গায়ে হাত দিয়ে দেখ জুর কি–না ! তােমার সঙ্গে আমি যে আচরণ করি, তা মােটামুটি বেশ্যামেয়েদের মতােই। বেশ্যামেয়ের গায়ে যে–কোনাে সময় হাত দেয়া যায়।
শওকত বলল, তােমার জ্বর। বেশ ভালাে জ্বর। বাসায় যাও। বাসায় গিয়ে শুয়ে থাক।
আনিকা বলল, আমি ছ‘টা পর্যন্ত ক্যাব ভাড়া করেছি। ছ‘টা পর্যন্ত ক্যাব নিয়ে ঘুরব। একা একা ঘুরব ।।
একা একা ?
দোকা কোথায় পাব ? একা একাই ঘুরব। বাসায় আমি ঠিকমতাে নিঃশ্বাস নিতে পারি না। মাঝে মাঝে বাইরে বের হই নিঃশ্বাস নেবার জন্যে। এখন তুমি যদি কিছু মনে না কর, তােমাকে একটা অনুরােধ করব।
করাে অনুরােধ। গাড়ি থেকে নেমে যাও। আমি চাচ্ছি না তুমি আমার সঙ্গে থাক। ছটা পর্যন্ত তােমার সঙ্গে থাকতে আমার কোনাে সমস্যা নেই। তুমি জানাে আমি এমন কোনাে ব্যস্ত মানুষ না।
আনিকা বলল, তােমার সমস্যা না থাকলেও আমার আছে। প্লিজ নেমে যাও।
শওকত গাড়ি থেকে নেমে গেল। ড্রাইভার বলল, আপা কোথায় যাব ?
আনিকা বলল, আমার শরীরটা প্রচণ্ড খারাপ। আমাকে বারবার প্রশ্ন করে বিরক্ত করবেন না। আপনাকে তাে বলেছি সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত আমাকে নিয়ে ঘুরবেন।
শহরের বাইরে যাব আপা? বাইরে মানে কোথায় ? গাজীপুর শালবন। কিংবা বিশ্বরােড ধরে কুমিল্লার দিকে যেতে পারি।
শহরের ভেতর ঘুরতে আপনার অসুবিধা কী ?
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(৬)-হুমায়ূন আহমেদ
কোনাে অসুবিধা নেই। শহরের ভেতরে যানজট। গাড়ি নিয়ে বসে থাকতে হয়।
আপনার যেখানে ইচ্ছা যান। ছটার সময় বাসায় পৌছলেই হবে। আমার বাসা কলাবাগানে।
আনিকা চোখ বন্ধ করল। তার শরীর হঠাৎ করেই বেশ খারাপ করছে। বুকের ভেতর ধ্বক ধ্বক শব্দ। নিঃশ্বাসে কষ্ট । নিঃশ্বাসের এই কষ্ট যখন হয়, তখন খুব পানির তৃষ্ণা হয় অথচ পানি খেতে গেলে বমির মতাে আসে। আনিকার ধারণা তার বড় ধরনের কোনাে হার্টের অসুখ হয়েছে। মেয়েদের জন্যে হার্টের অসুখ খুব খারাপ। হার্ট দুর্বল মেয়েরা বাচ্চা নিতে পারে না। আনিকার এক বান্ধবীর (শারমিন) হার্টের অসুখ ছিল। ডাক্তাররা তাকে বাচ্চা নিতে নিষেধ
করে দিয়েছিলেন। শারমিন এখন অস্ট্রেলিয়াতে। সেখানে তার বাচ্চা হয়েছে কি
কে জানে! হবার কথা। অস্ট্রেলিয়ায় বড় বড় ডাক্তার আছে। তারা নিশ্চয়ই শারমিনের হার্ট ঠিক করে ফেলেছে।
আনিকার খুব বাচ্চার শখ। শখটা বাড়াবাড়ি রকমের বলেই তার ধারণা এই শখ কোনােদিন মিটবে না। এই পর্যন্ত তার একটি শখও মিটে নি। বড় বড় শখ তাে অনেক পরের ব্যাপার, ছােটখাটো শখও মিটে নি। স্কুল থেকে একবার ঠিক করা হলাে সবাই মিলে ময়নামতিতে যাবে। বেশি দূর তাে না । ঢাকা থেকে দু’ঘণ্টা মাত্র লাগে। সে সত্তর টাকা চাঁদাও দিয়েছিল। যেদিন যাবার কথা, তার আগের রাতে উত্তেজনায় সে ঘুমাতে পর্যন্ত পারে নি। সারারাত ধরে উল্টাপাল্টা স্বপ্ন।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(৬)-হুমায়ূন আহমেদ
যেমন সে কাপড় খুঁজে পাচ্ছে না। সকাল নটার মধ্যে স্কুলে উপস্থিত হবার কথা। নটা বাজতে মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। যখন অতি সাধারণ একটা জামা পরে বের হলাে, তখন ঘড়িতে দশটা বেজে গেছে। সে স্কুলে যাবার জন্যে কোনাে রিকশা পাচ্ছে না। কারণ সেদিনই রিকশা হরতাল দেয়া হয়েছে। গাড়ি ঠিকই চলছে, শুধু রিকশা নেই।
ময়নামতি যাওয়া শেষপর্যন্ত হয় নি । আনিকার বাবা সকালে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে হুঙ্কার দিলেন কিসের শিক্ষা সফর! এইসব ফাজলামি আমি জানি। শিক্ষা সফরের নামে যেটা হয়, তাকে বলে কুশিক্ষা সফর। কোথাও যেতে হবে না। ঘরে বসে টিভি দেখ।।
সামান্য ময়নামতি যাবার শখ যেখানে মেটে না, সেখানে নিজের বাচ্চা কোলে নিয়ে আদর করার শখও তার মিটবে না। অথচ সে বাচ্চার নাম পর্যন্ত ঠিক করে রেখেছে। ডাক নাম। ভালাে নাম রাখবে ছেলের বাবা। ডাক নাম হচ্ছে— ছেলে হলে ‘ক’। মেয়ে হলে ‘আ’ । কেউ যখন ছেলেকে জিজ্ঞেস করবে, বাবা, তােমার নাম কী ? ছেলে গাল ফুলিয়ে বলবে, আমার নাম ক?
তােমার নাম ‘ক’? শুধু ক’? হ্যা। এই নাম কে রেখেছে ? আমার মা রেখেছেন। তােমার কি আরাে ভাইবােন আছে ? আমরা তিন ভাইবােন। আমার আরাে দু’টা বােন আছে। ওদের নাম কী ? একজনের নাম অ, আরেকজনের নাম আ।
আনিকা ঠিক করে রেখেছে তার তিনটা ছেলেমেয়ে হবে। তিন খুবই লাকি নাম্বার। ছেলেমেয়েরা তিনজন আর তারা দু’জন। সব মিলিয়ে পাঁচজন। পাঁচও লাকি নাম্বার ।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(৬)-হুমায়ূন আহমেদ
আচমকা ব্রেক কষে গাড়ি থামল। আনিকা চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। সে চোখ মেলে। ফাকা অচেনা রাস্তা। মনে হচ্ছে শহর থেকে তারা অনেকদূরে চলে এসেছে।
আনিকা বলল, আমরা কোথায় ? ড্রাইভার বলল, আশুলিয়ায়। আনিকা বলল, সেটা আবার কোন জায়গা ?
উত্তরার কাছে। ভালাে ভালাে চটপটির দোকান আছে। আপা, চটপটি খাবেন?
আনিকা বিরক্ত গলায় বলল, না। চটপটি খাব না। আমি চটপটি খাওয়া টাইপ মেয়ে না।
ড্রাইভার বলল, আপা, আপনারে একটা কথা বলি, কিছু মনে নিয়েন না।
আনিকা জবাব দিল না। চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার ধারণা জ্বর আরাে বেড়েছে। তার উচিত বাসায় ফিরে সিটামল টাইপ কোনাে ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়া। জ্বর কমাতে হবে। কাল সকাল নটা থেকে অফিস। অফিস কামাই দেয়া যাবে না। ক্যাজুয়েল লিভ পাওনা নেই। সেকশান অফিসার সিদ্দিক সাহেব তাকে ভালাে চোখে দেখেন না। সারাক্ষণ চেষ্টা কীভাবে ভুল ধরবেন। কয়েক দিন আগে জ্যামে পড়ে অফিসে যেতে এক ঘণ্টা দেরি হয়েছে, সিদ্দিক সাহেব বলেছেন, আরে ম্যাডাম, আজ যে এত সকালে! লাঞ্চ করে এসেছেন তাই না ? ভেরি গুড। নেক্সটটাইম শুধু লাঞ্চ করে আসবেন না, লাঞ্চের শেষে ঘুম দিয়ে আসবেন। দুপুরের ঘুম স্বাস্থ্যের জন্যে ভালাে।
ড্রাইভার বলল, আপা, আপনাদের বিয়েটা হয় নাই ? আনিকা বিরক্ত গলায় বলল, না।
ড্রাইভার বলল, পুরুষজাতের কোনাে বিশ্বাস নাই। পুরুষজাত বিরাট হারামি। আমিও হারামি । আমার জীবনেও এইরকম ঘটনা আছে।
আনিকা বলল, আপনার জীবনের ঘটনা শুনতে চাচ্ছি না। আপনি গাড়ি চালান। গাড়ি চালানাের সময় এত কথা বলেন কেন ?
আপা, গান দিব ?