যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(৭)-হুমায়ূন আহমেদ

গান দিতে হবে না। আপনি বরং ফিরে চলুনআমার শরীরটা ভালাে লাগছে না। 

লেকের ধারে নামবেন না ? আনিকা বলল, নাআমি লেকফেক দেখি নাআমার এত শখ নাই। 

ড্রাইভার গাড়ি ঘুরাল আনিকা বাসায় ফিরছে— এটা ভাবতে তার নিজের কাছে খারাপ লাগছেঝগড়া খেচাখেচির মধ্যে পড়তে হবেএর মধ্যে আবার সিনেমাও দেখা হবেতার বাবা সিনেমায় গানের দৃশ্যে মাথা ঝুঁকিয়ে তাল দেবেনদেখে মনে হবে সঙ্গীতের বিরাট ওস্তাদ বসে আছেনওস্তাদ মতিয়ুর রহমান খান। 

বাসায় না ফিরে অন্য কোথাও গেলে কেমন হয় ? শওকতের বাসায় হঠাৎ উপস্থিত হয়ে তাকে চমকে দেয়া যায়শওকত দরজা খুললেই সে বলবে, আমার খুব জ্বর আজ আমি তােমার বাসায় থাকবতুমি আমার সেবা করবেমাথায় জলপট্টি দেবেশওকত হকচকিয়ে বলবে, কী বলাে পাগলের মতাে! রাতে আমার এখানে থাকবে মানে

আনিকা সহজ গলায় বলবে, স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে থাকবে, এতে সমস্যা কী

যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(৭)-হুমায়ূন আহমেদ

শওকত আরাে অবাক হয়ে বলবে, স্ত্রী মানে ? তােমার সঙ্গে আমার বিয়ে কখন হলাে ? আনিকা বলবে, আজই তাে বিয়ে হলাে। মগবাজার কাজি অফিসে বিয়ে হলােনাকি হয় নি ? তাহলে বােধহয় জ্বরের ঘােরে এইসব মনে হচ্ছেসরিআমি চলে যাচ্ছি। 

এরকম মজার নাটক আনিকার মাঝেমাঝে করতে ইচ্ছা করেঅবশ্যি সে কখনােই করে না। সে ইচ্ছাসুখ মেয়ে না ইচ্ছাসুখ হলােযা করতে ইচ্ছা করে সেটা করে সুখ পাওয়া। আনিকা হলাে ইচ্ছাঅসুখ মেয়েযা করতে ইচ্ছা করে তা না করতে পেরে অসুখী হওয়া। 

শওকতের বাড়িতে যাবার প্রশ্নই আসে নাতার উচিত প্রাণপণে শওকতকে ভুলে থাকার চেষ্টা করাসে এমন কিছু না যে তাকে ভেবে সারাক্ষণ কষ্ট পেতে হবেমানুষটার বয়স হয়েছে পঞ্চাশবাংলাদেশের মানুষদের গড় আয়ু চল্লিশসেই হিসেবে সে দশ বছর বেশি বেঁচে ফেলেছেতার ঘণ্টা বেজে গেছেযে কোনাে সময় ফুড়ৎপ্রাণপাখি উড়ে যাবেপ্রাণপাখি নিয়ে সুন্দর একটা গানও আছে— 

উড়িয়া যায়রে প্রাণপাখি তিন দরজা দিয়া খবর আইছে প্রাণপাখির আইজ সইন্ধ্যায় বিয়া॥ 

মানুষটার প্রাণপাখি তিন দরজা দিয়ে বের হয়ে বিয়ে করতে যাবেতখন আনিকার কী হবে! সে বিধবাদের সাদা শাড়ি পরে অন্য কোনাে সেকেন্ডহ্যান্ড পুরুষের সন্ধানে বের হবে ? তার জীবন কেটে যাবে সন্ধানে সন্ধানে ? সেকেন্ড হ্যান্ড, থার্ড হ্যান্ড, ফোর্থ হ্যান্ড। 

যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(৭)-হুমায়ূন আহমেদ

শওকতের টাকাপয়সাও নেইঘরে টিভি নেইগান শােনার যন্ত্র নেই শােবার ঘরে একটা ফ্যান আছে, সেখান থেকে সারাক্ষণ কটকট ঘটঘট শব্দ হয়মিস্ত্রি ডাকিয়ে ফ্যান সারাবেসেই পয়সাও হয়তাে তার নেই। 

মানুষটার বাসা ভাড়া করার সামর্থ্য পর্যন্ত নেইঅন্যের বাসায় থাকেঠিক অন্যের বাসাও নাতার মামার বাসামামামামি থাকেন দেশের বাইরেতারা শ্যামলীতে সাত কাঠা জায়গা কিনে দুই কামরার টিনের একটা হাফ বিল্ডিং বানিয়ে শওকতকে পাহারাদার হিসেবে রেখে দিয়েছেনযেন জমি অন্য কেউ দখল নিতে না পারেমামামামি দেশে ফিরে এই জমিতে বাড়ি করবেন

তারা যেকোনাে দিন দেশে চলে আসবেনতখন শওকতের কী হবে ? মামামামি অবশ্যই গলাধাক্কা দিয়ে তাকে বের করে দেবেসে যাবে কোথায় ? কাকবক গাছপালা একে কি কোনাে মানুষ জীবন চালাতে পারে? শওকত একটা পেন্সিল হাতে নিয়ে একটানে একটা ছাগল এঁকে ফেলতে পারেতাতে লাভ কী? ছাগল আঁকার দরকারটাই বা কী! ক্যামেরায় ছাগলের ছবি তুললেই হয়। 

অনেকদিন পর তার ছেলেটা তার সঙ্গে কয়েকদিন থাকবেভালােমন্দ কিছু যে সে এই ছেলের জন্যে করতে পারবে তা তাে মনে হয় নাবাচ্চা ছেলেমেয়েরা দিনরাত টিভি দেখতে চায়তার উচিত ছােট হলেও একটা রঙিন টিভি কেনাসুন্দর সুন্দর কিছু বিছানার চাদর কেনাকিছু খেলনা কেনা। 

আনিকা ঠিক করে ফেলল, কাল অফিস থেকে ফেরার পথে শওকতের বাসায় যাবেএকটা খামে কিছু টাকা ভরে দরজার নিচ দিয়ে ফেলে দেবেসাদা মুখবন্ধ খাম দেখে শওকত বুঝতে পারবে না টাকাটা কোথেকে এসেছেবােঝার দরকারই বা কী

যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(৭)-হুমায়ূন আহমেদ

কত টাকা দেয়া যায় ? পাঁচ হাজার টিভি কিনতে চাইলে পাঁচ হাজারে হবেদশ হাজার দেয়া দরকারআনিকার টাকা আছেপ্রতি মাসেই সে বেতনের টাকার একটা অংশ জমায়বােনাসের টাকার পুরােটাই জমায়দুই লাখ এগারাে হাজার টাকা তার জমা আছেটাকাটা সে জমাচ্ছে বিয়ের জন্যেনতুন সংসার শুরু করতে কত কিছু লাগেপ্রতিটি খুঁটিনাটি জিনিসের জন্যে সে তাে আর শওকতের কাছে হাত পাততে পারবে নাঅবশ্যি যদি শওকতের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। 

আনিকা বাসায় ফিরল সন্ধ্যা সাতটায়তাকে দেখে তার মা মনােয়ারা ছুটে এসে বললেন, ভয়ঙ্কর ব্যাপার হয়েছেএক লােক বাসায় টেলিফোন করে তাের বাবাকে হামকি ধামকি করেছেগুণ্ডাদের মতো মােটা গলাতাের বাবা ভয়ে 

অস্থিরভীতু মানুষ তাে! 

আনিকা বলল, বাবাকে হামকি ধামকি করবে কেন

মনােয়ারা বললেন, মিতুকে তাের বাবা মেরেছেসেই খবর পেয়ে টেলিফোনআমি তাে কিছুই বুঝতে পারছি নাবাবা যদি তার মেয়েকে মারে, বাইরের লােক হামকি ধামকি করবে কেন

মিতু কী বলে? সে বলে, আমি কিছু জানি নামিতু কোথায়

দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে আছেঅনেকক্ষণ ধরে দরজা ধাক্কাধাক্কি করছি। দরজা খুলছে নাসাড়াশব্দও করছে নাঘুমের ওষুধটষুধ কিছু খেয়েছে কি না কে জানেতুই একটু দেখবি

আনিকা বলল, আমি কিছু দেখতেটেখতে পারব না মাআমার জ্বর। আমি গরম পানি দিয়ে গােসল করে শুয়ে থাকব। 

যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(৭)-হুমায়ূন আহমেদ

জ্বরের মধ্যে গােসল করবি কেন ? গা ঘিনঘিন করছেএই জন্যে গােসল করব। 

গােসল করতে করতে আনিকা শুনল, তার মা মিতুর ঘরের দরজা খােলার জন্যে খুবই চেষ্টা চালাচ্ছেন। মা দরজা খােল তােকে কেউ কিছু বলবে নাআচ্ছা যা, দরজা না খুললে খুলবি না, একটু কথা বলতাের বাবাকে যে টেলিফোন করেছে, সেই ছেলেটা কে

মিতুর ঘর থেকে কোনাে শব্দ আসছে না। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *