ইমন বলল, মা ছােটখালার বাসায় বেড়াতে গেছেন। আমাকে বলে গেছেন তুমি এলে তােমার সঙ্গে চলে যেতে।
তােমার সঙ্গে কী যাচ্ছে ? অনেক পুটলা-পুটলি দেখছি। দাও কিছু আমার কাছে দাও। তােমার হাতেরটা দাও।
হাতেরটা দেয়া যাবে না। হাতে কী ? চাইনিজ লণ্ঠন ।
চাইনিজ লণ্ঠনটা তাহলে তােমার হাতেই থাকুক। ব্যাক প্যাকটা আমার কাছে দাও।
বাবার আরেকটা জিনিস ইমনের খুবই ভালাে লাগল। তার মধ্যে ন্যাগিং ভাব নেই। সে যখন বলল, হাতের জিনিসটা দেয়া যাবে না, তখন বাবা এই নিয়ে কোনাে প্রশ্ন করেন নি। অন্য যে কেউ হলে বলত, কেন দেয়া যাবে না? মা শুধু এই প্রশ্ন করেই চুপ করে থাকত না। মা বলত, দেখি প্যাকেটটা খােল। আমি দেখতে চাই এটা এমন কী মহার্ঘ বস্তু যা আমার হাতে দেয়া যাবে না। ‘মহার্ঘ বস্তু বাক্যটা মা ঘনঘন ব্যবহার করে। মহার্ঘ বস্তুর ইংরেজি হচ্ছে— Valuable goods.
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১৩)-হুমায়ূন আহমেদ
রিকশা বড় রকমের একটা ঝাকুনি খেল । ইমন সিট থেকে পড়ে যেতে ধরেছিল। শওকত খপ করে তাকে ধরে ফেলল। ইমন মােটেই অবাক হলাে না। সে জানত বাবা তাকে কিছুতেই রিকশা থেকে পড়তে দেবেন না।
শওকত বলল, ইমন, তুমি তাে বাংলা বেশ ভালাে বলতে পার। অল্পবয়েসী বাচ্চারা বিলেত-আমেরিকায় গেলে ইংরেজিটা অতি দ্রুত শেখে। যত দ্রুত শেখে তার চেয়েও দ্রুত গতিতে বাংলা ভুলে যায়। তােমাদের নিউ জার্সির বাড়িতে তুমি কি বাংলায় কথা বলাে ?
মা’র সঙ্গে বাংলায় কথা বলি। বাংলা পড়তে পার ? পারি। গল্পের বই পড়ি। সবশেষ বাংলা বই কোনটা পড়েছ ? বিষের কাটা। লেখকের নাম কি মনে আছে ? শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। বলাে কী! এই বই তাে বাচ্চাদের জন্যে কঠিন। কঠিন না— এটা একটা ক্রাইম সলভিং ডিটেকটিভ স্টোরি ।
বাংলা বই কি তুমি নিজের আগ্রহেই পড়? না-কি তােমার মা জোর করে তােমাকে পড়ান ?
প্রথম প্রথম বকা দিয়ে পড়াতেন। এখন নিজেই পড়ি।
আচ্ছা দেখি এখন তােমার বাংলা জ্ঞানের একটা পরীক্ষা হবে। বলাে দেখি পানি শব্দটার ইংরেজি কী ?
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১৩)-হুমায়ূন আহমেদ
Water. হয়েছে, দশে দশ পেয়েছ। বলাে জল শব্দের ইংরেজি কী ? Water. আবারাে হয়েছে, দশে দশ। এখন বলাে অষু শব্দটার ইংরেজি কী ? Water.
হয়েছে। এখন পেয়েছ দশে এগারাে। এক নাম্বার বেশি দিয়ে দিলাম। দশে এগারাে দেবার নিয়ম নেই, তবে আমি পরীক্ষক হিসেবে ভালাে। আমি কাউকেই ফেল করাতে চাই না। আমি চাই সবাই পাস করুক । ভালাে স্টুডেন্টরা দশে এগারাে, বারাে পাক।।
ইমন মাথা নিচু করে হাসল। শওকত বলল, ইমন শােনাে, আমার মনে ক্ষীণ সন্দেহ হচ্ছে অষু শব্দটার মানে তুমি জানাে না। তুমি অনুমানে বলেছ। যেহেতু পর পর দুটি শব্দের ইংরেজি হলাে Water, তুমি ধরেই নিয়েছ পরেরটাও তাই হবে। আমার অনুমান কি ঠিক?
হু ঠিক।
তাহলে তাে তােমাকে দশে এগারাে দেয়া যায় না। নাম্বার অনেক কমে যাবে। তােমাকে এখন দিলাম দশে পাঁচ। ঠিক আছে ?
ইমন বলল, না ঠিক নেই। ঠিক নেই কেন ?
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১৩)-হুমায়ূন আহমেদ
ইমন শান্ত গলায় বলল, আমার উত্তর শুদ্ধ হয়েছে। তুমি সেইভাবে আমাকে নাম্বার দেবে। উত্তর কীভাবে দিয়েছি সেটা চিন্তা করে নাম্বার দেবে না।
তােমার যুক্তি গ্রাহ্য। গ্রাহ্য মানে জানাে ? গ্রাহ্য মানে হলাে গ্রহণযােগ্য। Accepted. এখন তুমিই বলাে দশে তােমাকে কত দিতে হবে ?
আগে যা দিয়েছ তাই। দশে এগারাে ।। ঠিক আছে তাই দিলাম। দশে এগারাে।
থ্যাংক য়ু।
শওকতের পায়ের কাছে বড় লাল রঙের একটা স্যুটকেস। হাতে ইমনের সবুজ রঙের ব্যাক প্যাক। শওকত ব্যাক প্যাক পায়ের কাছে রেখে বাঁ হাত দিয়ে ইমনের কোমর চেপে ধরেছে। কিছুটা জায়গা রাস্তা খুব খারাপ। খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। অথচ মাত্র এক সপ্তাহ আগেই নতুন পিচ ঢেলে রাস্তা ঠিক করা হয়েছিল।
শওকত বলল, এ জার্নি বাই রিকশা কেমন লাগছে ? ভালাে লাগছে। এই ঝাকুনি তাে ভালাে লাগার মতাে কিছু না। ভালাে লাগছে কেন ? ইমন বলল, আমি জানি না কেন ভালাে লাগছে।
শওকত বলল, সবচে’ ভালাে রিকশা ভ্রমণের একটা ব্যবস্থা আমি করব । যাতে তুমি যতদিন বেঁচে থাক, ততদিন যেন এই ভ্রমণের কথা তােমার মনে থাকে।
সেটা কেমন ?
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১৩)-হুমায়ূন আহমেদ
আমি কী করব শােন, প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে খােলা রিকশায় তােমাকে নিয়ে বের হব। রাস্তায় পানি জমে যাবে। পানির ভেতর দিয়ে রিকশা চলবে। তােমার কাছে মনে হবে, তুমি চাক্কা লাগানাে নৌকায় চড়েছ। মাথার উপর ঝুমঝুম করে বৃষ্টি পড়বে। ঠাণ্ডা বাতাসে তােমার শরীর শিরশির করবে।
ইমন মুগ্ধ গলায় বলল, I think I will like that. তােমার কি ঠাণ্ডার ধাত আছে ? ঠাণ্ডার ধাত মানে কী?
ঠাণ্ডার ধাত হলাে অল্পতেই যাদের ঠাণ্ডা লাগে। একটা আইসক্রিম খেলে গলা ফুলে গেল। মাথায় তিন ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল অমনি জ্বর, কাশি। আছে ঠাণ্ডার ধাত ?
আছে। থাকলে থাকুক, আমরা বৃষ্টিতে ভিজবই ।
Ok.
ইমন লক্ষ করল, তার কেন জানি কাঁদতে ইচ্ছা করছে। গলা ভার ভার লাগছে। গলার কাছে কী যেন আটকে আছে। অথচ কাদার মতাে কোনাে ঘটনা ঘটে নি। বাবার সঙ্গে রিকশা করে যেতে তার খুবই ভালাে লাগছে। আবার একই সঙ্গে কান্নাও পাচ্ছে। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখ ভিজে যাবে ।