রেবেকা ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। ইমন বসে আছে মেঝেতে। তার হাতে কাঁচি। সামনে কিছু লাল-নীল কাগজ, আইকা গাম। কাগজ কাটার চেষ্টা করছে কিন্তু কাচি ঠিকমতাে ধরতে পারছে না।
অনেক বয়স্ক মানুষই কাঁচি ঠিকমতাে ধরতে পারেন না। ন‘ বছর বয়েসী একটা ছেলের পারার কথা না। রেবেকা একবার ভাবলেন— ছেলেকে ডাক দিয়ে কাছে বসিয়ে কচি ধরা শিখিয়ে দেবেন। তারপর মনে হলাে প্রয়ােজন নেই । শিখুক নিজে নিজে। ভুল করে করে শিখবে। Through mistakes we learn. এটাও অনেকে পারে না। অনেকে সারাজীবন ভুলই করে যায়। কিছু শিখতে পারে না।
রেবেকা ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, Hello! ছেলে মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর কাগজ কাটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ইমন কথা খুব কম বলে। সে চেষ্টা করে প্রশ্নের জবাব ইশারায় দিতে। যে সব প্রশ্নের জবাব ইশারায় দেয়া যাবে না— সেইসব প্রশ্নের জবাব সে দেয়, তবে অনাগ্রহের সঙ্গে দেয়।
কী বানাচ্ছ ইমন ? চাইনিজ লণ্ঠন। চাইনিজ লণ্ঠন ব্যাপারটা কী ? মা, তােমাকে পরে বলি ? না এখন বলাে।
চাইনিজ লণ্ঠন হলাে এক ধরনের লণ্ঠন। লাল–নীল কাগজ দিয়ে বানাতে হয়। ভেতরে মােমবাতি থাকে। চিমনির মতাে লাল–নীল কাগজ থাকে বলে রঙিন আলাে হয়।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(৮)-হুমায়ূন আহমেদ
রেবেকা খুশি হয়ে লক্ষ করলেন, ছেলে এক নাগাড়ে অনেকক্ষণ কথা বলেছে। অনাগ্রহের সঙ্গে যে বলেছে তা না, আগ্রহের সঙ্গেই বলেছে। এটা খুবই ভালাে লক্ষণ। স্কুলে ইমনকে ডিসটার্বড চাইল্ড হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। স্কুল থেকে ঠিক করা এক সাইকিয়াট্রিস্ট ইমনকে দেখছেন। তিনি বারবার বলেছেন, কথা না–বলা রােগ থেকে ইমনাকে বের করে আনতে হবে। তার সঙ্গে প্রচুর কথা বলতে হবে । কৌশলে তাকে দিয়ে কথা বলাতে হবে। তবে কখনােই। বুঝতে দেয়া হবে না যে তাকে দিয়ে কথা বলানাের চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে তার ডিফেন্স মেকানিজম আরাে কঠিন হয়ে যাবে।
ইমনকে যে বাংলাদেশে আনা হয়েছে তা সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শেই আনা হয়েছে। সাইকিয়াট্রিস্ট বলেছেন সব শিশুই একজন ফাদার ফিগারের অনুসন্ধান করে। মা‘র কাছে সে চায় আশ্রয়। বাবার কাছে নেতত্ব । নির্দেশনা। এক সময়। আমাদের আদি পূর্বপুরুষরা ছােট ছােট দলে ভাগ হয়ে বনে–জঙ্গলে অসহায় জীবনযাপন করত। নেতৃত্বের ব্যাপারটা তখনি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। একজন ভালাে নেতার দলে থাকলেই সারভাইভেলের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। অতি প্রাচীন এই ধ্যান–ধারণা জিনের মাধ্যমে বর্তমান মানুষদের মধ্যেও চলে এসেছে। এখনাে মানুষ খোজে নেতা।
সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলােক হাসিমুখে খুব গুছিয়ে কথা বলেন। তার প্রতিটি কথাই বিশ্বাসযােগ্য মনে হয়।
ম্যাডাম, আপনি আপনার পুত্রকে কিছুদিনের জন্যে হলেও তার বাবার কাছে ফেলে রাখুন। তার ফাদার–ফিগার অনুসন্ধান তৃপ্ত হােক।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(৮)-হুমায়ূন আহমেদ
কিছুদিন ফেলে রাখলেই হবে ? | কিছুটা তাে হবেই। তার বাবা যদি বুদ্ধিমান হন, তাহলে ছেলের সমস্যা ঠিক করে ফেলতে পারবেন। তার বাবা কি বুদ্ধিমান ?
তঁা, বুদ্ধিমান। তার অনেক কিছুর অভাব আছে, বুদ্ধির অভাব নেই।
সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, সেই ভদ্রলােকের কী কী অভাব আছে, একটু বলুন তাে। নােট করি।
তার প্রয়ােজন আছে কি ?
হ্যা প্রয়ােজন আছে।
সে সবসময় নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। আশেপাশের কাউকেই গুরুত্বপূর্ণ ভাবে না। সে মনে করে সে নিজে যা ভাবছে, তা–ই ঠিক।
সাইকিয়াট্রিস্ট হেসে বললেন, সব মানুষই কিন্তু এরকম । কেউ একটু বেশি কেউ কম। এখন বলুন, এই ভদ্রলােককে কি আপনি ভালােবেসে বিয়ে করেছিলেন ?
হ্যা। তার কোন গুণটি দেখে তাকে ভালােবেসেছিলেন ?
রেবেকা ভুরু কুঁচকে বসে রইলেন। প্রশ্নটার জবাব দিতে তার ইচ্ছা করছিল। সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ সহজভাবে কথা বলুন। আপনিও যদি আপনার ছেলের মতাে চুপ করে থাকেন, তাহলে কীভাবে হবে! প্লিজ স্পিক আউট। তাকে কেন বিয়ে করলেন সেটা বলুন।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(৮)-হুমায়ূন আহমেদ
আর্ট কলেজে একবার ফোর্থ ইয়ারের ছেলেদের এক্সিবিশন হচ্ছে। আমি কয়েকজন বন্ধু–বান্ধব নিয়ে ছবি দেখতে গেছি। একটা ওয়েল পেইন্টিং–এর সামনে দাঁড়িয়ে আমি হতভম্ব। ছবিটা জঙ্গলের ছবি । গভীর জঙ্গলে একটি তরুণী মেয়ে এলােমেলাে হয়ে শুয়ে আছে। গাছের পাতার ফাক দিয়ে আলাে এসে পড়েছে মেয়েটির মুখে। খুবই সুন্দর ছবি। চোখ ফেরানাে যায় না এমন ছবি । কিন্তু আমি হতভম্ব সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। বনের ভেতর যে মেয়েটা শুয়ে আছে সে আমি। আমার চোখ, আমার মুখ । আমার মাথার চুল লালচে ধরনের। মেয়েটির মাথার চুলও সেরকম। আমি কিছু বলার আগেই আমার বান্ধবীরা চেঁচিয়ে বলল, এ কী এটা তাে তাের ছবি!
আমি আর্টিস্টকে খুঁজে বের করলাম। তার চেহারা সুন্দর । কথাবার্তা সুন্দর। স্বপ্ন স্বপ্ন চোখ। কোনাে একটা মজার কথা বলার আগে মানুষের মুখে যে–রকম এক্সপ্রেশন হয়, তার মুখের এক্সপ্রেশন সেরকম। যেন এক্ষুণি সে মজার কোনাে কথা বলবে। আমি তাকে গিয়ে বললাম, আপনার ছবির এই মেয়েটি কি আমি ? সে অবাক হয়ে বলল, আপনি হবেন কেন? আমি আপনাকে চিনি না। আপনি আমার ছবির জন্য মডেলও হন নি ।।
আপনি বলতে চান পুরো ছবিটা আপনি মন থেকে এঁকেছেন ?
আমি মন থেকে আঁকি নি । মধুপুর শালবনে রঙ–তুলি নিয়ে গিয়েছি। ছবিটার কাঠামাে সেখানে করা।
মেয়েটির ছবি মন থেকে এঁকেছেন ? জি।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(৮)-হুমায়ূন আহমেদ
আপনি আপনার নিজের ছবির দিকে তাকান এবং আমার দিকে তাকান, তারপর বলুন ছবিটির মেয়ে এবং আমি দু‘জন কি একই ব্যক্তি ?
অস্বাভাবিক মিল তাে আছেই। মিল কেন হলাে?
ছেলেটা তখন হেসে বলল, হয়তােবা কোনাে না কোনােভাবে আপনি আমার কল্পনায় ছিলেন । আপনার সঙ্গে কল্পনার জগতে আমার পরিচয় আছে । মিল দেখে আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন ? আপনার তাে উচিত খুশি হওয়া।
আমি রেগে গিয়ে বললাম, আমি কেন খুশি হবাে? এই ছবিটা কেউ একজন কিনে নিয়ে তার ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রাখবে। আমি একজন মানুষের ড্রয়িংরুমে শুয়ে থাকব, যাকে আমি চিনি না।
অন্যের ড্রয়িংরুমে আপনি শুয়ে থাকবেন কেন ? আপনি ছবিটা কিনে নিয়ে যান। আপনার শােবার ঘরে টানিয়ে রাখুন। আপনি শুয়ে থাকবেন আপনার শােবার ঘরে।
ছবিটার দাম কত?