যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২০)-হুমায়ূন আহমেদ

যদিও সন্ধ্যা

বলাে কী! আমরা সেই ট্রাউট মাছটা দিয়ে কী করেছি শুনলে তুমি খুব মজা পাবে বলাে শুনি। 

আমরা করলাম কী, শুকনা কাঠ জোগাড় করে আগুন করলামতারপর মাছটাকে পােড়ালামখেতে গিয়ে দেখলাম, উনি লবণ আনতে ভুলে গেছেনমাছ মুখে দিয়ে আমরা থুথু করে ফেলে দিলামউনি মাছটার উপর ভীষণ রেগে গেলেন । 

মাছের উপর রেগে গেলেন কেন? মাছটা তাে কোনাে ভুল করে নিভুল উনি করেছেনলবণ আনেন নি। 

মিস্টার অ্যান্ডারসনের এরকমই স্বভাবযে দোষী, তিনি তার উপর রাগ করেন নাঅন্যের উপর রাগ করেনমাছটার উপর তিনি ভয়ঙ্কর রেগে এফ ওয়ার্ড দিয়ে গালি দিলেন। 

এফ ওয়ার্ডের গালিটা কী

তিনি বললেন, Fuck you fish. Fuck you হলাে এফ ওয়ার্ডের গালিখুব খারাপ গালিতুমি কি এই গালি আগে শুনেছ

হ্যা, শুনেছিএফ ওয়ার্ডের গালি ছাড়াও তিনি অন্য গালিও জানেনযেমন SOB. SOB আবার কেমন গালি ? | SOB হলাে Son of a bitch. বাবা, তােমার কি চা খেতে ইচ্ছা করছে ? চা বানিয়ে আনব

যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২০)-হুমায়ূন আহমেদ

আনােচিনি আধাচামচ বেশি দেবেরাতের চায়ে আমি চিনি বেশি খাই| ইমন চা বানাতে গেলশওকত তাকিয়ে থাকল ছবিটার দিকে ছবি ভালাে হয় নিবুড়াে মানুষটাকে আলখাল্লা পরানাের কারণে তাকে লাগছে রবীন্দ্রনাথের মতােঅবচেতন মনে কোথাও হয়তাে রবীন্দ্রনাথ ছিলসেই রবীন্দ্রনাথ উঠে এসেছেনতার অর্ধেক শরীর পানির নিচেঅর্ধেক উপরেতিনি পিশাচের মতাে চোখে বনভূমির দিকে তাকিয়ে আছেনকী কুৎসিত!  ইমন চা নিয়ে এসে দেখে, তার বাবা কালাে রঙ ঢেলে ছবি নষ্ট করছেনতার চোখের দৃষ্টি অন্যরকম। 

শওকত ছেলের দিকে তাকিয়ে আহত গলায় বলল, ছবিটা আঁকতে পারি নিপরে এঁকে দেবঠিক আছে

ইমন বলল, ঠিক আছেআজ রাতেই এঁকে রাখবঘুম থেকে উঠে তুমি ছবি দেখতে পাবেইমন বলল, ঠিক আছেতুমি চা খাওসিগারেট এনে দেব

দাও। 

রাতে ইমনের ঘুম ভালাে হলাে নাযতবারই তার ঘুম ভাঙল, সে দেখলতার বাবা ছবি আঁকছেন । তার চোখ লালচোখে কেমন পাগলপাগল দৃষ্টিএকবার তার ইচ্ছা করল বলে, বাবা, ছবি আঁকতে হবে নাএসাে ঘুমিয়ে পড়ােএই কথাটাও সে বলতে পারল না। 

যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২০)-হুমায়ূন আহমেদ

ইমনের ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়ঘুম ভেঙে সে দেখল, তার বাবা তার পাশে বিছানায় বসে আছেনতাকে দেখে মনে হচ্ছে তাঁর খুব বড় কোনাে অসুখ হয়েছেগা থেকে অসুখঅসুখ গন্ধও আসছেশওকত ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা সরি ছবিটা আমি আঁকতে পারি নিআমি ছবি আঁকা ভুলে গেছি। 

মতিয়ুর রহমানকে আজ অতি আনন্দিত মনে হচ্ছেএমনিতেই তিনি আনন্দে থাকেনতাঁর মুখভর্তি পানহাতে জ্বলন্ত সিগারেটপানসিগারেট কিছুদিন আগে ছেড়ে দিয়েছিলেনদুটাই আজ ধরেছেনঘরে পান ছিল নাদোকান থেকে পাঁচ খিলি জরদা দেয়া পান এনেছেনসেই পাঁচ খিলির তিনটা শেষ হয়ে গেছেতাকে আবারাে পান কিনতে যেতে হবে। 

মতিয়ুর রহমানের আনন্দের কারণ তার বড় মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছেছেলে ভালােগ্রামে খামারবাড়ি করেছেদুটা পুকুর কাটিয়েছেপুকুরে মাছের চাষ হয়হাঁসমুরগি গরুছাগল নিয়ে থাকে বলেই বােধহয় চেহারায় চাষা চাষা ভাব আছেসেটা কোনাে বড় ব্যাপার নাপুরুষের পরিচয় চেহারায় না, কর্মেছেলে কর্মবীর

যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২০)-হুমায়ূন আহমেদ

 বিয়ের এই প্রস্তাব এসেছে মিতুর শ্বশুরবাড়ির দিক থেকেমিতুর শ্বশুর ওয়াজেদ আলী খোজখবর করে বের করেছেনতাদের দিক থেকে সামান্য আত্মীয়তাও আছেওয়াজেদ আলী মানুষটাকেও মতিয়ুর রহমান খুব পছন্দ করেছেনওয়াজেদ আলীর যে পরিচয় পেয়েছেন, তাতে মনে হয়েছে না এতদিনে মনের মতাে একজনকে পাওয়া গেছে। 

ওয়াজেদ আলী গলা নামিয়ে বলেছেন, বুঝেছেন বেয়াই সাহেব, আমাদের বয়স হয়ে গেছে বেশিদিন নাইযেকোনাে সময় আজরাইল এসে বলবে, এই শুওয়ের বাচ্চা, উঠ সময় হয়েছেবলবে না

বলবে তাে বটেইশেষ কয়েকটা দিন যদি আমরা একটু রঙঢঙ করি, অসুবিধা আছে ? অসুবিধা কী

ওয়াজেদ আলী আনন্দিত গলায় বললেন, সার কথা বলে ফেলেছেনজগতের সার কথা হলােঅসুবিধা কী ? তােমরা ইয়াংম্যানরা যদি ফুর্তি করতে পার, আমরা কেন পারব না? আমাদের দাবি আরাে বেশিআমাদের দিন শেষদিন শেষ কিনা বলেন

অবশ্যই দিন শেষ। 

এখন যদি এই শেষ বেলায় মাঝেমধ্যে সামান্য ওষুধ খাই, কার বাপের কী ? নিজের পয়সায় ওষুধ খাচ্ছিতাের পয়সায় তাে না। 

যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২০)-হুমায়ূন আহমেদ

মতিয়ুর রহমান বললেন, ওষুধ জিনিসটা বুঝলাম না । 

ওয়াজেদ আলী বললেন, না বােঝার কী আছে! যে ওষুধ খেলে মনে আনন্দ হয়, রাতে ঘুম ভালাে হয়, সেই ওষুধএখনাে বুঝেন নাই

বুঝেছি| কোকের সঙ্গে মিক্স করে নিয়ে এসেছিখাবেন নাকি এক টোক ? গরমের সময় ভালাে লাগে। 

মতিয়ুর রহমানের খেতে খুবই ইচ্ছা করছে, তারপরেও বললেন, না থাক| ওয়াজেদ আলী বললেন, আপনি না খেলে আমিও খাব নাএই জিনিস একা একা খেলে আর ওযুধ থাকে না, তখন হয়ে যায় বিষ। 

মতিয়ুর রহমান তখন বেয়াইকে সঙ্গ দেয়ার জন্যে ওষুধ মেশানাে কোক বেশ খানিকটা খেয়ে ফেললেন। 

ওষুধের গুণেই হােক বা অন্য কোনাে কারণেই হােক, খামারবাড়ি দেখে তিনি মুগ্ধ হলেনবেশ কয়েকবার বললেন, এই ছেলে কর্মবীর, আসল কর্মবীরআমার মেয়ের সঙ্গে যদি বিয়ের কথাবার্তা না হতাে, তাহলে আমি এই ছেলের পা ছুঁয়ে সালাম করতামকদমবুসি করার মতাে ছেলে। 

ফেরার পথে তিনি খামারের চার কেজি দুধ, লাউ, লাউ শাক, পুকুরের সরপুটি, এক ঝুড়ি কাচা বাদাম নিয়ে ফিরলেনছেলে এই প্রথমবার চিনাবাদামের চাষ করেছেভালাে ফলন হয়েছে। 

যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২০)-হুমায়ূন আহমেদ

মতিয়ুর রহমান ছেলের দুটা ছবিও নিয়ে এসেছেনআনিকাকে দেখাবেন। 

পাত্রের ছবি হিসেবে দুটা ছবির কোনােটাই চলে নাএকটা ছবিতে ছেলে অস্ট্রেলিয়ান গরুর পিঠে হাত দিয়ে হাসিহাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটায় সে মালকোচা মেরে পুকুরে দাঁড়িয়ে আছেতার হাতে চার কেজি ওজনের এক রুই মাছ। 

রাতের খাবারের পর মতিয়ুর রহমান আনিকা এবং তার মাকে ডেকে পাঠালেন। 

তাঁর দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে মূল প্রসঙ্গে যাবার শখ ছিল আনিকা তা হতে দিল 

গম্ভীরমুখে বলল, যা বলার তাড়াতাড়ি বলাে আমি শুয়ে পড়ব, আমার মাথা ধরেছে । 

মতিয়ুর রহমান বললেন, তাের বিখ্যাত মাথা কি সবসময় ধরা অবস্থায় থাকে

আনিকা বলল, সবসময় থাকে নাএখন মাথা ধরেছেকী বলবে বলাে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও শান্ত হয়ে বস, তারপর বলি। 

আনিকা বসলমতিয়ুর রহমান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, তুই কী ঠিক করেছিস ? বিয়ে করবি নাকি করবি না

বিয়ে করব না এমন কথা তাে কখনাে বলি নি

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *