বাথরুম থেকে একটা মগ চুরি গেছে। চুরি ছাড়া আর কী বলা যায়? একটা নতুন মগ তো ডানা মেলে উধাও হয়ে যেতে পারে না?
এ চুরির কথা শুনলে লোকে হাসবে। বাড়ি থেকে আর কিছু খোওয়া যায়নি, হ্যাঁ, সব মিলিয়ে দেখা হয়েছে, আর সব কিছুই ঠিকঠাক আছে, শুধু দু-দিন আগে কিনে আনা নীল মগটি পাওয়া যাচ্ছে না। একটা বালতি আর মগ একসঙ্গে কেনা হয়েছে, বালতিটা আছে, মগটা নেই।
কতই বা দাম, যৎসামান্য, একটা মগের জন্য মাথা না ঘামালেও চলে। কিন্তু প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় সবসময় একটা হিসেব মেলাবার ব্যাপার থাকে। কোনও কিছুতে, তা সে যত সামান্যই হোক, হিসেব না মিললে মনটা খচখচ করে।
যেমন, একদিন বাবার টেবিলের নীচে দেখা গেল একটা কমলালেবুর আধখানা খোসা। এটা কোথা থেকে এল? এ-বাড়িতে তো বেশ কিছুদিনের মধ্যে কমলালেবু খাওয়া হয়নি। বর্ষাকাল, এ-সময় কমলালেবু খাওয়ার রেওয়াজও নেই, কমলালেবু সস্তা হয় শীতকালে। তবু, ছেলে মেয়েরা কেউ শখ করে কিনে এনেছে? তিন ছেলে-মেয়েই বলল, তারা কেউ কিছু জানে না। ওদের কেউ যদি এনেই থাকে, কমলালেবু তো কোনও নিষিদ্ধ বস্তু নয়, অস্বীকার করবে কেন?
তাহলে খোসাটা এল কোথা থেকে? মগটাই বা গেল কোথায়?
পরিবারের সদস্যরা ছাড়া শুধু দুজন মানুষ ওই বাথরুমে ঢোকে। কাজের মেয়ে শেফালি, বাসন মাজা, কাপড় কাচার জন্য বাথরুমটা অনেকক্ষণ তার দখলে থাকে। বাড়িতে গয়নাগাঁটি কিছু হারালে প্রথম সন্দেহই গিয়ে পড়ে কাজের মেয়ে কিংবা কাজের লোকের ওপরে। এ-বাড়িতে। সেরকম কোনও ঘটনা ঘটেনি। অর্থাৎ, কানের দুল-টুল মাঝে-মাঝে তো হারাবেই, হারিয়েছে, আবার খুঁজেও পাওয়া গেছে। শেফালিই দু-একবার খুঁজে দিয়েছে। শেফালি এমন কিছু
হতদরিদ্রও নয়। তার বড় ছেলে এবার হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিয়েছে। ওর স্বামীও জুটমিলে কাজ করে, সেটা অনেকদিন বন্ধ থাকার পর গতমাসে খুলেছে আবার। পুরোনো মাইনে-টাইনেও পেয়েছে অনেকটা। এই তো কয়েকদিন আগে, এ-বাড়ির ভুলোমনা ছেলে যিশুর জামা কাচতে গিয়ে পকেটে পঁয়ষট্টি টাকা পেয়ে ফিরিয়ে দিয়েছে নিজে থেকে। সে চুরি করবে সামান্য একটা পনেরো টাকার মগ?
দ্বিতীয় যে বাইরের মানুষ রোজ এই বাথরুমে ঢোকে, সে একজন মেথর। আজকাল আর মেথর বলা হয় না, খবরের কাগজে লেখে ধাঙড়, আর গৃহস্থরা বলে জমাদার। কী তার নাম? জমাদারদের আবার নাম থাকে নাকি, সবাই তো জমাদার বলেই ডাকে। সে মগটা সরাল? কিন্তু সে তো চুপিচুপি আসে না। তাকে দরজা খুলে দিতে হয়, শেফালি তাকে জল ঢেলে দেয়। স্নানের মগ তো তত ছোট জিনিস নয়, যে টপ করে জামার পকেটে পুরে নেবে! আহা, তা ছাড়া জমাদাররা আবার গায়ে জামা পরল কবে? শীতকালেও তারা শুধু গেঞ্জি পরে আসে।
খাবার টেবিলে এই রহস্য নিয়ে আলোচনা হয়। যে ঘটনার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না, সেটাকে অনেকে ভূতুড়ে ব্যাপার বলে ভাবতে ভালোবাসে। কিন্তু এ-বাড়ির কেউই ওসব শিশু সাহিত্যে বিশ্বাস করে না।
পরিবারের প্রধান রণদেব বারাসত কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপক। মা সম্পূর্ণা রানি হর্ষমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ইংরিজি পড়ান। তিনটি সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে যিশু যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে শেষ পরীক্ষা দিয়েছে গত মাসে, আর ছোট ছেলে পথিকৃৎ মায়ের ইস্কুলে পড়ে ক্লাস নাইনে। মাঝখানে মেয়ে, নীলাঞ্জনা, বাবা-মায়ের খানিকটা অনিচ্ছাতেই ভরতি হয়েছিল গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে। বাচ্চা বয়েস থেকেই তার আঁকার হাত বেশ ভালো। আবার তার অঙ্কের রেজাল্টও খুব ভালো হত। তাই রণদেব চেয়েছিলেন, মেয়েও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুক, আঁকা-টাকার চর্চ তো বাড়িতে বসেও হয়। কিন্তু নীলাঞ্জনা গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে চান্স পেয়ে গেলে তিনি আর আপত্তি করেননি। সম্পূর্ণা খুঁতখুঁত করেছিলেন। এই নতুন বাড়ি বানানো হয়েছে হাবড়া অশোকনগরে, এখান থেকে নীলাঞ্জনাকে প্রতিদিন লোকাল ট্রেনে, তারপর বাসে চেপে যেতে হবে ক্লাস করতে, সে কি এই ধকল সইতে পারবে?
যিশু আর নীলাঞ্জনা প্রায় পিঠোপিঠি ভাইবোন। দুজনের স্বভাব একেবারে বিপরীত। যিশু দুর্দান্ত প্রাণবন্ত, জোরে কথা বলে, খেলাধুলোতেও চৌকশ। অচেনা মানুষের সঙ্গে সহজে ভাব জমিয়ে নিতে পারে। আর নীলাঞ্জনা খুবই মৃদুভাষী আর লাজুক, ভিড়ের ট্রেনে কিংবা বাসে কেউ তাকে ধাক্কা দিলে কিংবা পা মাড়িয়ে দিলেও সে প্রতিবাদ করতে পারে না। কখনও সে তর্ক করে না। কারুর সঙ্গে, মনে-মনে যা-ই ভাবুক সে, অন্যদের কথা মাথা নীচু করে মেনে নেয়। যে মেয়ে সাত চড়েও রা করে না, আমাদের দেশে তাদেরই তো ভালো মেয়ে বলে, আত্মীয়-স্বজনরা সবাই সব সময় বলে, আহা নীলাঞ্জনা কী ভালো মেয়ে, লক্ষ্মী মেয়ে! ছোট ছেলে পথিকৃৎ, ডাক নাম বাবলুও শান্ত স্বভাবের, গল্পের বইয়ের পোকা, বাবা-মায়ের কথা শোনে।
প্রথম-প্রথম যিশু আর নীলাঞ্জনা এক ট্রেনে যেত কলকাতায়। ভিড়ের মধ্যে বোনকে সামলাত যিশু। শিয়ালদায় নেমে নীলাঞ্জনাকে বাসে তুলে দিয়ে সে অন্য বাস ধরত। কিন্তু প্রত্যেকদিন তো দুজনের একসঙ্গে ক্লাস থাকে না। যিশু ক্রিকেট ম্যাচ খেলার জন্য প্রায়ই দুর্গাপুর কিংবা আসানসোল যায়, সুতরাং দু-একমাস পর থেকে নীলাঞ্জনাকে একাই যেতে হয় আর্ট কলেজে। যাওয়া-আসার পথে কোন দিন সে কোনও বিপদে পড়বে, এই চিন্তা থাকেই সম্পূর্ণার। সন্ধের আগেই মেয়ে বাড়ি ফিরলে তিনি নিশ্চিন্ত।
আগে থাকতেন ভাড়া বাড়িতে, এই বাড়িটি বানানো হয়েছে আড়াই বছর আগে। এতকলায় চারখানা ঘর, দোতলাতেও একটা ছোট ঘর হয়েছে কয়েক মাস আগে, সেখানে যিশু পড়াশোনা করে। পেছন দিকে একটা পুকুর। এ দিকটা এখনও কিছুটা ফাঁকা-ফাঁকা, যদিও প্রায় প্রতি। মাসেই একটা করে নতুন বাড়ি গজাচ্ছে। তা হলেও পল্লিটি বেশ নিরিবিলি, প্রতিবেশীরা ভদ্র।
আর্ট কলেজে বেশিদিন পড়া হল না নীলাঞ্জনার। মা যা আশঙ্কা করেছিলেন, একদিন তাই-ই ঘটল।
মাঝে-মাঝেই সে মন খারাপ করে বাড়িতে ফেরে। তারপর সারা সন্ধেটা সে মুখ ভার করে থাকে। কিংবা অসময়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে মুখ গুঁজে। কী হয়েছে, আসা-যাওয়ার পথে কেউ তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে কি না, তা জানবার উপায় নেই। নীলাঞ্জনা তো মুখ ফুটে কিছুই বলবে না। মায়ের শত প্রশ্নেও সে শুধু বলছে, কই, কিছু হয়নি তো! কিছু যে হয়েছে, তা স্পষ্টই বোঝা যায়।
মেয়ে কি কারুর প্রেমে পড়েছে? এই বয়েসে প্রেমের সঙ্গে মনখারাপের একটা নিবিড় সম্পর্ক থাকে। প্রেম ব্যাপারটাকে ভয় পান না সম্পূর্ণা, এই বয়েসের মেয়ে তো এক-আধবার প্রেমে পড়তেই পারে। তিনি নিজেও তো বিয়ের আগে অন্য একজনের সঙ্গে টানা দু-বছর প্রেম। করেছেন, সেই মানুষটিকে বিয়ে করা সম্ভব ছিল না, শেষপর্যন্ত প্রচুর কান্নাকাটি করেছিলেন, এখন সেসব দিনের কথা মনে পড়লে মুখে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে।
বন্ধুর মতন মেয়ের পাশে বসে সম্পূর্ণা মাঝে-মাঝে জিগ্যেস করেন, হ্যাঁরে, ছেলেটা কে রে? তাকে একদিন বাড়িতে নিয়ে আয় না!
