যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২১)-হুমায়ূন আহমেদ

যদিও সন্ধ্যা

ছেলে কি তাের বােনের মতাে তুই ঠিক করবি? নাকি আমাদের হাতে ছেড়ে দিবি

আমার পছন্দের একজন আছে, তাকে বিয়ে করব সেই একজনটা কে? এখন কিছু বলতে চাচ্ছি না বাবা, যখন সব ঠিকঠাক হবে তখন বলবসব ঠিকঠাক হবে মানে কী ? কোন জিনিসটা বেঠিক ? সবই বেঠিকঠিক করার চেষ্টা করছি। 

মতিয়ুর রহমান বললেন, যে ছেলেকে বিয়ের কথা ভাবছিস, তাকে কি আমরা চিনি

হ্যা চেনশওকত না তাে

আনিকা কিছু বলল নামতিয়ুর রহমান বললেন, এই বিষয় আমি আগেই সন্দেহ করেছিআমি তাে ফিডার দিয়ে দুধ খাই নাজগতের হিসাব জানি আধবুড়া এক ছেলে, তাকে বিয়ে করবি কোন দুঃখে? টাকা নাই পয়সা নাই, আয়রােজগার নাই ভ্যাগাবন্ড । 

আনিকা বলল, আমি কিছু কথা বলবআমার কথাগুলি মন দিয়ে শােনতুমি তাে টিভির সিনেমার কথাবার্তা ছাড়া অন্য কোনাে কথা মন দিয়ে শােন না। 

মতিয়ুর রহমান বললেন, তুই কী বাণী দিবি যে মন দিয়ে মহামানবীর বাণী শুনতে হবে

যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২১)-হুমায়ূন আহমেদ

আনিকা বলল, হ্যা আমি বাণীই দেবযে বুড়াের কথা তুমি বলছ, আমি যদি সেই বুড়ােকে বিয়ে করি, তাহলে তােমাদের না খেয়ে থাকতে হবে না অন্য কাউকে বিয়ে করলে আমাকে তার সংসারে উঠতে হবেআমার চাকরির। 

একটা পয়সা তােমরা পাবে নাওরা দিতে দিবে নাকোনাে জামাই শ্বশুর শাশুড়িকে তার বাড়িতে পুষবে নাআমার ভবিষ্যৎ চিন্তা করার আগে তােমরা তােমাদের ভবিষ্যৎ চিন্তা কর। 

মতিয়ুর রহমান হতভম্ব হয়ে বললেন, মেয়ে হয়ে তুই আমাকে ভাতের খোটা দিলি

সারাজীবন তুমি আমাকে নানান বিষয়ে নানান খোঁটা দিয়েছ আমি একটা দিলাম। 

আজ থেকে যদি আমি তাের ভাতের দানা একটা মুখে দেই, তাহলে আমি মানুষের বাচ্চা না আমি নেড়িকুত্তার বাচ্চা। 

আনিকা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আমি ঘুমুতে যাচ্ছিব্যথায় আমার মাথা ছিড়ে পড়ে যাচ্ছে। 

মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে মনােয়ারাও উঠে গেলেন। 

মতিয়ুর রহমান পান মুখে দিলেন সিগারেট ধরালেনতিনি খুবই দুশ্চিন্তায় পড়েছেনমেয়ের চাকরির টাকায় ভাত খেতে হবেএই দুশ্চিন্তা না তিনি খামারের ছেলেটাকে আগামীকাল সন্ধ্যায় বাসায় চা খেতে ডেকেছেনউদ্দেশ্য চা খেতে খেতে আনিকার সঙ্গে দুএকটা কথা বলবে। 

যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২১)-হুমায়ূন আহমেদ

এই সমস্যার সমাধান কী ? সন্ধ্যায় চায়ের ব্যাপারটা বাদ দেয়া যায় কীভাবে? বিয়ে না হলে না হবেভদ্রভাবে আনিকা ছেলেটার সঙ্গে টুকটাক কিছু কথা তাে বলবে ? | মতিয়ুর রহমান টিভি ছাড়লেন HBOতে প্রায়ই ভূতের ছবি দেখায়মতিয়ুর রহমান ইংরেজি মােটেই বুঝেন নাভূতের ছবির সুবিধা হলাে, ইংরেজি বুঝলেও ছবি বুঝতে কষ্ট হয় নারাতদুপুরে ভূতপ্রেতের ছবি দেখতে তার ভালােই লাগেজীবনের শেষপ্রান্তে যে চলে এসেছে, তার কাছে ভালাে লাগাটা জরুরি । 

