবে একটু রাগ হয়েছিল, তাও মনে আছে। | যে বাড়িতে আমার জন্ম, সেই একশাে নম্বর গড়পার রােডে আমি ছিলাম আমার পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত। তারপর অনেক বাড়িতে থেকেছি, আর সবই দক্ষিণ কলকাতায় ; কিন্তু গড়পার রােডের মতাে এমন একটা অদ্ভুত বাড়িতে আর কখনাে থাকিনি। |
শুধু তােবাড়ি নয়, বাড়ির সঙ্গে আবার ছাপাখানা । ঠাকুরদাদা উপেন্দ্রকিশাের নিজে নকশা করে বাড়িটা তৈরি করে তাতে থাকতে পেরেছিলেন মাত্র বছর চারেক। তিনি মারা যান আমার জন্মের সাড়ে পাঁচ বছর আগে। বাড়ির সামনে দেয়ালে উপর দিকে উচু উচু ইংরিজি হরফে লেখা ছিল ‘ইউ রায় অ্যান্ড সনস, প্রিন্টারস অ্যান্ড ব্লক মেকারস। গেট দিয়ে ঢুকে দারােয়ান হনুমান মিসিরের ঘর পেরিয়ে কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠে ছিল ছাপাখানার আপিসে ঢােকার বিরাট দরজা। এক তলায় সামনের দিকটায় ছাপাখানা, আর তার ঠিক উপরে দোতলায় ছিল ব্লক তৈরি আর হরফ বসানাের ঘর । আমরা থাকতাম বাড়ির পিছন দিকটায়। বাঁয়ে গলি দিয়ে গিয়ে ডাইনে পড়ত বসতবাড়িতে ঢােকার দরজা।