নীলাঞ্জনা মায়ের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। সেই নীরব ভাষার অর্থ বোঝা দুষ্কর।
এ কথাও ঠিক, সম্পূর্ণা ভাবেন, এ-মেয়ের পক্ষে কি কোনও ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক পাতানো সম্ভব? ও তো কারুর সঙ্গে কথাই বলতে চায় না। সুশ্রী চেহারা, ওর দিকে কোনও-কোনও ছেলে আকৃষ্ট হতেই পারে, কিন্তু মেয়ে যদি সাড়া না দেয়, তাহলে প্রেম হবে কী করে?
সুতরাং প্রেমই যে নীলাঞ্জনার মনখারাপের কারণ, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না।
এক সন্ধেবেলা তিনজন ভদ্রলোক ও এক মহিলা ধরাধরি করে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেল নীলাঞ্জনাকে। তার হাঁটার ক্ষমতা নেই।
স্টেশনে ট্রেন থামলেই একদল লোক এমন হুড়োহুড়ি করে নামার চেষ্টা করে, যেন এক মিনিট দেরি হলেও পৃথিবী রসাতলে যাবে। আবার সব লোক নেমে যাওয়ার আগেই কিছু মানুষ ঠেলাঠেলি করে ওপরে উঠতে চায়। কেউ কারুকে জায়গা ছেড়ে দেওয়ার মতন সৌজন্যের তোয়াক্কা করে না। প্রতিদিনই এটা সহ্য করতে হয়।
একদিন ফেরার সময় স্টেশনে ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে বেশ জোরে আছাড় খেয়ে পড়ে গেল নীলাঞ্জনা মানুষের ধাক্কায়। হয়তো কেউ ইচ্ছে করে ধাক্কা দেয়নি, আবার মেয়েদের পিঠে হাত রাখার লালসাও হয় কারু-কারুর। এমনই আঘাত লাগল নীলাঞ্জনার যে তার হাতের বই-খাতা ছিটকে পড়ে গেল, সে আর উঠে দাঁড়াতে পারল না।
সাধারণত কার কী আঘাত লাগল না লাগল, তা নিয়ে অধিকাংশ মানুষই ভ্রূক্ষেপ করে না। সকলেরই বাড়ি ফেরার কিংবা ট্রেনে উঠে জায়গা দখল করার তাড়া। আবার ব্যতিক্রমও তো থাকে। কয়েকজন সহৃদয় ব্যক্তি নীলাঞ্জনার অবস্থা দেখে তাকে টেনে তুললেন। কিন্তু নীলাঞ্জনা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে না। ব্যথায় তার চোখে জল আসছে, তবু মুখে বলছে না কিছুই।
এক মহিলা তাকে অস্পষ্টভাবে চিনতে পেরে জিগ্যেস করলেন, তুমি পুকুরধারে ছাই-রঙা বাড়িটাতে থাকো না? তোমার বাবা কলেজে পড়ান।
নীলাঞ্জনা ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানাল।
তখন নিজেদের কাজ ফেলে সেই মহিলা ও কতিপয় ভদ্রলোক দু-তিনখানা রিকশা নিয়ে নীলাঞ্জনাকে পৌঁছে দিয়ে গেলেন বাড়িতে।
সত্যিই খুব প্রশংসনীয় ব্যাপার।
বাঁ-পায়ে ফ্র্যাকচার হয়েছে নীলাঞ্জনার। এখন তার সেই পা-মোড়া প্লাস্টার। দিনপনেরো হয়ে গেছে। বাড়ির মধ্যে একটু-একটু হাঁটতেও পারে।
দেড়-দু-মাসের মধ্যে তার পা আবার ঠিক হয়ে যাবে। এই বয়েসের ছেলেমেয়েদের হাড় ঠিকঠাক জুড়ে যায়। কিন্তু এর মধ্যে আর-একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। এই ভাবে ট্রেন জার্নি করে। নীলাঞ্জনার আর আর্ট কলেজে যাওয়া চলবে না। সবাই সব কিছু পারে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি কোনও আর্ট কলেজে গিয়ে ছবি আঁকা শিখেছেন? নীলাঞ্জনা যদি চায়, তাহলে বাড়িতেই একজন আর্ট টিচার ঠিক করে দেওয়া যেতে পারে। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের এখন আর ভরতি হওয়ার। উপায় নেই। সে বরং স্থানীয় কলেজে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ুক। ইচ্ছে করলে ইংরিজি কিংবা বাংলাও পড়তে পারে। একটা বছর নষ্ট হবে, কী আর করা যাবে।
নীলাঞ্জনা জোরালো আপত্তি জানাতে পারেনি। শুধু মিনমিন করে দু-একবার বলেছিল, আমি পারব, এবার থেকে পারব।
বাবা-মা কেউ তাতে কর্ণপাত করেননি।
যিশুই বরং জোরের সঙ্গে বলেছিল, বারবার আছাড় না খেলে মানুষ দৌড়োতে শেখে না। একবার আছাড় খেয়েছে বলে খুকি আর্ট কলেজ ছেড়ে দেবে? এ আবার কীরকম কথা! না, না, যাবে!
বাবা-মা যিশুর কথা উড়িয়ে দেয়েছেন।
নীলাঞ্জনার ঘনিষ্ঠ কোনও বন্ধু নেই, কেউ এ-বাড়িতে আসে না। কিন্তু যিশুর বন্ধুরা প্রায়ই আসে। তারা আড্ডা দেয় ছাদের ঘরে। সেইসব বন্ধুদের কেউ নীলাঞ্জনার সঙ্গে ভাব জমাতে চায় কি না, আড়াল থেকে সেদিকে নজর রাখেন মা। দু-একটা ছেলের সঙ্গে ভাব হোক না, ভালোই তো। প্রেম কিংবা বিয়ের প্রশ্ন না থাক, এমনিই ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করা মেয়েদের পক্ষে স্বাস্থ্যকর।
বন্ধুদের মধ্যে তূনীর নামে একজনের দাদা খবরের কাগজে গল্প-টল্প লেখে ও ছবি আঁকে। তার নিজেরও আগ্রহ আছে ছবি সম্পর্কে। ছবি দেখার জন্য সে বারদু-এক গেছে নীলাঞ্জনার ঘরে। কিন্তু যে মেয়ে একটা-দুটোর বেশি কথাই বলে না, তার সঙ্গে ভাব জমবে কী করে?
তুণীর ছেলেটি অত্যন্ত ভদ্র, সে কখনও নীলাঞ্জনার গা ঘেঁষে দাঁড়ায় না। সম্পূর্ণা একালের। ছেলেমেয়েদের কিছুটা বুঝতে পারেন। এরা অনেকটা পূর্ব সংস্কার মুক্ত। ইচ্ছে করলে বিয়ের আগেও একসঙ্গে শুয়ে পড়তে পারে, আবার এরা, একটি ছেলে ও মেয়ে, দিনের-পর-দিন। একসঙ্গে সময় কাটালেও পরস্পরের সম্মতি ছাড়া কেউ কারুকে ছোঁয় না।
এখন দুপুরবেলা আর সবাই চলে যায়, নীলাঞ্জনাকে হয় একলা থাকতে। ছবি আঁকার অঢেল সময়, কিন্তু রংতুলিতে হাত দেওয়ার ইচ্ছেটা চলে গেছে তার। সে জানলা দিয়ে চেয়ে থাকে। বাইরের দিকে। পুকুরের জলে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার দৃশ্যটা তার খুব প্রিয়।
মগ উধাও রহস্যের মীমাংসা হতে-না-হতেই অদৃশ্য একটি ঘড়ি। এটা বেশ গুরুতর ব্যাপার। টেবল ক্লক, কিন্তু মোটেই সাধারণ নয়। আজকালকার ঘড়িতে টনটন শব্দ হয় না। কিন্তু এটাতে হয়, আর ঠিক এক ঘণ্টা পরপর টুংটাং করে একটা বাজনা বেজে ওঠে। বাবাকে তাঁর এক ছাত্র সুইজারল্যান্ড থেকে এনে দিয়েছে এই ঘড়ি। নীলাঞ্জনার পা ভাঙার পর বাবা বলেছিলেন, এটা তোর পড়ার টেবিলে রাখবি, এটা তোর।
ঘড়িটা বেশ দামি তো হবেই। এটা নিশ্চিত চুরির ব্যাপার। এবারে শেফালির কথা প্রথমেই মনে হবে। কিন্তু শেফালিকে কারুরই সন্দেহ করার ইচ্ছে হয় না।
অনেকদিন ধরে একজন মানুষকে দেখলে বোঝা যাবে না তার স্বভাব? বাসন মাজার কাজ করলেও তার আত্মমর্যাদাবোধ আছে।
যিশু দারুণ হইচই শুরু করে দিল। বাড়িতে চোরের উপদ্রব শুরু হল? চোর আসছে কোথা থেকে? ঘড়ি চুরি করেছে, এরপর আরও কোনও দামি জিনিস চুরি করতে পারে। এবার থানায় খবর দিতে হবে।
ছেলেকে ঘরের মধ্যে ডেকে নিয়ে সম্পূর্ণা বললেন, চুপ কর। এসব কথা এত চেঁচিয়ে বলতে নেই। পুলিশ এসে প্রথমেই তো শেফালিকে ধরবে। পুলিশের যা স্বভাব, থানায় নিয়ে গিয়ে ওকে নিশ্চয়ই মারধোর করবে। কিন্তু ও যদি সত্যিই দোষী না হয়! বরং দু-চারদিন সব দিক লক্ষ রেখে দেখা যাক। ছাদের দরজা তুই রাত্রিবেলা মনে করে বন্ধ রাখিস তো? নীলাঞ্জনা তো মুখ ফুটে কিছু বলবে না, কাঁদবেও না। কিন্তু অমন শখের ঘড়িটা চলে যাওয়ায় সে যে খুব কষ্ট পেয়েছে, তা তার মুখ দেখলেই বোঝা যায়। সে নিজের আঁচল দিয়ে ঘড়িটা রোজ যত্ন করে মুছত।
শেফালিকে কেউ সরাসরি দোষ না দিলেও শেফালি ঠিক বুঝতে পারে, ঘড়িটার ব্যাপারে তাকে কিছুটা সন্দেহ করা হচ্ছে। সে নিজেও বুঝতে পারছেনা, কী করে চোর ঢুকবে এ-বাড়িতে। মাঝে-মাঝে এঁদের কিছু আত্মীয়-স্বজন আসে। তাদের মধ্যেই কেউ সরিয়েছে ঘড়িটা? ভদ্দরলোকদের মধ্যেও কারুর-কারুর এরকম হাত-টান থাকে। কিন্তু মগটাই বা গেল কোথায়? দাম যাইই হোক, একটা মগ তো বাথরুম থেকে ডানা মেলে উড়ে যেতে পারে না?
