যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২২)-হুমায়ূন আহমেদ

যদিও সন্ধ্যা

আনিকা বিছানা থেকে উঠে বসলমার দিকে তাকাল। 

মনােয়ারা বললেন, মনজু ঘুমের ওষুধ খাবার আগে দুটা চিঠি লিখেছিলএকটা তাের বাবাকে, একটা আমাকেআমার চিঠিটা তুই একদিন পড়ে দেখিসচিঠিটা কাউকে পড়াতে আমার লজ্জা লাগে বলেই লুকিয়ে রাখি। 

চিঠি তুমি সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছ, তাই না মা? হাচিঠিটা রাখরেখে চলে যাওআমার সামনেই পড়। 

না। 

মনােয়ারা তেলের বাটি নিয়ে উঠে গেলেন। 

দামি রেডিও বন্ড কাগজে গুটি গুটি করে লেখা চিঠিমুক্তার মতাে হাতের লেখাযেন সাদা কাগজে অক্ষর সাজিয়ে ছবি আঁকা হয়েছে । 

মাগাে

আমি খুব বড় একটা ভুল করতে যাচ্ছিমা, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিওএকটা কষ্ট নিয়ে আমি পৃথিবী থেকে যাচ্ছিকষ্টটা হচ্ছে, তােমার স্নেহের ঋণ আমি শােধ করতে পারলাম না। 

প্রায়ই খুব কষ্ট পেয়ে আমি রাতে শুয়ে শুয়ে কাঁদতামআমার ঘুম আসত নাতুমি গভীর রাতে তেলের বাটি নিয়ে আসতেএকটা কথাও বলতে নাআমার মাথা তােমার কোলে তুলে নিয়ে চুলে বিলি কাটতেকেন কিছু কিছু মানুষ তােমার মতাে ভালাে হয় ? মা শােন, আমরা সবচেকষ্ট পাই কিন্তু ভালাে মানুষদের জন্যেতুমি এত ভালাে কেন হলে তােমার ছেলে মনজু 

যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২২)-হুমায়ূন আহমেদ

আজ ইমনের জন্মদিনজন্মদিনের ছােট্ট মানুষটা খালি গায়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। ঘুমাবার সময় তার গায়ে লাল রঙের একটা টিসার্ট ছিলকখন খুলেছে কে জানে! নিশ্চয়ই গরম লাগছিলগরম লাগার কথাসিলিং ফ্যানে কোনাে একটা সমস্যা আছেপ্রচণ্ড শব্দে ঘােরে, সেই তুলনায় বাতাস হয় নাশওকত ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেখুব মায়া লাগছেবেচারা যে আগ্রহ নিয়ে বাবার কাছে এসেছিল, সেই আগ্রহের ফল কি সে পেয়েছে ? মনে হয় নাছেলেকে আনন্দে অভিভূত করার মতাে কিছু করতে পারে নিগল্প করেছে এই পর্যন্তইগল্প করে কাউকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা তার নেই। 

ছেলেটাকে নিয়ে ঢাকার বাইরে কোথাও যেতে পারলে হতােযাওয়া হয় নিকেন জানি ইচ্ছা করে নিমানুষের বয়স যত বাড়তে থাকে, তার ইচ্ছাগুলিও ছােট হতে থাকেতার এখন দিনরাত ঘরে বসে থাকতেই ভালােলাগেসমস্ত ইচ্ছা ছােট্ট একটা ঘরে বন্দি হয়ে গেছে। 

শওকত বিছানা থেকে নামলসে এখন মগভর্তি করে এক মগ চা বানাবেবারান্দায় দাঁড়িয়ে দিনের প্রথম সিগারেটটা ধরাবেপ্রথম সিগারেট শেষ হবার পর দ্বিতীয় সিগারেট মানুষ খুব সহজে রুটিনে আটকা পড়ে যায়সে রুটিনে আটকা পড়ে গেছেসকালে মগভর্তি চা তার রুটিনের অংশ। 

যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২২)-হুমায়ূন আহমেদ

আকাশে মেঘ করেছেঝুম বৃষ্টি হবে এরকম মেঘ নাএই কদিনে একবারও ঝুম বৃষ্টি হয় নি যে ছেলেকে নিয়ে সে বৃষ্টিতে ভিজবেআনন্দময় কোনাে স্মৃতি কি এই ছেলে নিয়ে যেতে পারবে

আজ ইমনের জন্মদিনআজ সে থাকবেআগামীকালও থাকবেপরশু তাকে তার মায়ের কাছে দিয়ে আসতে হবেযেখান থেকে সে এসেছিল, সেখানে ফিরে যাবেমিস্টার অ্যান্ডারসন নামের একজন মানুষের হাত ধরে সে লেকে মাছ ধরতে যাবেবাড়ির পেছনের পাের্চে মিস্টার অ্যান্ডারসন বারবিকিউ করবেন ইমন তাকে সাহায্য করবেএখন যেমন সে তার বাবাকে সাহায্য করে সেরকমচা বানানাের একটা বিদ্যা সে তার বাবার কাছ থেকে শিখেছে। 

এই বিদ্যা নিশ্চয় সে মিস্টার অ্যান্ডারসনকে দেখাবে| শওকত চায়ের মগ নিয়ে মেঝেতে বসলএই বাসা তাকে ছেড়ে দিতে হবেএখানে অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স হবেমাপামাপি খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হবে এই মাসের শেষ থেকেশওকতকে নতুন কোনাে আস্তানা খুঁজে বের করতে হবেগ্রামের বাড়িঘর ঠিক করে কিছুদিন গ্রামে গিয়ে থাকলে হয় ইমনকে গ্রামের বাড়ি দেখিয়ে নিয়ে এলে হতােঝােপ, বাঁশবন, ডােবাবাড়ির পেছনে বিলের মতাে আছেসকালের দিকে সেই বিলে অনেক বক দেখা যায়

এইসব দৃশ্য দেখলে সে মজা পেততাকে কোনাে কিছুই দেখানাে হয় নিমিস্টার অ্যান্ডারসনের একটা ছবি আঁকা হয় নিআঁকা হবে এরকম মনে হচ্ছে নাছবি বানানোের বিদ্যা তাকে ছেড়ে গেছেমাথার কোনাে এক রহস্যময় জায়গায় জট লেগে গেছেহয়তাে কোনাে একদিন সেই জট খুলবেসে আবারাে ছবি আঁকতে শুরু করবেতখন মিস্টার অ্যান্ডারসনের ছবিটা এঁকে পাঠিয়ে দিতে হবেসঙ্গে একটা চিঠিচিঠিটা সে বাংলায় লিখবে, তারপর ভালাে ইংরেজি জানে এমন কাউকে দিয়ে অনুবাদ করিয়ে নেবে। 

যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২২)-হুমায়ূন আহমেদ

সে দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরিয়ে চিঠির বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবতে শুরু করল । 

প্রিয় মিস্টার অ্যান্ডারসন

 জলরঙে আঁকা আপনার একটি ছবি পাঠালামছবিতে আপনি এবং ইমন মাছ ধরছেনআমার ছেলেটিকে আপনি যে মমতা এবং স্নেহ দেখিয়েছেন, সে তা মনে রেখেছে এবং আমার কাছে প্রতিটি গল্প অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে করেছেআপনি আমার পুত্রের প্রতি যে স্নেহ দেখিয়েছেন তা যেন বহুগুণে আপনার কাছে ফিরে আসে, আমি সেই প্রার্থনা করছিইমনের কাছে শুনে শুনে আমি আপনার একটি রূপক ছবি আমার মনে তৈরি করেছিছবিটি বটবৃক্ষের

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *