দাম লেখা আছে পনের হাজার টাকা। তবে আপনি যা দেবেন আমি তা–ই নেব। খুবই টাকা–পয়সার টানাটানিতে আছি। একটা ছবি বিক্রি করতে না পারলে কলেজের বেতন দিতে পারব না। খাওয়া–দাওয়াও বন্ধ।
আমি সেই দিনই পনের হাজার টাকা দিয়ে ছবি কিনলাম। আমার ইচ্ছা ছিল ছবি নিয়ে বাড়ি ফেরা, সেটা সম্ভব হলাে না। যতদিন এক্সিবিশন চলবে ততদিন ছবি রাখতে হবে। তবে আমি ছেলেটির সঙ্গে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করতে গেলাম। সেই লাঞ্চ করতে যাওয়াটাই আমার জন্যে কাল হলাে। ছেলেটা হঠাৎ বলল, এত অল্প বয়েসী কোনাে মেয়ে যে তার ব্যাগে এতগুলাে টাকা নিয়ে ঘুরতে পারে তা তার কল্পনাতেই নেই।
এটা বলেই সে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, কল্পনার জগতে আপনার সঙ্গে আমার ভালো পরিচয় ছিল। সেই জগতে আমরা দু’জন হাত ধরাধরি করে হাঁটতাম। এখন আমরা বাস্তবে বাস করছি। আমি কি বাস্তবের এই মেয়েটাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে পারি ? তার কথা শুনে আমার হঠাৎ কী যেন হলাে, আমি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, কোনাে সমস্যা নেই, ছুঁয়ে দেখুন ।
অতি দ্রুত আমরা বিয়ে করে ফেললাম। আমার বাবা, আমার আত্মীয়স্বজনরা আমার উপর খুবই রাগ করলেন। কোর্টে বিয়ে করে মা’কে যখন খবর দিলাম, তখন তার স্ট্রোকের মতাে হলাে। But I was happy.
সাইকিয়াট্রিস্ট রেবেকার দিকে সামান্য ঝুঁকে এসে বললেন, আপনাদের বিবাহিত জীবনে প্রথম বড় ধরনের সমস্যা কখন হলাে? মানে কোন সে ঘটনা?
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(৯)-হুমায়ূন আহমেদ
রেবেকা শান্ত গলায় বলল, যে দিন তার ওয়েল পেইন্টিং–এ আমার চেহারার মেয়েটির রহস্য পরিষ্কার হলাে সেদিন।
রহস্যটা কী ?
আমার এক কাজিন আছে এয়ারফোর্সে। পাইলট। সে আমাকে আমার জন্মদিনে উপহার দেবে বলে আমার ছবি দিয়ে একটা ছবি ইমনের বাবাকে আঁকতে বলে। আমার একটা বড় ছবি সে–ই ইমনের বাবাকে দিয়ে আসে। ছবি
আঁকা হয়। কিন্তু আমার কাজিনকে তখন এয়ারফোর্স থেকে পাঠিয়ে দেয়। সােভিয়েট ইউনিয়নে কী একটা ট্রেনিং–এ। সে আর ছবিটা ইমনের বাবার কাছ থেকে নিতে পারে নি।
ছবির পেছনের এই রহস্য আপনি আপনার স্বামীর কাছ থেকে জানতে পারেন, না–কি আপনার কাজিন আপনাকে বলেন ?
আমার কাজিন আমাকে বলেন। ইমনের বাবা পুরাে ব্যাপারটা গােপন করেছিল।
পেইন্টিংটা কি আছে আপনার কাছে ?
। যেদিন আমাদের ডিভাের্স হয়ে যায়, সেদিনই আমি ছবিটা নষ্ট করে ফেলি।
এখন কি মনে হয় না কাজটা ভুল হয়েছে ?
, মনে হয় না। আপনি কি ভেবে–চিন্তে বলছেন, না–কি রাগ করে বলছেন ?
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(৯)-হুমায়ূন আহমেদ
আমি ভেবে–চিন্তেই বলছি। রাগ করে বলছি না। ছবিটা অবশ্যই সুন্দর ছিল। কিন্তু সেই সুন্দরের মধ্যে ছিল প্রতারণা। প্রতারণা আমার পছন্দ না । সুন্দর প্রতারণা সহ্য করে না।
আপনি নিজে কখনাে কারাে সঙ্গে প্রতারণা করেন নি ?
আমি কখনােই কারাে সঙ্গে প্রতারণা করি নি । নিজেকে নিজে প্রতারণা করেন নি ?
তা হয়তাে করেছি।
ইমন কাঁচি দিয়ে এখনাে কাগজ কাটছে। তবে কাগজ কাটতে গিয়ে সে তার হাত কেটে ফেলেছে। মােটামুটি ভালােই কেটেছে। বেশ কয়েক ফোটা রক্ত পড়েছে। ইমন রঙিন কাগজের একটা টুকরা রক্তের উপর দিয়ে রেখেছে, যাতে ব্যাপারটা মায়ের চোখে না পড়ে। রেবেকা ব্যাপারটা দেখেছেন। তার মন খারাপ হয়েছে। ছেলেটা এরকম হচ্ছে কেন? ব্যথা পেয়েছে সে বলবে। চিৎকার করবে। কাঁদবে । নিজেকে আড়াল করবে কেন?
