গান দিতে হবে না। আপনি বরং ফিরে চলুন। আমার শরীরটা ভালাে লাগছে না।
লেকের ধারে নামবেন না ? আনিকা বলল, না। আমি লেক–ফেক দেখি না। আমার এত শখ নাই।
ড্রাইভার গাড়ি ঘুরাল । আনিকা বাসায় ফিরছে— এটা ভাবতে তার নিজের কাছে খারাপ লাগছে। ঝগড়া খেচাখেচির মধ্যে পড়তে হবে। এর মধ্যে আবার সিনেমাও দেখা হবে। তার বাবা সিনেমায় গানের দৃশ্যে মাথা ঝুঁকিয়ে তাল দেবেন। দেখে মনে হবে সঙ্গীতের বিরাট ওস্তাদ বসে আছেন। ওস্তাদ মতিয়ুর রহমান খান।
বাসায় না ফিরে অন্য কোথাও গেলে কেমন হয় ? শওকতের বাসায় হঠাৎ উপস্থিত হয়ে তাকে চমকে দেয়া যায়। শওকত দরজা খুললেই সে বলবে, আমার খুব জ্বর । আজ আমি তােমার বাসায় থাকব। তুমি আমার সেবা করবে। মাথায় জলপট্টি দেবে। শওকত হকচকিয়ে বলবে, কী বলাে পাগলের মতাে! রাতে আমার এখানে থাকবে মানে ?
আনিকা সহজ গলায় বলবে, স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে থাকবে, এতে সমস্যা কী ?
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(৭)-হুমায়ূন আহমেদ
শওকত আরাে অবাক হয়ে বলবে, স্ত্রী মানে ? তােমার সঙ্গে আমার বিয়ে কখন হলাে ? আনিকা বলবে, আজই তাে বিয়ে হলাে। মগবাজার কাজি অফিসে বিয়ে হলাে। না–কি হয় নি ? তাহলে বােধহয় জ্বরের ঘােরে এইসব মনে হচ্ছে। সরি। আমি চলে যাচ্ছি।
এরকম মজার নাটক আনিকার মাঝে–মাঝে করতে ইচ্ছা করে। অবশ্যি সে কখনােই করে না। সে ইচ্ছা–সুখ মেয়ে না । ইচ্ছা–সুখ হলাে— যা করতে ইচ্ছা করে সেটা করে সুখ পাওয়া। আনিকা হলাে ইচ্ছা–অসুখ মেয়ে। যা করতে ইচ্ছা করে তা না করতে পেরে অসুখী হওয়া।
শওকতের বাড়িতে যাবার প্রশ্নই আসে না। তার উচিত প্রাণপণে শওকতকে ভুলে থাকার চেষ্টা করা। সে এমন কিছু না যে তাকে ভেবে সারাক্ষণ কষ্ট পেতে হবে। মানুষটার বয়স হয়েছে পঞ্চাশ। বাংলাদেশের মানুষদের গড় আয়ু চল্লিশ। সেই হিসেবে সে দশ বছর বেশি বেঁচে ফেলেছে। তার ঘণ্টা বেজে গেছে। যে কোনাে সময় ফুড়ৎ। প্রাণপাখি উড়ে যাবে। প্রাণপাখি নিয়ে সুন্দর একটা গানও আছে—
উড়িয়া যায়রে প্রাণপাখি তিন দরজা দিয়া খবর আইছে প্রাণপাখির আইজ সইন্ধ্যায় বিয়া॥
মানুষটার প্রাণপাখি তিন দরজা দিয়ে বের হয়ে বিয়ে করতে যাবে। তখন আনিকার কী হবে! সে বিধবাদের সাদা শাড়ি পরে অন্য কোনাে সেকেন্ডহ্যান্ড পুরুষের সন্ধানে বের হবে ? তার জীবন কেটে যাবে সন্ধানে সন্ধানে ? সেকেন্ড হ্যান্ড, থার্ড হ্যান্ড, ফোর্থ হ্যান্ড।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(৭)-হুমায়ূন আহমেদ
শওকতের টাকা–পয়সাও নেই। ঘরে টিভি নেই। গান শােনার যন্ত্র নেই । শােবার ঘরে একটা ফ্যান আছে, সেখান থেকে সারাক্ষণ কটকট ঘটঘট শব্দ হয়। মিস্ত্রি ডাকিয়ে ফ্যান সারাবে— সেই পয়সাও হয়তাে তার নেই।
মানুষটার বাসা ভাড়া করার সামর্থ্য পর্যন্ত নেই। অন্যের বাসায় থাকে। ঠিক অন্যের বাসাও না— তার মামার বাসা। মামা–মামি থাকেন দেশের বাইরে। তারা শ্যামলীতে সাত কাঠা জায়গা কিনে দুই কামরার টিনের একটা হাফ বিল্ডিং বানিয়ে শওকতকে পাহারাদার হিসেবে রেখে দিয়েছেন। যেন জমি অন্য কেউ দখল নিতে না পারে। মামা–মামি দেশে ফিরে এই জমিতে বাড়ি করবেন।
তারা যে–কোনাে দিন দেশে চলে আসবেন। তখন শওকতের কী হবে ? মামা–মামি অবশ্যই গলাধাক্কা দিয়ে তাকে বের করে দেবে। সে যাবে কোথায় ? কাক–বক গাছপালা একে কি কোনাে মানুষ জীবন চালাতে পারে? শওকত একটা পেন্সিল হাতে নিয়ে একটানে একটা ছাগল এঁকে ফেলতে পারে। তাতে লাভ কী? ছাগল আঁকার দরকারটাই বা কী! ক্যামেরায় ছাগলের ছবি তুললেই হয়।
অনেকদিন পর তার ছেলেটা তার সঙ্গে কয়েকদিন থাকবে। ভালাে–মন্দ কিছু যে সে এই ছেলের জন্যে করতে পারবে তা তাে মনে হয় না। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা দিনরাত টিভি দেখতে চায়। তার উচিত ছােট হলেও একটা রঙিন টিভি কেনা। সুন্দর সুন্দর কিছু বিছানার চাদর কেনা। কিছু খেলনা কেনা।
আনিকা ঠিক করে ফেলল, কাল অফিস থেকে ফেরার পথে শওকতের বাসায় যাবে। একটা খামে কিছু টাকা ভরে দরজার নিচ দিয়ে ফেলে দেবে। সাদা মুখবন্ধ খাম দেখে শওকত বুঝতে পারবে না টাকাটা কোথেকে এসেছে। বােঝার দরকারই বা কী ?
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(৭)-হুমায়ূন আহমেদ
কত টাকা দেয়া যায় ? পাঁচ হাজার । টিভি কিনতে চাইলে পাঁচ হাজারে হবে। দশ হাজার দেয়া দরকার। আনিকার টাকা আছে। প্রতি মাসেই সে বেতনের টাকার একটা অংশ জমায়। বােনাসের টাকার পুরােটাই জমায়। দুই লাখ এগারাে হাজার টাকা তার জমা আছে। টাকাটা সে জমাচ্ছে বিয়ের জন্যে। নতুন সংসার শুরু করতে কত কিছু লাগে। প্রতিটি খুঁটিনাটি জিনিসের জন্যে সে তাে আর শওকতের কাছে হাত পাততে পারবে না। অবশ্যি যদি শওকতের সঙ্গে তার বিয়ে হয়।
আনিকা বাসায় ফিরল সন্ধ্যা সাতটায়। তাকে দেখে তার মা মনােয়ারা ছুটে এসে বললেন, ভয়ঙ্কর ব্যাপার হয়েছে। এক লােক বাসায় টেলিফোন করে তাের বাবাকে হামকি ধামকি করেছে। গুণ্ডাদের মতো মােটা গলা। তাের বাবা ভয়ে
অস্থির। ভীতু মানুষ তাে!
আনিকা বলল, বাবাকে হামকি ধামকি করবে কেন?
মনােয়ারা বললেন, মিতুকে তাের বাবা মেরেছে– সেই খবর পেয়ে টেলিফোন।আমি তাে কিছুই বুঝতে পারছি না। বাবা যদি তার মেয়েকে মারে, বাইরের লােক হামকি ধামকি করবে কেন ?
মিতু কী বলে? সে বলে, আমি কিছু জানি না। মিতু কোথায় ?
দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে আছে। অনেকক্ষণ ধরে দরজা ধাক্কাধাক্কি করছি। দরজা খুলছে না। সাড়া–শব্দও করছে না। ঘুমের ওষুধ–টষুধ কিছু খেয়েছে কি না কে জানে। তুই একটু দেখবি ?
আনিকা বলল, আমি কিছু দেখতে–টেখতে পারব না মা। আমার জ্বর। আমি গরম পানি দিয়ে গােসল করে শুয়ে থাকব।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(৭)-হুমায়ূন আহমেদ
জ্বরের মধ্যে গােসল করবি কেন ? গা ঘিনঘিন করছে। এই জন্যে গােসল করব।
গােসল করতে করতে আনিকা শুনল, তার মা মিতুর ঘরের দরজা খােলার জন্যে খুবই চেষ্টা চালাচ্ছেন। মা দরজা খােল । তােকে কেউ কিছু বলবে না। আচ্ছা যা, দরজা না খুললে খুলবি না, একটু কথা বল। তাের বাবাকে যে টেলিফোন করেছে, সেই ছেলেটা কে?
মিতুর ঘর থেকে কোনাে শব্দ আসছে না।