শেষপর্যন্ত শেফালির নিজস্ব তদন্তেই কাজ হল। পুকুরপাড়ে একটা ঝোপের মধ্যে সে পেয়ে গেল ঘড়িটা। এখানকার একটা সরু রাস্তা দিয়ে অনেকেই যাতায়াত করে, এর মধ্যে কারুর চোখে। পড়েনি, সেটাই আশ্চর্যের। ঘড়িটা পেয়ে আনন্দে চিৎকার করতে-করতে বাড়ির মধ্যে চলে এল শেফালি।
কিন্তু ঘড়িটা ফিরে পাওয়ার রহস্য মিটল না, বরং আরও ঘনীভূত হল। ঘড়িটা সম্পূর্ণ ভাঙা এবং
অকেজো। কেউ যেন আছড়ে-আছড়ে সেটাকে ভেঙেছে। কেউ চুরি করলে এমন সুন্দর ও মূল্যবান বস্তুটিকে ভাঙবে কেন? যে-কোনও চোরই এর মূল্য বুঝবে। তবে কি বাঁদরের মতন কোনও প্রাণীর কীর্তি! এ অঞ্চলে বাঁদর কোথায়? কেউ কোনওদিন দেখেনি। কোনও একটা বাঁদর কিংবা হনুমান হঠাৎ অন্য কোথাও থেকে ছিটকে চলে এসেছে? এ-পাড়ায় দু-চারজনের বাড়িতে কলাগাছ আছে। এই নতুন বাড়িতেও পেয়ারা ও সবেদা গাছ লাগানো হয়েছিল, সবেদা গাছে। ফল এসেছে, সেসব গাছে কোনওদিন বাঁদর-হনুমানের উৎপাত হল না, তাদের কেউ এসে শুধু একটা ঘড়ি নিয়ে ভাঙল? অবিশ্বাস্য।
পরবর্তী ঘটনাটি সোজাসুজি অঙ্গুলি নির্দেশ করে অলৌকিকত্বের দিকে। এতে চুরিরও প্রশ্ন নেই। যখন কোনও ঘটনার কোনওরকমেই কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না, তখন তার দায় চাপানো হয় বেচারি ভূতদের ঘাড়ে।
একালে অনেক সভ্য-শিক্ষিত মানুষই ভূতে বিশ্বাস করে না। তবে যারা ঘোর অবিশ্বাসী, তাদেরও কখনও-সখনও গা ছমছম করে। বহুকালের সংস্কার, যা জিনের মধ্যে দিয়েও প্রবাহিত হয়।
যিশুর ছাদের ঘরের একদিকের দেওয়াল জোড়া একটা ম্যাপ টাঙানো। সামনের মাসে পুজোর ছুটিতে আর তিনজন বন্ধুর সঙ্গে তার সানডাক-ফু-তে ট্রেকিং করতে যাওয়ার কথা। অনেকদিন ধরে পরিকল্পনা হচ্ছে, ওই বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে এখন শুধু সেই আলোচনা। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফিস থেকে সেই অঞ্চলটার একটা ম্যাপ জোগাড় করেছে যিশু, ম্যাপটা ব্লো আপ করে টাঙিয়ে রেখেছে দেওয়ালে। সব পাহাড়ি রাস্তা ও তাঁবু ফেলার জায়গাগুলো লাল পেন্সিলের দাগ দেওয়া। একদিন সকালে দেখা গেল, সেই ম্যাপটা প্রায় ছিন্নভিন্ন। হাওয়ায় কিংবা ঝড়ের ঝাপটায় ছেড়া নয়, ছুরির মতন কোনও ধারালো অস্ত্র দিয়ে সেটা ফালাফালা করা হয়েছে, তা স্পষ্ট বোঝা যায়।
আগের দিন দুপুরবেলাতেও বাড়ি থেকে বেরুবার আগে যিশু ম্যাপটা অক্ষত দেখেছে। রাত্তিরে ঘর বন্ধ থাকে, ছাদের দরজাতেও এখন প্রতিদিন মনে করে তালা লাগানো হয়। সকালে যিশু নিজে সেই তালা খুলেছে, দরজা যেমন বন্ধ ছিল, তেমন বন্ধ আছে, তাহলে ম্যাপটার ওই অবস্থা হল কী করে?
যিশুর চ্যাঁচামেচি শুনে বাড়ির সবাই উঠে এল ওপরে। ঘটনাটি দেখে কারুর মুখে কোনও কথা নেই। এটা এমনই ব্যাপার যে, কেউ কোনও মন্তব্য কিংবা নিজস্ব থিয়োরিও দিতে পারছে না। সকলেরই মনে-মনে একটা প্রশ্ন, তবে কী, তবে কী, তবে কী কোনও অশরীরী…।
কঙ্কাল খটখটিয়ে যেসব ভূতপেতনি ঘুরে বেড়ায়, তাদের গল্প একেবারেই বাচ্চাদের ভয় দেখাবার জন্য। হিন্দুদের মৃতদেহ পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়। সেই ছাই থেকে আবার শরীর ধারণ করা যে একেবারেই অসম্ভব, তা বিজ্ঞানের সাধারণ ছাত্রও জানে। তবু একটা ব্যাপারে অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরও খটকা আছে। আত্মার অস্তিত্ব সম্পর্কে। মৃত্যুর পরেও মানুষের আত্মা ভেসে বেড়ায়, অতৃপ্ত আত্মা জীবিতদের মধ্যে ফিরে আসতে চায়?
প্রমাণিত সত্য নয় বলে বিজ্ঞান এখনও আত্মার অস্তিত্ব মানে না। কিন্তু অনেকের বিশ্বাস তা মানে। বিশ্বাসীদের মতে, অতৃপ্ত আত্মাকেই সাধারণ মানুষ মনে করে ভূত।
ছুটির দিন বলে, একটু বেলার দিকে বেড়াতে এলেন তুতুল মাসি। তাঁর দুই ছেলেমেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে। আগে থেকেই এ দিকে আসার ঠিক ছিল। তুতুল মাসির স্বামী নীরজ হালদার নির্বিরোধী, শান্ত প্রকৃতির মানুষ, সবসময় স্ত্রীর বাধ্য। সে বাধ্যতার পুরস্কার হিসেবে প্রায়ই তিনি স্ত্রীর কাছ থেকে ক্যাবলা, হ্যাবলা, বুদ্ধি কম, এইসব বিশেষণ পান। ছেলেমেয়ে দুটিও ভয় পায় মাকে।
তুতুল মাসি তো এসেই সব ঘটনা শুনলেন। সঙ্গে-সঙ্গে তিনি রায় দিলেন জোর গলায়। ফেং শুই! ফেং শুইনা মেনে বাড়ি বানানো হয়েছে, তাই এইসব অঘটন ঘটছে। তোমাকে তখনই বলেছিলুম সেজদি, উত্তর দিকে সদর দরজা কোরো না। তুমি শুনলে না। পুব কিংবা দক্ষিণ দিকে অনেক জায়গা ছিল। জানলাগুলোও যেন কেমন ধারা।
যিশু কৌতুক করে বলল, ফেং শুই না মানলে বুঝি বাড়ি থেকে জিনিসপত্র উধাও হয়ে যায়?
গভীর বিশ্বাসী চোখে তুতুল মাসি বললেন, মাসছয়েক আগে দিদির স্কুলের আগেকার হেড মিসট্রেস জয়ন্তীদি মারা গেলেন না? কী হিংসেই করতেন দিদিকে। কতবার ল্যাং মারার চেষ্টা করেছেন। ওইসব হিংসুটি মানুষদের মরে গেলেও মুক্তি হয় না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তারই আত্মা এইসব উপদ্রব করছে। ফেং শুই মেনে বাড়ি বানালে সে বাড়িতে কোনও দুষ্টু আত্মা নাক গলাতে পারে না। যিশু বলল, দুষ্টু আত্মার বুঝি চান করার জন্য মগ লাগে? তুতুল মাসি বললেন, তুই চুপ কর তো। ইয়ার্কি হচ্ছে আমার সঙ্গে?
যিশু বলল, না, ইয়ার্কি না, সিরিয়াসলি বলছি, আত্মা তো অশরীরী। তাই না? কোনও অশরীরী জিনিসপত্র টাচ করবে কী করে?
তুতুল মাসি বললেন, আত্মারা সব পারে। তখন ওদের অসাধারণ শক্তি হয়।
যিশু বলল, আমাদের ক্ষতি করার জন্য না হয় একটা দামি ঘড়ি ভাঙবে। কিন্তু আমার ঘরের ম্যাপটা ও ভাবে কাটবে কেন? এমনিই পাহাড়ের ম্যাপ। আত্মরা কি পাহাড়কে ভয় পায়?
তুতুল মাসি বললেন, তুই থাম তো, তোর সঙ্গে তর্ক করতে চাই না। ভারি দু-পাতা ইংরিজি পড়ে—
যিশু হাসতে-হাসতে বলল, আমি ইংরিজি বেশি পড়িনি। আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি। ম্যাটার, এনার্জি, ফিউশান এই সবের গুণাগুণ বিচার করতে হয়। বিজ্ঞানে যা প্রমাণিত হয়নি, যেমন এনার্জি কোনও ম্যাটারকে—
তুতুল মাসি বললেন, তোদের বিজ্ঞান অনেক কিছুই পারে না। ওইটুকু যে ছোট্ট একটা প্রাণী, মশা, বিজ্ঞান তাদের এই পৃথিবী থেকে শেষ করে দিতে পেরেছে?
যিশু বলল, তুমি ভূতের সঙ্গে মশার তুলনা দিলে? ভূতরা রেগে যাবে না?
যিশুর গায়ে একটা চাপড় মেরে মাসি বললেন, তুই থাম তো!
তারপর নীলাঞ্জনার দিকে তাকিয়ে বললেন, দ্যাখ তো এই মেয়েটাকে। কী শান্ত, কখনও তর্ক করে না মুখে-মুখে। কেমন আছিস রে খুকি? পায়ের ব্যথাটা কমেছে?
মাথা হেলিয়ে নীলাঞ্জনা বলল, হ্যাঁ।
কিছুক্ষণের জন্য ভূতের প্রসঙ্গ এড়িয়ে তুতুল মাসি নীলাঞ্জনার প্রশংসায় মেতে উঠলেন। সত্যিই তিনি খুব ভালোবাসেন নীলাঞ্জনাকে। তার গুণের বর্ণনা করতে-করতে উচ্ছ্বসিত হয়ে যান। অরুণবর্ণ হয়ে যায় নীলাঞ্জনার মুখ।
তুতুল মাসি নীলাঞ্জনার পিঠে হাত বুলাতে-বুলোত বললেন, জানো দিদি। এক-একজন মানুষকে দেখলেই বোঝা যায়, তারা ভগবানের খুব প্রিয়। ভগবান সবসময় নজর রাখেন তাদের ওপর। আমাদের খুকি সেরকম একজন, যে-কোনও বিপদ থেকে ভগবান সবসময় ওকে রক্ষা করবেন।
যিশু আবার ফস করে বলে উঠল, তাহলে খুকির পা ভাঙল কী করে? ভগবান কি তখন অন্যমনস্ক ছিলেন, না খেতে বসেছিলেন!
ছোট ভাইটাও এবার হেসে উঠল এই কথা শুনে।
তুতুল মাসি বললে, ভগবানকে নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতে নেই। বাবলু, ওরকম ভাবে হাসবি না কক্ষনো। ভগবান যা করেন, তা মঙ্গলের জন্য। খুকির পা ভেঙেছে, তার মানে ওর একটা কোনও বড় ফাঁড়া কেটে গেল। ও তো আছাড় খেয়েছে প্ল্যাটফর্মে, যদি ভিড়ের ধাক্কায় চলন্ত ট্রেন থেকে। পড়ে যেত, তা হলে কী হত? ভাবলেও ভয় করে। কলকাতায় কলেজে আর ওকে পড়তে যেতে হবে না!
তার পরেই নিজের দিদির দিকে তাকিয়ে বললেন, সদর দরজাটায় দেওয়াল তুলে বন্ধ করে দাও। দক্ষিণের দিকে গেট বসাও, না হয় একটু ঘুরে এসে বাড়িতে ঢোকা হবে। আর একটা যজ্ঞ করতে হবে। জাস্টিস অনিন্দ্য চৌধুরীর বাড়িতেই তো এরকম একটা যজ্ঞ হল। সে বাড়ির কোনও জানলায় ছিটকিনি লাগত না।
সম্পূর্ণা খুবই অবাক হয়ে বললেন, জানলায় ছিটকিনি লাগত না বলে যজ্ঞ?
তুতুল মাসি বললেন, হ্যাঁ গো, কতবার মিস্তিরি ডেকে ঠিক করা হয়েছে, তবু ঠিক হয় না, যখন তখন জানলা খুলে যায়। অনিন্দ্য চৌধুরীর স্ত্রী তো মাতৃসেবা সংঘের প্রেসিডেন্ট, তাই আমাদেরও নেমন্তন্ন করেছিলেন। জানো দিদি, ওঁদের ছেলে টংকার, অনেকদিন বিলেতে ছিল, সে হঠাৎ ফিরে এসেছে। ও দেশ তার আর ভালো লাগে না। এখন এখানেই বিজনেস করবে। কী ভালো ছেলে! যেমন চেহারা সুন্দর, তেমনি ভালো স্বভাব। স্মার্ট। আমাদের খুকির সঙ্গে চমৎকার মানাবে। আমাদের খুব ইচ্ছে, তুমি যদি মত দাও তো আমি ওঁদের সঙ্গে কথা বলতে পারি। ওরকম নামকরা ফ্যামিলি, কিন্তু টাকাপয়সার কোনও গুমোর নেই। খুকিকে একবার দেখলেই ওঁদের পছন্দ হয়ে যাবে।
এরপর আর এ-ঘরে থাকা যায় না। মুখ নীচু করে বেরিয়ে গেল নীলাঞ্জনা।
যিশুও সিগারেট টানার জন্য চলে গেল ছাদের ঘরে।
নিজের ঘরে এসে নীলাঞ্জনা জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে রইল পুকুরের দিকে চেয়ে। রাগে তার শরীর জ্বলছে। খুব রাগ হলে চোখে জল এসে যায়। যখনই কেউ তার একটানা প্রশংসা করে, তখনই তার অসহ্য বোধ হয়। সেইসব প্রশংসার ভাষা কী, সে খুব শান্ত, সে লাজুক, সে মুখে-মুখে। তর্ক করে না। এর প্রত্যেকটাই তো তার অযোগ্যতা। সে সত্যি কথা বলতে পারে না, সে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না, সে জোর দিয়ে কিছু চাইতে পারে না।
প্ল্যাটফর্মে আছাড় খেয়ে তার পা মটকে গেছে। এরকম ছোটখাটো অ্যাকসিডেন্ট তো অনেকেরই হয়। তা বলে তার আর্ট কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে? সে এতই দুর্বল যে জোরালো প্রতিবাদও করতে পারেনি। প্রতিবাদ করেনি বলেই সে ভালো? সে মা-বাবার অন্যায় মেনে নিয়েছে।
তুতুল মাসির বর ভদ্র, শান্ত ধরনের মানুষ। কিন্তু পুরুষ মানুষ বলেই এগুলো তাঁর অযোগ্যতা। ক্যাবলা, হাঁদারাম। আর মেয়েদের এইগুলোই গুণ। যিশু বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে এক একদিন কত দেরি করে ফেরে, কালই তো ফিরেছে রাত সাড়ে দশটায়, একটু নেশাও করেছিল, তাকে বাবা-মা কিছুই বলে না, আর নীলাঞ্জনার কোনওদিনই সন্ধের পর বাড়ির বাইরে থাকার। উপায় নেই! সে যে ভালো মেয়ে। সে মা-বাবাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে না। কীসের দুশ্চিন্তা? যাতে সে অবাধ্য বা মন্দ হয়ে না যায়!