ইমন। তাকাও আমার দিকে।
ইমন তাকাল। রেবেকা হাত কাটা প্রসঙ্গ তুলতে গিয়েও তুললেন না। ছেলে তাকে কিছু জানাতে চাচ্ছে না যখন, তখন আগ বাড়িয়ে প্রশ্ন করার দরকার কী! রেবেকা বললেন, তােমার চাইনিজ লণ্ঠনের কতদূর ? আর কতক্ষণ লাগবে ?
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(৯)-হুমায়ূন আহমেদ
বুঝতে পারছি না।
কাগজ কাটতে কি অসুবিধা হচ্ছে ? আমি কেটে দেব ? Do you need my help?
। আগামীকাল তােমার বাবা তােমাকে নিতে আসবেন । তুমি কি তা জানাে ? ইমন হঁা–সূচক মাথা নাড়ল। তুমি যা যা সঙ্গে নেবে সব গুছিয়ে নাও। আমি গুছিয়ে রেখেছি। কখন গােছালে ?
ইমন জবাব দিল না। রেবেকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। ইমন নিজে নিজেই তার সব জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখেছে। তার মাকে কিছু জানায় নি। বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্যে যে ব্যস্ততা তার মধ্যে আছে, সে তা মা’র কাছে গােপন করছে। কেন করছে ? তার কি ধারণা মা রাগ করবে ?
ইমন শােন, তােমার কোনাে সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে তােমার বাবাকে জানাবে। তুমি যে নিজ থেকে কিছু বলল না— তা তাে তােমার বাবা জানে না। আমি তােমার স্বভাব জানি বলেই তােমার দিকে লক্ষ রাখি । তােমার বাবা তা রাখবে না। ঠিক আছে ?
এই যে তুমি হাত কেটে ফেলেছ, আমি ব্যাপারটা দেখেছি। তােমার বাবা দেখবেও না। পুরুষমানুষ এত খুঁটিয়ে কিছু দেখে না।
কেন?
প্রকৃতি ছেলেদের একরকম করে বানিয়েছে আর মেয়েদের অন্যরকম করে বানিয়েছে।
কারা বেশি ভালাে ? তােমার কী ধারণা? কারা বেশি ভালাে ? জানি না।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(৯)-হুমায়ূন আহমেদ
জানলেও তােমার নিজের একটা চিন্তা আছে। সেই চিন্তাটা বলছ না। কারণ, তােমার ধারণা তুমি যা ভাবছ তা বললে আমি রাগ করব। তােমার চিন্তায় ছেলেরা বেশি ভালাে। ঠিক বলেছি বাবা?
এখন লক্ষ্মীছেলের মতাে আমার ঘরে যাও। আমার ড্রয়ার খুলে ব্যন্ড এইড নিয়ে এসাে। তােমার কাটা হাতে লাগিয়ে দিচ্ছি ।
ইমন ব্যন্ড এইড নিয়ে এলাে। রেবেকা ছেলের হাতে ব্যন্ড এইড লাগাতে লাগাতে বললেন, বাংলাদেশ তােমার কেমন লাগছে?
ইমন বলল, ভালাে লাগছে। বাংলাদেশের কোন জিনিসটা ভালাে লাগছে ? সব ভালাে লাগছে। বাহ্ ভালাে তাে। কোন জিনিসটা খারাপ লাগছে ? লিজার্ড । ঘরের দেয়ালে ঘুরে বেড়ায়।
এই ধরনের লিজার্ডকে আমরা বলি টিকটিকি। তুমি যে টিকটিকি ভয় পাও, তা অবশ্যই বাবাকে আগেই বলে দিও।
আচ্ছা।
আমি তােমার সঙ্গে একটা সেল ফোন দিয়ে দেব। সেল ফোন কীভাবে ব্যবহার করতে হয় শিখিয়ে দেব। কোনাে সমস্যা হলেই আমাকে টেলিফোন করবে।
ইমন আবার রঙিন কাগজের কাছে বসল। রেবেকাও ছেলের কাছে এসে বসলেন। হাসিমুখে বললেন, চাইনিজ লণ্ঠন বানানাে কোথায় শিখেছ ?
ইমন বলল, স্কুলে। আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট ক্লাসে। মা, আমার কিছু শক্ত কাগজ লাগবে ।
কী রকম শক্ত কাগজ ? ওয়ান মিলিমিটার থিক হার্ড বোের্ড ।
আমি আনিয়ে দিচ্ছি। আমাকে বলে দাও কী করতে হবে। আমি তােমাকে সাহায্য করি ।
ইমন বলল, না। রেবেকা বললেন, না কেন?
ইমন বলল, চাইনিজ লণ্ঠনটা আমি বাবার জন্যে নিয়ে যাব গিফট ।