আনিকা বিছানা থেকে উঠে বসল। মার দিকে তাকাল।
মনােয়ারা বললেন, মনজু ঘুমের ওষুধ খাবার আগে দু’টা চিঠি লিখেছিল। একটা তাের বাবাকে, একটা আমাকে। আমার চিঠিটা তুই একদিন পড়ে দেখিস। চিঠিটা কাউকে পড়াতে আমার লজ্জা লাগে বলেই লুকিয়ে রাখি।
চিঠি তুমি সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছ, তাই না মা? হা।। চিঠিটা রাখ। রেখে চলে যাও। আমার সামনেই পড়।
না।
মনােয়ারা তেলের বাটি নিয়ে উঠে গেলেন।
দামি রেডিও বন্ড কাগজে গুটি গুটি করে লেখা চিঠি। মুক্তার মতাে হাতের লেখা। যেন সাদা কাগজে অক্ষর সাজিয়ে ছবি আঁকা হয়েছে ।
মাগাে,
আমি খুব বড় একটা ভুল করতে যাচ্ছি। মা, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। একটা কষ্ট নিয়ে আমি পৃথিবী থেকে যাচ্ছি। কষ্টটা হচ্ছে, তােমার স্নেহের ঋণ আমি শােধ করতে পারলাম না।
প্রায়ই খুব কষ্ট পেয়ে আমি রাতে শুয়ে শুয়ে কাঁদতাম। আমার ঘুম আসত না। তুমি গভীর রাতে তেলের বাটি নিয়ে আসতে। একটা কথাও বলতে না। আমার মাথা তােমার কোলে তুলে নিয়ে চুলে বিলি কাটতে। কেন কিছু কিছু মানুষ তােমার মতাে ভালাে হয় ? মা শােন, আমরা সবচে’ কষ্ট পাই কিন্তু ভালাে মানুষদের জন্যে। তুমি এত ভালাে কেন হলে ? তােমার ছেলে মনজু
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২২)-হুমায়ূন আহমেদ
আজ ইমনের জন্মদিন। জন্মদিনের ছােট্ট মানুষটা খালি গায়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। ঘুমাবার সময় তার গায়ে লাল রঙের একটা টি–সার্ট ছিল। কখন খুলেছে কে জানে! নিশ্চয়ই গরম লাগছিল। গরম লাগার কথা। সিলিং ফ্যানে কোনাে একটা সমস্যা আছে। প্রচণ্ড শব্দে ঘােরে, সেই তুলনায় বাতাস হয় না। শওকত ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। খুব মায়া লাগছে। বেচারা যে আগ্রহ নিয়ে বাবার কাছে এসেছিল, সেই আগ্রহের ফল কি সে পেয়েছে ? মনে হয় না। ছেলেকে আনন্দে অভিভূত করার মতাে কিছু করতে পারে নি। গল্প করেছে এই পর্যন্তই। গল্প করে কাউকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা তার নেই।
ছেলেটাকে নিয়ে ঢাকার বাইরে কোথাও যেতে পারলে হতাে। যাওয়া হয় নি। কেন জানি ইচ্ছা করে নি। মানুষের বয়স যত বাড়তে থাকে, তার ইচ্ছাগুলিও ছােট হতে থাকে। তার এখন দিন–রাত ঘরে বসে থাকতেই ভালাে। লাগে। সমস্ত ইচ্ছা ছােট্ট একটা ঘরে বন্দি হয়ে গেছে।
শওকত বিছানা থেকে নামল। সে এখন মগভর্তি করে এক মগ চা বানাবে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দিনের প্রথম সিগারেটটা ধরাবে। প্রথম সিগারেট শেষ হবার পর দ্বিতীয় সিগারেট । মানুষ খুব সহজে রুটিনে আটকা পড়ে যায়। সে রুটিনে আটকা পড়ে গেছে। সকালে মগভর্তি চা তার রুটিনের অংশ।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২২)-হুমায়ূন আহমেদ
আকাশে মেঘ করেছে। ঝুম বৃষ্টি হবে এরকম মেঘ না। এই কদিনে একবারও ঝুম বৃষ্টি হয় নি যে ছেলেকে নিয়ে সে বৃষ্টিতে ভিজবে। আনন্দময় কোনাে স্মৃতি কি এই ছেলে নিয়ে যেতে পারবে ?
আজ ইমনের জন্মদিন। আজ সে থাকবে। আগামীকালও থাকবে। পরশু তাকে তার মায়ের কাছে দিয়ে আসতে হবে। যেখান থেকে সে এসেছিল, সেখানে ফিরে যাবে। মিস্টার অ্যান্ডারসন নামের একজন মানুষের হাত ধরে সে লেকে মাছ ধরতে যাবে। বাড়ির পেছনের পাের্চে মিস্টার অ্যান্ডারসন বারবিকিউ করবেন । ইমন তাকে সাহায্য করবে। এখন যেমন সে তার বাবাকে সাহায্য করে সেরকম। চা বানানাের একটা বিদ্যা সে তার বাবার কাছ থেকে শিখেছে।
এই বিদ্যা নিশ্চয় সে মিস্টার অ্যান্ডারসনকে দেখাবে। | শওকত চায়ের মগ নিয়ে মেঝেতে বসল। এই বাসা তাকে ছেড়ে দিতে হবে। এখানে অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স হবে। মাপামাপি খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হবে এই মাসের শেষ থেকে। শওকতকে নতুন কোনাে আস্তানা খুঁজে বের করতে হবে। গ্রামের বাড়ি–ঘর ঠিক করে কিছুদিন গ্রামে গিয়ে থাকলে হয় । ইমনকে গ্রামের বাড়ি দেখিয়ে নিয়ে এলে হতাে। ঝােপ, বাঁশবন, ডােবা। বাড়ির পেছনে বিলের মতাে আছে। সকালের দিকে সেই বিলে অনেক বক দেখা যায়।
এইসব দৃশ্য দেখলে সে মজা পেত। তাকে কোনাে কিছুই দেখানাে হয় নি। মিস্টার অ্যান্ডারসনের একটা ছবি আঁকা হয় নি। আঁকা হবে এরকম মনে হচ্ছে না। ছবি বানানোের বিদ্যা তাকে ছেড়ে গেছে। মাথার কোনাে এক রহস্যময় জায়গায় জট লেগে গেছে। হয়তাে কোনাে একদিন সেই জট খুলবে। সে আবারাে ছবি আঁকতে শুরু করবে। তখন মিস্টার অ্যান্ডারসনের ছবিটা এঁকে পাঠিয়ে দিতে হবে। সঙ্গে একটা চিঠি। চিঠিটা সে বাংলায় লিখবে, তারপর ভালাে ইংরেজি জানে এমন কাউকে দিয়ে অনুবাদ করিয়ে নেবে।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২২)-হুমায়ূন আহমেদ
সে দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরিয়ে চিঠির বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবতে শুরু করল ।
প্রিয় মিস্টার অ্যান্ডারসন,
জলরঙে আঁকা আপনার একটি ছবি পাঠালাম। ছবিতে আপনি এবং ইমন মাছ ধরছেন। আমার ছেলেটিকে আপনি যে মমতা এবং স্নেহ দেখিয়েছেন, সে তা মনে রেখেছে এবং আমার কাছে প্রতিটি গল্প অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে করেছে। আপনি আমার পুত্রের প্রতি যে স্নেহ দেখিয়েছেন তা যেন বহুগুণে আপনার কাছে ফিরে আসে, আমি সেই প্রার্থনা করছি। ইমনের কাছে শুনে শুনে আমি আপনার একটি রূপক ছবি আমার মনে তৈরি করেছি। ছবিটি বটবৃক্ষের।