নীলাঞ্জনা যে আসলে কী ভাবে, তা কেউ জানে না। সে এরকম ভালো হয়ে থাকতে চায় না। ভালো হওয়া মানে দুর্বলতা। সে আসলে দুর্বল। সে চিৎকার করে বলতে চায়, না, না আমি ভালো হতে চাই না। চাই না। চাই না। মুখে বলে না, ভেতরে-ভেতরে ফুঁসতে থাকে। যেন তার শরীরে প্রবাহিত সব রক্তস্রোতের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে রাগ। তখন কিছু একটানষ্ট করতে কিংবা ভাঙতে ইচ্ছে করে।
সেই রাগেই সে ভেঙেছিল তার প্রিয় টেবিল ঘড়িটা। সেই ঘড়ি সবসময় টিকটিক করে সময় জানায়। এক ঘণ্টা পরপর একটা সুর বেজে ওঠে, সেই সুর জানিয়ে দেয়, জীবন থেকে একটা ঘণ্টা খরচ হয়ে গেল। নীলাঞ্জনার জীবনে তো সময়ের কোনও মূল্যই নেই। সে চিরবন্দিনি, ভদ্রতার কাছে, ভালোমানুষির কাছে। সেটা মনে হতেই সে ঘড়িটা ঠুকে-ঠুকে ভেঙেছিল। সেটার সব কলকজা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল পুকুরের ধারে।
বাথরুমের নতুন মগটাও সে ওইভাবেই ফেলে দিয়েছিল পুকুরের জলে। সেটা জল ভরা ছিল, তাই সঙ্গে-সঙ্গে ডুবে গেছে।
যিশুর ঘরের ম্যাপটা ফালাফালা করাও তো তারই কীর্তি। কেন তার ভাই দেওয়ালে পাহাড়ের অতবড় একটা ম্যাপ টাঙিয়ে রাখবে? বন্ধুদের নিয়ে সে যাবে ট্রেকিং-এ, মাথার ওপর বরফ রঙের শরৎকালের আকাশ, মাঝে-মাঝে নীল হ্রদ, কোমরে দড়ি বেঁধে পাথরের খাঁজে-খাঁজে পা দিয়ে। উঠছে চারটে ছেলে, নীলাঞ্জনা কল্পনায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল, সন্ধেবেলা ওরা তাঁবুতে বসে আড্ডা মারতে-মারতে ব্র্যান্ডির বোতলে চুমুক দেবে, হঠাৎ শোনা যাবে বাতাসের শোঁ-শোঁ। আওয়াজ, কাছেই একটা ঝরনা…। নীলাঞ্জনা কোনওদিন যেতে পারবে ওখানে? সাড়া দিতে পারবে সুদূরের হাতছানিতে? আজকাল কিছু-কিছু মেয়েও এ-ভাবে যায়, নিজের দল বেঁধে, কিংবা পুরুষদের সঙ্গে। একটি মেয়ে তো এভারেস্টর চূড়াতেও উঠেছিল। নীলাঞ্জনা পারবে না,
তার সে সাহস নেই, বাবা-মাকে এমন প্রস্তাব দিলে তাঁরা আঁৎকে উঠবেন, সে জোর করতে পারবে না। তার নিজেরই এই অক্ষমতা তার ব্যর্থতার জন্য, অন্য কারুর ওপরে নয়, তার নিজের ওপরেই খুব রাগ হয়। সেই রাগে সে ফুঁসতে থাকে। যিশুর ঘরে সে গিয়েছিল একটা জেমস ক্লিপের খোঁজে। দেওয়ালের পাহাড় উপত্যকার মানচিত্র হঠাৎ তার অসহ্য বোধ হল। কেন ওই পাহাড়ে তার যাওয়া হবে না? তাহলে পাহাড়টাই মুছে যাক।
যিশুর দাড়ি কামানোর ব্লেড দিয়ে সে ম্যাপটাকে…।
আজও তুতুল মাসির কথা শুনে তার সেরকম রাগ হচ্ছে। ভালো মেয়ের নিকুচি করেছে! জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে-ফেলতে তার একবার ইচ্ছে হল জানলার গ্রিলের খানিকটা ভেঙে ফেলতে। তারপর সে পাখি হয়ে উড়ে যাবে।
কিন্তু শিক ভাঙার ক্ষমতা তার নেই। তাহলে কি গলায় দড়ির ফাঁস বেঁধে সে এই ভালোমানুষি থেকে মুক্তি নেবে? কিন্তু মরতে তো তার ইচ্ছে করে না! সে ছবি আঁকার একগুচ্ছ তুলি নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল বাইরে। একটা হলুদ রঙের টিউব থেকে খানিকটা রং সে মাখল সারা মুখে। এখন। তাকে দেখাচ্ছে অন্যরকম। তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে।
ফিসফিস করে সে বলতে লাগল, মরব কেন, মরব না! আমি আর ভালো মেয়ে থাকব না। এবার থেকে আমি ইচ্ছে মতন যা খুশি করব। যা খুশি, যা খুশি!
তবে বাবার টেবিলের তলায় কমলালেবুর খোসাটা সে ফেলেনি। কে ফেলেছে, কিংবা কোথা থেকে সেটা এল তা নীলাঞ্জনা জানে না। সেটা রহস্যই রয়ে গেল!