আনিকা চিন্তাই করতে পারে নি, আজও তার অফিসে পৌছাতে দেরি হবে। অন্যদিনের চেয়ে দশ মিনিট আগে সে ঘর থেকে বের হয়েছে। সেই হিসাব ধরলে পনেরাে মিনিট আগে অফিসে পৌছানাের কথা, অথচ এলিফ্যান্ট রােডের জ্যামে সে চল্লিশ মিনিট ধরে আটকা পড়ে আছে।
জ্যামের কারণ রাস্তার মাঝখানে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে একটি ট্রাক। ট্রাকের পাশের খালি জায়গাটা দিয়ে এক সঙ্গে দু’টা গাড়ি ঢুকতে গিয়ে গিটু লেগে গেছে। কেউ নড়তে পারছে না। কারাে তেমন মাথাব্যথাও নেই। সবাই গা ছেড়ে অপেক্ষা করছে। কিছু একটা হবে। কখন হবে কীভাবে হবে সেটা নিয়ে কারাে কোনাে টেনশন দেখা যাচ্ছে।
ফ্লাস্কে করে এক ছেলে রঙ চা বিক্রি করছে। অনেকেই আগ্রহ করে সেই চা খাচ্ছে।
ছেলেটা আনিকার কাছে এসে বলল, আফা, চা খাইবেন ? আনিকা বলল, যা ভাগ। থাপ্পড় খাবি।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১৫)-হুমায়ূন আহমেদ
আনিকা ভেবেই পাচ্ছে না ফট করে থাপ্পড় দেবার কথাটা সে কেন বলল। তার মেজাজ কি এতটাই খারাপ হয়েছে ? প্রতি সপ্তাহে তার দুই–তিনদিন লেট হচ্ছে। অন্যদেরও লেট হচ্ছে। অন্যদেরটা কারাের চোখে পড়ছে না। তারটা চোখে পড়ছে। সেকশান অফিসার সিদ্দিক সাহেব গতকাল খুব ভালাে মানুষের মতাে তার ঘরে এসে বললেন, মিস আনিকা, আপনি কি দুই আড়াইশ’ টাকা খরচ করতে পারবেন ?
আনিকা তটস্থ হয়ে বলল, কোন ব্যাপারে স্যার ?
একটা দেয়ালঘড়ি কিনে আপনার শােবার ঘরে টানিয়ে রাখবেন। আজকাল দেয়ালঘড়ি সস্তা হয়ে গেছে। দুই আড়াইশ’ টাকায় ভালাে ঘড়ি পাওয়া যায়। আমার ধারণা আপনার বাসায় কোনাে দেয়ালঘড়ি নেই।
অপমানে আনিকার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। সে অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকে রেখে বলল, এইবার বেতন পেয়েই একটা ভালাে ঘড়ি কিনব স্যার।
জ্যাম বােধহয় ছুটেছে। সব গাড়ি একসঙ্গে চলা শুরু করেছে। এতক্ষণ কারাে কোনাে ব্যস্ততা ছিল না। এখন ব্যস্ততার সীমা নেই— কে কার আগে যাবে! যেন অলিম্পিকের দৌড় প্রতিযােগিতা হচ্ছে। ফার্স্ট হয়ে সােনা জিততে এক ঘণ্টা বাইশ মিনিট লেট করে আনিকা অফিসে পৌছল।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১৫)-হুমায়ূন আহমেদ
সিদ্দিক সাহেব আজ কী বলবেন কে জানে! আজ হয়তাে বলবেন— মিস আনিকা, আপনাকে অফিসের খরচে একটা ঘড়ি কিনে দেই ?
শান্ত গলায় কঠিন অপমানের কথা একটা মানুষ কী করে বলে কে জানে! আনিকার ইচ্ছা করছে অফিসে না ঢুকে বাসায় চলে যেতে। পর পর তিনদিন বাসায় কাটিয়ে অফিসে হাজির হবে। যার যা ইচ্ছা বলুক।
যা ইচ্ছা করে তা করা যায় না। মানুষ চলে অনিচ্ছার পথে। তাকে বাধ্য হয়ে চলতে হয়। আনিকা তার ঘরে ঢুকল। তার ঘরে সে একা না, আরেকজন সিনিয়র কলিগ আছেন। জাহানারা। অফিসে তার নাম ‘পান আপা‘। তিনি সারাক্ষণ পান খান। শুধু যে নিজে খান তা না, অন্যদেরও খাওয়াবার চেষ্টা। করেন। ময়মনসিংহের মিকচার জরদা, মহেশখালির পান।
জাহানারা আনিকাকে দেখে কেমন যেন অন্যরকম চোখে তাকাল। আনিকার বুক উঁাৎ করে উঠল। আজ মনে হয় বড় কোনাে ঘটনা ঘটেছে।
আনিকা বলল, আপা কেমন আছেন ? আজ দেরি হয়ে গেল। কেউ কি আমার খাের্জ করেছিল ?
জাহানারা শুকনা গলায় বললেন, বড় সাহেব দু’বার এসে খোঁজ করেছেন। তােমাকে দেখা করতে বলেছেন।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১৫)-হুমায়ূন আহমেদ
আনিকা টোক গিলল। আজ ভালাে যন্ত্রণা হবে । এখনাে সময় আছে চেয়ারে বসে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেই হয়। তিনদিন বাসায় শুয়ে বসে থাকবে । বেইলী রােডে নাটক পাড়ায় নাটক দেখবে, ফুচকা খাবে । একদিন যাবে শওকতের বাসায়। শওকত তার ছেলেকে নিয়ে কী আহ্লাদী করছে দেখবে। ছেলের জন্মদিনে শওকত কি তাকে ডাকবে ? মনে হয় ডাকবে না। ডাকুক বা
ডাকুক, জন্মদিনের একটা উপহার তাে কিনতে হবে। ছেলেদের উপহার কেনার যন্ত্রণা আছে। একটা দিন লাগবে উপহার বেছে বের করতে। যত কিছুই সে ভাবুক, শেষপর্যন্ত বড় সাহেবের কামরায় তাকে ঢুকতেই হবে। সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় নিজের স্বাধীনতায় সে আজ পর্যন্ত কিছুই করতে পারে নি।
সিদ্দিক সাহেব আনিকাকে দেখে বললেন, ও আচ্ছা আপনি এসেছেন। বসুন বসুন।
আনিকা বসল।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১৫)-হুমায়ূন আহমেদ
সিদ্দিক সাহেব তার সামনের খবরের কাগজ ভাঁজ করে রাখতে রাখতে বললেন, আজকের কাগজ দেখেছেন? জোকস কর্নারে মজার একটা জোক ছাপা হয়েছে। টিচার ছাত্রকে জিজ্ঞেস করেছে— ঘােড়া এবং হাতি, এদের পার্থক্য কী ? ছাত্র বলেছে, ঘােড়ার লেজ পেছনে থাকে, হাতির লেজ সামনে থাকে। হা হা হা। এইসব জোকস এরা কোথায় পায় কে জানে!
আনিকা অবাক হয়ে দ্রলােকের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর আচার আচরণের কোনাে মানে সে বুঝতে পারছে না।
মিস আনিকা! জি স্যার। আপনার কী রাশি বলুন তাে। তুলা রাশি। লিবরা।
আজকের দিনে আপনার রাশিফল কী বলছে দেখি— তুলা রাশি : বন্ধু বান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনের যন্ত্রণা থেকে দূরে থাকুন। দূরপাল্লার ভ্রমণে বের হবেন না। চাকরি ও ব্যবসায় আর্থিক গােলযােগের সম্ভাবনা। আপনি কি রাশিফলে বিশ্বাস করেন?
আনিকা বলল, আমি বিশ্বাসও করি না, অবিশ্বাসও করি না ।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১৫)-হুমায়ূন আহমেদ
সিদ্দিক সাহেব হাসিমুখে বললেন, আমিও বিশ্বাস করি না, তবে আমার বেলায় খুব মিলে। আমি পত্রিকা খুলে প্রথম পড়ি রাশিফল । তারপর পড়ি জোকস, তারপর ফ্রন্ট পেইজে যাই ।
আনিকা বুঝতে পারছে না এই মানুষটার সমস্যা কী ? হড়বড় করে এত কথা কেন বলছে! কোনাে একটা ঘটনা অবশ্যই ঘটেছে। ঘটনাটা কী ?
মিস আনিকা! জি স্যার।
আপনার জন্যে একটা সুসংবাদ আছে। সুসংবাদ এবং সারপ্রাইজ। বিগ সারপ্রাইজ। চা খাবেন ?
জি–না স্যার, চা খাব না। সারপ্রাইজটা কী ?