আনিকা বাতি নিভিয়ে শুয়ে আছেমনােয়ারা মেয়ের মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছেনমাথায় সিঁথি করে আঙুলের ডগায় তেল নিয়ে সেই তেল ঘসামনােয়ারা এই কাজটা খুব ভালাে পারেননারিকেল তেল তিনি আগে গরম করে নেনপাশে ঠাণ্ডা পানির একটা বাটি থাকেগরম তেল মাথায় ঘষার পরপর তিনি তাঁর আঙুল ঠাণ্ডা পানিতে ডুবিয়ে ম্যাসেজ শুরু করেনএই অংশটা খুব আরামদায়ক। 

মনােয়ারা দ্রুত আঙুল চালাতে চালাতে বললেন, ভাতের খোটা দেয়া ভালাে রে মাআনিকা জড়ানাে গলায় বলল, আমার মেজাজ ঠিক ছিল না। 

মনােয়ারা বললেন, তাের বাবা মুখে কিছু না বললেও মেয়ের উপর ভর করে বেঁচে আছেএটা ভেবে সবসময় ছােট হয়ে থাকেনকেউ কিছু না বুঝলেও আমি বুঝি ছেলেমেয়ের কাছে ছােট হয়ে থাকা বড় কষ্টের। 

যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২১)-হুমায়ূন আহমেদ

আনিকা কিছু বলল নাতার ঘুম পাচ্ছেকথা বললেই ঘুম কেটে যাবেআরামের ঘুম কাটাতে ইচ্ছা করছে না। 

মনােয়ারা বললেন, আনিকা ঘুমিয়ে পড়েছিস ? আনিকা বলল, না। 

তাহলে একটা কথা বলি, মন দিয়ে শােনআমার মেজোভাই তাের মিজু মামা, একসময় সস্তা জমি পাওয়া যাচ্ছে দেখে বান্দরবানে অনেক জমি কিনেছিলঘরদুয়ার বানিয়েছিলপাহাড়িদের সঙ্গে সমস্যা শুরু হলে সে চিটাগাং চলে আসেতার জমিজমা এখনাে সেখানে আছেবিক্রির চেষ্টা করছিল, বিক্রি করতে পারে নি। 

আনিকা বলল, আসল কথা কী বলতে চাচ্ছ, সেটা বলােএতক্ষণ ধরে তবলার টুকটাক শুনতে পারব না। 

আসল কথা হলাে, আমি মেজোভাইকে চিঠি লিখেছিলামউনার জায়গাজমি আমি আর তাের বাবা দেখাশােনা করব, সেখানে গিয়ে থাকবভাইজান চিঠি পেয়ে খুবই খুশি হয়েছেনআমাদের যেতে বলেছেন। 

এই বিষয় কি বাবা জানে ? বাবাকে কিছু বলেছ

তাের বিয়ে ঠিক হয়ে গেলেই তাের বাবাকে বলব। সে খুশি হয়েই রাজি হবে। কানের কাছে আর ঘ্যানঘ্যান করবে না, আমার ঘুম পাচ্ছে। 

মনােয়ারা ক্ষীণ স্বরে বললেন, তাের যাকে খুশি তাকে বিয়ে করবিয়ে করে সুখী আমাদের কথা ভাববি নাআমরা আমাদের ব্যবস্থা করব। 

আচ্ছা ঠিক আছেমা, আরেকটা কথা বলি ? আনিকা বিরক্ত গলায় বলল, সব কথা কি তােমার আজই বলতে হবে

দিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২১)-হুমায়ূন আহমেদ

থাক আরেকদিন বলবনা বললেও চলে, এমন কোনাে জরুরি কথা নাজরুরি কথাটা আগে বলে ফেলেছি। 

আনিকা বলল, কী বলতে চাচ্ছ বলােযে ভণিতা দিয়ে কথা শুরু করেছ, এখন বাকিটা না শুনলে রাতে ঘুম হবে না। 

মনােয়ারা বললেন, কথাটা মনজু সম্পর্কে। 

ভাইয়াকে নিয়ে কথা ? তার নাম উচ্চারণ করাই তাে নিষিদ্ধ বলাে কী কথা তার বিষয়ে। 

 তার মৃত্যুর জন্যে তুই মনে মনে আমাকেও দায়ী করিসতাের ধারণা আমার এবং তাের বাবারএই দুইজনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সে ঘুমের ওষুধ খেয়েছে। 

মা, কথাটা কি ভুল

আমার বিষয়ে কথাটা ভুলআমার অপরাধ একটাইতাের বাবা যখন তার উপর রাগ করত, গালাগালি করত, আমি চুপ করে থাকতামকিছু বলতাম নামা শােন, চুপ করে থাকা আমার স্বভাবতাের বাবা যখন রেগে গিয়ে হৈচৈ করে, তখন আমি চুপ করে থাকিতার উপর যখন রেগে যায়, তখনাে কিন্তু চুপ করেই থাকিযখন বুঝি তুই মনে কষ্ট পেয়েছিস, তখন মাথায় তেল মাখিয়ে দেইতাের মাথায় যেমন আমি বিলি কেটে দেই, মনজুর মাথায়ও দিতাম

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *