ছেলে কি তাের বােনের মতাে তুই ঠিক করবি? নাকি আমাদের হাতে ছেড়ে দিবি ?
আমার পছন্দের একজন আছে, তাকে বিয়ে করব । সেই একজনটা কে? এখন কিছু বলতে চাচ্ছি না বাবা, যখন সব ঠিকঠাক হবে তখন বলব। সব ঠিকঠাক হবে মানে কী ? কোন জিনিসটা বেঠিক ? সবই বেঠিক। ঠিক করার চেষ্টা করছি।
মতিয়ুর রহমান বললেন, যে ছেলেকে বিয়ের কথা ভাবছিস, তাকে কি আমরা চিনি ?
হ্যা চেন।। শওকত না তাে?
আনিকা কিছু বলল না। মতিয়ুর রহমান বললেন, এই বিষয় আমি আগেই সন্দেহ করেছি। আমি তাে ফিডার দিয়ে দুধ খাই না। জগতের হিসাব জানি । আধবুড়া এক ছেলে, তাকে বিয়ে করবি কোন দুঃখে? টাকা নাই পয়সা নাই, আয়–রােজগার নাই । ভ্যাগাবন্ড ।
আনিকা বলল, আমি কিছু কথা বলব। আমার কথাগুলি মন দিয়ে শােন। তুমি তাে টিভির সিনেমার কথাবার্তা ছাড়া অন্য কোনাে কথা মন দিয়ে শােন না।
মতিয়ুর রহমান বললেন, তুই কী বাণী দিবি যে মন দিয়ে মহামানবীর বাণী শুনতে হবে ?
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২১)-হুমায়ূন আহমেদ
আনিকা বলল, হ্যা আমি বাণীই দেব। যে বুড়াের কথা তুমি বলছ, আমি যদি সেই বুড়ােকে বিয়ে করি, তাহলে তােমাদের না খেয়ে থাকতে হবে না । অন্য কাউকে বিয়ে করলে আমাকে তার সংসারে উঠতে হবে। আমার চাকরির।
একটা পয়সা তােমরা পাবে না। ওরা দিতে দিবে না। কোনাে জামাই শ্বশুর শাশুড়িকে তার বাড়িতে পুষবে না। আমার ভবিষ্যৎ চিন্তা করার আগে তােমরা তােমাদের ভবিষ্যৎ চিন্তা কর।
মতিয়ুর রহমান হতভম্ব হয়ে বললেন, মেয়ে হয়ে তুই আমাকে ভাতের খোটা দিলি?
সারাজীবন তুমি আমাকে নানান বিষয়ে নানান খোঁটা দিয়েছ । আমি একটা দিলাম।
আজ থেকে যদি আমি তাের ভাতের দানা একটা মুখে দেই, তাহলে আমি মানুষের বাচ্চা না । আমি নেড়িকুত্তার বাচ্চা।
আনিকা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আমি ঘুমুতে যাচ্ছি। ব্যথায় আমার মাথা ছিড়ে পড়ে যাচ্ছে।
মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে মনােয়ারাও উঠে গেলেন।
মতিয়ুর রহমান পান মুখে দিলেন । সিগারেট ধরালেন। তিনি খুবই দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। মেয়ের চাকরির টাকায় ভাত খেতে হবে— এই দুশ্চিন্তা না । তিনি খামারের ছেলেটাকে আগামীকাল সন্ধ্যায় বাসায় চা খেতে ডেকেছেন। উদ্দেশ্য চা খেতে খেতে আনিকার সঙ্গে দু‘একটা কথা বলবে।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২১)-হুমায়ূন আহমেদ
এই সমস্যার সমাধান কী ? সন্ধ্যায় চায়ের ব্যাপারটা বাদ দেয়া যায় কীভাবে? বিয়ে না হলে না হবে। ভদ্রভাবে আনিকা ছেলেটার সঙ্গে টুকটাক কিছু কথা তাে বলবে ? | মতিয়ুর রহমান টিভি ছাড়লেন । HBO–তে প্রায়ই ভূতের ছবি দেখায়। মতিয়ুর রহমান ইংরেজি মােটেই বুঝেন না। ভূতের ছবির সুবিধা হলাে, ইংরেজি বুঝলেও ছবি বুঝতে কষ্ট হয় না। রাতদুপুরে ভূত–প্রেতের ছবি দেখতে তার ভালােই লাগে। জীবনের শেষপ্রান্তে যে চলে এসেছে, তার কাছে ভালাে লাগাটা জরুরি ।
আনিকা বাতি নিভিয়ে শুয়ে আছে। মনােয়ারা মেয়ের মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছেন। মাথায় সিঁথি করে আঙুলের ডগায় তেল নিয়ে সেই তেল ঘসা। মনােয়ারা এই কাজটা খুব ভালাে পারেন। নারিকেল তেল তিনি আগে গরম করে নেন। পাশে ঠাণ্ডা পানির একটা বাটি থাকে। গরম তেল মাথায় ঘষার পরপর তিনি তাঁর আঙুল ঠাণ্ডা পানিতে ডুবিয়ে ম্যাসেজ শুরু করেন। এই অংশটা খুব আরামদায়ক।
মনােয়ারা দ্রুত আঙুল চালাতে চালাতে বললেন, ভাতের খোটা দেয়া ভালাে রে মা। আনিকা জড়ানাে গলায় বলল, আমার মেজাজ ঠিক ছিল না।
মনােয়ারা বললেন, তাের বাবা মুখে কিছু না বললেও মেয়ের উপর ভর করে বেঁচে আছে— এটা ভেবে সবসময় ছােট হয়ে থাকেন। কেউ কিছু না বুঝলেও আমি বুঝি । ছেলেমেয়ের কাছে ছােট হয়ে থাকা বড় কষ্টের।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২১)-হুমায়ূন আহমেদ
আনিকা কিছু বলল না। তার ঘুম পাচ্ছে। কথা বললেই ঘুম কেটে যাবে। আরামের ঘুম কাটাতে ইচ্ছা করছে না।
মনােয়ারা বললেন, আনিকা ঘুমিয়ে পড়েছিস ? আনিকা বলল, না।
তাহলে একটা কথা বলি, মন দিয়ে শােন। আমার মেজোভাই তাের মিজু মামা, একসময় সস্তা জমি পাওয়া যাচ্ছে দেখে বান্দরবানে অনেক জমি কিনেছিল। ঘর–দুয়ার বানিয়েছিল। পাহাড়িদের সঙ্গে সমস্যা শুরু হলে সে চিটাগাং চলে আসে। তার জমিজমা এখনাে সেখানে আছে। বিক্রির চেষ্টা করছিল, বিক্রি করতে পারে নি।
আনিকা বলল, আসল কথা কী বলতে চাচ্ছ, সেটা বলাে। এতক্ষণ ধরে তবলার টুকটাক শুনতে পারব না।
আসল কথা হলাে, আমি মেজোভাইকে চিঠি লিখেছিলাম। উনার জায়গাজমি আমি আর তাের বাবা দেখাশােনা করব, সেখানে গিয়ে থাকব। ভাইজান চিঠি পেয়ে খুবই খুশি হয়েছেন। আমাদের যেতে বলেছেন।
এই বিষয় কি বাবা জানে ? বাবাকে কিছু বলেছ ?
তাের বিয়ে ঠিক হয়ে গেলেই তাের বাবাকে বলব। সে খুশি হয়েই রাজি হবে। কানের কাছে আর ঘ্যানঘ্যান করবে না, আমার ঘুম পাচ্ছে।
মনােয়ারা ক্ষীণ স্বরে বললেন, তাের যাকে খুশি তাকে বিয়ে কর। বিয়ে করে সুখী হ। আমাদের কথা ভাববি না। আমরা আমাদের ব্যবস্থা করব।
আচ্ছা ঠিক আছে। মা, আরেকটা কথা বলি ? আনিকা বিরক্ত গলায় বলল, সব কথা কি তােমার আজই বলতে হবে ?
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২১)-হুমায়ূন আহমেদ
থাক আরেকদিন বলব। না বললেও চলে, এমন কোনাে জরুরি কথা না। জরুরি কথাটা আগে বলে ফেলেছি।
আনিকা বলল, কী বলতে চাচ্ছ বলাে। যে ভণিতা দিয়ে কথা শুরু করেছ, এখন বাকিটা না শুনলে রাতে ঘুম হবে না।
মনােয়ারা বললেন, কথাটা মনজু সম্পর্কে।
ভাইয়াকে নিয়ে কথা ? তার নাম উচ্চারণ করাই তাে নিষিদ্ধ । বলাে কী কথা তার বিষয়ে।
তার মৃত্যুর জন্যে তুই মনে মনে আমাকেও দায়ী করিস। তাের ধারণা আমার এবং তাের বাবার— এই দুইজনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সে ঘুমের ওষুধ খেয়েছে।
মা, কথাটা কি ভুল?
আমার বিষয়ে কথাটা ভুল। আমার অপরাধ একটাই— তাের বাবা যখন তার উপর রাগ করত, গালাগালি করত, আমি চুপ করে থাকতাম। কিছু বলতাম না। মা শােন, চুপ করে থাকা আমার স্বভাব। তাের বাবা যখন রেগে গিয়ে হৈচৈ করে, তখন আমি চুপ করে থাকি। তার উপর যখন রেগে যায়, তখনাে কিন্তু চুপ করেই থাকি। যখন বুঝি তুই মনে কষ্ট পেয়েছিস, তখন মাথায় তেল মাখিয়ে দেই। তাের মাথায় যেমন আমি বিলি কেটে দেই, মনজুর মাথায়ও দিতাম।