হঁ্যা।
তখন কী করলে এরা কামড় ছেড়ে দেয় ?
কিছুতেই ছাড়ে না। মাঝে–মাঝে এমনও হয়েছে– গলা কেটে ফেলতে হয়েছে। তারপর ছেড়েছে।
খুব আশ্চর্য তাে!
আশ্চর্যের কিছু নেই। মানুষের মধ্যেও এরকম কচ্ছপ স্বভাব আছে। কিছু মানুষ আছে যারা কচ্ছপের মতাে। কাউকে কামড়ে ধরলে ছাড়ে না। যেমন
আমি। আমি যদি কাউকে ধরি, তাহলে ছাড়ি না। মৃত্যু পর্যন্ত ধরে রাখি।
ইমন বলল, তুমি কাকে ধরেছ ? আনিকা বলল, আপাতত তােমাকে ধরেছি।
ইমন একটা কচ্ছপ হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। তার মাথায় কোনাে পরিকল্পনা আছে।
শওকত চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলল, আনিকা, তুমি আমার ছেলের সঙ্গে কথা বলার সময় সাবধানে বলবে। সে খুব স্মার্ট ছেলে। তুমি যা বলবে তা তাে সে বুঝবেই, যা বলবে না তাও বুঝবে।
আনিকা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, আমি যদি কিছুক্ষণ তােমাদের সঙ্গে থাকি, তােমাদের অসুবিধা হবে?
শওকত বলল, অসুবিধা হবে কেন ? প্রশ্নের জবাব প্রশ্ন দিয়ে দিও না । অসুবিধা হবে কি হবে না সেটা বলাে।
অসুবিধা হবে না। বরং আমার খুবই লাভ হবে। আমি দুই–তিন ঘণ্টার জন্যে বাইরে যাব । ছেলেকে তােমার কাছে রেখে যেতে পারি। তিন ঘণ্টা থাকতে পারবে ?
তোমাকে অফিসে যেতে হবে না ?
তােমাদের সঙ্গে আজ বেশকিছু সময় থাকব। দুপুরে তােমাদের রান্না করে খাওয়াব— এই ভেবে আমি আজ ছুটি নিয়েছি। তুমি থাকতে দেবে কি দেবে
— এই ভেবে শুরুতে অফিস থেকে ছুটি নেবার কথা বলি নি।
যদিও সন্ধ্যা -(শেষ)-পর্ব)-হুমায়ূন আহমেদ
দুপুরে কী খাওয়াবে ? তােমার ছেলে যা খেতে চায়, তাই খাওয়াব। তুমি রান্না করতে জানাে তা জানতাম না। আমি অনেক কিছুই জানি, যা তুমি জানাে না। রান্না যে করবে— জিনিসপত্র লাগবে না ?
সেই ব্যবস্থা আমি করব । নিউমার্কেট থেকে বাজার করে আনব। তােমার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে যাব। সে কি যাবে আমার সঙ্গে ?
যাবে। কচ্ছপ দিয়ে তুমি তারে কজা করে ফেলেছ।
আনিকা বলল, আমার সমস্যা হচ্ছে, আমি যাদেরকে কজা করতে চাই তাদের কজা করতে পারি না। আর যাদের কজা করার আমার কোনাে প্রয়ােজন নাই, তারা কীভাবে কীভাবে যেন কজায় চলে আসে।
খারাপ কী ? কেউ না কেউ তাে কজায় আসছে।
খারাপ বলছি না তাে! ইয়েলাে ক্যাবের ড্রাইভারের কথা তােমার মনে আছে? কোন ড্রাইভার ?
আকবর নাম। যার গাড়িতে করে তােমাকে তুলে মগবাজার কাজি অফিসে গিয়েছিলাম। সে এখন কজায় চলে এসেছে। আমি যাতে গান শুনতে পারি, সেজন্যে সে তার গাড়ির ক্যাসেটপ্লেয়ার ঠিক করেছে। মাঝে–মধ্যেই সে বাসায় চলে আসে, আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবার জন্যে।
বিনা পয়সায় ট্যাক্সি চড়ায়, না–কি টাকা নেয় ? টাকা নেয়। ট্যাক্সিড্রাইভার ছাড়া আরাে একজনকে কজা করেছি।
নাম জামাল। খামারের মালিক। গরু–ছাগল পুষে। পুকুরে মাছ চাষ করে। কাল সন্ধ্যায় আমাদের বাসায় চা খেতে এসেছিল। তার চোখের দৃষ্টি দেখে বুঝেছি, আমাকে তার অসম্ভব মনে ধরেছে। আমি খুবই অবাক হয়েছি।
অবাক হবার কী আছে? তুমি কি মনে ধরার মতাে মেয়ে না ?
যদিও সন্ধ্যা -(শেষ)-পর্ব)-হুমায়ূন আহমেদ
এক সময় হয়তাে ছিলাম, এখন নাই। আমার চেহারা কথাবার্তা সব কেমন জানি শুকনা হয়ে গেছে। দশটা–পাঁচটা চাকরি করি বলে হয়তাে এরকম হয়েছে।
শওকত জবাব দিল না। আনিকা কেমন যেন দুঃখী দুঃখী মুখ করে বসে আছে। তার মুখ দেখে মায়া লাগছে ।
আনিকা ছােট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তােমার ছেলে কবে যাবে ? পরশু। মন খারাপ?
শওকত জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়াল । আনিকাকে দেখে সে খানিকটা স্বস্তি বােধ করছে। ঘণ্টা দুই–তিন সময় তার আসলেই দরকার। পত্রিকা অফিসে যেতে হবে। ইলাসট্রেশনের কাজ করে দিয়ে আসতে হবে। দেরি হয়ে গেছে। মাসুম সাহেব এই দেরি সহজভাবে নেবেন বলে মনে হয় না। মেজাজ গরম মানুষ। হুট করে বলে বসতে পারেন আপনাকে আমাদের দরকার নেই। আপনি আপনার পথ দেখুন। আমরা আমাদের পথ দেখব। ইলাসট্রেশন হিসেবে। কাকের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং চালাচ্ছেন।
কাক–বক দিয়ে আর চলবে না। মাসুম। সাহেবের সঙ্গে দেখা করারও আগে ইমনের মা’র সঙ্গে দেখা করা দরকার। ছেলের জন্মদিনে উপস্থিত থাকার নিমন্ত্রণ। ইমন বলছে তার মা আসবে না। কিন্তু শওকতের ধারণা সে আসবে। অনেকদিন ছেলেকে দেখে নি। বিশেষ একটি দিনে ছেলের সঙ্গে থাকার সুযােগ সে নষ্ট করবে না। রেবেকা কঠিন মেয়ে, কিন্তু এত কঠিন না।
যদিও সন্ধ্যা -(শেষ)-পর্ব)-হুমায়ূন আহমেদ
ইমন খুবই ব্যস্ত দুই কচ্ছপের দৌড় প্রতিযােগিতার আয়ােজনে। আনিকা এই বিষয়ে তাকে সাহায্য করছে। মেঝেতে চক দিয়ে দু’টা লাইন টানা হয়েছে। কচ্ছপ দু’টিকে একসঙ্গে ছাড়া হচ্ছে। দুজনের একজন সােজাসুজি যাচ্ছে, অন্যজন শুরুতেই নব্বই ডিগ্রি টার্ন করছে।
ইমন এবং আনিকা দু’জন হাল ছাড়ার পাত্র না। তারা চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে। আনিকা শুকনা মরিচের গুঁড়া এনে কচ্ছপের দৌড়ের জায়গা ছাড়া অন্য সব দিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। এতে তেমন কোনাে লাভ হয় নি। শুকনা মরিচ ছড়ানাে জায়গায় কচ্ছপ যাচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু তারা দু‘জনই দৌড়ানাে বন্ধ করে দিয়েছে।
আনিকা বলল, দাঁড়াও, আমার মাথায় আরেকটা বুদ্ধি এসেছে। এই বুদ্ধিতে মনে হয় কাজ হবে।