যুগলাঙ্গুরীয়-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

যুগলাঙ্গুরীয়-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

প্রথম পরিচ্ছেদ

দুইজনে উদ্যানমধ্যে লতামণ্ডপতলে দাঁড়াইয়াছিলেন। তখন প্রাচীন নগর তাম্রলিপ্তের চরণ ধৌত করিয়া অনন্ত নীল সমুদ্র মৃদু মৃদু নিনাদ করিতেছিল।
তাম্রলিপ্ত নগরের প্রান্তভাগে, সমুদ্রতীরে এক বিচিত্র অট্টালিকা ছিল। তাহার নিকট একটি সুনির্ম্মিত বৃক্ষবাটিকা। বৃক্ষবাটিকার অধিকারী ধনদাস নামক একজন শ্রেষ্ঠী। শ্রেষ্ঠীর কন্যা হিরণ্ময়ী লতামণ্ডপে দাঁড়াইয়া এক যুবা পুরুষের সঙ্গে কথা কহিতেছিলেন।
হিরণ্ময়ী বিবাহের বয়স অতিক্রম করিয়াছিলেন। তিনি ঈপ্সিত স্বামীর কামনায় একাদশ বৎসরে আরম্ভ করিয়া ক্রমাগত পঞ্চ বৎসর, এই সমুদ্রতীরবাসিনী সাগরেশ্বরী নাম্ণী দেবীর পূজা করিয়াছিলেন, কিন্তু মনোরথ সফল হয় নাই। প্রাপ্তযৌবনা কুমারী কেন যে এই যুবার সঙ্গে একা কথা কহেন, তাহা সকলেই জানিত। হিরণ্ময়ী যখন চারি বৎসরের বালিকা, তখন এই যুবার বয়:ক্রম আট বৎসর। ইঁহার পিতা শচীসূত শ্রেষ্ঠী ধনদাসের প্রতিবাসী, এজন্য উভয়ে একত্র বাল্যক্রীড়া করিতেন। হয় শচীসূতের গৃহে, নয় ধনদাসের গৃহে, সর্ব্বদা একত্র সহবাস করিতেন। এক্ষণে যুবতীর বয়স ষোড়শ, যুবার বয়স বিংশতি বৎসর, তথাপি উভয়ের সেই বালসখিত্ব সম্বন্ধই ছিল। একটু মাত্র বিঘ্ন ঘটিয়াছিল। যথাবিহিত কালে উভয়ের পিতা, এই যুবক যুবতীর পরস্পরের সঙ্গে বিবাহসম্বন্ধ করিয়াছিলেন। বিবাহের দিন স্থির পর্য্যন্ত হইয়াছিল। অকস্মাৎ হিরণ্ময়ীর পিতা বলিলেন, “আমি বিবাহ দিব না |” সে অবধি হিরণ্ময়ী আর পুরন্দরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতেন না। অদ্য পুরন্দর অনেক বিনয় করিয়া, বিশেষ কথা আছে বলিয়া, তাঁহাকে ডাকিয়া আনিয়াছিলেন। লতামণ্ডপতলে আসিয়া হিরণ্ময়ী কহিল, “আমাকে কেন ডাকিয়া আনিলে? আমি এক্ষণে আর বালিকা নহি, এখন আর তোমার সঙ্গে এমত স্থানে একা সাক্ষাৎ করা ভাল দেখায় না। আর ডাকিলে আমি আসিব না |”
ষোল বৎসরের বালিকা বলিতেছে, “আমি আর বালিকা নহি” ইহা বড় মিষ্ট কথা। কিন্তু সে রস অনুভব করিবার লোক সেখানে কেহই ছিল না। পুরন্দরের বয়স বা মনের ভাব সেরূপ নহে।
পুরন্দর মণ্ডপবিলম্বিত লতা হইতে একটি পুষ্প ভাঙ্গিয়া লইয়া তাহা ছিন্ন করিতে করিতে বলিলেন, “আমি আর ডাকিব না। আমি দূর দেশে চলিলাম। তাই তোমাকে বলিয়া যাইতে আসিয়াছি |”
হি। দূরদেশে? কোথায়?
পু। সিংহলে।
হি। সিংহলে? সে কি? কেন সিংহলে যাইবে?
পু। কেন যাইব? আমরা শ্রেষ্ঠী–বাণিজ্যার্থ যাইব। বলিতে বলিতে পুরন্দরের চক্ষু ছল ছল করিয়া আসিল।
হিরণ্ময়ী বিমনা হইলেন। কোন কথা কহিলেন না, অনিমেষলোচনে সম্মুখবর্ত্তী সাগরতরঙ্গে সূর্য্যকিরণের ক্রীড়া দেখিতে লাগিলেন। প্রাত:কাল, মৃদুপবন বহিতেছে,-মৃদুপবনোত্থিত অতুঙ্গ তরঙ্গে বালারুণরশ্মি আরোহণ করিয়া কাঁপিতেছে–সাগরজলে তাহার অনন্ত উজ্জ্বল রেখা প্রসারিত হইয়াছে–শ্যামাঙ্গীর অঙ্গে রজতালঙ্কারবৎ ফেননিচয় শোভিতেছে, তীরে জলচর পক্ষিকুল শ্বেতরেখা সাজাইয়া বেড়াইতেছে। হিরণ্ময়ী সব দেখিলেন,-নীলজল দেখিলেন, তরঙ্গশিরে ফেনমালা দেখিলেন, সূর্য্যরশ্মির ক্রীড়া দেখিলেন,-দূরবর্ত্তী অর্ণবপোত দেখিলেন, নীলাম্বরে কৃষ্ণবিন্দুবৎ একটি পক্ষী উড়িতেছে, তাহাও দেখিলেন। শেষে ভূতলশায়ী একটি শুষ্ক কুসুমের প্রতি দৃষ্টি করিতে করিতে কহিলেন, “তুমি কেন যাবে–অন্যান্য বার তোমার পিতা যাইয়া থাকেন |”
পুরন্দর বলিল, “আমার পিতা বৃদ্ধ হইতেছেন। আমার এখন অর্থোপার্জ্জনের সময় হইয়াছে। আমি পিতার অনুমতি পাইয়াছি |”
হিরণ্ময়ী লতামণ্ডপের কাষ্ঠে ললাট রক্ষা করিলেন। পুরন্দর দেখিলেন, তাঁহার ললাট কুঞ্চিত হইতেছে, অধর স্ফুরিত হইতেছে, নাসিকারন্ধ্র স্ফীত হইতেছে। দেখিলেন যে, হিরণ্ময়ী কাঁদিয়া ফেলিলেন।
