প্রশ্ন : কী কথা ?
উত্তর : কী কথা বলত আমার মনে নেই। সারারাত জেগে জেগে ছবি আঁকত আর কথা বলত— এইটা মনে আছে। তারপর একদিন বাবাকে লম্বা। একটা চিঠি লিখে সে ঘুমের ওষুধ খেয়ে মরে গেল।
প্রশ্ন : সেই চিঠিতে কী লেখা?
উত্তর : কী লেখা আমি বলতে পারব না। বাবা সেই চিঠি কাউকে পড়তে দেন নি। মিসির আলী সাহেব শুনুন, আমি কিন্তু ভালাে মেয়ে না। আমি খুব খারাপ মেয়ে। আমি কতটা খারাপ আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। ভাইয়ার মৃত্যুর পর আমি ঠিক করেছিলাম— দোকান থেকে ইঁদুর মারা বিষ কিনে এনে চিনি দিয়ে শরবত বানিয়ে বাবা–মা দু’জনকেই খাওয়াব। শুধু যে চিন্তা করেছিলাম তা না, বিষ কেনার জন্যে ঘর থেকে বেরও হয়েছিলাম। শুনুন, আমি এখন ঘুমিয়ে পড়ব। খুব ঘুম পাচ্ছে। যতটুকু শুনেছেন সেখান থেকে অ্যানালাইসিস করে কিছু বলতে পারবেন ?
মিসির আলী : পারব। শওকত নামের মানুষটির প্রতি তােমার কোনাে প্রেম নেই। তুমি তার হাত ধরেছ অপ্রেমে। তােমার ভাইয়ার প্রতি তােমার যে প্রচণ্ড আবেগ এবং ভালােবাসা ছিল, সেই আবেগ আর ভালােবাসাই তুমি ভাইয়ার বন্ধুর দিকে ছড়িয়ে দিয়েছ। বাবার মৃত্যুর পর মানুষজন ব্যস্ত হয়ে পড়ে ফাদার ফিগার খোঁজার জন্য । তুমি ব্যস্ত হয়েছ ব্রাদার ফিগারের জন্যে।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১৯)-হুমায়ূন আহমেদ
উত্তর : আপনি কিছুই জানেন না। শওকত যেদিন বিয়ে করলেন, সেদিন সকাল থেকে রাত এগারােটা পর্যন্ত আমি কোনাে কিছু মুখে দেই নি। রাত এগারােটার সময় আমি এক গ্লাস পানি খাই আর তার সঙ্গে নয়টা ঘুমের ওষুধ খাই। ভাইয়া যে ওষুধগুলি খেয়েছিল সেই ওষুধ। আমি খুব আনলাকি মেয়ে তাে, ওষুধ খাবার পরও আমার মৃত্যু হয় নি। আমি খুব আনলাকি মেয়ে সেই জন্যেই আমি বেঁচে যাই। আমাকে কেউ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় নি। স্টোমাক ওয়াশ করে নি।
তিন–চারদিন বিছানায় আধমরার মতাে পড়ে থেকে সুস্থ হয়ে উঠি। তারপর যে কাজটা করি তা হলাে– শওকতের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হই। তাঁকে বলি, আমি তােমাকে ছাড়া বাঁচব না। আমি তােমার কোনাে কথা শুনব না। তুমি অবশ্যই আমাকে বিয়ে করবে । উনি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, এরকম ছটফট করছ কেন? বসাে তাে। ঠাণ্ডা হয়ে বসে কথা বলাে । চা খাবে? আমি চা বানিয়ে আনি, চা খাও।
মিসির আলী : তুমি যখন কথা বললে, তখন শওকত সাহেবের স্ত্রী বাসায় ছিলেন না ?
উত্তর : না, ছিলেন না। আর থাকলেও আমি তার সামনেও এই কথাগুলি বলতাম। এখন বুঝেছেন আমি যে শওকতের হাত ধরেছি তা অপ্রেমে ধরি নি। প্রেমেই ধরেছি। এখন আপনি বিদেয় হন। ফুটেন। আপনার সঙ্গে বকবক করে আমার মাথা ধরে গেছে।
আনিকার চোখ বন্ধ। মাথার যন্ত্রণার জন্য মদিনাবাসীর গান শুনতে ভালাে লাগছে না। আনিকা চোখ মেলে বিরক্ত গলায় বলল, ড্রাইভার সাহেব, ক্যাসেটটা বন্ধ করেন তাে।।
ড্রাইভার অবাক হয়ে বলল, আপা, ক্যাসেট তাে বাজতেছে না। ক্যাসেটপ্লেয়ার নষ্ট।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১৯)-হুমায়ূন আহমেদ
ইমন তার বাবাকে বই পড়ে শােনাচ্ছে। বইটার নাম Fear at Midnight. ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প। ফিফথ গ্রেডের কিছু ছেলেমেয়ে মন্টানার জঙ্গলে সামার ক্যাম্প করতে যায়। সেখানে পৌছার পর শুরুটা তারা খুবই আনন্দে কাটায়। সমস্যা শুরু হয় মধ্যরাত থেকে। লেক থেকে উঠে আসে এক বুড়াে। বুড়াের চেহারায় মায়া । কথাবার্তায় মায়া। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ তার চোখ ধ্বক করে ওঠে। তখন চোখের মণিতে হালকা নীল আলাে দেখা যায়।
ভূতের গল্প পাঠের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। টেবিলে চারটা বড় বড় মােমবাতি জ্বলছে। মােমবাতির আলাে ছাড়া ঘরে কোনাে আলাে নেই। ফ্যান বন্ধ রাখা হয়েছে। ফ্যানের বাতাসে মােমবাতি নিভে যায় । তবে আজ গরম নেই। সন্ধ্যাবেলা তুমুল বৃষ্টি হওয়াতে আবহাওয়া ঠাণ্ডা ।
ইমন খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ছে। অন্যরকম পরিবেশ তৈরি হওয়ায় তার নিজেরই খানিকটা ভয়–ভয় লাগছে। গলাও শুকিয়ে যাচ্ছে। পানির গ্লাসে পানি রাখা আছে। ইমন মাঝে–মাঝে পানির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। পানি খাবার সময়ে কিছুক্ষণ পাঠের বিরতি হয়। তখন পিতা–পুত্র গল্প করে ।
এখন পানি পানের বিরতি। শওকত বলল, বুড়াে যে লােক লেকের পানি থেকে উঠে এলাে, সে আসলে কে? মানুষ নিশ্চয়ই না ?
ইমন বলল, মানুষ না।
সে কি ভ্যাম্পায়ার জাতীয় কিছু ?
ভ্যাম্পায়াররা পানিতে থাকে না। তারা থাকে পুরনাে অন্ধকার বাড়ির কফিনের ভেতর।
তাহলে বুড়ােটা কী?
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১৯)-হুমায়ূন আহমেদ
ইমন বলল, বুড়ােটা কী আমি জানি। কিন্তু আগেই তােমাকে বলে দিলে মজা নষ্ট হয়ে যাবে।
শওকত বলল, তাহলে থাক। আমার নিজের ধারণা— সে পানির কোনাে ভূত।
ইমন বলল, You are very close. বুড়ােটার একটা ছবি আঁকলে কেমন হয় ? খুব ভালাে হয় বাবা। জোছনা রাতে পানি থেকে উঠে আসছে আলখাল্লা পরা এক বুড়াে। ইমন আগ্রহ নিয়ে বলল, কখন আঁকবে বাবা? গল্পটা শেষ হােক।
ইমন বলল, বাকি গল্পটা আমি অন্য আরেকদিন পড়ব। আমার ছবি আঁকা দেখতে ইচ্ছা করছে।
শওকত বলল, ছবি আঁকা তাে দেখতে পারবে না। কেউ তাকিয়ে থাকলে আমি ছবি আঁকতে পারি না।
তাহলে আমি তাকিয়ে থাকব না। আমি অন্য কিছু করব। অন্য কিছুটা কী ? নকল পার্ল তৈরি করব। কীভাবে ?
এক বাটি ঠাণ্ডা পানি নিতে হবে।