বাবার রিঅ্যাকশান যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং। ছেলে চলে যাবার পর বাবা আমাকে ডেকে বললেন– ঐ ছেলে যে পাঞ্জাবিটা এনেছে, সেটা বাথরুমে রেখে আয় । আমি বললাম, কেন? বাবা বললেন, আমি ঐ পাঞ্জাবির উপর পিশাব করব, এই জন্যে।
হ্যালাে শােন, তিন মিনিট পার হয়েছে। এখন তুমি টেলিফোন নামিয়ে রাখতে পার। যে তােমাকে দশ হাজার টাকা পাঠিয়েছে, তার প্রতি আমি খুবই কৃতজ্ঞ । সে টাকাটা পাঠিয়েছে বলেই তুমি আমাকে টেলিফোন করেছ।
টাকাটা কে দিতে পারে বলাে তাে ? ইমনের মা না তাে ? উনি পরিত্যক্ত স্বামীকে টাকা পাঠাবেন কী জন্যে।
সে জানে আমি হতদরিদ্র। ছেলে আসছে আমার সঙ্গে থাকতে। ছেলের যেন কষ্ট না হয়। সরাসরি আমাকে দিতে লজ্জা পাচ্ছিল বলে কাউকে দিয়ে খামে ভরে টাকাটা পাঠিয়েছে।
হতে পারে। সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। আমি কি টাকার ব্যাপারটা তাকে জিজ্ঞেস করব? জিজ্ঞেস না করাই ভালাে। তিনি যদি টাকাটা দিয়ে থাকেন, তাহলে কোনাে কোনােভাবে সেটা তিনি তােমাকে জানাবেন।
কেন জানাবে ?
জানাবেন কারণ কোনাে মানুষ যখন কারাের উপকার করে, তখন তার একটা চেষ্টাই থাকে উপকারের বিষয়টা মনে করিয়ে দেবার। কোনাে মানুষই মহাপুরুষ না। এই পৃথিবীতে শুধুমাত্র একটা জায়গাতে মহাপুরুষরা বাস করেন। আর কোথাও বাস করেন না।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১১)-হুমায়ূন আহমেদ
মহাপুরুষরা কোথায় বাস করেন ? ডিকশনারিতে।।
আনিকা টেলিফোন রেখে দিয়ে উঠে বসল। নিজেই কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখল। জ্বর আগের মতােই আছে না–কি কিছুটা কমেছে বােঝা যাচ্ছে না। বালিশের নিচে থার্মোমিটার আছে। ইচ্ছা করলেই জ্বর দেখা যায়। দেখতে ইচ্ছা করছে না। বরং জ্বর নেই— এমন ভাব করে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। সাজতে ইচ্ছা করছে। মিতুর দেয়া শাড়িটা পরে কোনাে একটা পার্লারে গিয়ে চুল বেঁধে এলে কেমন হয় ? আজকাল সব মেয়েরা ফ্যাসিয়েল করে। এতে
–কি মুখের চামড়া কমনীয় হয়। আনিকা কখনাে এই জিনিস করে নি। একবার করে দেখলে হয়। আনিকা গুনগুন করে গাইলাে— “ওগাে সুন্দরী, আজ অপরূপ সাজে সাজো সাজো সাজো।‘ একটি লাইন বলেই চুপ করে গেল। তার খুব
সুন্দর গানের গলা ছিল। তাদের স্কুলের গানের টিচার শিবু স্যার বলতেন, তাের গানের গলা প্রতিমার চেয়েও মিষ্টি। তুই গান করলে খুব নাম করবি। গান শিখবি ? আমি তােকে গান শেখাব। আমাকে কোনাে টাকা–পয়সা দিতে হবে
না। তুই শুধু ভালাে দেখে একটা হারমােনিয়াম কিনবি ।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১১)-হুমায়ূন আহমেদ
আনিকা বাবাকে হারমােনিয়ামের কথা বলেছিল। মতিয়ুর রহমান অনেকক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, শুধু হারমােনিয়াম ? ঘুংঘুর কিনে দেই ? বাইজি হয়ে যা । তারপর তােকে পাড়াতে রেখে আসি । গান করবি, নাচ করবি। দুই হাতে টাকা কামাবি।
রেকর্ড শুনে শুনে শেখা একটা গান শিবু স্যার প্রায় জোর করেই তাকে দিয়ে স্কুলের রজতজয়ন্তীতে গাইয়েছিলেন। নজরুলের গান– “ওগাে মদিনাবাসী প্রেমে ধর হাত মম‘। সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রী। তিনি অনুষ্ঠান শেষে তাকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, নাম কী মা তােমার ? আনিকা ভয়ে ভয়ে নিজের নাম বলল। শিক্ষামন্ত্রী বললেন, তােমার গান শুনতে শুনতে হঠাৎ চোখে পানি এসে গেল। আমরা রাজনীতি করা ঘাঘু লােক। আমাদের চোখে পানি আনা কঠিন ব্যাপার। খুবই তৃপ্তি পেয়েছি গাে মা।
আরাে অনেক বড় বিস্ময় আনিকার জন্য অপেক্ষা করছিল। কিছুদিন পর শিল্পকলা একাডেমির ডিজি এক চিঠিতে জানালেন শিশুশিল্পীদের একটা দল তুরস্ক যাবে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যােগ দেবার জন্য। নজরুলসঙ্গীতের তালিকায় আনিকার নাম আছে। সে যেন আগামী শুক্রবার থেকে রিহার্সেলে আসে।
তুরস্ক যাওয়া তাে অনেক পরের ব্যাপার, ভয়ে এই চিঠির কথা সে তার বাবাকে বলতেই পারে নি। স্কুল থেকে অ্যাসিসটেন্ট হেডমিসট্রেস রাবেয়া আপা এসেছিলেন। মতিয়ুর রহমান তার কাছ থেকে তুরস্ক বিষয়ক সব কথা শুনে গম্ভীর গলায় বললেন, আপনার কি মস্তিষ্কবিকৃতি হয়েছে ? আমি আমার মেয়েকে একা একা পাঠাব তুরস্ক?
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১১)-হুমায়ূন আহমেদ
অ্যাসিসটেন্ট হেডমিসট্রেস বললেন, একা তাে যাচ্ছে না, আরাে অনেক ছেলেমেয়ে যাচ্ছে।
মতিয়ুর রহমান বললেন, আপনাদের মস্তিষ্ক বিকৃতিরােগ হয়েছে বলে তাে আমার হয় নাই। আমার মেয়ে কোথাও যাবে না। মেয়ের যথেষ্ট সাহস হয়ে গেছে। আমাদের কিছু না জানিয়ে স্কুল ফাংশনে গান গায়। গােপনে গােপনে আঙ্গুরবালা । আমি তার বালাগিরি বের করছি।
তার ইচ্ছা ছিল মেয়েকে কঠিন শাস্তি দেন। মনােয়ারার জন্য পারলেন না। কঠিন গালাগালি দিয়েই তাকে খুশি থাকতে হলাে। শেষ পর্যায়ে শুধু বললেন
তােমাকে আর স্কুলে যেতে হবে না। বাসায় থাকবে। মা’কে রান্নাবান্নায় সাহায্য করবে । অতি শিগগিরই তােমার বিবাহের ব্যবস্থা করছি। কোনাে বড় কেলেঙ্কারি হয়ে যাবার আগেই ঘর থেকে আপদ বিদায় করতে হবে। তােমার যা অবস্থা। হঠাৎ কোনাে একদিন দেখব পেট বাধিয়ে ঘরে ফিরেছ।
মতিয়ুর খুব আগ্রহ নিয়ে টিভিতে রান্নার একটা প্রােগ্রাম দেখছেন। মুরগি মুসাল্লাম যে এত সহজে রান্না করা যায় তার ধারণায় ছিল না। হাতের কাছে কাগজ–কলম থাকলে সুবিধা হতাে— লিখে রাখতে পারতেন।
আনিকাকে সাজগােজ করে বের হতে দেখে তিনি টিভি থেকে মুখ ফেরালেন। বিস্মিত হয়ে মেয়েকে ডাকলেন। জ্বর এসেছে বলে যে মেয়ে অফিসে যায় নি, সে এখন যাচ্ছে কোথায় ? মিতুর বদ জামাইটা যে শাড়ি নিয়ে এসেছে, সেই শাড়িটাই সে পরেছে। দুয়ে–দুয়ে চার মিলানাে যাচ্ছে। আনিকার গন্তব্য মিতুর শ্বশুরবাড়ি । অথচ তিনি কঠিন গলায় বলে দিয়েছিলেন— ঐ বাড়িতে যদি কেউ যায়, তাহলে তার ঠ্যাং ভেঙে ফেলা হবে।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১১)-হুমায়ূন আহমেদ
তুই যাচ্ছিস কোথায় ? কাজে যাচ্ছি।
কিছুক্ষণ আগেই দেখলাম জ্বরে কে কে করছিস। এখন আবার কাজে যাচ্ছিস। কী এমন কাজ যে পটের রাণী সেজে যেতে হয় ?
আনিকা বলল, পটের রাণী সাজি নি বাবা । শুধু নতুন একটা শাড়ি পরেছি।
তুই কি মিতুর শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছিস ? ঐ বাড়িতে গেলে আমি কিন্তু তাের ঠ্যাং ভেঙে দেব।
আনিকা শান্ত গলায় বলল, ঠ্যাং ভাঙাভাঙি তাে অনেক করেছ। এখন এইসব বাদ দাও। টিভি দেখছিলে, টিভি দেখ।
মতিয়ুর রহমান কঠিন গলায় বললেন, তার মানে ? আনিকা বলল, যা বলেছি তার মানে তােমার না বােঝার কথা না। তুই মিতুর শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিস কি যাচ্ছিস না সেটা বল!
আনিকা বলল, হ্যা যাচ্ছি । এখন তুমি কী করবে করাে। হাতুড়ি নিয়ে আস। ঠ্যাং ভাঙো।