পুরন্দর মুখ ফিরাইলেন। তিনিও একবার আকাশ, পৃথিবী, নগর, সমুদ্র সকল দেখিলেন, কিন্তু কিছুতেই রহিল না–চক্ষুর জল গণ্ড বহিয়া পড়িল। পুরন্দর চক্ষু মুছিয়া বলিলেন, “এই কথা বলিবার জন্য আসিয়াছি। যেদিন তোমার পিতা বলিলেন, কিছুতেই আমার সঙ্গে তোমার বিবাহ দিবেন না, সেই দিন হইতেই আমি সিংহলে যাইবার কল্পনা স্থির করিয়াছিলাম। ইচ্ছা আছে যে, সিংহল হইতে ফিরিব না। যদি কখন তোমায় ভুলিতে পারি, তবেই ফিরিব। আমি অধিক কথা বলিতে জানি না, তুমিও অধিক কথা বুঝিতে পারিবে না। ইহা বুঝিতে পারিবে যে, আমার পক্ষে জগৎসংসার এক দিকে, তুমি এক দিকে হইলে, জগৎ তোমার তুল্য নহে |” এই বলিয়া পুরন্দর হঠাৎ পশ্চাৎ ফিরিয়া পাদচারণ করিয়া অন্য একটা বৃক্ষের পাতা ছিঁড়িলেন। অশ্রুবেগ কিঞ্চিৎ শমিত হইলে, ফিরিয়া আসিয়া আবার কহিলেন, “তুমি আমায় ভালবাস, তাহা জানি। কিন্তু যবে হউক, অন্যের পত্নী হইবে। অতএব তুমি আর আমায় মনে রাখিও না। তোমার সঙ্গে যেন এ জন্মে আমার আর সাক্ষাৎ না হয় |”
এই বলিয়া পুরন্দর বেগে প্রস্থান করিলেন। হিরণ্ময়ী বসিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। রোদন সংবরণ করিয়া একবার ভাবিলেন, “আমি যদি আজি মরি, তবে কি পুরন্দর সিংহলে যাইতে পারে? আমি কেন গলায় লতা বাঁধিয়া মরি না–কিম্বা সমুদ্রে ঝাঁপ দিই না?” আবার ভাবিলেন, “আমি যদি মরিলাম, তবে পুরন্দর সিংহলে যাক না যাক, তাতে আমার কি?” এই ভাবিয়া হিরণ্ময়ী আবার কাঁদিতে বসিল।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
কেন যে ধনদাস বলিয়াছিলেন যে, “আমি পুরন্দরের সঙ্গে হিরণের বিবাহ দিব না” তাহা কেহ জানিত না। তিনি তাহা কাহারও সাক্ষাতে প্রকাশ করেন নাই। জিজ্ঞাসা করিলে বলিতেন, “বিশেষ কারণ আছে |” হিরণ্ময়ীর অন্যান্য অনেক সম্বন্ধ আসিল–কিন্তু ধনদাস কোন সম্বন্ধেই সম্মত হইলেন না। বিবাহের কথামাত্রে কর্ণপাত করিতেন না। “কন্যা বড় হইল” বলিয়া গৃহিণী তিরস্কার করিতেন ; ধনদাস শুনিতেন না। কেবল বলিতেন, “গুরুদেব আসুন–তিনি আসিলে এ কথা হইবে |”
পুরন্দর সিংহলে গেলেন। তাঁহার সিংহল যাত্রার পর দুই বৎসর এইরূপে গেল। পুরন্দর ফিরিলেন না। হিরণ্ময়ীর কোন সম্বন্ধ হইল না। হিরণ অষ্টাদশ বৎসরের হইয়া উদ্যানমধ্যস্থ নবপল্লবিত চূতবৃক্ষের ন্যায় ধনবাসের গৃহ শোভা করিতে লাগিল।
হিরণ্ময়ী ইহাতে দু:খিত হয়েন নাই। বিবাহের কথা হইলে পুরন্দরকে মনে পড়িত ; তাঁহার সেই ফুল্লকুসুমমালামণ্ডিত কুঞ্চিতকৃষ্ণকুন্তলাবলীবেষ্টিত সহাস্য মুখমণ্ডলে মনে পড়িত ; তাঁহার সেই দ্বিরদশুভ্র স্কন্ধদেশে স্বর্ণপুষ্পশোভিত নীল উত্তরীয় মনে পড়িত ; পদ্মহস্তে হীরকাঙ্গুরীয়গুলি মনে পড়িত ; হিরণ্ময়ী কাঁদিতেন। পিতার আজ্ঞা হইলে যাহাকে তাহাকে বিবাহ করিতে হইত। কিন্তু সে জীবন্মৃত্যুবৎ হইত। তবে তাঁহার বিবাহোদ্যোগে পিতাকে অপ্রবৃত্ত দেখিয়া, আহ্লাদিত হউন বা না হউন, বিস্মিতা হইতেন। লোকে এত বয়স অবধি কন্যা অবিবাহিতা রাখে না–রাখিলেও তাহার সম্বন্ধ করে। তাঁহার পিতা সে কথায় কর্ণ পর্য্যন্ত দেন না কেন? এক দিন অকস্মাৎ এ বিষয়ের কিছু সন্ধান পাইলেন।
ধনদাস বাণিজ্যহেতু চীনদেশে নির্ম্মিত একটি বিচিত্র কৌটা পাইয়াছিলেন। কৌটা অতি বৃহৎ-ধনদাসের পত্নী তাহাতে অলঙ্কার রাখিতেন। ধনদাস কতকগুলিন নূতন অলঙ্কার প্রস্তুত করিয়া পত্নীকে উপহার দিলেন। শ্রেষ্ঠিপত্নী পুরাতন অলঙ্কারগুলিন কৌটাসমেত কন্যাকে দিলেন। অলঙ্কারগুলিন রাখা ঢাকা করিতে হিরণ্ময়ী দেখিলেন যে, তাহাতে একখানি ছিন্ন লিপির অর্দ্ধাবশেষ রহিয়াছে।
হিরণ্ময়ী পড়িতে জানিতেন। তাহাতে প্রথমেই নিজের নাম দেখিতে পাইয়া কৌতূহলাবিষ্ট হইলেন। পড়িয়া দেখিলেন যে, যে অর্দ্ধাংশ আছে, তাহাতে কোন অর্থবোধ হয় না। কে কাহাকে লিখিয়াছিল, তাহাও কিছুই বুঝা গেল না। কিন্তু তথাপি তাহা পড়িয়া হিরণ্ময়ীর মহাভীতিসঞ্চার হইল। ছিন্ন পত্রখণ্ড এইরূপ।

জ্যোতিষী গণনা করিয়া দেখিলা
হিরণ্ময়ী তুল্য সোণার পুত্তলি।
বাহ হইলে ভয়ানক বিপদ।
সর মুখ পরস্পরে।
হইতে পারে।

হিরণ্ময়ী কোন অজ্ঞাত বিপদ আশঙ্কা করিয়া অত্যন্ত ভীতা হইলেন। কাহাকে কিছু না বলিয়া পত্রখণ্ড তুলিয়া রাখিলেন।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

দুই বৎসরের পর আরও এক বৎসর গেল। তথাপি পুরন্দরের সিংহল হইতে আসার কোন সংবাদ পাওয়া গেল না। কিন্তু হিরণ্ময়ীর হৃদয়ে তাঁহার মূর্ত্তি পূর্ব্ববৎ উজ্জ্বল ছিল। তিনি মনে মনে বুঝিলেন যে, পুরন্দরও তাঁহাকে ভুলিতে পারেন নাই–নচেৎ এতদিন ফিরিতেন।
এইরূপে দুই আর একে তিন বৎসর গেলে, অকস্মাৎ এক দিন ধনদাস বলিলেন যে, “চল, সপরিবারে কাশী যাইব। গুরুদেবের নিকট হইতে তাঁহার শিষ্য আসিয়াছেন। গুরুদেব সেইখানে যাইতে অনুমতি করিয়াছেন। তথায় হিরণ্ময়ীর বিবাহ হইবে। সেইখানে তিনি পাত্র স্থির করিয়াছেন |”
ধনদাস, পত্নী ও কন্যাকে লইয়া কাশী যাত্রা করিলেন। উপযুক্ত কালে কাশীতে উপনীত হইলে পর, ধনদাসের গুরু আনন্দস্বামী আসিয়া সাক্ষাৎ করিলেন। এবং বিবাহের দিন স্থির করিয়া যথাশাস্ত্র উদ্যোগ করিতে বলিয়া গেলেন।
বিবাহের দিন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইল–এক প্রহর রাত্রে লগ্ন, তথাপি গৃহে যাহারা সচরাচর থাকে, তাহারা ভিন্ন আর কেহ নাই। প্রতিবাসীরাও কেহ উপস্থিত নাই। এ পর্য্যন্ত ধনদাস ভিন্ন গৃহস্থ কেহও জানে না যে, কে পাত্র–কোথাকার পাত্র। তবে সকলেই জানিত যে, যেখানে আনন্দস্বামী বিবাহের সম্বন্ধ করিয়াছেন, সেখানে কখন অপাত্র স্থির করেন নাই। তিনি যে কেন পাত্রের পরিচয় ব্যক্ত করিলেন না, তাহা তিনিই জানেন–তাঁহার মনের কথা বুঝিবে কে? একটি গৃহে পুরোহিত সম্প্রদানের উদ্যোগাদি করিয়া একাকী বসিয়া আছেন। বাহিরে ধনদাস একাকী বরের প্রতীক্ষা করিতেছেন। অন্ত:পুরে কন্যাসজ্জা করিয়া হিরণ্ময়ী বসিয়া আছেন–আর কোথাও কেহ নাই। হিরণ্ময়ী মনে মনে ভাবিতেছেন -“এ কি রহস্য! কিন্তু পুরন্দরের সঙ্গে যদি বিবাহ না হইল-তবে যে হয় তাহার সঙ্গে বিবাহ হউক-সে আমার স্বামী হইবে না |”
এমন সময়ে ধনদাস কন্যাকে ডাকিতে আসিলেন। কিন্তু তাঁহাকে সম্প্রদানের স্থানে লইয়া যাইবার পূর্ব্বে, বস্ত্রের দ্বারা তাঁহার দুই চক্ষু: দৃঢ়তর বাঁধিলেন। হিরণ্ময়ী কহিলেন, “এ কি পিতা?” ধনদাস কহিলেন, “গুরুদেবের আজ্ঞা। তুমিও আমার আজ্ঞামত কার্য্য কর। মন্ত্রগুলি মনে মনে বলিও |” শুনিয়া হিরণ্ময়ী কোন কথা কহিলেন না। ধনদাস দৃষ্টিহীনা কন্যার হস্ত ধরিয়া সম্প্রদানের স্থানে লইয়া গেলেন।
হিরণ্ময়ী তথায় উপনীত হইয়া যদি কিছু দেখিতে পাইতেন, তাহা হইলে দেখিতেন যে, পাত্রও তাঁহার ন্যায় আবৃতনয়ন। এইরূপে বিবাহ হইল। সেই স্থানে গুরু পুরোহিত এবং কন্যাকর্ত্তা ভিন্ন আর কেহ ছিল না। বর-কন্যা কেহ কাহাকে দেখিলেন না। শুভদৃষ্টি হইল না।
সম্প্রদানাস্তে আনন্দস্বামী বর-কন্যাকে কহিলেন যে, “তোমাদিগের বিবাহ হইল, কিন্তু তোমরা পরস্পরকে দেখিলে না। কন্যার কুমারী নাম ঘুচানই এই বিবাহের উদ্দেশ্য ; ইহজন্মে কখন তোমাদের পরস্পরের সাক্ষাৎ হইবে কি না, বলিতে পারি না। যদি হয়, তবে কেহ কাহাকে চিনিতে পারিবে না। চিনিবার আমি একটি উপায় করিয়া দিতেছি। আমার হাতের দুইটি অঙ্গুরীয় আছে। দুইটি ঠিক এক প্রকার। অঙ্গুরীয় যে প্রস্তরে নির্ম্মিত, তাহা প্রায় পাওয়া যায় না। এবং অঙ্গুরীয়ের ভিতরের পৃষ্ঠে একটি ময়ূর অঙ্কিত আছে। ইহার একটি বরকে, একটি কন্যাকে দিলাম। এরূপ অঙ্গুরীয় অন্য কেহ পাইবে না-বিশেষ এই ময়ূরের চিত্র অননুকরণীয়। ইহা আমার স্বহস্তখোদিত। যদি কন্যা কোন পুরুষের হস্তে এইরূপ অঙ্গুরীয় দেখেন, তবে জানিবেন যে, সেই পুরুষ তাঁহার স্বামী। যদি বর কখন কোন স্ত্রীলোকের হস্তে এইরূপ অঙ্গুরীয় দেখেন, তবে জানিবেন যে, তিনিই তাঁহার পত্নী। তোমরা কেহ এ অঙ্গুরীয় হারাইও না, বা কাহাকে দিও না, অন্নাভাব হইলেও বিক্রয় করিও না। কিন্তু ইহাও আজ্ঞা করিতেছি যে, অদ্য হইতে পঞ্চ বৎসর মধ্যে কদাচ এই অঙ্গুরীয় পরিও না। অদ্য আষাঢ় মাসের শুক্লা পঞ্চমী, রাত্রি একাদশ দণ্ড হইয়াছে, ইহার পর পঞ্চম আষাঢ়ের শুক্লা পঞ্চমীর একাদশ দণ্ড রাত্রি পর্য্যন্ত অঙ্গুরীয় ব্যবহার নিষেধ করিলাম। আমার নিষেধ অবহেলা করিলে গুরুতর অমঙ্গল হইবে |”
এই বলিয়া আনন্দস্বামী বিদায় হইলেন। ধনদাস কন্যার চক্ষুর বন্ধন মোচন করিলেন। হিরণ্ময়ী চক্ষু চাহিয়া দেখিলেন, গৃহমধ্যে কেবল পিতা ও পুরোহিত আছেন-তাঁহার স্বামী নাই। তাঁহার বিবাহরাত্রি একাই যাপন করিলেন।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

বিবাহান্তে ধনদাস স্ত্রী ও কন্যাকে লইয়া দেশে ফিরিয়া আসিলেন। আরও চারি বৎসর অতিবাহিত হইল। পুরন্দর ফিরিয়া আসিলেন না—হিরণ্ময়ীর পক্ষে এখন ফিরিলেই কি, না ফিরিলেই কি?
পুরন্দর যে এই সাত বৎসরে ফিরিল না, ইহা ভাবিয়া হিরণ্ময়ী দু:খিতা হইলেন। মনে ভাবিলেন, “তিনি যে আজিও আমায় ভুলিতে পারেন নাই বলিয়া আসিলেন না, এমত কদাচ সম্ভবে না। তিনি জীবিত আছেন কি না সংশয়। তাঁহার দেখার আমি কামনা করি না, এখন আমি অন্যের স্ত্রী ; কিন্তু আমার বাল্যকালের সুহৃৎ বাঁচিয়া থাকুন, এ কামনা কেন না করিব?”
ধনদাসেরও কোন কারণে না কোন কারণে চিন্তিত ভাব প্রকাশ হইতে লাগিল, ক্রমে চিন্তা গুরুতর হইয়া শেষে দারুণ রোগে পরিণত হইল। তাহাতে তাঁহার মৃত্যু হইল। ধনদাসের পত্নী অনুমৃতা হইলেন। হিরণ্ময়ীর আর কেহ ছিল না, এজন্য হিরণ্ময়ী মাতার চরণ ধারণ করিয়া অনেক রোদন করিয়া কহিলেন যে, তুমি মরিও না। কিন্তু শ্রেষ্ঠিপত্নী শুনিলেন না। তখন হিরণ্ময়ী পৃথিবীতে একাকিনী হইলেন।
মৃত্যুকালে হিরণ্ময়ীর মাতা তাঁহাকে বুঝাইয়াছিলেন যে, “বাছা, তোমার কিসের ভাবনা? তোমার একজন স্বামী অবশ্য আছেন। নিয়মিত কাল অতীত হইলে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইলেও হইতে পারে। না হয়, তুমিও নিতান্ত বালিকা নহে। বিশেষ পৃথিবীতে যে সহায় প্রধান—ধন–তাহা তোমার অতুল পরিমাণে রহিল |”
কিন্তু সে আশা বিফল হইল–ধনদাসের মৃত্যুর পর দেখা গেল যে, তিনি কিছুই রাখিয়া যান নাই। অলঙ্কার অট্টালিকা এবং গার্হস্থ্য মমমম ভিন্ন আর কিছুই নাই। অনুসন্ধানে হিরণ্ময়ী জানিলেন যে, ধনদাস কয়েক বৎসর হইতে বাণিজ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া আসিতেছিলেন। তিনি তাহা কাহাকেও না বলিয়া শোধনের চেষ্টায় ছিলেন। ইহাই তাঁহার চিন্তার কারণ। শেষে শোধনও অসাধ্য হইল। ধনদাস মনের ক্লেশে পীড়িত হইয়া পরলোকপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন।
এই সকল সংবাদ শুনিয়া অপরাপর শ্রেষ্ঠীরা আসিয়া হিরণ্ময়ীকে কহিল যে, তোমার পিতা আমাদের ঋণগ্রস্ত হইয়া মরিয়াছেন। আমাদিগের ঋণ পরিশোধ কর। শ্রেষ্ঠিকন্যা অনুসন্ধান করিয়া জানিলেন যে, তাহাদের কথা যথার্থ। তখন হিরণ্ময়ী সর্ব্বস্ব বিক্রয় করিয়া তাহাদের ঋণ পরিশোধ করিলেন। বাসগৃহ পর্য্যন্ত বিক্রয় করিলেন।
এখন হিরণ্ময়ী অন্নবস্ত্রের দু:খে দু:খিনী হইয়া নগরপ্রান্তে এক কুটীরমধ্যে একা বাস করিতে লাগিলেন। কেবল মাত্র এক সহায় পরম হিতৈষী আনন্দস্বামী, কিন্তু তিনি তখন দূরদেশে ছিলেন। হিরণ্ময়ীর এমন একটি লোক ছিল না যে, আনন্দস্বামীর নিকট প্রেরণ করেন।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

হিরণ্ময়ী যুবতী এবং সুন্দরী—একাকিনী এক গৃহে শয়ন করা ভাল নহে। আপদ্লও আছে–কলঙ্কও আছে। অমলা নামে এক গোপকন্যা হিরণ্ময়ীর প্রতিবাসিনী ছিল। সে বিধবা-তাহার একটি কিশোরবয়স্ক পুত্র এবং কয়েকটি কন্যা। তাহার যৌবনকাল অতীত হইয়াছিল। সচ্চরিত্রা বলিয়া তাহার খ্যাতি ছিল। হিরণ্ময়ী রাত্রিতে আসিয়া তাহার গৃহে শয়ন করিতেন।
এক দিন হিরণ্ময়ী অমলার গৃহে শয়ন করিতে আসিলে পর, অমলা তাহাকে কহিল, “সংবাদ শুনিয়াছ, পুরন্দর শ্রেষ্ঠী না কি আট বৎসরের পর নগরে ফিরিয়া আসিয়াছে |” শুনিয়া হিরণ্ময়ী মুখ ফিরাইলেন—চক্ষুর জল অমলা না দেখিতে পায়। পৃথিবীর সঙ্গে হিরণ্ময়ীর শেষ সম্বন্ধ ঘুচিল। পুরন্দর তাঁহাকে ভুলিয়া গিয়াছে। নচেৎ ফিরিত না। পুরন্দর এক্ষণে মনে রাখুব বা ভুলুক, তাঁহার লাভ বা ক্ষতি কি? তথাপি যাহার স্নেহের কথা ভাবিয়া যাবজ্জীবন কাটাইয়াছেন, সে ভুলিয়াছে ভাবিতে হিরণ্ময়ীর মনে কষ্ট হইল। হিরণ্ময়ী একবার ভাবিলেন—“ভুলেন নাই—কত কাল আমার জন্য বিদেশে থাকিবেন? বিশেষ তাহাতে তাঁহার পিতার মৃত্যু হইয়াছে—আর দেশে না আসিলে চলিবে কেন?” আবার ভাবিলেন, আমি কুলটা সন্দেহ নাই—নহিলে পুরন্দরের কথা মনে করি কেন?”
অমলা কহিল, “পুরন্দরকে কি তোমার মনে পড়িতেছে না? পুরন্দর শচীসূত শেঠির ছেলে|”
হি। চিনি।
অ। তা সে ফিরে এসেছে—কত নৌকা যে ধন এনেছে, তাহা গুণে সংখ্যা করা যায় না। এত ধন না কি এ তামলিপে কেহ কখন দেখে নাই।
হিরণ্ময়ীর হৃদয়ে রক্ত একটু খর বহিল। তাঁহার দারিদ্র্যদশা মনে পড়িল, পূর্ব্বসম্বন্ধও মনে পড়িল। দারিদ্র্যের জ্বালা বড় জ্বালা। তাহার পরিবর্ত্তে এই অতুল ধনরাশি হিরণ্ময়ীর হইতে পারিত, ইহা ভাবিয়া যাহার খর রক্ত না বহে, এমন স্ত্রীলোক অতি অল্প আছে। হিরণ্ময়ী ক্ষণেক কাল অন্যমনে থাকিয়া পরে অন্য প্রসঙ্গ তুলিল। শেষ শয়নকালে জিজ্ঞাসা করিল, “অমলে, সেই শ্রেষ্ঠিপুত্রের বিবাহ হইয়াছে?”
অমলা কহিল, “না, বিবাহ হয় নাই |”
হরিণ্ময়ীর ইন্দ্রিয় সকল অবশ হইল। সে রাত্রিতে আর কোন কথা হইল না।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

পরে একদিন অমলা হাসিমুখে হিরণ্ময়ীর নিকটে আসিয়া মধুর ভর্ৎসনা করিয়া কহিল, “হাঁ গা বাছা, তোমার কি এমনই ধর্ম্ম?”
হিরণ্ময়ী কহিল, “কি করিয়াছি?”
অম। আমার কাছে এতদিন তা বলিতে নাই?
হি। কি বলি নাই?
অম। পুরন্দর শেঠির সঙ্গে তোমার এত আত্মীয়তা!
হিরণ্ময়ী ঈষল্লজ্জিতা হইলেন, বলিলেন, “তিনি বাল্যকালে আমার প্রতিবাসী ছিলেন—তার বলিব কি?”
অম। শুধু প্রতিবাসী? দেখ দেখি কি এনেছি!
এই বলিয়া অমলা একটি কৌটা বাহির করিল। কৌটা খুলিয়া তাহার মধ্য হইতে অপূর্ব্বদর্শন, মহাপ্রভাযুক্ত, মহামূল্য হীরার হার বাহির করিয়া হিরণ্ময়ীকে দেখাইল। শ্রেষ্ঠিকন্যা হীরা চিনিত-বিস্মিতা হইয়া কহিল, “এ যে মহামূল্য—এ কোথায় পাইলে?”
অম। ইহা তোমাকে পুরন্দর পাঠাইয়া দিয়াছে। তুমি আমার গৃহে থাক শুনিয়া আমাকে ডাকিয়া পাঠাইয়া ইহা তোমাকে দিতে বলিয়াছে।
হিরণ্ময়ী ভাবিয়া দেখিল, এই হার গ্রহণ করিলে, চিরকাল জন্য দারিদ্র্য মোচন হয়। ধনদাসের আদরের কন্যা আর অন্নবস্ত্রের কষ্ট সহিতে পারিতেছিল না। অতএব হিরণ্ময়ী ক্ষণেক বিমনা হইল। পরে দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিল, “অমলা, তুমি বণিক্্‍কে কহিও যে, আমি ইহা গ্রহণ করিব না |”
অমলা বিস্মিতা হইল। বলিল, “সে কি? তুমি কি পাগল, না আমার কথায় বিশ্বাস করিতেছ না?”
হি। আমি তোমার কথায় বিশ্বাস করিতেছি—আর পাগলও নই। আমি উহা গ্রহণ করিব না।
অমলা অনেক তিরস্কার করিতে লাগিল। হিরণ্ময়ী কিছুতেই গ্রহণ করিলেন না। তখন অমলা হার লইয়া রাজা মদনদেবের নিকটে গেল। রাজাকে প্রণাম করিয়া হার উপহার দিল। বলিল, “এ হার আপনাকে গ্রহণ করিতে হইবে। এ হার আপনারই যোগ্য |” রাজা হার লইয়া অমলাকে যথেষ্ট অর্থ দিলেন। হিরণ্ময়ী ইহার কিছুই জানিল না।
ইহার কিছুদিন পরে পুরন্দরের একজন পরিচারিকা হিরণ্ময়ীর নিকটে আসিল। সে কহিল, “আমার প্রভু বলিয়া পাঠাইলেন যে, আপনি যে পর্ণকুটীরে বাস করেন, ইহা তাঁহার সহ্য হয় না। আপনি তাঁহার বাল্যকালের সখী; আপনার গৃহ তাঁহার গৃহ একই। তিনি এমন বলেন না যে, আপনি তাঁহার গৃহে গিয়া বাস করুন। আপনার পিতৃগৃহ তিনি ধনদাসের মহাজনের নিকট ক্রয় করিয়াছেন। তাহা আপনাকে দান করিতেছেন। আপনি গিয়া সেইখানে বাস করুন, ইহাই তাঁহার ভিক্ষা |”
হিরণ্ময়ী দারিদ্র্যজন্য যত দু:খভোগ করিতেছিলেন, তন্মধ্যে পিতৃভবন হইতে নির্ব্বাসনই তাঁহার সর্ব্বাপেক্ষা গুরুতর বোধ হইত। যেখানে বাল্যক্রীড়া করিয়াছিলেন, যেখানে পিতা মাতার সহবাস করিতেন, যেখানে তাঁহাদিগের মৃত্যু দেখিয়াছেন, সেখানে যে আর বাস করিতে পান না, এ কষ্ট গুরুতর বোধ হইত। সেই ভবনের কথায় তাঁহার চক্ষু জল আসিল। তিনি পরিচারিকাকে কহিলেন, “এ দান আমার গ্রহণ করা উচিত নহে—কিন্তু আমি এ লোভ সংবরণ করিতে পারিলাম না। তোমার প্রভুর সর্ব্বপ্রকার মঙ্গল হউক!”
পরিচারিকা প্রণাম করিয়া বিদায় হইল। অমলা উপস্থিতা ছিল। হিরণ্ময়ী তাহাকে বলিলেন, “অমলা, তথায় আমার একা বাস করা যাইতে পারে না। তুমিও তথায় বাস করিবে চল |”
অমলা স্বীকৃতা হইল। উভয়ে গিয়া ধনদাসের গৃহে বাস করিতে লাগিলেন।
তথাপি অমলাকে সর্ব্বদা পুরন্দরের গৃহে যাইতে হিরণ্ময়ী এক দিন নিষেধ করিলেন। অমলা আর যাইত না।
পিতৃগৃহে গমনাবধি হিরণ্ময়ী একটা বিষয়ে বড় বিস্মিতা হইলেন। একদিন অমলা কহিল, “তুমি সংসারনির্ব্বাহের জন্য ব্যস্ত হইও না, বা শারীরিক পরিশ্রম করিও না। রাজবাড়ী আমার কার্য্য হইয়াছে—আর এখন অর্থের অভাব নাই। অতএব আমি সংসার চালাইব—তুমি সংসারে কর্ত্রী হইয়া থাক |” হিরণ্ময়ী দেখিলেন, অমলার অর্থের বিলক্ষণ প্রাচুর্য্য। মনে মনে নানা প্রকার সন্দিহান হইলেন।

সপ্তম পরিচ্ছেদ

বিবাহের পর পঞ্চমাষাঢ়ের শুক্লা পঞ্চমী আসিয়া উপস্থিত হইল। হিরণ্ময়ী এ কথা স্মরণ করিয়া সন্ধ্যাকালে বিমনা হইয়া বসিয়াছিলেন। ভাবিতেছিলেন, “গুরুদেবের আজ্ঞানুসারে আমি কালি হইতে অঙ্গুরীয়টি পরিতে পারি। কিন্তু পরিব কি? পরিয়া আমার কি লাভ? হয়ত স্বামী পাইব, কিন্তু স্বামী পাইবার আমার বাসনা নাই। অথবা চিরকালের জন্য কেনই বা পরের মূর্ত্তি মনে আঁকিয়া রাখি? এ দুরন্ত হৃদয়কে শাসিত করাই উচিত। নহিলে ধর্ম্মে পতিত হইতেছি |”
এমন সময়ে অমলা বিস্ময়বিহ্বলা হইয়া আসিয়া কহিল, “কি সর্ব্বনাশ! আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। না জানি কি হইবে!”
হি। কি হইয়াছে?
অ। রাজপুরী হইতে তোমার জন্য শিবিকা লইয়া দাস-দাসী আসিয়াছে। তোমাকে লইয়া যাইবে।
হি। তুমি পাগল হইয়াছ। আমকে রাজবাড়ী হইতে লইতে আসিবে কেন?
এমন সময়ে রাজদূতী আসিয়া প্রণাম করিল এবং কহিল যে, “রাজাধিরাজ পরম ভট্টারক শ্রীমদনদেবের আজ্ঞা যে, হিরণ্ময়ী এই মুহূর্ত্তেই শিবিকারোহণে রাজাবরোধ যাইবেন|”
হিরণ্ময়ী বিস্মিতা হইলেন। কিন্তু অস্বীকার করিতে পারিলেন না। রাজাজ্ঞা অলঙ্ঘ্য। বিশেষ রাজা মদনদেবের অবরোধে যাইতে কোন শঙ্কা নাই। রাজা পরম ধার্ম্মিক এবং জিতেন্দ্রিয় বলিয়া খ্যাত। তাঁহার প্রতাপে কোন রাজপুরুষও কোন স্ত্রীলোকের উপর কোন অত্যাচার করিতে পারে না।
হিরণ্ময়ী অমলাকে বলিলেন, “অমলে, আমি রাজদর্শনে যাইতে সম্মতা। তুমি সঙ্গে চল |”
অমলা স্বীকৃতা হইল।
তৎসমভিব্যাহারে শিবিকারোহণে হিরণ্ময়ী রাজাবরোধমধ্যে প্রবিষ্টা হইলেন। প্রতিহারী রাজাকে নিবেদন করিল যে, শ্রেষ্ঠিকন্যা আসিয়াছে। রাজাজ্ঞা পাইয়া প্রতিহারী একা হিরণ্ময়ীকে রাজসমক্ষে লইয়া আসিল। অমলা বাহিরে রহিল।

অষ্টম পরিচ্ছেদ

হিরণ্ময়ী রাজাকে দেখিয়া বিস্মিতা হইলেন। রাজা দীর্ঘাকৃতি পুরুষ, কবাটকক্ষ; দীর্ঘহস্ত ; অতি সুগঠিত আকৃতি ; ললাট প্রশস্ত ; বিস্ফারিত, আয়ত চক্ষু ; শান্ত মূর্ত্তি—এরূপ সুন্দর পুরুষ কদাচিৎ স্ত্রীলোকের নয়নপথে পড়ে। রাজাও শ্রেষ্ঠিকন্যাকে দেখিয়া জানিলেন যে, রাজাবরোধেও এরূপ সুন্দরী দুর্লভ।
রাজা কহিলেন, “তুমি হিরণ্ময়ী?”
হিরণ্ময়ী বলিলেন, “আমি আপনার দাসী |”
রাজা কহিলেন, “কেন তোমাকে ডাকাইয়াছি, তাহা শুন। তোমার বিবাহের কথা মনে পড়ে?”
হি। পড়ে।
রাজা। সেই রাত্রে আনন্দস্বামী তোমাকে যে অঙ্গুরীয় দিয়াছিলেন, তাহা তোমার কাছে আছে?
হি। মহারাজ! সে অঙ্গুরীয় আছে। কিন্তু সে সকল অতি গুহ্য বৃত্তান্ত, কি প্রকারে আপনি তাহা অবগত হইলেন?
রাজা তাহার কোন উত্তর না দিয়া কহিলেন, “সে অঙ্গুরীয় কোথায় আছে? আমাকে দেখাও |”
হিরণ্ময়ী বলিলেন, “উহা আমি গৃহে রাখিয়া আসিয়াছি। পঞ্চ বৎসর পরিপূর্ণ হইতে আরও কয়েক দণ্ড বিলম্ব আছে—অতএব তাহা পরিতে আনন্দস্বামীর যে নিষেধ ছিল—তাহা এখনও
আছে |”
রাজা। ভালই—কিন্তু সেই অঙ্গুরীয়ের অনুরূপ দ্বিতীয় যে অঙ্গুরীয় তোমার স্বামীকে আনন্দস্বামী দিয়াছিলেন, তাহা দেখিলে চিনিতে পারিবে?
হি। উভয় অঙ্গুরীয় একই রূপ ; সুতরাং দেখিলে চিনিতে পারিব।
তখন প্রতিহারী রাজাজ্ঞা প্রাপ্ত হইয়া এক সুবর্ণের কৌটা আনিল। রাজা তাহার মধ্য হইতে একটি অঙ্গুরীয় লইয়া বলিলেন, “দেখ, এই অঙ্গুরীয় কাহার?”
হিরণ্ময়ী অঙ্গুরীয় প্রদীপালোকে বিলক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন, “দেব! এই আমার স্বামীর অঙ্গুরীয় বটে, কিন্তু আপনি ইহা কোথায় পাইলেন?” পরে কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন, “দেব! ইহাতে জানিলাম যে, আমি বিধবা হইয়াছি। স্বজনহীন মৃতের ধন আপনার হস্তগত হইয়াছে। নহিলে তিনি জীবিতাবস্থায় ইহা ত্যাগ করিবার সম্ভাবনা ছিল না |”
রাজা হাসিয়া বলিলেন, “আমার কথায় বিশ্বাস কর, তুমি বিধবা নহ |”
হি। তবে আমার স্বামী আমার অপেক্ষাও দরিদ্র। ধনলোভে ইহা বিক্রয় করিয়াছেন।
রা। তোমার স্বামী ধনী ব্যক্তি।
হি। তবে আপনি বলে ছলে কৌশলে তাঁহার নিকট ইহা অপহরণ করিয়াছেন।
রাজা এই দু:সাহসিক কথা শুনিয়া বিস্মিত হইলেন। বলিলেন, “তোমার বড় সাহস! রাজা মদনদেব চোর, ইহা আর কেহ বলে না |”
হি। নচেৎ আপনি এ অঙ্গুরীয় কোথায় পাইলেন?
রা। আনন্দস্বামী তোমার বিবাহের রাত্রে ইহা আমার অঙ্গুলিতে পরাইয়া দিয়াছেন।
হিরণ্ময়ী তখন লজ্জায় অধোমুখী হইয়া কহিলেন, আর্য্যপুত্র! আমার অপরাধ ক্ষমা করুন—আমি চপলা, না জানিয়া কটু কথা বলিয়াছি।

নবম পরিচ্ছেদ

হিরণ্ময়ী রাজমহিষী, ইহা শুনিয়া হিরণ্ময়ী অত্যন্ত বিস্মিতা হইলেন। কিন্তু কিছুমাত্র আহ্লাদিত হইলেন না। বরং বিষণ্ণা হইলেন। ভাবিতে লাগিলেন যে, “আমি এত দিন পুরন্দরকে পাই নাই বটে, কিন্তু পরপত্নীত্বের যন্ত্রণাভোগ করি নাই। এক্ষণ হইতে আমার সে যন্ত্রণা আরম্ভ হইল। আর আমি হৃদয়মধ্যে পুরন্দরের পত্নী—কি প্রকারে অন্যানুরাগিণী হইয়া এই মহাত্মার গৃহ কলঙ্কিত করিব?” হিরণ্ময়ী এইরূপ ভাবিতেছিলেন, এমত সময়ে রাজা বলিলেন, “হিরণ্ময়ি! তুমি আমার মহিষী বটে, কিন্তু তোমাকে গ্রহণ করিবার পূর্ব্বে আমার কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা আছে। তুমি বিনা মূল্যে পুরন্দরের গৃহে বাস কর কেন?”
হিরণ্ময়ী অধোবদন হইলেন। রাজা পুনরপি জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার দাসী অমলা সর্ব্বদা পুরন্দরের গৃহে যাতায়াত করে কেন?”
হিরণ্ময়ী আরও লজ্জাবনতমুখী হইয়া রহিলেন; ভাবিতেছিলেন, “রাজা মদনদেব কি সর্ব্বজ্ঞ?”
তখন রাজা কহিলেন, “আর একটা গুরুতর কথা আছে। তুমি পরনারী হইয়া পুরন্দরপ্রদত্ত হীরকহার গ্রহণ করিয়াছিলে কেন?”
এবার হিরণ্ময়ী কথা কহিলেন। বলিলেন, “আর্য্যপুত্র, জানিলাম আপনি সর্ব্বজ্ঞ নহেন। হীরকহার আমি ফিরাইয়া দিয়াছি |”
রাজা। তুমি সেই হার আমার নিকট বিক্রয় করিয়াছ। এই দেখ সেই হার।
এই বলিয়া রাজা কৌটার মধ্য হইতে হার বাহির করিয়া দেখাইলেন। হিরণ্ময়ী হীরকহার চিনিতে পারিয়া বিস্মিতা হইলেন। কহিলেন, “আর্য্যপুত্র, এ হার কি আমি স্বয়ং আসিয়া আপনার কাছে বিক্রয় করিয়াছি?”
রাজা। না, তোমার দাসী বা দূতী অমলা আসিয়া বিক্রয় করিয়াছে। তাহাকে ডাকাইব?
হিরণ্ময়ীর অমর্ষান্বিত বদনমণ্ডলে একটু হাসি দেখা দিল। বলিলেন, “আর্য্যপুত্র! অপরাধ ক্ষমা করুন। অমলাকে ডাকাইতে হইবে না—আমি এ বিক্রয় স্বীকার করিতেছি |”
এবার রাজা বিস্মিত হইলেন। বলিলেন, “স্ত্রীলোকের চরিত্র অভাবনীয় তুমি পরের পত্নী হইয়া পুরন্দরের নিকট কেন এ হার গ্রহণ করিলে?”
হি। প্রণয়োপহার বলিয়া গ্রহণ করিয়াছি।
রাজা আরও বিস্মিত হইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে কি? কি প্রকারে প্রণয়োপহার?”
হি। আমি কুলটা। মহারাজ! আমি আপনার গ্রহণের যোগ্যা নহি। আমি প্রণাম করিতেছি, আমাকে বিদায় দিন। আমার সঙ্গে বিবাহ বিস্মৃত হউন।
হিরণ্ময়ী রাজাকে প্রণাম করিয়া গমনোদ্যত হইয়াছেন, এমন সময়ে রাজার বিস্ময়বিকাশক মুখকান্তি অকস্মাৎ প্রফুল্ল হইল। তিনি উচ্চৈর্হাস্য করিয়া উঠিলেন। হিরণ্ময়ী ফিরিল।
রাজা কহিলেন, “হিরণ্ময়ি! তুমিই জিতিলে,—আমি হারিলাম। তুমি কুলটা নহ, আম তোমার স্বামী নহি। যাইও না |”
হি। মহারাজ! তবে এ কাণ্ডটা কি, আমাকে বুঝাইয়া বলুন। আমি অতি সামান্যা স্ত্রী- আমার সঙ্গে আপনার তুল্য গম্ভীরপ্রকৃতি রাজাধিরাজের রহস্য সম্ভবে না।
রাজা হাস্যত্যাগ না করিয়া বলিলেন, “আমার ন্যায় রাজারই এরূপ রহস্য সম্ভবে। ছয় বৎসর হইল, তুমি একখানি পত্রার্দ্ধ অলঙ্কারমধ্যে পাইয়াছিলে? তাহা কি আছে?”
হি। মহারাজ! আপনি সর্ব্বজ্ঞই বটে। পত্রার্দ্ধ আমার গৃহে আছে।
রা। তুমি শিবিকারোহণে পুনশ্চ গৃহে গিয়া সেই পত্রার্দ্ধ লইয়া আইস। তুমি আসিলে আমি সকল কথা বলিব।

দশম পরিচ্ছেদ

হিরণ্ময়ী রাজার আজ্ঞায় শিবিকারোহণে স্বগৃহে প্রত্যাগমন করিলেন, এবং তথা হইতে সেই পূর্ব্ববর্ণিত পত্রার্দ্ধ লইয়া পুনশ্চ রাজসন্নিধানে আসিলেন। রাজা সেই পত্রার্দ্ধ দেখিয়া, আর একখানি পত্রার্দ্ধ কৌটা হইতে বাহির করিয়া হিরণ্ময়ীকে দিলেন। বলিলেন, “উভয় অর্দ্ধকে মিলিত কর |” হিরণ্ময়ী উভয়ার্দ্ধ মিলিত করিয়া দেখিলেন, মিলিল। রাজা কহিলেন, “উভয়ার্দ্ধ একত্রিত করিয়া পাঠ কর |” তখন হিণ্ময়ী নিম্নলিখিত মত পাঠ করিলেন।
“(জ্যোতিষী গণনা করিয়া দেখিলাম) যে, তুমি যে কল্পনা করিয়াছ, তাহা কর্ত্তব্য নহে। (হিরণ্ময়ী তুল্য সোণার পুত্তলিকে) কখন চিরবৈধব্যে নিক্ষিপ্ত করা যাইতে পারে না। তাহার বিবাহ হইলে ভয়ানক বিপদ।) তাহার চিরবৈধব্য ঘটিবে গণনা দ্বারা জানিয়াছি। তবে পঞ্চ বৎসর (পর্য্যন্ত পরস্পরে) যদি দম্পতি মুখদর্শন না করে, তবে এই গ্রহ হইতে যাহাতে নিষ্কৃতি (হইতে পারে) তাহার বিধান আমি করিতে পারি |”
পাঠ সমাপন হইলে, রাজা কহিলেন, “এই লিপি আনন্দস্বামী তোমার পিতাকে লিখিয়াছিলেন |”
হি। তাহা এখন বুঝিতে পারিতেছি। কেন বা আমাদিগের বিবাহকালে নয়নাবৃত হইয়াছিল-কেনই বা গোপনে সেই অদ্ভুত বিবাহ হইয়াছিল-কেনই বা পঞ্চ বৎসর অঙ্গুরীয় ব্যবহার নিষিদ্ধ হইয়াছে, তাহা বুঝিতে পারিতেছি। কিন্তু আর ত কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।
রাজা। আর ত অবশ্য বুঝিয়াছ যে, এই পত্র পাইয়াই তোমার পিতা পুরন্দরের সহিত সম্বন্ধ রহিত করিলেন। পুরন্দর সেই দু:খে সিংহলে গেল।
এ দিকে আনন্দস্বামী পাত্রানুসন্ধান করিয়া একটি পাত্র স্থির করিলেন। পাত্রের কোষ্ঠী গণনা করিয়া জানিলেন যে, পাত্রটি অশীতি বৎসর পরমায়ু। তবে অষ্টাবিংশতি বৎসর বয়স অতীত হইবার পূর্ব্বে মৃত্যুর এক সম্ভাবনা ছিল। গণিয়া দেখিলেন যে, ঐ বয়স অতীত হইবার পূর্ব্বে এবং বিবাহের পঞ্চবৎসরমধ্যে পত্নীশয্যায় শয়ন করিয়া তাঁহার প্রাণত্যাগ করিবার সম্ভাবনা। কিন্তু যদি কোন রূপে পঞ্চ বৎসর জীবিত থাকেন, তবে দীর্ঘজীবী হইবেন।
অতএব পাত্রের ত্রয়োবিংশতি বৎসর অতীত সময়ে বিবাহ দেওয়া স্থির করিলেন। কিন্তু এত দিন অবিবাহিত থাকিলে পাছে তুমি কোন প্রকার চঞ্চলা হও, বা গোপনে কাহাকে বিবাহ কর, এই জন্য তোমাকে ভয় দেখাইবার জন্য এই পত্রার্দ্ধ তোমার অলঙ্কারমধ্যে রাখিয়াছিলেন।
তৎপরে বিবাহ দিয়া পঞ্চ বৎসর সাক্ষাৎ না হয়, তাহার জন্য যে যে কৌশল করিয়াছিলেন, তাহা জ্ঞাত আছ। সেই জন্যই পরস্পরের পরিচয় মাত্র পাও নাই।
কিন্তু সম্প্রতি কয়েক মাস বড় গোলযোগ হইয়া উঠিয়াছিল। কয়েক মাস হইল আনন্দস্বামী এ নগরে আসিয়া, তোমার দারিদ্র্য শুনিয়া নিতান্ত দু:খিত হইলেন। তিনি তোমাকে দেখিয়া আসিয়াছিলেন, কিন্তু সাক্ষাৎ করেন নাই। তিনি আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তোমার বিবাহ বৃত্তান্ত আনুপূর্ব্বিক কহিলেন। পরে কহিলেন, ‘আমি যদি জানিতে পারিতাম যে, হিরণ্ময়ী এরূপ দরিদ্রাবস্থায় আছে, তাহা হইলে আমি উহা মোচন করিতাম। এক্ষণে আপনি উহার প্রতীকার করিবেন। এ বিষয়ে আমাকেই আপনার ঋণী জানিবেন। আপনার ঋণ আমি পরিশোধ করিব। সম্প্রতি আমার আর একটি অনুরোধ রক্ষা করিতে হইবে। হিরণ্ময়ীর স্বামী এই নগরে বাস করিতেছেন। উহাদের পরস্পর সাক্ষাৎ না হয়, ইহা আপনি দেখিবেন |’ এই বলিয়া তোমার স্বামীর পরিচয়ও আমার নিকটে দিলেন। সেই অবধি অমলা যে অর্থব্যয়ের দ্বারা তোমার দারিদ্র্যদু:খ মোচন করিয়া আসিতেছে, তাহা আমা হইতে প্রাপ্ত। আমি তোমার পিতৃগৃহ ক্রয় করিয়া তোমাকে বাস করিতে দিয়াছিলাম। হার আমিই পাঠাইয়াছিলাম—সেও তোমার পরীক্ষার্থ |”
হি। তবে আপনি এ অঙ্গুরীয় কোথায় পাইলেন? কেনই বা আমার নিকট স্বামিরূপে পরিচয় দিয়া, আমাকে প্রতারিত করিয়াছিলেন? পুরন্দরের গৃহে বাস করিতেছি বলিয়া কেনই বা অনুযোগ করিতেছিলেন?
রাজা। যে দণ্ডে আমি আনন্দস্বামীর অনুজ্ঞা পাইলাম, সেই দণ্ডেই আমি তোমার প্রহরায় লোক নিযুক্ত করিলাম। সেই দিনই অমলার দ্বারা তোমার নিকট হার পাঠাই। তার পর অদ্য পঞ্চম বৎসর পূর্ণ হইবে জানিয়া, তোমার স্বামীকে ডাকাইয়া, কহিলাম, ‘তোমার বিবাহবৃত্তান্ত আমি সমুদায় জানি। তোমার সেই অঙ্গুরীয়টি লইয়া একাদশ দণ্ড রাত্রের সময়ে আসিও। তোমার স্ত্রীর সহিত মিলন হইবে |’ তিনি কহিলেন যে, ‘মহারাজের আজ্ঞা শিরোধার্য্য, কিন্তু বনিতার সহিত মিলনের আমার স্পৃহা নাই। না হইলেই ভাল হয় |’ আমি কহিলাম, ‘আমার আজ্ঞা |’ তাহাতে তোমার স্বামী স্বীকৃত হইলেন, কিন্তু কহিলেন যে, ‘আমার সেই বনিতা সচ্চরিত্রা কি দুশ্চিত্রা, তাহা আপনি জানেন। যদি দুশ্চরিত্রা স্ত্রী গ্রহণ করিতে আজ্ঞা করেন, তবে আপনাকে অধর্ম্ম স্পর্শিবে |’ আমি উত্তর করিলাম, অঙ্গুরীয়টি দিয়া যাও। আমি তোমার স্ত্রীর চরিত্র পরীক্ষা করিয়া গ্রহণ করিতে বলিব |’ তিনি কহিলেন, ‘এ অঙ্গুরীয় অন্যকে বিশ্বাস করিয়া দিতাম না, কিন্তু আপনাকে অবিশ্বাস নাই |’ আমি অঙ্গুরীয় লইয়া তোমার যে পরীক্ষা করিয়াছি, তাহাতে তুমি জয়ী হইয়াছ।
হি। পরীক্ষা ত কিছুই বুঝিতে পারিলাম না।
এমন সময়ে রাজপুরে মঙ্গলসূচক ঘোরতর বাদ্যোদ্যম হইয়া উঠিল। রাজা কহিলেন, “রাত্রি একাদশ দণ্ড অতীত হইল—পরীক্ষার কথা পশ্চাৎ বলিব। এক্ষণে তোমার স্বামী আসিয়াছেন; শুভলগ্নে তাঁহার সহিত শুভদৃষ্টি কর |”
তখন পশ্চাৎ হইতে সেই কক্ষের দ্বার উদ্ঘাটিত হইল। এক জন মহাকায় পুরুষ সেই দ্বারপথে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল। রাজা কহিলেন, “হিরণ্ময়ি, ইনিই তোমার স্বামী |”
হিরণ্ময়ী চাহিয়া দেখিলেন—তাঁহার মাথা ঘুরিয়া গেল—জাগ্রৎ স্বপ্নের ভেদজ্ঞানশূন্যা হইলেন। দেখিলেন, পুরন্দর!
উভয়ে উভয়কে নিরীক্ষণ করিয়া স্তম্ভিত, উন্মত্তপ্রায় হইলেন। কেহই যেন কথা বিশ্বাস করিলেন না।
রাজা পুরন্দরকে কহিলেন, “সুহৃৎ, হিরণ্ময়ী তোমার যোগ্যা পত্নী। আদরে গৃহে লইয়া যাও। ইনি অদ্যাপি তোমার প্রতি পূর্ব্ববৎ স্নেহময়ী। আমি দিবারাত্র ইঁহাকে প্রহরাতে রাখিয়াছিলাম, তাহাতে বিশেষ জানি যে, ইনি অনন্যানুরাগিণী, তোমার ইচ্ছাক্রমে উঁহার পরীক্ষা করিয়াছি, আমি উঁহার স্বামী বলিয়া পরিচয় দিয়াছিলাম, কিন্তু রাজ্যলাভেও হিরণ্ময়ী লুব্ধ হইয়া তোমাকে ভুলেন নাই। আপনাকে হিরণ্ময়ীর স্বামী বলিয়া পরিচিত করিয়া ইঙ্গিতে জানাইলাম যে, হিরণ্ময়ীকে তোমার প্রতি অসৎপ্রণয়াসক্ত বলিয়া সন্দেহ করি। যদি হিরণ্ময়ী তাহাতে দু:খিতা হইত, ‘আমি নির্দ্দোষী, আমাকে গ্রহণ করুন’ বলিয়া কাতর হইত, তাহা হইলে বুঝিতাম যে, হিরণ্ময়ী তোমাকে ভুলিয়াছে। কিন্তু হিরণ্ময়ী তাহা না করিয়া বলিল, ‘মহারাজ, আমি কুলটা, আমাকে ত্যাগ করুন |’ হিরণ্ময়ি! তোমার তখনকার মনের ভাব আমি সকলই বুঝিয়াছিলাম। তুমি অন্য স্বামীর সংসর্গ করিবে না বলিয়াই আপনাকে কুলটা বলিয়া পরিচয় দিয়াছিলে। এক্ষণে আশীর্ব্বাদ করি, তোমরা সুখী হও |”
হি। মহারাজ! আমাকে আর একটি কথা বুঝাইয়া দিন। ইনি সিংহলে ছিলেন, কাশীতে আমার সঙ্গে পরিণয় হইল কি প্রকারে? যদি ইনি সিংহল হইতে সে সময় আসিয়াছিলেন, তবে আমরা কেহ জানিলাম না কেন?
রাজা। আনন্দস্বামী এবং পুরন্দরের পিতায় পরামর্শ করিয়া সিংহলে লোক পাঠাইয়া ইঁহাকে সিংহল হইতে একেবারে কাশী লইয়া গিয়াছিলেন, পরে সেইখান হইতে ইনি পুনশ্চ সিংহল গিয়াছিলেন। তাম্রলিপ্তে আসেন নাই। এই জন্য তোমরা কেহ জানিতে পার নাই।
পুরন্দর কহিলেন, “মহারাজ! আপনি যেমন আমার চিরকালের মনোরথ পূর্ণ করিলেন, জগদীশ্বর এমনই আপনার সকল মনোরথ পূর্ণ করুন। অদ্য আমি যেমন সুখী হইলাম, এমন সুখী কেহ আপনার রাজ্যে কখন বাস করে নাই |”

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *